লেবুর জল
লেক মার্কেটে ফুচকা খাচ্ছি। খান দশেক খেয়েছি। অভ্যাসবশত, দুটো শুকনো খাওয়ার দিকে এগোচ্ছি। শুকনো মানে জল ছাড়া। কিন্তু এ কী? কামড় বসিয়ে চেনা স্বাদ না পাওয়ায় কেমন একটা ফ্যাল-ফ্যাল করে ফুচকাওয়ালার দিকে তাকালাম। এ-ফুচকায় বিটনুন আছে, কিন্তু… লেবু কই? টক আছে বটে, কিন্তু সে তো তেঁতুলের!
অনিল রায় রোডের মোড়ের এই ফুচকাওয়ালা আমার পুরনো, বিশ্বস্ত লোক; সে আমার সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল, ভাবতে পারছিলাম না। হেসেই ফেলল। ‘বাবু, একটা মাঝারি সাইজের পাতিলেবু ১০-১২ টাকায় বিকোচ্ছে, হাত খুলে লেবু দিতে পারছি না, মাপ করবেন!’
‘পাতি’লেবু— নামেই যেন সহজলভ্য, অত্যন্ত তুচ্ছ পরিচয়। কিন্তু এই সাধারণ লেবু যে প্রত্যেকদিন কত কাজে লাগে, তা দাম না-বাড়ার আগে পর্যন্ত কেউই বোধহয় খুব একটা খেয়াল করেননি, ফুচকাওয়ালারা তো নয়ই। আম্বে বাহার, হাস্তা বাহার – এ-বছর পর-পর দুটো পাতিলেবুর ফসল ফেল। এমনটা সাধারণত ঘটে না, তবে গত দু-বছরই তো একটু অ-সাধারণ বটে; ‘অতিমারী’ শব্দটাই যে গোটা বিশ্ব নতুন করে চিনে উঠল। ২০২১-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অযাচিত বৃষ্টি এ-ফসলের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে চলে গেছিল; এ-বছরের অস্বাভাবিক গরম তা একেবারে থেঁতলে দিয়ে যায়। এ-সোনায় সোহাগা জ্বালানির চড়-চড় করে ওঠা দাম, যা লেবুর বাজারদরকে একেবারে আকাশছোঁয়া বানিয়ে দিয়েছে।
শাইনিং ইন্ডিয়ার মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল্যবৃদ্ধি– বলা উচিত অগ্নিমূল্যরও বৃদ্ধি— যে-রেটে এগোচ্ছে, ‘সর্বত্র সহজলভ্য লেবুর জল’ ব্যাপারটাই বোধহয় আর কিছুদিনের মধ্যে ‘কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ফিরিওয়ালা’-র ক্যাটেগোরিতে পৌঁছে যাবে। এমনিতেই আজকাল টিনের ছোট গাড়িতে সারি-সারি কাঁচের গেলাস সাজিয়ে লেবুর-জল বিক্কিরি-ওয়ালাদের খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না; তার উপর অতিমারিতে সম্ভবত শতকরা সত্তর ভাগ পরিযায়ী ফেরিওয়ালারা নিজেদের ‘দেশের বাড়ি’ ফিরে গেছেন এবং ফেরিটাই গেছে উবে।
