পুরবাইয়া রে
হাজিপুর, ঔরঙ্গাবাদ ইত্যাদি বিহারের ঠেট গ্রামেগঞ্জে ওই রাজ্যের পুবপ্রান্তের বাসিন্দাদের ‘পুরবাইয়া’ বলে উল্লিখিত হতে শুনেছি। বাঙলার লাগোয়া হওয়ায় ওখানকার মানুষের মুখের ভাষায় তপ্ত দাবদাহের দাপ নেই বলেই তামাম বিহারের বিশ্বাস। পুরবাইয়ার মুখের বুলি মিঠে ও চটুল, বিবরণধর্মী এবং, হামেশাই, ঈষৎ আমিষগন্ধী। মিষ্টত্ব ও মৃদুতার কারণে মৈথিলি বা ভোজপুরি বাংলার একটু এদিক-ওদিক বলে মনে করা হত হয়তো। বাঙলার বাইরে ভদ্রলোক বাঙালি ও তার ভদ্র বচন সম্বন্ধে মানুষজনের মনে একরকম সমীহ একদা ছিল। অবশ্য তখনও বাঙালি শবযাত্রায় খই ছড়ানোর মতো প্রতি বাক্যে ব-এর অনুপ্রাস ছড়িয়ে দিতে শেখে নি।
শোনপুর মেলা চলার সময়ে একবার বেশ রাত্রে গণ্ডক নদীর ওপর দোতলা ব্রিজটা অজস্র মানুষের সাথে হেঁটে পেরোচ্ছি। ওপারে হাজিপুর। এই ব্রিজের দোতলায় ট্রেন চলে, একতলায় গাড়ি ও মানুষ। মানুষই বেশি। ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছেছি যখন, তখনই কুয়াশার বলয় নিয়ে জ্বলতে থাকা সবকটা আলো একসাথে দপ করে নিভে গেল। দু-এক সেকেন্ড অপার নৈশব্দ, তারপরই আমার খুব কাছ থেকে এক বৃদ্ধার আর্তস্বর কানে এল–‘ ভজনওয়া…এ ভজনওয়ায়া…কাঁহা গৈলঅঅ…”। বাঁদিকে খানিক দূর অন্ধকার থেকে জবাব এল — ‘হিথাই তো … ক্যা ভৈলঅ…ক্যা ভৈলঅঅ…..”। চাপান-উতোরের পরবর্তী নিশ্চুপ স্তব্ধতা ভাঙলো আবার খুব কাছ থেকে হেঁড়ে গলায় কিন্তু দারুন সুরে গাওয়া দু-কলি গানে — “ভজনওয়া রে…পুরবাইয়া রে…হারায়ে গৈলঅ…ঘর ওয়াপস না আইল…”।
সমবেত অন্ধকার হা হা অট্টহাসিতে ব্রিজ ভাঙবার উপক্রম করলেও এই ছমছমে ভয়, ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস, এবং পুরবাইয়ার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে দৈববাণীর মতো অন্তিম দুই খিল্লি-কলি যেন আমার হৃৎপিণ্ডে সজোরে এক ঘুসি মারলো। আট-দশ সেকেন্ডের মধ্যে তিনটে কন্ঠস্বরের তিনরকম প্রতিধ্বনি স্মৃতিতে বাজলে আমি এখনও অন্ধকারে মেলার ভিড়ে টাল খাই। আর গণ্ডক নদীর কুয়াশার চরে বিকিয়ে যেতে দেখি চোখছলছল পূর্ণবয়স্ক হাতি। কুয়াশাই হোক বা মধ্যরাত্রে ব্রিজের ওপর আলো নিভে যাওয়া আঁধার, তার পুরবাইয়ার জন্য মনখারাপের বীজ রক্তে বপন করা আমি ঠেকাতে পারি না। এখন স্পষ্ট জানি আজকের ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে আমিও একজন পুরবাইয়া–হারছি, পা হড়কাচ্ছি, বিকিয়ে যাচ্ছি। আমার ঘর-ওয়াপসি নেই।
ভোটের মাতন
বেগুসরাইয়ের বেহাত গ্রামের মসনদপুর পাড়ায় কানহাইয়া কুমারের লম্বাটে বাড়িটা সম্ভবত এখন দেশের সবচেয়ে পরিচিত খোলার চালের বাড়ি। টোটোয় চড়ে সেই বাড়ির দিকে প্রথমবার যাচ্ছি যখন, তখনই চোখে পড়ল পাড়ায় ঢোকার মুখে প্লাস্টারহীন দেওয়ালে বিবর্ণ হয়ে আসা অসামান্য পুরবাইয়া প্রশ্ন– ‘ছট কি চিনি / দিওয়ালি কা তেল / বোলো হো মুখিয়া / কাঁহা গৈল ?’ লালনের ভনিতার মতো অমোঘ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় বা ইচ্ছে মুখিয়ার আছে কিনা তা যদিও আলাদা কথা, কিন্তু আমি বেশ তৃপ্তি পেলাম। গ্রোথসেন্ট্রিক অর্থনীতির ভাঁওতা মুলোর মতো জনতার মুখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে ধম্মের ষাঁড়েরা রাজনীতির ঘোলাজল মথিত করছে যখন, তখন পুরবাইয়া অন্তত চিনি ও তেলের মতো প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তগুলোকে হিসেবের মধ্যে রেখেছে।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন তখন শিয়রে। দেশজুড়ে অরাজক অস্থিরতা– অসভ্যতাও বলা যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রের শুভাকাঙ্খী যারা– আজন্ম শুনে এসেছি এদের সংখ্যাই বেশি কিন্তু নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে দেখেছি এরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ সংখ্যালঘু হয়ে গেছেন– তারা হত্যে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন বেগুসরাইয়ের দিকে। গণতন্ত্রের একটা প্রগতিশীল ও নিরপেক্ষ চেহারা মনশ্চক্ষে হলেও দেখতে পাওয়ার যোগ্যতা যাদের আছে, তাদের সবার কাছেই স্বৈরাচারী ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক বেগুসরাই কেন্দ্রের সি.