সেবার মামার বাড়ি গিয়ে যা একখানা অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল আমাদের! এ-গল্প তখনকার, যখন আমাদের বয়স এই তোমাদের মতনই হবে! দাদা সবে ক্লাস ফাইভে আর আমি ক্লাস টু-তে। বলার মধ্যে, সে-বছরই পুজোয় প্রথমবার দাদার সব ক’টা ফুলপ্যান্ট হয়েছে। আমারও হয়েছে— একখানা কার্বন ফ্রেমের চশমা। চকোলেট-রঙা পাড় তার। আর মাঝখানে হরলিক্সের শিশির নীচটার মতন গোলুমোলু কাচ লাগানো। দু’দিকের ডাণ্ডা থেকে আবার তেনাকে ঝুলিয়ে দোল খাওয়াবার ব্যবস্থাও আছে। সবে মিলে আমাদের আবহাওয়া খানিক ‘এই তো চাচা, বড় হয়েচি খাসা’ মাপের গম্ভীর।
সে-বছর আমাদের মামাবাড়ি যাওয়ার কারণ মূলত দুটো। এক, একটা কানলটকা নেড়ির ছানা জোগাড় করা। তবে হ্যাঁ লালচে হতে হবে। নাম দেব লালু। দাদার সাথে এইরকমই কথা হয়ে আছে। আর দুই, দু-চারখানা পায়রার ডিম, চাই-ই চাই। মা যেভাবে গত বছর গরমকালে দাদার ফোঁড়াটাকে সেঁক-তাপ দিয়ে-দিয়ে দুরমুশ করে দিয়েছিল, আমাদের পরিকল্পনাটাও খানিক ওইরকমই। ওই স্টিলের বাটিতে গরম জল নিয়ে, সকাল-সন্ধে তুলোর ভাপ দিয়ে-দিয়ে, ডিম থেকে পায়রা ফোটব আমরা।
হবু লালুর জন্য একটা লাল টুকটুকে বেল্টও রেডি। ভাগ্যে মা’র ভেলভেট পাড় শাড়িটা সময়মতো ফেঁসেছিল! আর হ্যাঁ পায়রার খুপরিও মোতায়েন করা আছে ব্যাগে। পুজোয় যে ফোস্কার ঝুড়ি, থুড়ি ইয়ে কোলাপুরি হয়েছিল আমার! তার খাপখানা আর কি!
গল্প আরেকটু এগোবার আগে এইবেলা বুল্টির ব্যাপারটা বলে নিই। মায়ের তুতো দাদার মেয়ে, মানে আমার মামাতুতো বোন বুল্টি। ওর সাথে আমাদের খুব ভাব। বিকেলে পুকুরঘাটের বড় পাথরটায়, আমরা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। ঢিল ছুড়ে মাছের বুদবুদ স্পট করি। পা ডোবালে মাথা হালকা লাগে।
সেই বুল্টির মাসির বিয়ে তার মামাবাড়িতে। অমিতঘর গ্রামে। নামটা আসলে অমৃতগড়। মুখে-মুখে অমিতঘর হয়ে গেছে। বুল্টি যাবে মানে আমি আর দাদাও যাব। তখনই থিওরাইজ করে ফেলেছি, মামার বাড়ি নিয়ে নিজের-পরের করতে নেই। মায়ের কোনও আপত্তি খাটল না। বললাম, ‘দেখো, আমাদের ঠিকানা কিন্তু মোটেও পাল্টাচ্ছে না। একটা মামাবাড়ি থেকে আরেকটা মামাবাড়ি যাচ্ছি শুধু।’
দুজনে ফটাফট একটা হ্যান্ডেল দেওয়া চটের ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। আর তার পরদিন সকালেই, মৃদুমন্দ হাওয়ায়, ভ্যানে চড়ে বাসরাস্তার দিকে রওনা হওয়া গেল।
ঠান্ডা একটা ঝোড়ো হাওয়া বাসে থাকতে-থাকতেই দেওয়া শুরু করেছিল। পৌঁছবার অল্পক্ষণ পরেই আরম্ভ হল কালবৈশাখী আর শিলাবৃষ্টি। বিকেলে সেই যে কারেন্ট গেল, সন্ধের পরও এল না। মাটির দালানবাড়ির দোতলায় ও একতলায় বেশ কিছু হ্যারিকেন আর লণ্ঠন। বুল্টি ভিতরঘরে নিতকনের গুরুদায়িত্ব নিয়ে বসে-বসে ঢুলছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই নীল, সবুজ বেনারসি পরা মেয়েরা এদিক-ওদিক শাড়ি খসখস আর গয়না রিনঠিন করে যাতায়াত করছে। আর বৃষ্টির মেঘ সব ফুরিয়ে গিয়ে আকাশে তখন ঢালাও তারার কুচি।
২.
