প্রথম বিলেত
একটা গানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে।’ ঘুরে বেড়াতে কখনও ক্লান্ত হননি তিনি— যেমন দেশে, তেমনই বিদেশে। প্রায় ছয়টি মহাদেশের তিরিশটি দেশে ঘুরেছিলেন পথিক-কবি, তাঁর আশি বছরের জীবনকালে।
রবীন্দ্রনাথের বয়েস তখন সতেরো। তখনও শ্মশ্রু-গুম্ফে মুখের সীমানা ঢেকে যায়নি তাঁর। বাড়ি থেকে ভাবা হল, উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁকে বিলেতে পাঠানো হবে। সেইমতো ১৮৭৮-এর ২০ সেপ্টেম্বর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে ইংল্যান্ডে রওনা হলেন। দু’বছর থেকে ফিরে এলেন ১৮৮০-তে। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের দেশের বাইরে পা রাখা। সেই প্রথম য়ুরোপ যাত্রা আর ইংল্যান্ড প্রবাসের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন, যার কয়েকটা লিখিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা ‘ভারতী’র জন্য। প্রবাস থেকে লেখা তেরোটা চিঠি সাজিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম ভ্রমণ-বৃত্তান্তের বই ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ১৮০৩ শকাব্দে। বইটা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ভাই জ্যোতিদাদা, ইংলণ্ডে যাঁহাকে সর্বাপেক্ষা অধিক মনে পড়িত, তাঁহারই হস্তে এই পুস্তকটি সমর্পণ করিলাম।’ একটু হলেও এই বইটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গর্ব ছিল। চারুচন্দ্র দত্তকে লেখা এক চিঠিতে তিনি তাই লিখেছিলেন, ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রশ্রেণী আগাগোড়া অরক্ষণীয়া নয়। এর স্বপক্ষে একটা কথা আছে সে হচ্ছে এর ভাষা। নিশ্চিত বলতে পারি নে কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষায় লেখা বই এই প্রথম… আমার বিশ্বাস বাংলা চলতি-ভাষার সহজ-প্রকাশ-পটুতার প্রমাণ এই চিঠিগুলির মধ্যে আছে।’
এই বইয়ের প্রথম পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘সমুদ্র পীড়া’ কাকে বলে অবিশ্যি জানো, কিন্তু কিরকম তা জানো না। আমি সেই ব্যামোয় পড়েছিলেম, সে কথা বিস্তারিত করে লিখলে পাষাণেরও চোখে জল আসবে।’ রবীন্দ্রনাথের তখন অল্প বয়স, মেয়েদের প্রতি যেন অনুভব করছেন বিশেষ একটা টান। সেইসব কথাও মন খুলে এইসব চিঠিপত্রে লিখেছিলেন তিনি। ইতালির মেয়েদের দেখে লিখলেন, ‘ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রঙ, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ আর মুখের গড়ন অতি চমৎকার। আমরা রাস্তায় ঘাটে কেবল ছোটোলোকদের মেয়েদের দেখেছি মাত্র, কিন্তু তাদেরই এমন ভালো দেখতে যে কী বলব!’ ছোট্ট ছোট্ট এমনই সব চোখের দেখা আর মনের গল্প ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এর আনাচে-কানাচে।
খেলনাওয়ালা এনে দিলেন শেলির বই?