পি.আই প্রার্থী সাড়ে পাঁচ ফুটের এক ফায়ারব্র্যান্ড পুরবাইয়া– কানহাইয়া কুমার। তার প্রচারে আজ এসে পড়ছেন শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার তো কাল আসছেন প্রকাশ ঝা, স্বরা ভাস্কর। বেগুসরাইয়ের বাতাসে একটা মাত মাত ভাব। গোটা দেশের নির্বাচনী উত্তাপ যেন বেগুসরাইয়ের মার্চ মাসের বেয়াল্লিশ ডিগ্রি গরম অবলীলায় শুষে নিচ্ছে।
আসানশোল থেকে বেগুসরাইগামী কোনও একটা ট্রেনের আনরিজার্ভড কামরায় কোনোক্রমে উঠে পড়া মাত্র এই উত্তাপে নিজেকেও সেঁকে নেওয়া শুরু হল। বিহারের লোক চায়ের দোকানে অচেনা লোকের সাথে রাজনীতির তর্কে মেতে উঠতে সময় নেন তিন মিনিট, শেয়ার অটোয় পাঁচ মিনিট। এ খোদ কানহাইয়া কুমারের লেখা তথ্য, যদিও অভিজ্ঞতায় জানি সময়টা কানহাইয়া কিছুটা বাড়িয়েই লিখেছে। এক কেরালা ছাড়া রাজনীতির এমন সর্বজনীন নেশা দেশে আর কোত্থাও নেই। তার্কিক বাঙালির রাজনৈতিক তর্কের গন্ডি আপাতত কোনো নেতার পরস্ত্রীহরণ থেকে কারো মাল্লু খেয়ে ডিগবাজি প্রদর্শন পর্যন্ত। ওটা ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে নয়, আধুনিক বাঙালি সমাজের সামগ্রিক প্রতিফলন হলেও নয়।
যা হোক, ট্রেনে উঠে দেখি খোপে খোপে নানা বয়সি ১২-১৫ জন করে পুরুষ– শুধু পুরুষই– ঘণ্টা তিনেক আগেও যারা কেউ কাউকে চিনতেন না, ভোটের গনগনে তর্কে মুখচোখ লাল করে ফেলেছেন। দু-একজনের গলাও বসে গেছে। বিহারে রাজনীতির তর্কে যোগ দেওয়ার একটা অলিখিত কোড হল আপনার নিজের রাজনৈতিক অবস্থান আড্ডাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে, দোদুল্যমান বা ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি মননকে বিহারের আড্ডা তর্কের যোগ্য মনে করে না। বন্ধু সৈকত সেটা জানে, তাই নিকটবর্তী আড্ডা আমাদের দিকে উৎসুক চোখে তাকাতেই জানিয়ে দিল আমরা বেগুসরাই যাচ্ছি, কানহাইয়া কুমারের প্রচার দেখতে। কাজ হল। আড্ডা সবিশেষ দক্ষতায় আরও সংকুচিত হয়ে আমাদের দুজনকে নিজেদের ঠিক মধ্যিখানে বসিয়ে নিল। মিনিটখানেক আমাদের মেপে নেওয়ার পর উপরের বার্থে আসনপিঁড়ি হয়ে বসা সাদা ফতুয়া-ধুতি কদমছাঁট চুলের শিখাধারী (প্রতিটিই ব্রাহ্মণত্বের লক্ষণ) বৃদ্ধ বললেন– ‘কানহাইয়া? লেড়কা তেজ হ্যায়, লেকিন হারেগা।’ আমরা আর আড্ডার আরও দুই ছোকরা চেঁচামেচি করে ওঠায় বৃদ্ধ শান্তভাবে বললেন ভুলে যেও না বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রের ৮১ শতাংশ লোক গ্রামে থাকে, তারা তোমাদের ওই জে.এন.এউ কোথায় বা সেখানে ঠিক কি হয় তা জানে না, জানতে চায়ও না– ‘এ ঊনিকো খেতি কি সওয়াল নেহি হ্যায়। ‘ ব্যস, আবার চড়ায় ঊঠল তর্ক, ক্রমশ আরো উপভোগ্য ও খরতর হয়ে উঠল পুরবাইয়া জিভ।
ক্রমশ আমিও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আড্ডার মতো এই নির্বাচনও আসলে আবেগ বনাম শীতল মস্তিষ্কের অঙ্কের। পাঁচটি ঘন্টা সরস ব্যবচ্ছেদ চলল আস্ত বেগুসরাই কেন্দ্রর– পরে সেন্সাস রিপোর্ট মিলিয়ে দেখেছি প্রতিটি তথ্য সঠিক। ট্রেন বারাউনি স্টেশনে ঢোকার মুখে ওই বৃদ্ধ বললেন– ‘এখানে তিরিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র চার লক্ষ মুসলমান, আর হাজার দেড়েক আদিবাসী। আবার ছাব্বিশ লাখ হিন্দুর মধ্যে দলিত মেরেকেটে চার লাখ, বাকি বাইশ লাখ উচ্চবর্ণের। এখানে কাশ্মীর বা রোহিত ভিমুলা চলবে ভেবেছ?’ এক ফাজিল ছোকরা ফুট কাটল– ‘বাইশ বা বারো যাই হোক না কেন, নানাজি কা পার্টিকো কোই ফারাক নেহি আয়ে গা। উনিকো যো নেতা হ্যায় না, ও যব সি.এম হৈল তব বড়িয়া এক জেলখানা বনাইলো। লেকিন ও জেলখানামে কয়েদি কম হো গৈল। তব ও খোদ হি জেলখানামে রহনে গৈল।’ এক্কেবারে, যাকে বলে, নক-আউট পাঞ্চ। সবার সাথে হাত মিলিয়ে নেমে এলাম প্ল্যাটফর্মে। পাঁচ ঘন্টা ধরে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা, চোখে জল।