বাতাসা নদীর ধারে, এখনও গেলে দেখতে পাবে সেই পোড়োবাড়িখানা। সেটাই নাকি দুর্গ ছিল একদিন! মামাদাদুর মুখে অনেক শুনেছি এই দুর্গের কথা। শুনেছি, নদী খাঁটি বাতাসিয়া ছিল এককালে। এখন কালে-কালে ঘিঞ্জি হয়েছে অবশ্যি। হবে না? পর পর দুখানা ফ্যাক্টরি বসেছে যে!
এদিকে এমনিতেই বিয়েবাড়িটায় তেমন গা নেই আমাদের। বরং নদী আর পোড়োবাড়িটা টানছে। সানাই-টানাই শুনশান। বদলে ঝিঁঝিঁ ডাকছে তেড়ে। একদল চেঁচামেচি করে রাধাবল্লভী খুঁজছে। আরেকদল হাতপাখা। চূড়ান্ত ক্যাওস। মাঝে আমরা দুটো খোলা গরু। ভীষণ টক একটা শরবত জোগাড় হয়েছিল। তার দু’চুমুক নমুনা খেয়ে, সোজা হাঁটা দিয়েছি নদীর দিকে।
মশা আর গোবরের গন্ধ ডজ করে-করে এগোচ্ছি। প্রথমে পড়ল একটা পাতকুয়ো। তারপর চাষজমি। এবার কিছুদূর গিয়ে পেলাম একটা তালাচাবি মারা ধানকল। ধানের বস্তা ওজন করার জন্য বাইরে ঝুলছে মস্ত একখান ওজনদাঁড়ি। তাতে অল্প দুলে না নিলে ভগবান তো আবার পাপ দেবে! সেসব করে-টরে আরেকটু এগোতে পড়ল একটা তালপুকুর। আগাপাশতলা তালগাছে মুড়ি দেওয়া।
তালতলার কাছাকাছি এসেছি, হঠাৎ শুনি খুক খুক হাসি। তার সাথে ধরা গলায় প্রশ্ন, ‘কে যায়?’
আমরা বলি, ‘আমরা।’ অমনি অন্ধকার ফুঁড়ে সাদা ধুতি-ফতুয়া পরা এক দাদুর উদয় হল পুকুরপাড়ে।
‘আমরাটা কারা? এ-গাঁয়ের তো নও! বিয়েবাড়ি এয়েচ বুঝি?’
আমরা বলি, ‘হুঁ।’ দাদা বলে, ‘আপনি কে?’
‘আমাকে চাঁদুদাদু বলতে পারো। এসো না, একটু বসি! গপ্পো হবে!’
দাদা বলে, ‘না চাঁদুদাদু। এখন না। এখন ওই নদীটার দিকে যাচ্ছি।’
‘বাব্বা! খুব সাহস তো তোমাদের? রাতের বেলা একা-একা ঘুরছ! ভয়ডর নেই না কি একেবারে?’
দাদা হেসে বলল, ‘আরে চাঁদুদাদু, এখন আর ভূত বলে কোথাও কিছু নেই। আমাদের স্যর বলে দিয়েছে। ভয় আর করবটা কাকে?’