ঠিক ‘প্রান্তিক’ না হলেও, কলেজ স্ট্রিট, ডালহৌসি বা হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশন বাদে, এই দোকান-গাড়ির লেবুর জলওয়ালারা কিন্তু চিরকালই একটু আধা-শহর অঞ্চলে ঘোরাফেরা বেশি করতেন। মধ্য এবং উত্তর কলকাতার বেশ কিছু পাড়ায় এখনও দেখা গেলেও, শহরের বর্ধিষ্ণু দক্ষিণে বেশ কিছু বছর কাফে, অর্গ্যানিক জুস-বার ইত্যাদির প্রাচুর্যে এঁরা মিসিং; দেখা মেলে একেবারে যাদবপুর পার হয়ে— গড়িয়া, সোনারপুর, কুঁদঘাট, বেহালা, বারুইপুরে। আর যেখানে মেলা বসে, সেই-সেই মেলার মাঠে। একই সাথে বেড়ে ওঠা দুটো কলকাতার “টোয়াইলাইট জোন’-এ; সাধের এপিঠে-ওপিঠে, অদৃশ্য কিন্তু প্রবলভাবে উপস্থিত আর্থ-সামাজিক রাজনীতির মধ্যবর্তী রেখায়।
আমরা কেন, কখন, কী খাই, সেই খাদ্য রাজনীতি বোঝার বহুযুগ আগে আমার ফেরিওয়ালার থেকে কেনা লেবুর জলের শুরুয়াত, মাধ্যমিক পেরনোর পর, যখন টিউশনের খাতিরে যাদবপুর অঞ্চলে একা-একা যাতায়াত শুরু হয়ে যায়, তখন থেকে। আমার প্রথম দেখা লেবুর জল ফেরিওয়ালা দাঁড়াতেন ৮বি বাস স্ট্যান্ডে; কিনে জল খাওয়াও তাঁর কাছেই প্রথম। কিছুটা কৌতূহলবশত, কেননা ওই রকম অদ্ভুত কনট্র্যাপশন আগে কখনও দেখিনি। চার চাকার একটা টিনের দোকান-গাড়ি, গাড়িটাই ফ্রিজ, বরফ রাখা আছে নিচের খোপে। উপরে সেই বরফে ঠান্ডা হওয়া জলের একটা ট্যাঙ্ক। তারও উপরে ‘গাড়ির’ মাথায় গোল করে সাজিয়ে রাখা লোহার খোপে সারি-সারি গেলাস। গেলাসে ভর্তি সবুজ-হলুদ লেবু। চাইলেই নুন-চিনি মেরে এক গেলাস বরফ-ঠান্ডা জল হাজির। ওই ট্যাঙ্কটার মাথাতেই একটা লম্বা হাতল, যেটা ধরে টান মারলে জল উঠে এসে পিচকিরির মাফিক গেলাসে-গেলাসে ভরে যায়। ঠিক মনে নেই, তবে কলেজের সময় যদি এক বা দু-টাকা দাম হয়ে থাকে, আমি বোধহয় আট আনা দামের জলও খেয়েছি। আশির দশকের শেষের দিকে, দোকানে-দোকানে মিনেরাল ওয়াটারের চল যখনও দূর অস্ত, লোকে গেলাস-গেলাস শুধু ঠান্ডা জল এই ফেরিওয়ালাদের থেকে কিনে খেত। তার দাম ছিল আরো কম।
বাড়িতে এনে ফ্রিজ ভর্তি করে রাখা সফ্ট ড্রিঙ্কের বদভ্যাসটা আমাদের ছোটবেলায় অন্তত ঘরে-ঘরে শুরু হয়ে যায়নি, তার প্রধান কারণ বোধহয় অধিকাংশ বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতেই তখনও ফ্রিজ একটা লাক্সারি আইটেম ছিল। দ্বিতীয় কারণ বোধহয় প্লাস্টিকের বোতলের চল তখনও শুরু না হওয়া। আমরা কোল্ড ড্রিঙ্কটা পাড়ার পানের দোকানেই (খুবই কদাচিৎ) খেতাম; গ্রীষ্মকালে একটু মেতে উঠতাম বাড়িতে কিসান স্কোয়াশ ঢুকলে। কিন্তু স্কোয়াশ বা অন্যান্য বোতলের পানীয় থাকলেও, আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল ঠা-ঠা গরমের দুপুরে বেশি করে চিনি আর বিটনুন দেওয়া, বেশ ঠেসে বরফে ঠান্ডা করা লেবুর জল। তার কারণ আর কিছুই না— জলটা যত চাও পাওয়া এবং খাওয়া যায়। একটার বদলে দুটো গ্লাসভর্তি স্কোয়াশ চাইলেই তো মা’র চোখ-রাঙানি অনিবার্য, কী দরকার!