লেনিনগ্রাদ অফ বিহার
বেহাত গ্রামের রামচরিত্র সিং ছিলেন সচ্চরিত্র, সর্বজনশ্রদ্ধেয় গান্ধিবাদী নেতা। স্বাধীনতার পর বিহারের প্রথম মন্ত্রীসভায় তিনি হন বিদ্যুৎ ও সেচ বিভাগের মন্ত্রী। মহালানবিশ মডেল মেনে রামচরিত্র সিং বেগুসরাইতে শিল্পায়নের ঝড় বইয়ে দেন–রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গড়ে ওঠে সার কারখানা, বারাউনির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তৈল শোধনাগার। এর ফলে কৃষিনির্ভর বেগুসরাই বেশ খানিকটা মিশ্র অর্থনীতির দিকে সরে আসে। এখানকার রাজনীতিও খানিকটা মিশ্র পথে হাঁটে।
রামচরিত্র সিং-এর পুত্র চন্দ্রশেখর সিং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে আগুনখেকো বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন ও প্রথমেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন। এবং পরে দীক্ষিত কমিউনিস্ট হয়ে আবার বেগুসরাই ফেরত আসেন। পুত্রের কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়ার দায় মাথায় নিয়ে রামচরিত্র সিং কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন, কিন্তু তাতে পুত্রের বেগুসরাই জয় ঠেকানো যায় নি। চন্দ্রশেখর সিং-এর নেতৃত্বে গোটা অঞ্চল হয়ে ওঠে এমনই লাল দুর্গ যে বেগুসরাই-এর আর এক নাম হয় ‘লেনিনগ্রাদ অফ বিহার’। আর কানহাইয়া কুমারের বেহাত গ্রামটার পরিচয় হয় ‘লিটল মস্কো’। চন্দ্রশেখর সিং-এর হাতে কমিউনিস্ট হয়ে কানহাইয়ার দাদু আমৃত্যু সি.পি.আই থেকে যান। স্কুল ছেড়ে কানহাইয়ার বাবা তখনও নিষিদ্ধ সি.পি.আই (এম-এল) দলে যোগ দেন ও তারা পরে নকশালবাড়ির পথ থেকে হটে এসে সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা স্থাপন করলে চূড়ান্ত হতাশায় রাজনীতি থেকে সরে আসেন। ভালো করে জ্ঞান হবার আগেই কানহাইয়া কুমারের ডাফলি-বাজানো-গান শেখা শুরু বেহাত গ্রামের আই.পি.টি.এ শাখায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ.আই.এস.এফ-এর ক্ষুরধার ছাত্রনেতা টুপ করে আকাশ থেকে জে.এন.ইউ ক্যাম্পাসে ঝরে পড়েন নি। কার্যকারণ সম্পর্কটা স্পষ্ট। তবে বেগুসরাই-এর লাল দুর্গের পতন কংগ্রেস বা বি.জে.পি-র হাতে হয় নি। এর পিছনে রয়েছেন বহুকাল ধরে বামেদের আত্মার আত্মীয় স্বয়ং লালুপ্রসাদ। পুরবাইয়া লালের কফিনে গভীরতম পেরেকটা মারা হয় ১৯৯৮ সালে, যখন পাপ্পু যাদবের হাতে খুন হয়ে যান পূর্ণিয়ার চার বারের সি.পি.এম বিধায়ক অজিত সরকার। পরে জানা গেছে অজিত সরকারের স্থির শরীরে মোট ১০৭টা বুলেট গেঁথে ছিল।
২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের সময়ে লালুপ্রসাদ শ্রীঘরে। পুত্র তেজস্বী দলের মাথা। যথারীতি কানহাইয়া কুমারের যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য তিনিও বেগুসরাইতে একজন প্রার্থী গুঁজে দিয়েছেন। ট্রেনের ফাজিল ছোকরাটা বাপ-বেটার প্রতি কিছু বাছাই করা শব্দবন্ধ ছুঁড়ে দিচ্ছিল যেগুলো আমারও খুবই মনের কথা, যদিও প্রকাশ্যে মুখে বলা একটু শক্ত। আর এখানে লেখার তো প্রশ্নই উঠছে না।
পথে এবার নামো সাথী
সকাল সাতটার মধ্যে মসনদপুর পাড়ায় কানহাইয়া কুমারের বাড়ি পৌঁছে দেখি কোত্থাও কেউ নেই, শুধু বাড়ির বাইরে টানা বারান্দা মতো জায়গাটায় চৌকি পেতে আড্ডা দিচ্ছেন তিন অতিবৃদ্ধ। তিনজনেরই পরনে খেটো ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। গেঞ্জির বুকে লাল ব্যাজ। কথায় কথায় জানলাম এদের একজন অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়েছেন ১৯৫৬ সালে, বাকি দুজন ৫৮-এ। কিন্তু প্রচারপার্টি কই?