‘ভূত বলে আর কিছু নেই? আচ্ছা?’ বলেই খুক খুক করে চাঁদুদাদু হাসল না কাশল ঠিক বোঝা গেল না।
ব্রিজের ওপর বাসরাস্তাটা মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে এখান থেকে। মাঝে মাঝে খেলনা লরি যাচ্ছে। মাথায় আলো জ্বেলে। আকাশে একটা ফিনফিনে জরির চাঁদ। চলেছি তো চলেছিই। পিছন ফিরে দেখছি আবছা হয়ে আসছে সাদা ধুতি-ফতুয়া। টিমটিমে হ্যারিকেন-জ্বলা দোতলা মাটির বাড়িটা দেখে রাখছি মাঝে মাঝে। ছোট হয়ে আসছে ঠিকই কিন্তু দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
বাঁ-দিকের ধানজমিতে আলের ফাঁকে এরকম সময় কেঁউকেঁউটা প্রথম শুনলাম। ইউরেকা! লালু না কালু দিনের আলোয় সে তো কাল বোঝা যাবে! দাদা গিয়ে কোলে তুলে নিতেই সব কাঁইকুঁই থেমে গেল। এবার একটা খেলা শুরু হল। নামিয়ে দিলে সে গটমট করে একটু এগোয়। আবার থামে। ঘুরে দেখে আমরা ফলো করছি কি না। ওর পিছন-পিছন গেলে খুশি হয়ে দ্বিগুণ ঝাঁপায়। না যেতে চাইলে আমার ফ্রক কামড়ে, দাদার চটি চিবিয়ে, চেটে, আমাদের একরকম টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে নদীর দিকে।
নদীর ধারে ঝুপড়িগুলো পেরিয়ে দেখি পোড়োদুর্গটার ঠিক পিছনে আলে ঘেরা ছোট একফালি মাঠ। সেইখানে জনাপাঁচেক ছেলে সাগর ডিঙাডিঙি খেলছে। লালু দৌড়ে গিয়ে তাদের চাটাচাটি করল। ওরা খেলতে ডাকল আমাদের। গেলাম। ঠাহর করতে পারলাম, মাথায় চুল নেই ওদের কারো। গরমের জন্য মাথা মুড়িয়েছে? না কি উকুন হয়েছিল? কে জানে! আস্তে-আস্তে গলা শুনতে-শুনতে এক সময় আন্দাজ করতে পারলাম, ওদের মধ্যে দুজন ছেলে আর তিনজন মেয়ে।
৩.
তারাদের কিপটে আলোয়, সাগর ডিঙাডিঙি চলছে অবাধ। যে আউট, সে আছে মাথা নীচু করে চার হাত-পা মাটিতে রেখে। সে ঢেউ। তার পিঠে দু’হাতে ভর দিয়ে, ঝপাং-ঝপাং করে হাই জাম্প দিচ্ছি আমরা। মনের যত উচ্চাশা পূরণ করে নিচ্ছি আর কি!
আশ্চর্য সব খেলা। নাম-ধাম জানি না খেলুড়েদের, কিন্তু মনে সুখ ষোলোআনা। সে বড় সুন্দর ব্যাপার। রাতদুপুরে একঝুড়ি অমন খিলখিলে, খলবলে বন্ধু পেয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়!
খেলার একটা নমুনা দেওয়া যাক। বন্ধু ক, আপাতত এক প্রকার কাল্পনিক ঘুঁটে দিচ্ছে চারপেয়ে বন্ধু খ-এর পিঠে। ডানহাতে ঘুঁটে দেওয়া কনটিনিউ রেখে, সে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘুঁটে পিটাই, ঘুঁটে পিটাই, তোর নাম কি?’
