এই কলকাতা শহরেই, আমি নিজের চক্ষে দেখেছি, পানশালার দুয়োরে গোটা-গোটা ইংরিজি অক্ষরে, কার্ডবোর্ডে প্রিন্ট করে ইস্ক্রুপ-আঁটা স্থায়ী ঘোষণা লেখা— chappals and lungis are not allowed— বেশি না, বচ্ছর বিশেক আগেও। তখনও সোশ্যাল মিডিয়া হয়নি, মন করলেই ফোন টিপে-টিপে আন্দোলন গড়ে তোলা যেত না, তখনও সুধী বলতে সিপিএম আর রুধী বলতে মমতা, দু’য়ের কারুরই সাহেবপাড়ার মদিরাখানার নোটিশ-ফোটিশ নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসত ছিল না। তো, আমিই সাহস করে এগিয়ে গেলুম। দ্বারপালকে ঝাঁঝিয়ে দিলুম— ‘এসব কী?’ তিনি জবাব করলেন, ‘সাহেবপাড়া, ভাই। আসলে ছোটলোকেরা ঢুকে পড়ে তো মধ্যে-মধ্যে, তাই।’
আপন আহ্লাদীর তরে একখান শাড়ি কিনব, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে পয়সা জমিয়েও, এসি দোকানে ঢোকা যায়নি কোনওদিন। দেখে বড়লোক মনে হয় না। দোকানি একটার বেশি দুইখানা দেখাতে চায় না। শো-কেসে টাঙানো কাপড়খানার দাম শুধোলেও, প্রথমে বিস্ময় আর বিদ্রূপ মিশায়ে চেয়ে রয় খানিক। তারপর বলে। এমন ভাবে বলে, আমি শুনতে পাই, ‘আ বে, এ-দাম জেনে তুই কী করবি রে, ভিকিরির বাচ্চা!’ উপস্থিত অন্যান্য খরিদ্দারেরাও ওই একই চোখে চায়— এসব দোকানে, এসব আবার কারা!
টাকা, তার গরম দুই প্রকার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থাকলে, অভিজাত। আর, তা না থাকলে হঠাৎ-পয়সা। এই দুই প্রকারের মিল হল, এই যে এত-এত-এত-এত পয়সা, দোঁহের কেউই সৎ পথে রোজগার করেনি। সৎ পথে বড়লোক হওয়া যায় না এ-দুনিয়ায়। লোকঠকানো আর রংবাজি ভিন্ন অন্য কোনও উপায় নেই পয়সা করবার। শ্রম-মেধা-নিষ্ঠা-একাগ্রতা দিয়ে অথবা ঘটে কয়েন জমিয়ে, কোনও কালে কারুর সাতমহলা স্বর্গ নির্মাণ হয়নি। চুপিসার চুরি কিম্বা সরাসরি বুকের ওপর চড়ে বসে টুঁটি টিপে ধরে উগড়িয়ে নেওয়া পয়সা দিয়েই লোকের টাকা হয়েছে। এখন, অভিজাতদের বেলা এ-কাজটি তার বাপ-ঠাকুদ্দা করে গেছেন, তাই আজকের এই বাবুকে ভদ্র-মার্জিত-মিহি দেখাচ্ছে, পয়সা করবার পরে খানিক সাহিত্যসঙ্গীত অর্জনে মন দেওয়ার তো সুযোগ পেয়েছে দুটি প্রজন্ম। দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ এক রাতে হয় না মা, হঠাৎ-পয়সার তো সবে ফার্স্ট জেনারেশন, অমনি করলে হয়!
ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র থেকে দেশ— এভাবেই মোহরে গড়া মই বেয়ে মহান হয়েছে। টাকার গরমের সর্বোচ্চ পর্যায় রুচি। আমি যে ফরাসি পারফিউম বুঝি, তার যে টপ নোট, হার্ট নোট আর বেস নোট বলে তিনটে লেয়ার হয়, দারচিনিকে যে সিন্নামন বলে, বুনো ফুলেও যে সুবাস থাকে, তাই দিয়ে যে হালকা একটা ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার গুঁজে দেওয়া যায় বেস নোটে, তেমন নাক না থাকলে যে সে-ঘ্রাণের ঘনত্ব বিচার সম্ভবই না, আরে, নাক আছে বে, বিড়ি খাওয়া নাক, লক্ষ-লক্ষ বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির পোড়া ডিজেলের ধোঁয়ায় ধৌত নাসা, বিজগুড়ি ফুটতে থাকা খোলা নর্দমার আজন্ম আটকে থাকা পাঁকের বাষ্পে বিস্ফারিত নাসিকা আমার, ওতে অত নোট-ফোট আসে না শালা! শুদ্ধ হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে-নিতে-নিতে-নিতে, সাতপুরুষ শুদ্ধতার সাধনা করতে-করতে-করতে-করতে, তারপরেও চোদ্দোবার কফি বিন্স শুঁকে তবে, হার্ট নোটে ল্যাভেন্ডার না ললিপপ, বুঝবার ক্ষমতা হবে। রাজবাড়ির ফর্সাদের মতো