এ বাড়ির উল্টোদিকে একটা পাকা দোতলা বাড়ির নিচের দুটো ঘরে খানতিনেক কম্পিউটার বসিয়ে কানহাইয়া কুমারের নির্বাচনী অফিস। এখান থেকেই অনবদ্য সব মিম আর টুইট ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা দুনিয়ায়। উঁকি দিয়ে দেখলাম দুই নেহাতই কলেজপড়ুয়া ছোকরা গভীর অভিনিবেশ সহকারে ছাপানো পোস্টার গোছ করে রাখছে। আমাদের দেখেই বলল–একটু বসুন। দেখছি ওরা কোথায়।
আবার চৌকিতে ফিরে আসতেই হাতে এল শালপাতার প্লেটে চিঁড়ে আর টকদই, উপরে ছড়ানো চারটে বাতাসা। শুনলাম প্রার্থী ও তার সমর্থকেরা প্রতিদিন সকালে এই খেয়েই প্রচারে বেরিয়ে পড়ে। তবে সেদিন সকালে এই বাড়ি থেকে বেরোয় নি তারা। আগের রাত্রে ঘুরতে ঘুরতে একটা বেজে যাওয়ায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে চর বারিয়ারপুর গ্রামে পার্টি অফিসে ও কয়েকজন কমরেডের বাড়ির ছাদে গোটা দলটা ভাগাভাগি হয়ে থেকে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ল এই তিন বুড়ো পার্টির মেম্বার হচ্ছেন যখন, ঠিক সেই সময়টায় দেশের প্রথম কম্যুনিস্ট সরকারকে নেহেরু ভেঙ্গে দিচ্ছেন কেরালায়। সাড়ে ছয় দশকের অনেক পালাবদলের পর ইতিহাস কি আবার কাউন্ট-আপ শুরু করছে শূন্য থেকে? এই তিন বুড়োকে কি দ্বিজ বলে চলে?
মিনিট পনেরোর মধ্যে আমাদের জন্য নির্দেশ এল সকাল দশটা নাগাদ মোকামার রাস্তায় বারিয়ারপুর বাজার ছাড়িয়েই যে চৌমাথা, সেখানে পৌঁছতে হবে। কানহাইয়ার প্রচারসচিব– নামটা বোধহয় সূরজ– ওখানেই আমাদের স্পট করে দলে ভিড়িয়ে নেবেন। তড়িঘড়ি হোটেলে ফিরে আগের রাতে চেনা হওয়া অজয় ও তার অলটোকে জোগাড় করে চললাম দরিয়ারপুর। সজ্ঞানে ও সানন্দে জীবনে এই প্রথম কোনো নির্বাচনী প্রচারে যাওয়া, কিন্তু যেতে যেতেই ঘোর সিনিকের মতো মনে হয়েছে কানহাইয়ার লড়াইটা কেবলমাত্র একটি দুর্দান্ত প্রতীকী লড়াই হয়ে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেটা মাখনের মতো, যে গ্রামগুলো পেরোচ্ছি তার কোনোটায় একটাও কাঁচা বাড়ি নেই, মাইলের পর মাইল একটাও ফসলশূন্য মাঠ নেই। এর বেশিটাই রেমিটান্স অর্থনীতির ম্যাজিক হলেও গত দশ বছরে বিহারকে ছুঁয়ে থাকা নীতিশকুমারের জাদুদণ্ডও হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে। কানহাইয়ার লড়াইটা বি জে পি-র বিরুদ্ধে অবশ্যই, কিন্তু সেটা দূরতর নাগরিক অর্থে। তাকে সরাসরি ভোট দিতে পারেন যারা তাদের কাছে লড়াইটা কিন্তু নীতিশের বিরুদ্ধে। আসলে অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর একটি অসাড় ধারণা মাত্র, আমাদের দেশে শাসক এক্কেবারে অসহ্য হয়ে না ওঠা পর্যন্ত মানুষজন তাকে মেনেই নেয়। এটাও ইতিহাসের সাক্ষ্য।
বারিয়ারপুর চৌমাথায় ছড়ানো বটগাছের নিচে ঘন হওয়া ভিড়টা দেখেই প্রথম বুঝতে পারলাম কানহাইয়া কুমারের সমর্থকদের প্রজন্মগত বৈশিষ্ট– ভিড়ের অর্ধেক পঁচিশের নিচে, বাকি অর্ধেক সত্তরের উপরে। মাঝামাঝি কেউ নেই। একজনও না। আদর্শের লড়াইয়ের যোদ্ধাদের মাঝখানে পাঁচ দশকের ফাঁক। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পশ্চিমে শিবালা গ্রামের রাস্তায় ধুলো উড়তে দেখা গেল। সেই ধুলোর ভিতর থেকেই লাল ঝান্ডা উড়িয়ে প্রথমে বেরিয়ে এল গোটা কুড়ি মোটরবাইক। তারপর ম্যাটাডোরের পেটে সেনাপ্রধানদের মতো পোষাক পরা অবসন্ন এক ব্যান্ডপার্টি। এর পরে এল বৃদ্ধবোঝাই একটা ভ্যান। ভ্যানের মাথায় সরু চোঙা বাঁধা, সেই চোঙা থেকে অদ্ভুত নাকি ও ধাতব কন্ঠস্বরে– যা মানুষের কন্ঠস্বর বলে মেনে নেওয়া শক্ত– ভোজপুরি একটা গান ভেসে আসছে। ভাগ্যিস রেকর্ড করেছিলাম, তাই সেই গান পরে বহুবার শুনে মোটামুটি বুঝেছি কথাগুলো এরকম– ‘ মানিলো হামারো বাত / জোটাই ছিল হাত / সবে মিলি ইনিকো জিতাইও / হাঁসুয়াবালি বটন দাবাইও / কানহাইয়া ভাই কো জিতাইও।’ এই এক গানের গুঁতোতেই খেলা জমে গেল।
