পর্ব ১
তথ্য হচ্ছে সবার সত্য। কল্পকাহিনি কারোরই সত্য না। আবার পৌরাণিক গল্প হচ্ছে কারোর-কারোর সত্য। এ-সত্য সাংস্কৃতিক সত্য, ধর্মীয় সত্য, জাতীয় সত্য। যে-সত্য একটি জাতি বা সমাজকে যাপন করার মতো একটি সম্মিলিত জীবনবোধ উপহার দিয়ে এক সূত্রে বেঁধে রাখে।
এ-দুনিয়া ঠিক কীভাবে চলেছে, সেই হিসেব আমাদের বিজ্ঞান দিতে পারে। তবে দুনিয়া এইভাবে কেন চলেছে, তার উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একমাত্র পৌরাণিক গল্পরই শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। যেমন ঈশ্বরের কল্পনা আসলে একটি সাংস্কৃতিক সত্য, তা বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম বা সেকুলারিজমের অংশ নয়। আবার হিন্দু জীবনদর্শনে প্রফেট বা নবি-রসুলের ধারণাটির কোনও অর্থ নেই। কোনও কাহিনিতে নায়ক, খলনায়ক এবং পীড়িতের যে-ভূমিকা, তার উৎস আসলে গ্রিক পৌরাণিক গল্পর চিন্তায়। পরবর্তীকালে আধুনিক গল্প-বলিয়েরা এ-জিনিসকে পৃথিবীর বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পয় আরোপ করেন, যার ফলে নানান সাংস্কৃতিক ভাবনায় বিকৃতি আসে। সাম্যবাদ বা সমতার ধারণা আসলে যুক্তি থেকে আসে না। এ-জিনিস এব্রাহামিক পৌরাণিক গল্প থেকে পাওয়া একটি আপেক্ষিক সত্য। একই ভাবে ন্যায়ের ধারণা আসে গ্রিক পৌরাণিক গল্পের থেকে। এই দুটি পাশ্চাত্য ধারণার মধ্যে প্রায়ই ঠোকাঠুকি লেগে থাকে!
একটি পৌরাণিক গল্পর অনুগামীরা যে তাঁদের সত্যটিকেই ধ্রুব সত্য বলে বিশ্বাস করেন, সে-কথা অবশ্য অনস্বীকার্য। বহিরাগতদের তাঁদের সাথে মতান্তর ঘটে। এই মতান্তর থেকেই জন্ম নেয় যত গোষ্ঠীগত, ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ। আমরা বরং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দশটি পৌরাণিক গল্প নিয়ে তুলনা করে দেখি, কীভাবে বিভিন্ন সমাজের মানুষ এই পৃথিবীর স্বরূপ চেনার চেষ্টা করেছেন।
নর্স পুরাণ
জ্ঞানের মূল্য: দেবরাজ ওডিন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তাঁর ত্যাগের গল্প
ওডিন ছিলেন আসির জাতির রাজা, একাধারে তিনি যুদ্ধ এবং পৃথিবীর দেবতা, আবার আকাশ, জ্ঞান, পদ্য এবং ইন্দ্রজালেরও দেবতা। ওডিন ছিলেন শামান গোত্রের ব্যক্তি, তিনি ভালবাসতেন সুখের সাগরে ভেসে যেতে, ঘোরের মধ্যে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে। তাঁর আচার-ব্যবহারে প্রায়ই নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেত, যা তাঁর ভাইকিং যোদ্ধাদের যারপরনাই লজ্জায় ফেলে দিত, কারণ তারা ওডিনের চরিত্রের পুরুষালি দিকটাকেই বেশি পছন্দ করত। ওডিনের চেহারায় যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করত, তা হচ্ছে তাঁর একমাত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। তাঁর অন্য চোখের জায়গায় একটি ফাঁকা গর্ত—ওই চোখটি তিনি দিব্যজ্ঞান অর্জনের মূল্য হিসেবে বলি দিয়েছিলেন। ওই চোখটি ত্যাগ করার বিনিময়ে তিনি দিব্যজ্ঞানের কুয়ো থেকে পান করার অনুমতি লাভ করেছিলেন। আর একবার ওডিন বিশ্ববৃক্ষ ইগদ্রাসিল থেকে ন’দিন ন’রাত্রি টানা ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন, নিজের সাথীদের থেকে কোনও রকমের আহার-পানীয় ইত্যাদি পুষ্টির প্রলোভনে না ভুলে নিজের কাছেই নিজেকে আত্মত্যাগ করেছিলেন তিনি। এই কঠোর সাধনা এবং আত্মত্যাগের শেষে তিনি র্যুন দর্শন করা এবং পড়ার অধিকার লাভ করেছিলেন। র্যুন হচ্ছে জাদুবিদ্যা এবং ইন্দ্রজালের শক্তিতে পূর্ণ প্রাচীন জার্মানিক বর্ণমালা, যার আখরে লুকিয়ে আছে সৃষ্টির গোড়ার যত গভীর রহস্য!