খ বলল, ‘সাবান।’ ক নামের মেয়েটি, ঘুঁটে দেওয়া বন্ধ করে, খিলখিল করে উঠল। খ-এর পিঠে লম্বা একটা ডিঙ মেরে সে বলল, ‘সাবানকে এক ঢাল দিলাম।’
তারপরে চলল, ‘আয় রে আমার গো-ও-লাপ!’, ‘আয় রে আমার টি-ইয়ে-এ!’ ইত্যাদি। ‘আয় রে আমার’ মুখড়াটুকু ফিক্সড রেখে, শালিখ, চড়াই, আইসক্রিম, আলু, শিলনোড়া হয়ে টিউবকল পর্যন্ত।
এখন বেশ টুপটাপ শিশির মালুম হচ্ছে। গায়ে, মাথায়ও। ভেজা ঘাসে বসে, ওদের সাথে গলা মিলিয়ে, মিছিমিছি ‘দুধ ভাত খাই’, ‘দুধ ভাত খাই’ বলছি। মনটা আনন্দে টইটম্বুর। রাতের অন্ধকারের পেটে-পেটে যে এত আনন্দ গুঁড়ি মেরে থাকে, আজ অবধি এ-কথা কেউ আমাদের বলেনি। কেন বলেনি, ভেবে বড় আশ্চর্য হই। তখন কিন্তু রাত কত, কেউ আমাদের খুঁজছে কি না, সেসবের কোনো খেয়াল নেই। আনন্দ হচ্ছে, করছি! সোজা হিসেব।
শেষ রাতের কাছাকাছি নদীর দিক থেকে একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ আসতে শুরু করল। অমনি ছেলেমেয়েগুলো তিড়িংবিড়িং করে পোড়োবাড়িটায় গিয়ে ঢুকল। আমরাও গেলাম পিছু-পিছু। কিন্তু ভাঙা ইঁট আর অশ্বত্থের শিকড় পেরোনোই সার। কাউকে দেখতে পেলাম না। অগত্যা লালুকে কোলে নিয়ে ফেরার পথ ধরা!
এবার তালপুকুরের কাছটায় এসে ভাল করে দেখি, একটা মাচামতন বাঁধা আছে পুকুরধারে। অমনি পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম আমরা। নীচে জল, উপরে তারা, কানে ঝিঁঝিঁ। চারপাশে ইয়াব্বড়বড় তালগাছ। হঠাৎ আমাদের পিছন থেকে উদয় হল চাঁদুদাদু। কেশে-টেশে নিয়ে বলল, ‘হুঁম, এসেচ? তবে সেই গল্পটাই বলি। শোনো।’
৪.
চাঁদুদাদু গল্প শুরু করল।
‘দরকারে পুজোআচ্চা করে দিই। নন্দীরা তাই ঠাকুরমশাই বলে ডাকে। খুব খাতিরও করে আমাকে । কোঠাবাড়িটায় থাকতে দেয় ও-গ্রামে গেলে। যদ্দিন থাকি, একজন রান্নার ঠাকুর রাখে। শালপাতায় মুড়ে, নদীর টাটকা চিংড়ি এনে দেয়। তখন তো কাঠ আমদানির চক্করে চরকির মতো ঘুরে বেড়াই নানান জায়গা।
সেদিন আমি আর পোদ্দার দুজনায়, পশ্চিমের মাঠজানপুর থেকে হাঁটতে-হাঁটতে পুবে যাচ্ছি শ’মিলের কাজে। পথে পড়ল এক বিশাল মাঠ। সেইটে পেরোলে তবে বড়রাস্তায় ওঠা যাবে। মাঠজানপুর হয়ে আসতে গেলে এদিককার গ্রামটা যে অমিতঘর, তা অবশ্যি জানি না তখনও।
এর মাঝে বিকেলে ঢালাও বৃষ্টি হয়েছে। এঁটেল মাটি চিটিয়ে চটচট করছে। আমার নাগরা জুতো এক-দু’পা ছাড়া-ছাড়া, সেঁধিয়ে যাচ্ছে এক-এক হাত কাদার পেটে। সাইকেল ঠেলে এগোনো তো আরও দায়! সে একেবারে মাখামাখি কাণ্ড! কিন্তু মাঠটা তো পেরোতে হবে!
হঠাৎ মাঝমাঠে দেখি একপাল ছেলেমেয়ে। মোটামুটি একইরকম হাইট। প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন হবে! ন্যাড়া মাথা সব্বার। চাঁদের আলোয় ঘুরঘুর করছে মাঠের মধ্যিখানে। আমি ও-বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করলুম না। বুঝতে পারছি কিছু একটা গোলমাল আছে। গায়ত্রী মন্ত্র জপছি মনে-মনে। পোদ্দারকে বললে সে তো এখুনি ফ্ল্যাট হয়ে যাবে। এখনও যে খেয়াল করেনি এই অনেক।
বাচ্চাগুলো চুপচাপই বলা যায়। একটু দূরে থেকে পিছু-পিছু আসছে আমাদের। পোদ্দারকে বললাম, ‘চলো পোদ্দার, সাইকেল দুটো ডাম্বেল করে তোলো দিকি!’