কাভালকাডের চার থেকে ছয়নম্বর গাড়ি জীপজাতীয়, প্রতিটায় কানহাইয়ার জে.এন.ইউ-র বন্ধুরা, সংবাদমাধ্যম যাদের নাম দিয়েছে ‘টিম আজাদি’। সপ্তম গাড়িটায় পিছনের সিটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কানহাইয়া, বুকের ওপর থেকে শরীরের বাকি অংশটা গাড়ির ছাদের ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে, মুখের চামড়ায় রোদ্দুরের ট্যান, সবুজ টি-শার্টে ঘামের ছোপ, গলায় গাঁদাফুলের মালা। এই গাড়ির পিছনে স্পেয়ার টায়ারের ওপর চড়ে বসা ছেলেটিই সম্ভবত সূরজ, কারণ আমাদের দেখতে পেয়েই চেঁচামেচি করে আগের গাড়ির সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে অলটোকে মাঝখানে ঢুকে পড়তে বলল। শেষ গাড়িটা পুলিশের, ড্রাইভার ছাড়া তিনজন পেয়াদা বসে আছে, দেখে মনে হল ‘বটন দাবাইও’-র সুরে বিভোর হয়ে গেছে।
জোট বাঁধো, তৈরি হও
ইউটিউবের বাইরে প্রথমবার কানহাইয়া কুমারের বক্তৃতা শুনলাম শিরপুর গ্রামে, একটা ঝুড়িনামানো অশ্বত্থ গাছের নিচে।
গ্রামটা মুসলমানপ্রধান। ভিড় দেখে মনে হল সি.পি.আই-এর শক্ত ঘাঁটি। প্রাচীন বৃক্ষের নিচে কানহাইয়ার গাড়িটাকে মাঝখানে রেখে অন্য গাড়িগুলো গোল হয়ে দাঁড়ালো। জানতাম কানহাইয়া এখানে তার অসাম্প্রদায়িকতার কার্ডটা খেলবে। খেললও তাই, কিন্তু মোক্ষম চালে। প্রথমেই ওর গাড়ির গায়ে সেঁটে গিয়ে ছবি তুলতে থাকা আমাদের দুজনকে দেখিয়ে জনতাকে সটান প্রশ্ন করল– ‘এ ভাইলোগ কলকাত্তা সে বেগুসরাই আয়ে কিউ? কোই বোল সকে?’ উত্তরে কয়েকজন অস্ফুটে ‘আপকে বারে’ বলা মাত্র কানহাইয়া গর্জে উঠল–‘গলদ হ্যায়। ভাইলোগ বেগুসরাই আয়া কিঁউ কি ও চাহতে হ্যায় কি দেশ সে মনুবাদ খতম হো যায়ে’। হাজার পায়রা ওড়ার শব্দের মতো হাততালি পড়ল, তীক্ষ্ণ সিটিও কানে এল বেশ কয়েকটা। একটু ঝুঁকে অভিবাদন গ্রহন করে কানহাইয়া চলে গেল স্থানীয় প্রসঙ্গে। গ্রামের লোককে হাত তুলিয়ে একটু আন্দাজ করে নিল পরিবার পিছু পরিযায়ী শ্রমিকের অনুপাতটা কি। তারপর ও জিতলে কিভাবে চাকরির সুযোগ ও কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে ঘরের ছেলেকে ঘরেই রেখে দেবে তার একটা ছক আঁকলো। পাবলিক ডিসকোর্সের একটা নতুন তত্ব শিখলাম, জানলাম যে শ্রোতাকে বক্তৃতার মধ্যে সরাসরি জড়িয়ে নিয়ে তার আবেগের জায়গাগুলোয় একটু হাত বুলিয়ে দিতে পারলে কাজ হয় বেশি। এর পরে হরিজনপ্রধান কড়োর গ্রামে মোটামুটি একই বক্তৃতা হল, শুধু সেখানে আমাদের বেগুসরাই আগমন দেশ থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ নিকেশ করতে বলে জানানো হল। জগদীশপুর কলেজের মাঠে অবশ্য জাতপাত-ব্রাহ্মণ্যবাদ ছুঁয়েই দেখল না কানহাইয়া। শুধু এলাকায় একটি আই আই টি-র যে কত প্রয়োজন সেই বিষয়েই বিশদ হল। লক্ষ্য করলাম তিনটে মিটিংয়ের কোনোটাতেই একবারের জন্যও কানহাইয়া মুসলমান বা দলিত শব্দ দুটো উচ্চারণ করল না, জে.এন.ইউ বা তিহার জেলও না। বুঝলাম কি দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে মেধাবী কমরেড।
আড়াইটের সময় লাঞ্চ ব্রেক হল ভবানন্দপুর গ্রামে। পার্টি অফিসের চারিদিকে যজ্ঞবাড়ির গোলমাল। এ.আই.এস.এফ-এর ট্যাবলো নিয়ে হাজির হয়েছে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়ে, ডাফলি বাজিয়ে গান গাইছে তারা। আজাদির গান। স্লোগান উঠছে ঢেউ-এর মতো। একটা প্রকাণ্ড ড্রামের তেতে ওঠা জলে হাতমুখ ধুয়ে সবাই সামিয়ানার নিচে সারি দিয়ে খেতে বসে যাচ্ছে। এই গরমে ভাত খাব না ভেবে আমি আর সৈকত সটকাবার তালে ছিলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। ধরলেন পঁচাশি বছরের গোপাল পাসোয়ান। শুধু ধরলেন না, আমাদের দুজনকে দুই বগলে চেপে সোজা নিয়ে এলেন সামিয়ানায়। সাড়ে ছ-ফুট গোপাল পাসোয়ানের মাড়িতে আপাতত যদিও একটিমাত্র দাঁত, কিন্তু দিব্যি বোঝা যায় যৌবনে ইনি প্রখর রুদ্রই ছিলেন। গরম ভাত, ডাল, আলুর ঝোল এবং–আবার–টক দই ও বাতাসা খেতে খেতে জানলাম গোপাল পাসোয়ানের পার্টিকার্ড ১৯৫৫ সালের। উল্টোদিকে একটি বাড়ির উঠোনে কানহাইয়াকে নিয়ে বসে যারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে নিচ্ছেন, তারাও সবাই গোপাল পাসোয়ানের সমসাময়িক। এদের বোধহয় একটা অলিখিত ড্রেস কোড আছে– হাঁটু পর্যন্ত তোলা মোটা ধুতি, হাফহাতা লম্বা ঝুলের শার্ট, বুকপকেটে পেন ও ছোটো ডায়রি, পায়ে কেডস। আগাগোড়া দেখেছি কানহাইয়ার ক্যাম্পেনের মাটি ছোঁয়া যাবতীয় ঝক্কি এরাই সামলাচ্ছেন। মিম বা টুইট বা ক্রাউডফান্ডিং ‘টিম আজাদি’ ম্যানেজ করলেও প্রচারপার্টি কোন রুট ধরবে, কোথায় মিটিং করবে, কোথায় খাবে, রাত্রে কোথায় থেকে যাবে– সবই এই বৃদ্ধব্রিগেডের গেমপ্ল্যান। আসলে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এ সব অঞ্চলে এরা হামেশাই নির্বাচন জিতেছেন, কিন্তু তারপর– গোপাল পাসোয়ানের কথায়– ‘লাল্লুয়া ঝুটমুট ঝামেলা পাকাইল’। তবে তার পরের শপথটি সত্যিই আঁতকে ওঠার মতো– ‘ইস বার কোই ঝামেলা পাকাইব তো মারব।’
একটি মহেশ ভাটীয় সিক্যুয়েন্স
ঝামেলা পাকবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল আমরা প্রচারে বেরোনোর দ্বিতীয় দিন সাতসকালেই।
বেহাত থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে ওঠার মুখেই দেখলাম বি.জে.পি-র প্রচারপার্টি গোটা রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে পার্টির খরচে প্রচারে বেরোনো সমস্ত বাইক-গাড়ি তেল নিচ্ছে পাশের পেট্রোলপাম্পে। অপেক্ষারত গাড়িগুলোর লম্বা কিউ রাস্তায় উপচে এসে লাল ঝান্ডার সামনে খাড়া করেছে এক দুস্তর ব্যারিকেড।
বি.জে.পি-র এক সাদা টয়োটার সামনের সিটে পাহাড়ের মতো বসে আছেন প্রার্থী গিরিরাজ সিং। এনার আর.এস.এস পশ্চাৎপট ও অসংযমী বাক্যপ্রয়োগ সম্বন্ধে বিস্তর কুকথা শুনেছি গত দু-দিন ধরে। অনুরাগ কাশ্যপ বা মহেশ ভাটের ছবিতেও এমন থমথমে সিক্যুয়েন্স বিস্তর দেখা আছে। তাই ঝাড়পিট একটা লাগছেই ধরে নিয়ে ক্যামেরা রেডি করে সন্তর্পণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম।
নেমে দেখি আমাদের আগেই এক্কেবারে সামনের গাড়িটা থেকে নেমে পড়েছেন পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি কৃশকায় এক বৃদ্ধ। সবাই এনাকে যোগেশবাবু বলে ডাকে, এবং সবার এনার ওপর নির্ভরতা দেখেই বোঝা যায় কানহাইয়ার উপস্থিতি সত্বেও আমাদের দলটার মূল কম্যান্ডার ইনিই। সেই যোগেশবাবু দেখলাম হনহন করে সোজা গিরিরাজ সিং-এর গাড়ির দিকে চলেছেন, আর গিরিরাজ সিং-ও তাকে আসতে দেখে ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন। হাত মেলানো ও কুশলসংবাদ বিনিময়ের পর দুই সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বৃদ্ধ যে জড়াজড়িটা করলেন তাতে দৃশ্যত অনেকটা কমিক খোরাক থাকলেও আমি কিন্তু হাসতে ভুলে গেলাম। শুধু দেখলাম এই এক জড়াজড়িতেই বি.জে.পি-র প্রচার গাড়িগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তার ধারে ধারে সরে গিয়ে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার জায়গা করে দিল। এমনকি ওদিকে জটলা করা কিছু ছেলে এদিকে এসে কানহাইয়ার সঙ্গে সেলফিও তুলে গেল। পাকা মাথার রাজনীতি ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ তার একটা ধারণা পেলাম।
প্রসঙ্গত জানাই বিহারে ২০১৯ সালের লোকসভা ও ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বিজয়মিছিল পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই কোথাও একটা ঢিল পড়েছে বলেও আমার কাছে খবর নেই। প্রতিবেশী রাজ্যের সাথে তুলনা টানাটা ঠিক হবে না, কারণ পশ্চিমবাংলায় রাজনীতি বলে এখন যেটা চালানো হয় সেটা আসলে কিছু সামাজিক নন-এনটিটির অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার লড়াই। আক্ষরিক অর্থেই ক্ষমতায় থাকা ও না-থাকা এদের কাছে বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার সমার্থক। উল্টে গেলে পাল্টে যাওয়াটাই তাই অধুনা বঙ্গদর্শন।
লাল দুর্গের জাত সেপাই
কানহাইয়া কুমারও হেরেছে চার লক্ষ বাইশ হাজার ভোটে। লালু যাদবের দল ভোট না কাটলেও হারত অন্তত সোয়া দুই লক্ষ ভোটে। কিন্তু এই হারের জন্য গোপাল পাসোয়ান বা যোগেশবাবু আত্মসমাধিস্থ হবেন না, আশা করা যায় শহিদও হবেন না। এরা পার্টি ভাগ হতে দেখেছেন, দেখেছেন চিনের সাথে যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, পরিস্থিতির দাবিতে শোধনবাদ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পুঁজির সাম্রাজ্যবাদ। এরা কালেভদ্রে জিতেছেন যেমন তেমন নিষিদ্ধও ঘোষিত হয়েছেন কখনো সখনো। দেহাতের লাল দুর্গ সুধী সমাজকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য কানহাইয়া কুমার একজন পোষ্টারবয় মাত্র–গোপাল পাসোয়ান বা যোগেশবাবু স্বয়ং দুর্গবাসী।
একদল পুরবাইয়া ব্রাহ্মণ মৌর্যদের শেষ সময়টায় তাল বুঝে বৌদ্ধ হয়ে যান এবং রাজ-অনুগ্রহে বহু জমিজমার মালিক হন। সেই জমি রক্ষা করতে গুপ্ত যুগে এরা সদলবলে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন ও ব্রাহ্মণত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আপিল করেন। রাজা মানলেও সমাজ কখনো কায়েমি স্বার্থে এদের এই ডিগবাজি মেনে নেয় নি, এবং ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকার না করে এদের দাগিয়ে দিয়েছে ভূমিহার বলে। বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রের সিংহভাগ মানুষ ভূমিহার। কানহাইয়া কুমারও তাই। তেমন বুক ফোলানোর মতো ইতিহাস নয় যদিও, তবু ওর কড়া সমর্থক আমাদের হোটেলের ম্যানেজার আক্ষেপ করছিলেন– ‘লেড়কা আপন-কা আইডেনটিটি অ্যাসার্ট-ই নেহি করতা’। এখন যখন মাঝেমাঝে আমিও ভাবতে বাধ্য হচ্ছি আমার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কেউ মতুয়া বা মটুকধারী বৈষ্ণব ছিল কি না, তখন এই ‘আপন-কা’ জাত বা সম্প্রদায়ভিত্তিক আইডেনটিটি ‘অ্যাসার্ট’ না করার স্পর্ধাটা ঠিক পরাজয় কি? বোধহয় না।