ওডিন প্রায়ই ওয়াইল্ড হান্টের অধিনায়ক রূপে আবির্ভূত হন। ওয়াইল্ড হান্ট হচ্ছে শীতের আকাশের বুক চিড়ে মৃত আত্মাদের ভৌতিক মিছিল। ওডিন যে-ঘোড়ায় চড়েন, তার আটটি পা। একটা নেকড়ে আর একটা দাঁড়কাক অনুচর হয়ে তাঁর সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কী ঘটছে না ঘটছে সেই খবর ওডিনকে পৌঁছে দেয়।
ওডিনের আর এক নাম ‘ওটান’ থেকেই এসেছে বুধবারের ‘ওয়েডনেসডে’ নামটি। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে বুধবারের যোগসূত্র রয়েছে তরল-কঠিন মেশানো পাঁচমেশালি বুধগ্রহের সঙ্গে, যে-বুধের অবস্থান পুরুষালি মঙ্গলগ্রহ এবং নারীসুলভ শুক্রগ্রহের মাঝখানে।
পশ্চিম আফ্রিকার পৌরাণিক গল্প
চতুর মাকড়সার গল্প: কীভাবে একটি জীব গোটা পৃথিবীর জ্ঞান চুরি করার চেষ্টা করেছিল
আনান্সি একবার মাকড়সার রূপ ধারণ করে ঠিক করল, গোটা পৃথিবীতে যত জ্ঞান আছে, সেসব চুরি করে নিজের জন্য একটি ঘড়ার মধ্যে জমিয়ে রাখবে। এ-কাজে সফল হয়ে সে ঘড়াটাকে একটা লম্বা গাছের মাথায় লুকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করলো, যাতে কেউ সেটা খুঁজে না পায়। সে নিজের দেহের সামনের দিকে ঘড়াটাকে বেঁধে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু যতবারই ওঠার চেষ্টা করে, খালি পিছলে যায়, ঠিকমতো উঠতে পারে না। আনান্সির সঙ্গে তার ছেলেও এসেছিল। বাবাকে সে বুদ্ধি দিল, ঘড়াটাকে সামনে না বেঁধে পিছনে বাঁধো, তাহলে একটু সহজে উঠতে পারবে। আনান্সি ছেলের কথা শুনে যেই না ঘড়াটাকে অন্যভাবে বাঁধতে চেষ্টা করল, অমনি ঘড়াটা তার হাত ফসকে একেবারে নীচের মাটিতে গিয়ে পড়ল। ঘড়া থেকে যত জ্ঞান বেরিয়ে এল, আচমকা একপশলা বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপটে সে-জ্ঞান গিয়ে পড়ল নদীতে, আর নদীর স্রোতের টানে শেষকালে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল জগৎজোড়া সমুদ্রের জলে। এ-কারণেই আজ পৃথিবীতে সবাই সেই জ্ঞান খানিকটা করে অধিকার করে নিতে পেরেছে।
গ্রিক পৌরাণিক গল্প
রূপের প্রতিযোগিতা থেকে যুদ্ধের সূচনা: কীভাবে দেবীদের কলহের থেকে ট্রোজান যুদ্ধের উদয় হল
পেলিয়াস আর থেটিসের বিয়ের ভোজে অলিম্পাসের সমস্ত দেবদেবীদেরই নিমন্ত্রণ ছিল। ডাকা হয়নি শুধু ঝগড়ার দেবী এরিসকে। মহা ক্রোধে এরিস ঠিক করলেন, অলিম্পাসের সবাইকে সাজা দিতে হবে! তিনি দেবদেবীদের মাঝখানে ছুঁড়ে দিলেন একটি সোনার আপেল, তাতে লেখা ‘সবচেয়ে সুন্দরী যে, তার জন্য।’ তিনজন দেবী আপেলটির অধিকার চেয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন— সংসারের দেবী হেরা, মেধা এবং গুণের দেবী এথিনা, আর প্রেমের দেবী আফ্রোদিতে। এই তিন দেবীর মধ্যে কে সবচেয়ে সুন্দরী, এবং আপেলটি কার প্রাপ্য, সে-বিচার করার দুঃসাহস কোনও দেবতা করলেন না, এমনকী স্বয়ং দেবরাজ জিউসও না। অতএব অনেক আলোচনার পরে তিন দেবীকে বলা হল ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের কাছে যেতে, কারণ তিনি নারীর সৌন্দর্যের মর্ম বোঝেন এবং সুবিচার করে থাকেন। তিন দেবী অতঃপর প্যারিসের কাছে গিয়ে নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে তাঁর মন জয় করার চেষ্টা করলেন। প্যারিস যখন মনস্থির করতে পারলেন না, তখন তিনজনেই তাঁকে নানা ভাবে ঘুষ দেবার চেষ্টা করলেন। হেরা বললেন, তোমায় আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজত্বের রাজা করে দেব। এথিনা বললেন, তোমায় আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবার মাননীয় যোদ্ধা করে দেব। আর আফ্রোদিতে বললেন, তোমার সঙ্গে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেনের মিলন ঘটিয়ে দেব।
প্যারিস আফ্রোদিতের দাবি মেনে নিলেন এবং তাঁকে সোনার আপেলটি পুরস্কার দিয়ে আজীবন নিজেকে এবং নিজের দেশ ট্রয়কে হেরা আর এথিনার বিরাগভাজন করে তুললেন। অতএব ট্রয়ের যুদ্ধের পিছনে যতটা না ছিল মানুষের ভুলভ্রান্তি, তার চেয়েও বেশি ছিল দেবতাদের হিংসা এবং নীচতা।