ফর্সা যেমন হাজার মাজাঘষা দিয়েও হয় না, রক্ত বেছে-বেছে বিয়ে করে যেতে হয় দুশো-তিনশো-চারশো বচ্ছর ধরে, তবেই না আপনি একবার চাইলেই চিনতে পারেন অভিজাত ঘরের সন্তান, এখন অবস্থা খানিক পড়ে গেলেও চেহারাখানা দেখে ঠিকই বুঝতে পারা যায় তবু। পয়সা করুন, চামড়ার টেক্সচার পরীক্ষা করে, পায়ের পাতা আর কাঁধ-কোমরের গড়নখানা খেয়াল করে, বাহুর ভিতরের দিককার রং দেখে-দেখে, মেয়েমানুষ ঘরে তুলতে থাকুন ধৈর্য ধরে কয়েক পুরুষ, তাকে রোদে দেবেন না, সাবানে ধোবেন না, রিঠে আর সরে, পিওর কটনে মুড়িয়ে রাখবেন আর ফ্রুটস খাওয়াবেন চার বেলা করে, দেখবেন আপনারও গুষ্টিতে মেমসাহেব জম্মাবে একদিন, তারা সুগন্ধীর সূক্ষ্ম সুবাস আর সারেঙ্গির সুর চিনতে পারবে, মুহূর্তে বলে দেবে, পুরিয়া কল্যাণে কোমল সা আছে কি নেই, কোমল সা বলে এ-দুনিয়ায় কিছু হয় কি হয় না, ভিন্টেজ ঘড়ি কেমন করে চিনতে হয়, ম্যাসটিফের কত রকমের ব্রিড হয় আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাখরখানি ইস্তাম্বুলের কোন গলিতে পাওয়া যায়। রুচি। রুচি। রুপাইয়ার অনুসারী শিল্প।
আর, গরম দেখাবার সবচাইতে ভাল রাস্তা নাক-সিঁটকানি। ছিঃ ছিঃ করতে শেখা। ছিঁচকে হঠাৎ-পয়সার কলারতোলা রংবাজি থেকে রুচিশীল উন্নাসিকতায় উত্তরণ। আমি যে আমি, নিজেকে যে একটা পর্যায়ে তুলতে পেরেছি, আর সক্কলকে যে অচ্ছুত করে দিতে পেরেছি, আমার ঘরে ঢুকতে গেলে যে কোনও লোককে সাত বার ভাবতে হয়, বসতে গেলে যে সত্তর বার মাথা চুলকোতে হয়, কুঁকড়ে-মুকড়ে হাত কচলাতে হয় সাত জন্ম ধরে, প্রত্যেকে যে আমার সামনে নিজেকে নিকিরি ভাবতে থাকে, এই যে নিকৃষ্ট হওয়ার অস্বস্তি আমি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি আর সক্কলকার অস্তিত্বের গোড়া অবধি, এইটেই আমার জিত, সর্বশ্রেষ্ঠ জয়।
না, সর্বশ্রেষ্ঠ নয়। সর্বশ্রেষ্ঠ সেদিন হবে, যেদিন আমি উদার হতে পারব। যে আমার দুয়োর ডিঙোতে পা অবশ করে ফেলছে, তাকে যেদিন আহা-আহা করতে পারব, আমিও তোমারই মতো বলে পিঠে হাত দিয়ে ডেকে আনতে পারব আমার বাহারি বৈঠকখানায়, এক আসনে বসতে পারব, খেতে পারব, কাউকে বোলো না বলে হাতে টাকা গুঁজে দিতে পারব তার দরকারের সময়ে, যেদিন তার সাথে হাঁটতে পারব রাস্তায় আর সে সারাক্ষণ ব্যস্ত হয়ে থাকবে, এই আমার রোদ লাগল না তো, এই আমার কষ্ট হচ্ছে না তো, হাঁটতে-হাঁটতে যেদিন তাকে বলতে পারব, তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে আমায় একদিন, সে লজ্জায় লুকোবার জায়গা পাবে না, তবু আমি জোরজার করব, শেষে পৌঁছব গিয়ে তার আধভাঙা ঘরে, তার ঘরভর্তি খাট আর দালানভর্তি রান্নাঘর, উঁচিয়ে তোলা ইটের পায়ার খাটের নীচে আদ্ধেক সংসার আর বাকি আদ্ধেক তার থেকে ঝুলছে, সেখানে সে কোথায় আমায় বসাবে, কীসে করে জল গড়িয়ে দেবে, আমি কি এ জল খাই, এমন আরও যত রকম অস্বস্তি তার হতে থাকবে অনবরত আর যত আমি আহা-আহা করতে থাকব, আমার জন্যে ব্যস্ত হতে বারণ করব, শেষে তার অ্যালুমুনিয়ামের বাটিতে সস্তার ফোটানো চা খেয়ে যখন বলতে পারব, এমন চা কতকাল খাইনি, আমি চলে আসবার পর, সোহাগ বাদ দিয়ে স্বামী-স্ত্রী খালি আমার গল্প করবে, বাবু কত ভাল, এত টাকা, এত টাকা, তবু কোনও দেখনদারি নেই, এক্কেবারে মাটির মানুষটি গো— সেদিন আমার টাকার আসলি গরমটা পাব আমি।
দজ্জালের দেবতায় অভিষেক। তার চেয়ে বড় মুকুট আর কীই-বা হতে পারে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র