রাজনীতি তো আলাদা কিছু নয়, তা সমকালীন অর্থনীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ মাত্র। বিকল্প অর্থনীতি না থাকলে বিকল্প রাজনীতিও থাকতে পারে না। বিশ্বায়নের পর গোটা দুনিয়া জুড়ে যখন পুঁজির অবাধ দিগ্বিজয়, তখন রাজনীতিও যে একমাত্রিক হবে তাতে আর আশ্চর্য কি। একচাটিয়া পুঁজির শাসনে সমাজে যে ব্যাপক বৈষম্য জন্ম নেয়, সেই বৈষম্যর বিষ্ফোরক হয়ে ওঠা ঠেকিয়ে রাখাই আধুনিক রাজনীতির একমাত্র কাজ। অন্তত আমাদের দেশে কাজটা কঠিন কিছু নয়। কারণ বিত্ত পিরামিডের এক্কেবারে ভূমিতে যে কোটি কোটি মানুষ আছেন তাদের চরিত্র ও মননে গত তিরিশ বছরে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। লকডাউনের সময় আত্মধিক্কারে নুয়ে পড়ে যে মানুষটি খয়রাতি করা অন্ন নেবার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তিনিও তার হা-অন্ন সর্বহারা পরিচয়টা সমস্ত শরীরমন দিয়ে লুকিয়ে রাখতেই চান। বিত্তই এখন সামাজিক বর্ণের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে। সুতরাং আপাদমস্তক বঞ্চিত মানুষ তার শ্রেণি-অবস্থান স্বীকার করবেন ও শোষণের বিরুদ্ধে একজোটে রুখে দাঁড়াবেন এমন সম্ভাবনা আর নেই। রাজনীতির কাজ হচ্ছে এই সাম্যাবস্থা টিঁকিয়ে রাখা। তাই শাসক কখনো শাহজাহানের মতো জবরজং পোষাক পরে ময়ূরকে চানা খাওয়ানোর ছবি টুইট করছেন। কখনও বিপদ বুঝলে কদর্যভাবে টিভির পর্দায় চোখ খুঁচিয়ে দু-ফোঁটা জল বার করে কর্তব্য সারছেন। (আমার এক মুখপাতলা বন্ধু অনেকদিন আগে শিখিয়েছিল– ‘পুরুষমানুষ সর্বসমক্ষে চোখের জল ফেলছে দেখলেই বুঝবে এর মতো ঢ্যামনা আর নেই।’ বক্তব্যে ঈষৎ জেন্ডারবায়াস থাকলেও নিয়মটা বোধহয় খাটে।) নেহাত কোহিনূর ফেরত পাওয়া যায় নি, পেলে হয়তো তা পাগড়িতে গেঁথে মাথায় পরে শাসক লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। গণতন্ত্রের প্রতি শাহজাহানের মর্মবোধ নিয়েই গণতন্ত্র শাসন করার এই রকমটা আসলে জনমানসে নিজের একটা আগাগোড়া ভার্চুয়াল এবং লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজ প্রক্ষেপণের জন্যই, যাতে মানুষ ক্ষমতার কেন্দ্রকে নিজের দুনিয়ার বাইরের দূরবর্তী ও অবাস্তব কিছু ভেবে নেয় ও তাকে খামোখা চ্যালেঞ্জ করার কথা না ভেবে স্থিতাবস্থা মেনে নেয়। এর বিপরীতে আবার কিছু শাসক গরিবকে নিংড়ে বার করা ট্যাক্সের দু-পাঁচশো গরিবের দিকেই ছুঁড়ে দিয়ে হর্ষবর্ধনের মতো অনুদান-শাসনের কল্কি হচ্ছেন। তবে বাদশা বা কল্কি যাই হোন না কেন, বাস্তববোধ বলছে আজকের অর্থনীতিতে রাজনীতিকের পুঁজির পৃষ্ঠপোষক (মানে কর্পোরেটের দালাল) না হয়ে কোনো উপায় নেই। বৈষম্যের কারণে যারা ফেটে পড়তে পারে তাদের নরমে-গরমে-ভাঁওতায় একটু তুইয়ে-বুইয়ে রাখাই এখন শাসনক্ষমতার সুশাসনের মাত্রা।
তিন দিনে হাটে-বাজারে-চৌমাথায়-নাটমন্দিরে অন্তত তিরিশবার কানহাইয়া কুমারকে বলতে শুনেছি, কিন্তু একবারের জন্যও তাকে ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ ইত্যাদি অর্বাচীন জারগন ওগরাতে শুনিনি। বিহারের লাল দুর্গে রাজনীতি করতে হয় মাটির ওপর দাঁড়িয়ে, তাই মাটির কাঁপন টের পেতে হয়, ধুলোর গন্ধ চিনতে হয়। ২০১৯ সালে বেগুসরাইতে কানহাইয়া অবশ্যই হেরে গেছে, কিন্তু এই নির্বাচনেই অন্তত কিছু মানুষ প্রতিরোধের একটা খসড়া লিখতে শিখেছেন। নাগরিকত্ব আইন বা কৃষি-আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার শুরুটা হয়তো কানহাইয়া কুমারের এই হেরে যাওয়া নির্বাচনেই।
গত ২৮শে সেপ্টেম্বর কানহাইয়া কুমার কম্যুনিস্ট পার্টি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় বিহারের লেনিনগ্রাদে সমস্ত লাল পতাকা অর্ধনমিত ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। তবে এটা জানি ‘ঘর কা বেটা’-র লড়াইকে লাল সেলাম জানাতে যোগেশবাবু বা গোপাল পাসোয়ান কখনও এতটুকু দ্বিধাবোধ করবেন না। লাল দুর্গের এরা হলেন পোক্ত সেপাই, এদের আপশোশ-অভাববোধের চর্চা নেই। গোটা জীবন ধরে এরা যার চর্চা করেছেন তা আসলে বিকল্প রাজনীতির চেয়ে আরেকটু বেশি কিছু– বিকল্প জীবনবোধ।