কোনোভাবে, লেবুর জল ব্যাপারটা আমার জীবনে একটা প্রধান ‘ড্রিঙ্ক’ হয়ে উঠেছিল, দুধ-টুধের বদলে। খুব ভোরে উঠে ব্যাডমিন্টন খেলার প্র্যাকটিসে যেতে হত বলে মা আগের দিন রাত থেকেই লেবু-নুন-চিনি জোগাড় করে রাখতেন, পরদিন সকাল-সকাল জল বানিয়ে সোজা লেক স্টেডিয়াম, এক্সারসাইজ করার ডাকে। জলটা খাওয়া হত খুব গরমের দিনেই, এবং এক-একটা গেমের ফাঁকে। একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজেই বানিয়ে ফেলতাম।
প্রেসিডেন্সি কলেজের মেন গেটের ঠিক বাইরে দু-দিকে দুজন বসতেন; একজন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলুকাবলিওয়ালা, এবং অন্যজন ওই টিনের টানা গাড়ি-দোকানের লেবুর জলওয়ালা। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বৈশাখ মাসের খুনে গরমটা ঠিক ২০২২-এর মতো ছিল কি না, তা আবহাওয়াবিদরা বলতে পারবেন, কিন্তু সারাদিনের কলেজ দাপানোর পর বিকেল-বিকেল ওই আলুকাবলি আর তার ঝাল কাটাতে হুশ-হাশ করে বরফ-ভাঙ্গা লেবুর জল, একটু নুন-চিনি বেশি দিয়ে, আমরা প্রায়শই খেতাম, এবং খেয়ে দিব্যি ঠান্ডা আরামও হত। কোনোদিনই ডায়রিয়া বা হুপিং কফ হয়ে মারা যাইনি।
অতিমারী-পরবর্তী কালে, পাঁচগুণ বেশি বকুনি খেয়ে খুচরো খাবার থেকে দূরে থাকা বেচারা পড়ুয়াদের মতো আমাদের কলেজ-জীবনেও বহু ছুৎমার্গ এবং সংক্রমণ-সচেতন সহপাঠী ছিলেন, যাঁরা অবশ্যই এই সব কোনোদিনও খাননি। ‘সচেতন’ এই মানুষেরা কলেজ স্ট্রিটে পড়েও যেন কলেজ স্ট্রিটে পরিদর্শক ছিলেন, তাই তাঁরা কলুটোলার কাবাব খাননি, কলেজ স্কোয়ার YMCA ক্যান্টিনের চিকেন স্টু খাননি, না খেয়েছেন কালিকার বেগুনি বা প্যারামাউন্টের শরবত। খাদ্য রাজনীতি নিয়ে তখন প্রায় কিছু না জানলেও, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ঢের বেশি সিরিয়াস, গুরুগম্ভীর, ‘ফোকাস্ড’ এই দলের থেকে আমাদের কলেজ স্ট্রিট আর কলকাতা যে আলাদা, তা আমরা বুঝতাম। তাতে কিছু এসে গেছে কি না, জানি না, তবে শহরটাকে এভাবে চিনে ওঠাটাই আমাদের কাছে সহজাত ছিল। পরবর্তীকালে খাদ্যে রাজনীতি নিয়ে যতবার বিরোধ বেধেছে, যতবার কেউ না কেউ বলতে চেয়েছে যে এই খাবার খাওয়া যাবে না বা ওই খাবার খাওয়া উচিত, শহর জুড়ে, শহর ঘুরে খাওয়ার স্বাধীনতাটাকে মনে রেখে রুখে দাঁড়িয়েছি। এতে ৮বি বাস স্ট্যান্ডের লেবুর জলের যে একটা ভূমিকা রয়ে গেছে, সেটা অনস্বীকার্য।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র