বিলেতের মেয়েদের দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হল তাঁরা সব ‘দর্জিশ্রেণীর জীবিকা, ফ্যাশান-রাজ্যের বিধাতা ও যুবকদলের খেলনাস্বরূপ।’ মনে হল, ওদেশে পুরুষের মন ভোলানোই যেন মেয়েদের একমাত্র ব্রত। ব্যাপারটা তাঁর মোটে পছন্দ হল না। কিছু ধারণা ভেঙে গেল। ভাবতেন ইন্টেলেকচুয়াল খাদ্যই ওদেশের সকলের মনের একমাত্র খাদ্য, ভাবতেন মেয়েরাও সেই খাদ্যকেই মনের প্রধান খোরাক মনে করে নাচ-তামাশাকে তার নীচে স্থান দেয়। ওদিকে বিলেতে এসে দেখলেন মেয়েদের পড়াশোনার বহর এতই সামান্য যে, তা চোখেই পড়ে না। দেখলেন পাড়ায়-পাড়ায় মদের দোকান, রাস্তায় বেরোলেই জুতোর দোকান, দর্জির দোকান, মাংসের দোকান, খেলনার দোকান। তিনি আগে জানতেন ওই দেশে একটা কসাইয়ের দোকান যেমন জরুরি তেমনই জরুরি একটা বইয়ের দোকান। অথচ আদপে দেখলেন কাছাকাছি বইয়ের দোকান একটাও নেই। তাঁর দরকার ছিল শেলির কবিতার একটা বই। শেষমেশ এক খেলনাওয়ালাকে হুকুম করা হল ইংরেজ কবির সেই বই এনে দেওয়ার জন্য।
সবাই যেন ভাবত দুগ্ধপোষ্য বালক
তখন বিলেতে সবে রবীন্দ্রনাথের আলাপ জমে উঠছে দু-একজন লোকের সঙ্গে। তাদের সমস্যা একটাই। সবার কাছেই তিনি যেন এক অতিদুগ্ধপোষ্য, কিচ্ছুটি না-জেনে-আসা এক ভারতবর্ষীয় বালক। সকলের যেন তাঁকে পেয়েই, নির্বোধ ভেবে কিছুটা জ্ঞান বিতরণ করার একটা প্রবণতা। এক ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। একটা দোকানের সামনে কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সাজানো। সে ভাবল ফোটোগ্রাফ দেখে রবীন্দ্রনাথের একেবারে তাক লেগে যাবে। তাই সে বলে উঠল, ‘একরকম যন্ত্র দিয়ে ওই ছবিগুলো তৈরি হয়, মানুষে হাতে করে আঁকে না।’ রবীন্দ্রনাথের চারদিকে তখন নানা লোকজন, তাই কিছুটা লজ্জাই করছিল। রবীন্দ্রনাথ ছেলেটাকে বললেন, এইসব খবর তাঁর জানা। তবু সেই ছেলের উৎসাহের যেন শেষ নেই। একটা ঘড়ির দোকানের সামনে গিয়ে ঘড়িটা যে কত আশ্চর্য এক যন্ত্র সে তারই ব্যাখ্যা দিয়ে চলে। তার ওপর একটা সান্ধ্য পার্টিতে এক মহিলা রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, তিনি পিয়ানোর ‘ডাক’ আগে কোথাও শুনেছেন কি না। এদিকে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন এক ডাক্তারকে তাঁর শিক্ষক খুবই শিক্ষিত লোক বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু আদপে সেই ডাক্তার শুধু জানেন, শেলি এক ইংরেজ কবি। ‘কিন্তু শেলী যে চেঞ্চি (Cenci) ব’লে একখানা নাটক লিখেছেন বা তাঁর Epipsychidion ব’লে একটি কবিতা আছে’ তা তিনি রবীন্দ্রনাথের মুখেই প্রথম শুনলেন। ব্যাপারস্যাপার দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হল, বিলেতের লোকজন পরলোকের একটা মানচিত্রও হয়তো চাইলে এঁকে দিতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষ বিষয়ে একবিন্দুও জানে না।
সাজলেন বাংলার জমিদার
এক ছদ্মবেশ-নাচের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সোজা কথায় ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ অনুষ্ঠান। সবাই যে-যার মতো সেজে নাচতে জড়ো হয়েছে প্রকাণ্ড একটা ঘরে। ব্যান্ড বাজছে। বিচিত্র সব সাজে প্রায় ছয়-সাতশো নারী-পুরুষ নাচের তালে। বেশির ভাগই সুন্দরী আর সুপুরুষ। জমিদারের ছেলে রবীন্দ্রনাথ সেজেছেন বাংলার জমিদার। পরেছেন জরি দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি দেওয়া মখমলের পাগড়ি। এ-পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কয়েকজন পীড়াপীড়ি করে তাঁর মুখে এঁটে দিলেন দাড়ি আর গোঁফ। কয়েকজন মহিলা তাঁর তারিফ করায় রবীন্দ্রনাথ বেজায় খুশি হয়ে নাচের ঘরে গেলেন। কিন্তু এ কী কাণ্ড! যে জনাকয়েক সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, তারা তাঁর গোঁফ-দাড়ি দেখে সকলেই চম্পট দিল। অনেকেই অনেককে করমর্দন করছে কিন্তু ‘বাংলার জমিদার’ রবীন্দ্রনাথের ত্রিসীমানায় আর কেউ ঘেঁষে না। রবীন্দ্রনাথ যারই কাছে যান সে-ই সরে পড়ে। ‘রাগে দুঃখে অভিমানে বিরক্তিতে আত্মগ্লানিতে অভিভূত হয়ে’ সেই মুহূর্তেই তাঁর গোঁফ-দাড়ি উৎপাটন করে পকেটে পুরলেন রবীন্দ্রনাথ।
কভারের ছবি: ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথ
ছবি সৌজন্যে: লেখক