হায় রে কালা!
আমরা কি দেশ-শুদ্ধ সবাই কালা হয়ে যেতে বসেছি? প্রশ্নটা আক্ষরিক অর্থে, এবং রূপক হিসাবে, দু-ক্ষেত্রেই করলাম। বিশেষত আমরা যারা মহানগরবাসী, প্রতিদিন সকাল-বিকেল অহরহ যে শব্দকল্পদ্রুমের ধাক্কায় হিমসিম খাই, তাতে আমাদের বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়া, বা নিদেনপক্ষে শ্রবণশক্তি খুইয়ে ফেলার বিপদটা খুবই বাস্তব একটি আশঙ্কা।
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে, বায়ু (দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮১—এর আওতায় এ-দেশে শব্দকে দূষণকারী চিহ্নিত করা হয়। বিশেষজ্ঞেরা শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন, কোন-কোন ধরনের শব্দকে বিপজ্জনক বলা যেতে পারে, যা থেকে স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য-সমস্যা হতে পারে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু ভারতে আমজনতার কাছে, শব্দের এক্সপোজার থেকে স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হওয়া, বা অনেকটা সময় ধরে শব্দদূষণে উন্মুক্ত থাকার বিপদ সম্বন্ধে সচেতনতা এতই কম, এবং উদাসীনতা এতটাই বেশি, যে এই সমস্যা, বা এই ধরনের সমস্যার সমাধান বার করা বা প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব, কিছুটা নিরর্থকও।
হাল ছেড়ে দিয়েছি, এমন একটা সুরেই নিজের শব্দ-সংক্রান্ত বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার কথা শুরু করি। দিল্লি আর মুম্বাই, দুই শহরেই আমার বাড়ি, এবং কয়েক দশক ধরে দুটো শহরেই আমার বাস। মধ্য দিল্লির যে ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িতে আমি থাকি, সেখানে দৈনন্দিন শব্দদূষণের কিছু উদাহরণ:
শব্দদূষণ আমাদের দেশে বিপজ্জনক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত (https://cpcb.nic.in/noise-pollution-rules/), এর সমাধানে আইন পাশ করানো হয়েছে, কিন্তু তবুও এই সব আইনের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে, এবং যা হয়ে এসেছে তা একটু এলোমেলো, অযৌক্তিক এবং কোনোমতেই সন্তোষজনক নয়। আমার কাছে এই সব আইনের অপব্যবহারের প্রামাণ্য দলিলপত্র কিছু নেই, কিন্তু কাছাকাছি বাড়ি-ওয়ালা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল থেকে রাত ১০টা বাজার বহু আগেই ইচ্ছামত সাউন্ড সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করার কথা শুনেছি। অন্যদিকে, ধর্মীয় গানের চিল-চিৎকারের বিরুদ্ধে শব্দদূষণের অভিযোগ করে দেখুন তো কোনও সুরাহা হয় কি না!। অভিযোগের উত্তরে আমাকে রাত ২.৩০-এর সময় শুনতে হয়েছিল, ‘ম্যেডামজি, ডিজ্জে হোতা তো বন্ধ্ কর দেতে, পর ইয়েহ তো ভাগওয়ান কা নাম লে রে হ্যায়…’
এই সব অবস্থায় একমাত্র এটাই মেনে নিতে হয় যে যে আইন প্রয়োগ করা যায় না বা একমাত্র প্রতিপত্তিশালী এবং ধনী ব্যক্তিদের অঙ্গুলি-সঞ্চালনেই প্রয়োগ হতে পারে, তা কার্যকরী নয়, তা কোনো কাজের নয়।
আমার স্থির ধারণা যে এই ঘটনাগুলো শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যজনক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, সারা দেশ জুড়ে বহু মানুষ এ-ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। জ্বলন্ত কিছু বাস্তব থেকে আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি, যেমন পরিবেশ দূষণ, এবং শব্দদূষণের ক্ষেত্রেও যে জরুরি নজরদারি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সেটা আমরা মেনে নিতে চাইব না বলেই আমার মনে হয়।
এবং এই কারণেই আমার মনে হয়, আমরা একে অপরের কথা শোনাটাই বন্ধ করে দিয়েছি। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার করতে-করতে গণপিটুনিতে একের পর এক মানুষের প্রাণ দেওয়াকে আমরা মেনে নিয়েছি, মেনে নিয়েছি দেশের অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই ভয়াবহ অবস্থায়, কষ্টের কান্না আমাদের চারপাশের শোরগোলে হয় ডুবে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে— বা আমরা সত্যিই সবাই বদ্ধ কালা হয়ে যাচ্ছি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
Read in English