ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মুখঋত: পর্ব ১৮

    ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (April 17, 2022)
     


    রেনেসাঁস

    বের্টল্ট ব্রেখট নাকি মর্তে নেমে এসেছেন। সেই বিখ্যাত জার্মান নাট্যকার ও চিন্তক নাকি, আসবি তো আয়, আমাদের কলকাতাতেই এসেছেন! এ খবর আমাকে দিল আমাদের পাড়ার উত্তমদা। সে এক সময় খুব ব্রেখটের নাটক নিয়ে কাজ করেছে। অল্প বয়স থেকে অভিনয়ে খুব ন্যাক, তাই বোধহয় বাবা-মা শখ করে ‘উত্তম’ নাম দিয়েছিলেন। পাড়ায় দারুণ থিয়েটার, নাটক, যাত্রা সব করেছিল এককালে। তারপর যা হয়, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘উত্তম’ নাম হলেও, শিল্পচর্চা নিয়ে জীবন গড়ে তোলা যাবে না! তারপর থেকেই উত্তমদা সকালে হার্ডওয়্যার দোকান সামলায়, আর বাকি সময়ে নাটকের প্রযোজনার চেষ্টা করে, বাচ্চাদের নিয়ে ক্লাস করে।

    কপাল করে উত্তমদার সাথেই ব্রেখটের দেখা। রাসবিহারী মোড়ে উত্তমদা দেখল, এপ্রিলের গরমের মধ্যে এক কাঁচাপাকা চুলের লোক, কোট-প্যান্ট পরে, হাতে পাইপ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এরকম পাগল যদিও কলকাতায় বহু দেখা যায়, তবুও উত্তমদার মন বলল, এ নির্ঘাত অন্য কেস! তারপর লং স্টোরি শর্ট, মুখ দেখে আর কথা বলে দাদা বুঝল, ইনিই হলেন দাদার সেই প্রিয় নাট্যকার ও কবি! রাসবিহারী মোড়ে এই মিরাকল দেখে উত্তমদা মুচ্ছো যায় আর কী!

    বাকিটা উত্তমদার জবানিতেই বলি:

    তো আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝলি? তবে অমন স্পষ্ট করে কথা বলা আর কনফিডেন্স নিয়ে হাঁটাচলা একমাত্র জার্মানরাই পারে। আমিও ছাড়লাম না। হাজরায় মালের ঠেকে নিয়ে গিয়ে বসালাম। সারাদিন বিয়ার খাওয়া জাত তো, বাংলা খেতে শুরু করল হরলিক্স-এর মতো। আমি ভাবলাম এইবার আমার প্রশ্নের ভাণ্ডার খুলি! কিন্তু ব্রেখট নিজেই শুরু করলেন।

    ‘উত্তমবাবু, নাটকের কী পরিস্থিতি এখন আপনাদের কান্ট্রিতে?’

    ‘হচ্ছে স্যার। কান্ট্রি জুড়ে বহু নাটক তো হয়। আমার দেখা হয় না অত। তবে এখানে নানা ব্যাপার। নাটকে দর্শক নেই সেভাবে, টিকিটের টাকায় থিয়েটার দল চালানো মুশকিল, শুধু নাটক করে পেটটাও চলে না!’

    ‘হোয়াট? এখনো? সো মেনি ইয়ার্স লেটার?’

    ‘হ্যাঁ স্যার। মানুষ অত পাত্তা দেয় না থিয়েটারকে। আমি তো কতবার পাড়ার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে করতে চেয়েছি আপনারই ‘ককেশিয়ান চক সার্কল’, কিন্তু ওদের বাবা-মায়েরা খুব আপত্তি…’

    ব্যাস! কথা শেষ হল না! ব্রেখট রেগে উঠে দাঁড়ালেন। বাংলার সদ্য ঢালা পেগটা পড়ে রইল টেবিলে। আমায় তখনি বললেন, থিয়েটারের হলে নিয়ে চলো। আমিও ঘোরালাম অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্র সদন, তপন থিয়েটার।

    ব্রেখট শুধু পাইপ টানেন আর সব দেখেন। মাঝে মাঝে জার্মানে কীসব আওড়ান। সন্ধে হওয়ার পর বোধয় কিঞ্চিৎ ক্লান্ত হয়েই বসলেন একটা ফুটপাথে। তারপর অনেক কিছু বললেন। কখনো ইংরিজি, কখনো জার্মানে। যা বুঝলাম, ব্রেখট-কে আমি সামনাসামনি পেয়ে যতটা আপ্লুত, উনি পৃথিবীর অবস্থা দেখে ততটাই ব্যথিত।

    জার্মান তো বুঝি না। কিন্তু বাকিটা বুঝলাম। উনি বললেন, উনি ভেবেছিলেন প্রায় ৬৬ বছর পর পৃথিবীতে এসে দেখবেন, ওঁর বা অন্য অনেকের কাজ মানুষকে আগামীর এক দিশা দেখাবে। তবে তার কোনো চিহ্নই প্রায় উনি এই মর্তের সফরে পাননি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে উনি সারাজীবন নাটক নির্মাণ করেছেন, আর মানুষ সেই নাটককে ব্যঙ্গ করেছে: আবার সেই জুদ্দু নিয়ে নাটক? আবার সেই রাজনৈতিক কচকচানি? তারপরেও উনি দেখছেন পৃথিবীর এখন হুবহু সেই আগেরই চেহারা, সেই যুদ্ধবাজি! রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের কথাও বললেন! ৬০ বছরে মানুষের সভ্যতার বিবর্তনের চেহারাটা বিপথগামী দেখে ব্রেখট বোধহয় একটু রাগেই পাইপটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

    আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। জার্মান লোকের রাগ বাবা!

    কিন্তু তারপর আরও শান্ত হয়ে বললেন যে ওঁর স্বপ্ন ছিল, একদিন পৃথিবীতে আর ‘মাদার কারেজে’-এর মতো নাটক লিখতে হবে না। কিন্তু ১০০ বছর পরেও আমরা সেই গর্তেই পড়ে আছি— যার বিরুদ্ধে উনি সকলকে সতর্ক করেছিলেন। আরো কষ্ট পেয়েছেন উনি এটা শুনে যে আজকাল বাস্তবের থেকে ফেসবুক বলে একটি মাধ্যমে কমিউনিস্টদের সংখ্যা বেশি! বললেন, আমরা সফলভাবে ‘ম্যাক দা নাইফ’ -দের ফাঁসি দিয়ে আরো অনেক বড় চোরদের সাথে সহবাস করতে পেরেছি।

    আমার এসব শুনে চোখে জল চলে আসছিল বুঝলি? বললাম, না স্যার, আপনি শুধু এইভাবে দেখবেন না! আপনার লেখা, আপনার ভাবনা আমাদের মতো অনেক মানুষকে কত প্রভাবিত করেছে!

    ‘বাট আই কুড নট হেল্প দ্য পিপল অফ দিস ওয়ার্ল্ড! রটন! ব্লাডি রটন! এভরিথিং ইজ রটন!’

    ‘স্যার?’

    ‘আমি আর আসব না এই পৃথিবী দেখতে। আপনারা যদি আমার কাজ ভালোবেসে থাকেন, আপনারাই চালিয়ে যান। হোয়েন ইউ আর গন ফ্রম দিস শিট-হোল, হয়তো আমরা মিট করব আফটার লাইফে!’

    ‘স্যার?’

    তারপর নাকি উত্তমদার হাতে ব্রেখট একটা নাটকের প্রথম পাঁচ সিনের খসড়া ধরিয়ে চলে গেলেন। ওই কাগজটা উত্তমদা আমাকে কিছুতেই দেখাল না! দেখাবেই বা কেন? স্বয়ং বের্টল্ট ব্রেখট-এর লেখা যে হাতে পেয়েছে, সে কি আর সবাইকে দেখিয়ে বেড়াবে?

    উত্তমদা কিছু একটা করবে ওই লেখা নিয়ে, আমি জানি। তবে আমি ভাবছি হয়তো এসব পরলোকের কোনো প্ল্যান। মহান সব মানুষ ওপর থেকে এসে এরকম নাটক, গান, সিনেমার দুটো-একটা কনসেপ্ট ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন না তো? আবার পৃথিবীতে কিছু ঘটবে না কি?

    যাক, আমিও অপেক্ষায় রইলাম। হয়তো রবি ঠাকুর, হারবার্ট স্পেন্সার, কুরোসাওয়ার সাথে রাসবিহারীতে দেখা হতে পারে! কারণ ইতিহাসে পড়েছিলাম, অন্ধকার মধ্যযুগে আলো পাওয়ার জন্য রেনেসাঁসের সময়ে মানুষ ফিরে গেছিলেন অতীতের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের কাছে। আমরা যে জঘন্য নোংরা সময়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছি, হয়তো আবার রেনেসাঁস আসন্ন!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook