ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ১২


    শুভময় মিত্র (April 1, 2022)
     

    চাপ

    কথা চেপে রাখতে না পারলে খুব মুশকিল হয়। আবার, যা লুকোইনি, তেমন বলার মতো নয়, সেটা ভুল সময়ে বেরিয়ে পড়ে। কেন কে জানে! গতকাল রাতে, একজন একটা সাধারণ কথা জিজ্ঞেস করল ফোনে। মতামত দিতে-দিতে, ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য মূল ব্যাপার হোল্ডে রেখে আরও কিছু রেফারেন্স দিতে-দিতে, কখন যে অন্য কথায় চলে গেছি, খেয়ালই নেই। অন্যদিকের মানুষটা হয়তো অধৈর্য হয়ে পড়ছে। ভদ্রতা করে কিছু বলছে না। বিষয় যখন ইউক্রেন থেকে নাৎসি জার্মানি হয়ে বালেশ্বরের ওপর দিয়ে উড়ছে, লাইন কেটে গেল। কেটে দিল? হতেই পারে না। ভাইটাল জায়গা। ফের ধরলাম। যেটা বলছিলাম, বলে আবার শুরু করলাম। অনিয়ন্ত্রিত হাওয়ায় অনেক দূর সরে গেছি বুঝতে পেরেও নিজেকে থামাতে পারছিলাম না। কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, আবছা হয়ে এলেও মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম। সেখানে ফিরে আসতে পারবই এই বিশ্বাসে জয়স্টিক মুচড়োচ্ছিলাম ক্রমাগত। আবার কেটে গেল। আর ফোন করলাম না। অনেক রাত হয়ে গেছে। অন্ধকারে চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। খুব জোরে অনেক দূর থেকে এসে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করলে পিস্টনের ক্লান্ত মোবিলগুলো যেমন খুব ধীরে-ধীরে ইঞ্জিনের ভেতরে নামতে থাকে, জিরিয়ে নিতে চায়, আমিও ভেতরে-ভেতরে সেরকম কিছু একটা অনুভব করছিলাম। বেশ কয়েকদিন যদি কথা না হয়, তাহলে ব্যাপারটা চাপা পড়ে যেতে পারে। না পড়লে? কোনও কিছুরই গ্যারান্টি নেই। মাঝখান থেকে অন্য অনেক দুর্ভাবনা ফিরে এল। একগাদা হোস পাইপ দিয়ে কেউ যেন পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন, আমপোড়ার শরবত— একসঙ্গে ঢেলে দিচ্ছে মাথার মধ্যে। আলাদা মিটারে সংখ্যা বদলে যাচ্ছে হু হু করে। একটায় যোগফল দেখাচ্ছে। চোখ বুজে ফেললেও সেটা যাচ্ছে না। জল খেলাম। মেল চেক করলাম। জানি কিছু নেই। ক’দিন ধরে ফেসবুকে কিছু আসছে না। কেউ আমাকে কিছু বলছে না। আমিও না। দেখেও না দেখার ভান করে আছি। হোয়াটসঅ্যাপের দিকে হাত বাড়িয়েই সরিয়ে নিলাম। যদি সেখানে কিছু দেগে দিয়ে থাকে? এত রাতে রাস্তায় বেরোব? একটু ঘুরে আসব? কার্ফু কি এখনও আছে? আমাদের পাশের মিষ্টির দোকানের চটচটে লোকটা, রোদ্দুরে রসগোল্লা, সন্ধের পর পান্তুয়ার মতো দেখায় ওকে। সে দোকান বন্ধ করে অনেক রাত অবধি বসে থাকে একা-একা। ফোন ঘাঁটে না কিন্তু। চোখাচোখি হলে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে। ‘খুব গরম পড়বে কিন্তু, এসি লাগাবে না?’ ছোটবেলায় আমাকে নাকি খুব ভাল দেখতে ছিল! এটা ও খুব বলে। আমার একটু-একটু মনে আছে। পাড়ার মেয়েরা আমার গাল টিপত। তাকে বিয়ে করব কি না জিজ্ঞেস করলে নির্দ্বিধায় ‘হ্যাঁ’ বলতাম। বেরিয়ে কাজ নেই আর। দেখি, চাঁদ-ফাঁদ কিছু একটা যদি তোলা যায়।

    সকালে রাতের ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। দেখি প্রচুর পাঁউরুটি। একটাও ডিম নেই। আনতে বেরোতেই রোদ্দুরটা ছ্যাঁক করে লাগল। মন ঘুরে গেল অন্যদিকে। এবারে কিন্তু অন্য ঘটনা ঘটেছে। পায়ের ক্র্যাম্পের মতো, মাঝে মাঝে কোনও একটা গানের লাইন মাথায় ফিরে-ফিরে আসে। ক্যারামের প্রথম স্ট্রাইকের মতো ফেটে যায়। কিছুতেই বেরোতে চায় না। ‘শান্ত, শীতল সন্ধ্যে তন্বী গাছের ছায়াই ভালো’-এর আগে পরের লাইনগুলো নয়, এখন ওইটুকু পাক খাচ্ছে মাথায়। এটা আমি যে এখন শুনতে চাইছি তা নয়। আমি জাস্ট কিছুই চাইছি না। মাথাটা ফাঁকা রাখতে ইচ্ছে করছে। হচ্ছে না। কী হবে কিনে? এগুলো ডিম না কি? কুসুম আর বাকিটার একই রং। দেশি নিলে কমলা হবে। লাল নাকি শেষ। হাঁসের নীল ডিম পেলে অন্য ব্যাপার। আবার অবান্তর প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ছে। দাম দিয়ে অরগ্যানিক ডাল কিনেছিলাম, পাথরের টুকরো ছিল। জেনুইন ন্যাচারাল মিনারেল আছে বলেই হয়তো। মিষ্টির দোকানে গিয়ে কচুরি চাইলাম। ‘লাল দেখে দিও তো।’ জিলিপি খেলাম, সবে নেমেছে। ক্রিস্‌প। বেলা বাড়লে একটু টকে যাবে। ঝিমিয়ে পড়বে। বিকেলে তেঁতুলের চাটনি। পিউপা ক্রাইসেলিস পড়েছি। প্যাঁচ মিষ্টির মেটামরফোসিস বুঝি আমি। দুপুরের আগে আমার করণীয় কিছু নেই। আছে, কিন্তু সেগুলো করতে ইচ্ছে করছে না। একটা না করে পারলাম না। ফ্রিজ থেকে বহু দিনের বাসি একটা মাছের কী যেন, আমার একদম ভাল লাগে না, ফেললাম। খাবার নষ্ট করি না আমি। কিন্তু পাশের বাড়ির লোক এটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। নিজেরা খাবে না, তাই। ওদের কেউ দিয়েছিল নিশ্চয়ই। জল থেকে উঠে খাবি খেতে-খেতে সে মাছ এ-হাত সে-হাত ঘুরতে-ঘুরতে, ঝালে ডুবে মরে রিজেক্ট হতে-হতে শেষ পর্যন্ত আমার কাছে। শিগগিরই সে ধাপায় পৌঁছে যাবে। মাঝে মাঝে তো আমার নিজেকেই এর সমগোত্রীয় বলে মনে হয়। গ্রোইং এজে আমার মাথা উপযুক্ত ভিটামিন নিতে পারেনি। তাই আজ আমার এই হাল। যাবতীয় অবান্তর ব্যাপার থেকে নিজেকে সরানোর মতো ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। বাধ্য হয়ে বিকল্প খুঁজে চলেছি। অব্যাহত আছে মনের মধ্যে নক্কারজনক কল্পনার স্ট্রিমিং ভিডিও। কেউ বুঝে ফেললে সর্বনাশ। টেনশন হয় সারাক্ষণ। 

    একই সঙ্গে চোখে পড়ল একটা কাক। ল্যাম্পপোস্টে কেবলে বাঁধা লুজ একটা তার দেখে টানাটানি করছে। রাস্তা দেখলাম। গত বছর অনেক রাতে কারা যেন চিরে দিয়েছিল। বেশি না, ঠিক যেটুকু দরকার। পাক্কা সার্জেনদের মতো। নানা রঙের প্লাস্টিকের শিরা নিঃশব্দে চালান করে দিয়েছিল ভেতরে। এখন নিশ্চয়ই সেখান দিয়ে নিশ্চিন্তে ডাটা যায় মেট্রোর মতো। কাজের কোটেশন, আত্মহত্যার হুমকি, অসতর্ক ছবি, ঠাকুরের গান— কী না যায় একসঙ্গে! ধাক্কাধাক্কি, কনুই মারা নেই। কেউ দেখতে পায় না। টানাটানিও করতে পারে না। নিপুণ ভাবে রাস্তা সেলাই করে চলে গেছে ওরা।


    বেশ কিছু লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে খবরের কাগজ পড়ছে একসঙ্গে। নির্ঘাত সাংঘাতিক কোনও ঘটনা ঘটেছে। তার বিশদ বিবরণ বেরিয়েছে। এগুলো উৎসবের মতো চলে কয়েকদিন ধরে। পরের ঘটনা এসে গেলে এটা ভাসান দিয়ে দেওয়া হয়। আমি পড়ি না। অভ্যেসবশে উঁকি দিলাম। গতকাল ফোনে দেখেছি। প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম ওর মধ্যে। বেঁচে গেলাম পায়ের কাছে থপ করে একটা পলাশ পড়ায়। ওপরে তাকিয়ে দেখি অনেক হয়েছে। একই সঙ্গে চোখে পড়ল একটা কাক। ল্যাম্পপোস্টে কেবলে বাঁধা লুজ একটা তার দেখে টানাটানি করছে। রাস্তা দেখলাম। গত বছর অনেক রাতে কারা যেন চিরে দিয়েছিল। বেশি না, ঠিক যেটুকু দরকার। পাক্কা সার্জেনদের মতো। নানা রঙের প্লাস্টিকের শিরা নিঃশব্দে চালান করে দিয়েছিল ভেতরে। এখন নিশ্চয়ই সেখান দিয়ে নিশ্চিন্তে ডাটা যায় মেট্রোর মতো। কাজের কোটেশন, আত্মহত্যার হুমকি, অসতর্ক ছবি, ঠাকুরের গান— কী না যায় একসঙ্গে! ধাক্কাধাক্কি, কনুই মারা নেই। কেউ দেখতে পায় না। টানাটানিও করতে পারে না। নিপুণ ভাবে রাস্তা সেলাই করে চলে গেছে ওরা। কোথাও-কোথাও স্কার চোখে পড়ে। সোমনাথ হোরের ছবির মতো। উনি ব্যাপারটা রেখেছিলেন সাদার ওপর। এরা পিচ কালোতে। কাক সুবিধে করতে পারছে না। আমার খুব আনন্দ হল। আসলে কাক দেখলেই আমার রাগ হয়। ওদের দৃষ্টিটা খুব ধান্দাবাজ, কুচুটে ধরনের। অনেক রকম নোংরা কাজ করে ওরা। সাদা জামা পরা লোক দেখলে কালো, ডার্ক কালারের পোশাক দেখলে সাদাটে বিষ্ঠা ফেলে দেয় অব্যর্থভাবে। স্রষ্টা কিছু একটা সেন্সর দিয়েছেন ওদের। এই কথা একবার বলায় সবাই খুব হ্যা-হ্যা করে হেসেছিল। যার মানে হল, আমার জীবন কাকের চেয়েও ঝুল। একজন বলেছিল, ‘তোর তো কোনও সেন্সই নেই।’

    গান আরও খারাপ জিনিস। কথা কানে ঢোকে না। কী যে বলে, বুঝি না কিছু। কতগুলো শব্দ কৌটোতে ভরে ঝাঁকিয়ে সামনে ছড়িয়ে দিলেই গান? তারপর জোঁকের মতো লেগে যাবে একটা মাথা চোষা লাইন। ব্যাস হয়ে গেল!


    সকাল-সকাল রাস্তায় আরও অনেক কাণ্ড ঘটছিল। হলুদ ট্যাক্সি জল ধোয়া হয়ে কঁকিয়ে স্টার্ট নিচ্ছে। আর্তনাদ চলবে কিছুক্ষণ। নিতে পারলে বিকট উল্লাস। চলে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকবে একটা জলের ফ্রেম। মাঝখানে কিছু নেই। ঠিক এরকম একটা স্পেস আমি খুঁজছি। ট্যাক্সি চলে যাবার পর কালো তেলের হেমারেজ চোখে পড়তে পারে। সাদা গাড়িগুলোয় এসব হয় না। যদি দুপুরের কাজটা না আসে, তাহলে কী করব জানি না। আসার আশায় চুপ করে বসে থাকা যাবে না। আমাকে একা, অরক্ষিত অবস্থায় পেলে ধরবার জন্য অনেকেই ঘুরঘুর করছে। কিছু একটা করে সময় কাটাতে হবে। বই পড়ে লাভ নেই, অনেক পড়েছি। কিছু হয়নি। খুব শত্রু একজন, ইচ্ছে করে মাউস ট্র্যাপটা ধরিয়েছিল। অব্যর্থ ফাঁদ। ঠিক যা আমি নিজে জানতে চাই না, সেগুলোই লিখেছে। গান আরও খারাপ জিনিস। কথা কানে ঢোকে না। কী যে বলে, বুঝি না কিছু। কতগুলো শব্দ কৌটোতে ভরে ঝাঁকিয়ে সামনে ছড়িয়ে দিলেই গান? তারপর জোঁকের মতো লেগে যাবে একটা মাথা চোষা লাইন। ব্যাস হয়ে গেল! সেদিক থেকে সিনেমা ব্যাপারটা ভালো। এত রকম মিথ্যে যে, সেগুলো আসলে সত্যি নয় ভেবে খুব আরাম হয়। স্পিলবার্গের ‘ডুয়েল’ আছে আমার কাছে। দেখি মাঝে মাঝে। সেই যে জঘন্য, নোংরা ট্রাক, একটা ভালোমানুষ গাড়ির ওপর ক্রমাগত মানসিক অত্যাচার করে চলেছে। এই বোধহয় চাপা দিয়ে দেবে। গাড়ির লোকটা প্রথমে খুব রেগে গেলেও পরে বেদম ভয় পাচ্ছে। মনস্টার ট্রাকের ড্রাইভারকে একবারও দেখা যায়নি। সে হাইওয়েতে কালাপাহাড়ের মতো, ড্র্যাগনের মতো, সুযোগ পেয়ে একটা দেশকে গিলে খেতে চাওয়া পলিটিশিয়ানদের মতো সারাক্ষণ গাঁক-গাঁক করে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার, দর্শকের মাথা খাবে বলে বুদ্ধি খাটিয়ে এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল ডিরেক্টর। যেটা আরামের ব্যাপার সেটা হল, সব কিছু এতই বাস্তব যে, নির্ভরযোগ্য অবাস্তবতার ভায়োলেন্সে আমার খুবই আরাম লাগে, যখনই দেখি। 


    কাজটা না এলে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যেতে পারে। সূর্যটা সেই ট্রাকের মতো যতই ভয় দেখাক, একটা বাড়ির বারান্দার তলায় চলে গেলে আমাকে কিস্যু করতে পারবে না। এই তো বাচ্চারা ইস্কুলে চলে যাচ্ছে বকর-বকর করতে-করতে। এর মধ্যে একটাকে আমি চিনি। সেটার হাতে একটা রুলার থাকে। স্কুলে নিশ্চয়ই মার খায়। তাই স্কুলের বাইরে রাস্তার কুকুর-বেড়াল যাকে যখন পায়, চালিয়ে দেয়। ধরব একদিন। গরম বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাড়তে থাকে হর্নের দাপাদাপি। সামনে ফাঁকা থাকলেও টানা বাজিয়ে চলে মোটর সাইকেলের লোকরা। আওয়াজ দিয়ে সামনের অদৃশ্য বাধাগুলো ভেদ করে চলে যায় জাহান্নামপুরে। এর মধ্যে যেটা আমি খুব মন দিয়ে দেখি, ভাল লাগে, তা হল, কুলফি তৈরি করা। কাঠের বালতির মধ্যে বরফ। তার মধ্যে লোহার পাত্রে যা ভরার ভরে, ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে তৈরি হয়। শান্ত-শীতল বরফ একটু-একটু করে দুধের তাপ শুধু শুষে নেয় তাই নয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয় তার গরম শরীরটাকে। প্রায় জমিয়ে দেয়। এক বিশেষ মুহূর্তে থেমে যায় মধুর ড্রিলিং। এরা জানে, ঠিক কখন থামতে হয়। ঠিক কোন অবস্থায় নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। পুল আউট ইন টাইম। ব্যাপার বোঝার আছে। 

    একেবারেই ব্যবহার না হওয়া দোকান-পালানো একটা ধোপদুরস্ত কাগজের ঠোঙা ফুলে ফেঁপে উড়োউড়ি শুরু করে দেয়। এর অ্যাক্সিডেন্টের ভয় নেই। হাওয়া এর ফ্রি ফুয়েল। এই ম্যাজিকটা আমরা জানি না। কতদিন মহাজাতি সদনে যাওয়া হয় না, এখন আর ম্যাজিক হয় না।


    আমি চাইছিলাম না যে ফোনটা আসুক। এলও না। এই যে আমাকে আর ভাবতে হল না কাজ নিয়ে, এতে আমার কিছু রোজগার মার খেল ঠিকই, কিন্তু যে-সময়টা পেলাম, তা আমার কাছে এখন অনেক বেশি আরামের। মাথা খালি করতে হবে, সেটাও কাজ। গত কয়েক বছরে অনেক গাড়ি রাস্তায় অপেক্ষা করে-করে নষ্ট হয়ে গেছে। চাকা বসে গেছে। রিমের মধ্যে গাছও গজাতে দেখেছি। লোহা, রবার থেকে এরা খাবার জুটিয়ে নিয়ে দিব্যি থাকে। কিছু দূরে, যেখানে রিকশাগুলো দাঁড়িয়ে থাকে তার পরেই এমন একটাকে দেখতে পাই। কাচ নামানো। ভেতরে ড্যাশবোর্ডের ওপর ঠাকুরের ছবি। তার ওপর মালা জড়ানো। ফ্রেশ। মালিক কি রোজ এটুকু করে? যদি দেখতে পাই, কথা বলব। ড্রাইভারের সিটে ধুলো নেই তেমন। দুপুরবেলা ওখানে ঢুকে বসা যেতে পারে। দুপুরে কিছু একটা খাওয়ার ব্যাপার আছে। না ভাবলে, না খেলে কি আর হবে? প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে এত ট্র্যাফিক কেন? জোর করে জল খেলাম অনেকটা। আমার চেনা একজন আসছিল। এগোলাম। আমাকে খেয়াল না করে সে চলে গেল। 


    দুপুর হয়েছে বোঝার জন্য ঘড়ি বা সূর্য দেখার দরকার নেই। একটু অপেক্ষা করতে হয়। ল্যাম্পপোস্টের ছায়া লাঞ্চে চলে যায়। দক্ষিণ দিক থেকে একটা সুন্দর হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রথমে গাছের ওপরে, তারপর তলার ডালপাতাগুলো মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে। রাস্তার ওপর দিয়ে হওয়া চলছে পরিষ্কার বুঝতে পারি। একেবারেই ব্যবহার না হওয়া দোকান-পালানো একটা ধোপদুরস্ত কাগজের ঠোঙা ফুলে ফেঁপে উড়োউড়ি শুরু করে দেয়। এর অ্যাক্সিডেন্টের ভয় নেই। হাওয়া এর ফ্রি ফুয়েল। এই ম্যাজিকটা আমরা জানি না। কতদিন মহাজাতি সদনে যাওয়া হয় না, এখন আর ম্যাজিক হয় না। গাড়িতে বসব বলে দরজা খুলতে গিয়ে সুবিধে হল না। জ্যাম হয়ে গেছে। পেছনেরটা খুলল। সেখান দিয়ে ঢুকে সিট টপকে সামনে বসে গেলাম। বসেই বুঝতে পারলাম খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একেবারে ছোটবেলার মতো ব্যাপার। স্টিয়ারিং ঘুরছে না। গিয়ার যেদিকে চাইছি সেদিকেই চলে যাচ্ছে জলের মতো। পায়ের কাছে চোখ পড়ল। চাতালের অনেকটাই নেই। তলায় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সামনে, দু’পাশে জানলা দিয়ে নিজের চেনা পাড়াটা দেখতে পাচ্ছি। অচেনা লাগছে। ট্যাঙ্ক নিয়ে এক সময় নিজের দেশে ঢুকলে রাশিয়ানদের কি একই কথা মনে হচ্ছে? আজ কিন্তু ঠাকুরের ছবিতে মালা নেই। হাত বাড়িয়ে সাইড মিররটা অ্যাডজাস্ট করে দিলাম যাতে ঠিক পিছনের কৃষ্ণচূড়াটা স্ক্রিনে ভরে থাকে। আয়নায় যে-কথাটা লেখা আছে, দেখে হাসি পেল। একজোড়া শালিখ ঢুকে পড়ল গাড়ির মধ্যে। ঠাকুরের দু’পাশে বসে আমাকে দেখেশুনে নিজেদের মধ্যে কীসব সিদ্ধান্ত নিয়ে উড়ে গেল। আর একজন চেনা লোক, ছোট থেকেই চিনি, স্কুলে পড়াত, আমাকে বসে থাকতে দেখে হাসি-হাসি মুখ করে এগিয়ে এল। জানলায় ঝুঁকে বলল, ‘বসো, বসো। কেউ তো তাও আমার গাড়িতে একবার চাপল।’ সে রিটায়ার করে গাড়ি বের করেছিল কিন্তু চালাতে পারেনি। প্রথম থেকেই গাড়ি বসে আছে। এর জন্য ভীষণ দুঃখিত বলে মনে হল না। পাতাখোররা মাঝে মাঝে এটা-সেটা খুলে নিয়ে যায়। তলাতেই নজর বেশি। ক্লাচ-গিয়ার থেকে গাড়ি মুক্তি পেয়েছে ক’দিন আগে। কী আর করা যাবে! গাড়িটা যদি একটা ছোট এক তলার ঘর হয়, সেখানে এসে কেউ যদি নিশ্চিন্তে বসে, সেটাও তার কাছে আনন্দের। ব্যাপারটা এরকম। ‘বসো, বসো। আমি যাই, বিরক্ত করব না’ বলে সে চলে গেল। ও কী করে বুঝল আমার এখন ঠিক কী চাই? ও নিজে কি এইরকম কিছু না চাওয়ার টেকনোলজিটা ধরে ফেলেছে? মাস্টারমশাইদের মধ্যে এই ব্যাপারটা থাকে। একগাদা ছাত্রছাত্রী নিয়ে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। এদের মুখ দেখলে অন্তত মনে হয় যে, এরা খারাপ নেই। সত্যি বলতে কী আমারও ইচ্ছে ছিল এরকম হবার। কিন্তু আমার স্বভাব অন্য রকমের। এত বেশি মাথা দিয়ে ফেলি সব ব্যাপারে যে, নিজেই বিপদে পড়ে যাই। খালি টেনশন হয়। 


    বিকেল হবে-হবে করছে। আকাশে দানা-দানা ভাব। হজমিওয়ালা এসে আমার দরজার পাশে দাঁড়াল। স্কুলের বাচ্চারা আসছে হল্লা করতে-করতে। একদল এসে তেঁতুল-তেঁতুল করতে লাগল। সেই বজ্জাতটাও আছে। কুলের আচারের ওপর আর যা-যা চাই সে বলে যাচ্ছে। বয়ামগুলো নজর করলাম। এই ব্যাপারটা একটুও বদলায়নি। কালো নুন, মুখে দিলেই শক লাগে, শুনেছি অ্যাসিড দেওয়া থাকে। গোলাপি চুরান। আমচুরের মধ্যে খেজুরগুঁড়ো নাকি লালচে হবার কারণ। বাদামি আর একটা। মিষ্টি-মিষ্টি। গুড় থাকে বোধহয়। লঙ্কাগুঁড়ো, বিটনুন তো আছেই। ওইগুলো, প্রত্যেকটা, সে বেশি-বেশি করে চায়। ‘এগুলো আসলে কী জানিস?’ জিজ্ঞেস করায় অম্লানবদনে বলে গেল, ‘কোল, আয়রন ওর, ম্যাঙ্গানিজ, জিপসাম।’ আজকালকার ছেলে, সহজে সুবিধে হবে না। ওরা চলে যেতে আবার একটু চুপচাপ। কথা হল আলগোছে। লোকটার বাড়ি বিহারের মধুবনীতে। সন্ধের মুখে উল্টো ফুটপাথে ফুচকাওয়ালা বসল। খিদে পেয়েছিল। ইশারা করে একপাতা চুরমুর বললাম। মেখে নিয়ে এসে আমাকে দেবার সময় আধা হিন্দিতে বলল, ‘ভাল করেছেন, স্কিরাপ হিসেবে কিনে নিন, ধুয়ে-মুছে তেল ভরে চালালেই চলবে। এখন তো সব চলছে।’ এই কাজটা আমি করতে পারব না। যার গাড়ি তার চোখের সামনে এরকম ঘটলে সে দুঃখ পাবে। বরং অন্য কিছু ভাবা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে অনেক দোকান আর খোলেনি। যা নতুন খুলতে দেখেছি তা হল বিউটি পার্লার আর কুকুরের প্রয়োজনের দোকান। খাবারের দোকান বন্ধ হয়েছে কিছু। জমে উঠেছে রান্নাঘরের ব্যবসা। নতুন একটা কাজ করছে অনেকে। পিঠে বিশাল ব্যাগ নিয়ে বাইক বা সাইকেল চালিয়ে কত কী ডেলিভারি দিচ্ছে। আধুনিক রানার। অনেক রাত অবধি এদের দেখতে পাই। এর একটাও আমি করতে পারব বলে মনে হয় না। এই অবধি ভেবে আমার খুব আরাম হল। মাথার মধ্যে অনেকটা জায়গা এখন। বিশাল ময়দান। মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ার ভয় নেই। 


    একটা কুকুরছানা আমাকে জুলজুল দেখছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে চাপ দিতে দরজা খুলে গেল। সে দৌড়ে এসে আমার পাশে বসে পড়ল। ওকে দেখে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল সব কিছু। পকেট থেকে ফোন বের করে একটা-একটা করে যা-যা জমিয়ে রেখেছিলাম সব মুছে দিলাম। ফোনটার আমার মতোই দশা হয়েছিল। আমাকে বলল ‘কনগ্র্যাচুলেশনস।’ ওর কয়েক ইঞ্চির ঝলমলে স্ক্রিনে এই মুহূর্তে এক্কাদোক্কা খেলার দেদার জায়গা। ডিলিট করিনি আমার নিজের একদম ছোটবেলার কয়েকটা ছবি। আজ সারারাত এগুলো দেখবো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। কুকুরছানার সঙ্গে গল্প করব, যদি ওটা জেগে থাকে। আলো ফোটার আগে মুছে দেব যাবতীয় কনট্যাক্টস। এরপর থেকে সবাই অচেনা। আবার সব কিছু নতুন করে। সকাল হবার আগে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook