শতবর্ষে অসিত সেন
প্রথম দেখা ওঁর সঙ্গে হায়দারাবাদ বিমান বন্দরে। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। আমি এবং অভিজিৎ তখন ইটিভি- তে বিভিন্ন কুইজ অনুষ্ঠান করি। কলকাতায় একটা লটে অনেকগুলো এপিসোড শুট করে চলে যেতাম হায়দ্রাবাদ, রামজি সিটিতে। এক সপ্তাহ থেকে, দিন-রাত ধরে এডিট করে ফেরত আসা। সেরকমই একটা লটে গিয়ে শুনলাম অসিত সেন এসেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার কাছে তখন অসিত সেন বললেই সেই চারিত্রাভিনেতার মুখ ভেসে ওঠে যিনি হাফ-প্যান্ট পরে মজার পুলিশ কনস্টেবলের রোল করতেন। এটা বলায় আমাকে প্রবল ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়। যাই হোক, তখন আর ওঁর সঙ্গে দেখা বা আলাপ হল না, কারণ আমি আর রাণা এডিট করতাম সন্ধে ৭টা থেকে সকাল ৭টা, আর ঘুমোতাম দিনে। আর অসিত সেন ওই সময়টাতেই কাজ করতেন।
ইতিমধ্যে অনেক কিছু জেনে গেছি রাণার কাছে অসিত সেন সম্পর্কে। এছাড়া ‘সফর’, ‘খামোশি’ আর ‘মমতা’ আমার দেখা ছবি। এতে সবাই খুব হেসেছিল, এই বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি অথচ অসিত সেনের ‘উত্তর ফাল্গুনী’ বা ‘দীপ জেলে যাই’ দেখিনি, হিন্দি ছবি দেখেছি। অবশ্য ওঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওগুলো দেখে নিয়েছিলাম।
আমরা যেদিন ফিরছি, অসিত সেনও সেদিনই ফিরছেন শুনলাম। রাণা বলেছিল, একই গাড়িতে গেলে ভাল হয়। কিন্তু শুনলাম উনি তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরে পৌঁছতে চান তাই আগেই বেরিয়ে গেছেন।
আমরা যখন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছলাম, তখনও প্লেন ছাড়তে দু’ঘণ্টা দেরি। বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে শুনলাম প্লেন লেট হবে। আমরা ঢুকে বোর্ডিং পাস নিয়ে যখন রেস্তোরাঁয় ঢুকব, দেখি অসিত সেন বসে আছেন বাইরে। আমি চিনতে পারিনি, রাণাই চিনল। আমরা এগিয়ে গেলাম ওঁর দিকে। নিজেদের পরিচয় দিলাম। রাণা বলল, ‘আমরা দুজন ভাবী ফিল্মমেকার!’ কথাটা শুনে উনি হাসলেন, বললেন ‘আমিও এভাবেই আরম্ভ করেছিলাম। ফিল্মমেকার হব বললেই হওয়া যায় না, আর হিটের পর হিট দেওয়ার পরও দ্যাখো এখনও একটা কাজের জন্য হাঁটুর বয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে! হাঁটুর বয়সি ছেলেমেয়েরা আমাকে সমীহ করছে ঠিকই কিন্তু কাজ দেওয়ার সময় তাদের কত প্রশ্ন! ফিল্ম-মেকিং ধীরে-ধীরে কর্পোরেট ও পেশাদারি হয়ে উঠছে। কিন্তু যতই যা হোক না কেন, হৃদয়ের দোল, মনের উন্মাদনা ছাড়া ছবি হয় না।’ মনে পড়ে গেল ক’দিন ধরে রানার সব গল্প ওঁকে ঘিরে। ডিসিপ্লিনের ধার ধারতেন না। এমনকী চায়ের বদলে চায়ের কাপে রামও খেতেন। আমার মুখ দেখে ওঁর বোধ হয় মনে হয়েছিল আমি একটু বেশি কাজ নিয়ে বা নিয়ম নিয়ে ভাবি। তাই হঠাৎ বললেন, ‘সৃজনশীলতার পিছনে কিছুটা ডিসিপ্লিন ভাঙা দরকার। সেটা মদ খেয়ে হতে পারে বা না খেয়ে, অন্য কিছু নেশা করেও…।’ ভাবতে শুরু করলাম। ঋতুপর্ণর সঙ্গে তখন কাজ করি। ঋতুর ওই যে পোশাক বা আসবাব কেনার নেশা, আমার যে সর্বক্ষণ একটা উত্তেজনার পিছনে ঘোরা, এক বন্ধু পরিচালকের নারীসঙ্গের মাদকতা, এইসব!
‘কিন্তু অন্যান্য নেশা নিয়ে লোকের তেমন মাথাব্যথা নেই, কিন্ত মদ আর মহিলা নিয়ে তাঁদের কী আস্ফালন! মদ খেয়ে শেষ হয় যাচ্ছি এ-নিয়ে কত কী না শুনতে হয়! অথচ কত হাজার-হাজার লোক মদ না খেয়েও যে শেষ হয় যাচ্ছে তার বেলা?’ কোনও উত্তর নেই আমার, ভাবছি কী যুক্তি খাড়া করব। আর রাণার মুখটা উজ্জ্বল। আমার মুখ দেখে হেসেই ফেললেন উনি। ‘তোমরা দুজন আছ তো, তাই একজন ডিসিপ্লিনড হবে অন্যজন উন্মাদ।’ আজ এত বছর পরও আমি আর রাণা তর্ক করে মরি, কে কোনটা তাই নিয়ে।
কথায়-কথায় আমরা ওঁকে কফি অফার করি। বললেন, ‘এখন রাত আটটা; এটা কফির সময় নয়, কিন্তু অন্য কিছু সঙ্গে নেই, যা ছিল গাড়িতে শেষ, তোমাদের আছে?’ আমি তো অন্য কিছু খাই না, কিন্তু রাণা খায়। রাণা তখনও অতটা দড় হয়নি যে হিপ ফ্লাস্ক বা রেডিমিক্স নিয়ে ঘুরবে। বিমানবন্দরে বার আছে কি না রাণাকে দেখতে বলায়, সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন, ‘থাকলেও ওখানে খাব না, অত দাম দেওয়ার কোনও মানে হয় না, চলো কফিই খাই! সাহেবরা তো ডিনারের পরই কফি খায়।’ আমাদের ফ্লাইটে ডিনার দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেরি হওয়ায়, ডিনার কুপন দেয়। আমরা ঠিক করি আগে ডিনার, তারপর কফি।
ব্যস, চলল আড্ডা। ওঁর সঙ্গে সুচিত্রা সেনের সখ্য, রাজেশ খান্নার দেরিতে আসা অথচ দারুণ ব্যবহার, ওয়াহিদা রেহমানের চোখের ভাষা, ধর্মেন্দ্রের গলায় ভাব আনা, অশোক কুমারের দরাজ স্বভাব, বসন্ত চৌধুরীর সফিস্টিকেশন… পুরো সিনেমা-জগৎটা খুলে গেল চোখের সামনে। সেই সব তারকা, যাঁদের ছবি দেখে বড় হয়েছি, তাঁদের সঙ্গে ইনি কাজ করেছেন। তখন তো আর টিভিতে সর্বক্ষণ তারাদের কথা চলত না, তাই ওঁর সান্নিধ্যে এসে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি তো এত সুন্দরী হিরোইনের সঙ্গে কাজ করেছেন, এঁদের মধ্যে কে আপনার সবচেয়ে প্রিয়?’ একটু ভাবলেন, তারপর, ‘এখনও ফিল্মমেকার হওনি তাই এই প্রশ্ন করলে, জানবে ফিল্মমেকারের কাছে যে যখন হিরোইন, সেই সেরা, সেই তখন প্রিয়তমা।’
শুধু যে ওঁর কথাই হল তা নয়, আমাদেরও করলেন হাজারও প্রশ্ন। ঋতুর সঙ্গে কাজ করি শুনে বললেন, ‘ওঁর একটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি আছে, ও মনস্তত্ত্বটা ভাল বোঝে, বিশেষত মহিলাদের, অন্তত যে-দুটো ছবি দেখেছি, তা দেখে মনে হয়েছে।’ সম্ভবত উনি ‘দহন’ ও ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখেছিলেন। ওঁর কাছ থেকে এটা বড় প্রশংসা, কারণ নারীকেন্দ্রিক ছবি করার ব্যাপারে উনি ছিলেন মাস্টার। মুম্বইতে বসে ষাট ও সত্তরের দশকে নারীকেন্দ্রিক ছবিতে উনিই কিস্তিমাত করেছিলেন। ঋতুকে কথাটা বলায় ও খুব খুশি হয়েছিল। অসিত সেন মেইনস্ট্রিম সিনেমায় একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন, আবার ঋতু অন্য ধারার ছবিতে একটা মেইনস্ট্রিম ধারার প্রচলন করে।
রাত যখন ১০টা, তখনও প্লেন আসতে ঘণ্টাখানেক বাকি। ওঁর কিছু প্রকল্প নিয়ে কথা চলছে তখন। ভাবছেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করবেন কী করে। পুরনো টিমের অনেকেই ছড়িয়ে পড়েছে। টিম ছাড়া কাজ করা শক্ত। এরই মধ্যে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কি ঋতুপর্ণর সঙ্গে নাড়া বাঁধা না কি তোমরা অন্যদের সঙ্গেও কাজ করো?’ জানালাম আমরা ফ্রিলান্সার, যখন যা পাই তখন তাই করি। তবে চেষ্টা করি কমিটমেন্ট না ভাঙার। শুনে খুশি হয়েছিলেন এবং আমাদের ওঁর সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণও দেন। কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তারপর তো ২০০১ সালে ছেড়েই চলে গেলেন! আজ সেই প্রথম দেখার ২৩ বছর পর ওঁর শতবর্ষে বার বার ওঁর কথাগুলো মনে পড়ছে… ওঁর উপলব্ধিগুলো এখন আমাদের কাছে বাস্তব। কিন্তু তার সঙ্গে লড়ছি আমরা, ওঁরই কথা মাথায় রেখে।
কথায়-কথায় রাণা ওঁকে বলে দিয়েছিল, আমি অসিত সেন শুনে চরিত্রাভিনেতার কথা ভেবেছিলাম। ‘এটাই ট্র্যাজেডি; আমরা ছবি করি, অভিনেতাদের তুলে ধরি, কিন্তু আমাদের visibility নেই বলে কেউ চিনতে পারে না। আমাদের কাজই আমাদের পরিচয়।’ একদম হক কথা, আজ ওঁর শতবর্ষে ওঁর কাজগুলো নিয়ে নাড়াচাড়ার সময় এসেছে।