পোদ্দার তো ব্যায়ামবীর। মুগুর ভাঁজে। কিন্তু দেখতে পালোয়ান হলে কী হবে, ভূতের ভয় ওর সাংঘাতিক। দু’ঘাড়ে দুটো সাইকেল তুলে নিল সে নিমেষে। একনাগাড়ে অনেকটা পথ হনহনিয়ে হেঁটে, কাদা-চোরকাঁটা ঠেলে, শেষমেশ দেখা পেলাম নদীর। বড়রাস্তায় উঠলাম যখন, তখনও ভোর হয়নি। তখন হুসহাস মোটরগাড়ি ছিল না এত! গরুরগাড়ি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল একজন, তাকে ধরলাম।
আমরা মাঠের কোনাকুনি হয়ে এসেছি শুনে সে তাজ্জব হয়ে গেল। বলল, ‘এ-মাঠ দিয়ে কেউ যায় না কত্তা। মাঠ তো নয়, গোরস্থান! কত যে ছোট বাচ্চার কবর ছড়িয়ে আছে জমিটায়! আমরা গাঁয়ের লোক, স্কুলের ওদিকের তিনগুন পথ ঘুরে বড়রাস্তায় আসি। তেনাদের এড়াতে। একবার ওদের যে দেখেছে, সে কখনও আর জ্যান্ত এ-মাঠ পেরোয় না।’
লোকটা অবিশ্বাসীর মতো তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।
কাদার মধ্যে ধপ করে একটা আওয়াজ হল। আমি ডাকলাম, ‘পোদ্দার, পোদ্দার!’ সে কি আর তখন চোখ খোলে!’
যাবার আগে চাঁদুদাদু বলল, ‘আসলে কী জানো, ভূতেদেরও বন্ধু লাগে। দেখো, ওরা তো আমার কোনও ক্ষতি করেনি! কে জানে ছেলেপুলেগুলোর হয়তো গল্প শুনতে মন হয়েছিল! এই যে আজকে তোমরা আমার বন্ধু হলে, কত আনন্দ পেলাম বলো তো? নদীর দিকটায় আসলে এত বাড়ি হয়ে যাচ্ছে আজকাল, কারো মুখই দেখতে পাই না ভালো করে। ওই বেড়াল-কুকুরই ভরসা! যাক, কথা হয়ে ভাল লাগল। চলি!’
৫.
চাঁদুদাদুর সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু এ-গল্পটার একটা ছোট উপসংহার আছে।
এর প্রায় চোদ্দো বছর পরের কথা। আমি তখন কলেজে পড়ি। ততদিনে লালুর ছবিতে রোজ ধূপ ঘোরানো হয়। বুল্টির ঠাকুমার শরীর ভাল না। দেখা করতে আমিও গেছি ওর সাথে।
রাত আটটার বাসে ফিরব। বুল্টি চিপ্স কিনছে দোকানে। আমি একটু কড়ে আঙুলের বাহানা দেখিয়ে সরে এসেছি। ঢ্যাঙা দুর্গটা আজ আর অতটাও ঢ্যাঙা লাগছে না। পিছনের একফালি জমিটা কে বা কারা টিন দিয়ে যেন ঘিরে রেখেছে। ঘেরার মধ্যে বসে, দুটো বাচ্চা খেলাধুলো করছে। সাথে একটা কানলটকা কুকুর।
স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে বলছে, ‘ওকে নীচে নিয়ে গিয়ে সেদিনের মতো খেলবি?’ তারপর দেখি দুজনে খুশি মনে ঘাড় নাড়ছে।
লালু শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে ভৌ করেছিল। ব্যস। আর কেউ কোত্থাও নেই। খালি জ্যোৎস্না। তবে মাটির উপর কান পাতলে, একটা ফিসফিস শোনা যাচ্ছিল। কারা যেন খুব আহ্লাদ করছে কুকুরটার সাথে। আর চাপা গলায় ‘অ্যাঁও, অঁও’ করছে লালু। খুশি হলে যেমনটা করে।
বাসে ফিরতে-ফিরতে খেয়াল করলাম, একটা জিনিস কিছুতেই মনে করতে পারছি না। সে-রাতে কি আদৌ বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র