দেবভাষা-য় প্রায় একশোরও বেশি কাজ নিয়ে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী হয়ে গেল। কালি-কলম, কালি-তুলি, প্যাস্টেল, জলরং আর পেন্সিলের আনন্দসম্ভার।
রামানন্দবাবু বর্তমানে ছিয়াশির কোঠায়। সেই ১৯৬৩ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তাঁর শিল্প-যাত্রাপথের শুরুয়াত। অতি সরল, অতি সাধারণ রামানন্দ ভারতশিল্পের সহজিয়া ভাবের বাহক— এমনটা বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না।
একতারাটা যেমন। একটা তারা মুঠোয় ধরে এক আঙুলের যাওয়া-আসায় বেজে ওঠা সুর। নিবিড়, উদাস। ওই রকমই রেখা তাঁর; একটানা বেজে যাওয়া একতারাটার মতো। সেই রেখার ঘেরাটোপে অবয়ব ধরা আছে। ‘ধরা আছে’-র থেকে, ঘিরে আছে বললেই ভাল। বন্ধনীতে ধরে রাখা নিপুণ বাক্য যেমন।
‘ভালো ছবি, ভালো গান, ভালো সবকিছুর মাঝে আছে আত্মপোলব্ধির রসদ। আমায় নিজেকেই সেই ধ্রুবে নিয়ে যাওয়ার পথগড়া।’
(‘চিত্রকরের রোজকথা’, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়)।
মুখোমুখি মানুষ। কখনও রসিক দর্শকের পানে, কখনও বা একে অপরের পানে, আবার কখনও শূন্যপানে চেয়ে থাকা। কখনও যুগলে, কখনও সখা সখী পরিবেষ্টিত জটলায়, কখনও মায়ে-পোয়ে, কখনও ফুল পাখির নিবিড় সান্নিধ্যে। পৌরাণিক আখ্যান থেকে প্রতিদিনের চেনা দেখা মানব মানবীর সহাবস্থান তাঁর পটে। এই হল বিষয় বৈচিত্র। সবেতেই পারিপাট্য। তবুও যেন সেই পারিপাট্যের মাঝে উঁকি দেয় একের সাথে আরেকের বোঝাপড়ার ইঙ্গিত, চাতুরি, সংশয়, বিষণ্ণতা, কখনও বা প্রীতি, সৌহার্দ্য, অপত্যস্নেহ বা ভরসার ছাপ। চোখের চাহনিতে, শরীরি বিভঙ্গে, উপবোধনের ভঙ্গিতে বা ছটফটানিতে।
‘প্রতিদিন সকালটুকু নিত্যদিনের মতো থাকবে এমনটা হয় না। তুমি ভাবলে এক, দেখলে হলো আরেক রকম। একে নিজের মতো করে মেনে নিতে না পারলে তোমারই সোয়াস্তিতে থাকা নেই। আমরা সবসময় কতো ভাবনার মাঝ দিয়ে হাঁটতে থাকি— গন্তব্যে পৌঁছে দেখি— তেমনটি নয়। পট গড়ার বেলাতেও অনেক সময়ে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়ার অর্থ হেরে যাওয়া নয়। কাজের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়ার মতো। নিজেকেই এর বিহিত তৈরি করতে হয়।’
(‘চিত্রকরের রোজকথা’, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়)।
ডিম্বাকৃতি, গোলাকৃতি, পানের মতো মুখগুলো সব। খুঁটিয়ে দেখলে একঘেয়েমি কাটে। সব চরিত্রগুলোই আলাদা মনে হয়। এদের কেউ আদিবাসী, কেউ দেহাতি, কেউ বানজারা, কেউ-বা পড়শি। রেখার বিন্যাসে, অলঙ্কারের আবহে পাল্টে-পাল্টে যায়।
রামানন্দের ছবির আর এক চরিত্র হল আলো। ছবিতে অন্ধকার নেই। আলোয় ঝলমলে প্রেক্ষাপট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। রাতের পটভূমিতে যে নীল ব্যবহার করেছেন, তা-ও বড় স্নিগ্ধ। আঁধারকে আলো দেখাচ্ছে যেন।
প্রতিদিনের শিল্পযাপনের সম্ভারে ঋদ্ধ প্রদর্শনীতে চমকে দেখি এক ধূসর মুখাবয়ব। স্বল্পকেশ, গোল চশমায় উদাস দৃষ্টি হেনে আছেন। শিল্পীকে শুধানো হয়েছিল সেটি কার ছবি। উত্তরে বলেছিলেন, কোনও একজনের। এই কোনও একজন প্রদর্শনীটিকে ভরিয়ে দিয়েছেন। যেমন আরও একটি ব্যতিক্রমী কাজ ছিল ভেতরের ঘরে। মেরুন প্যাস্টেলে আঁকা শায়িতা এক নগ্নিকা। নিদ্রামগ্ন। গাঢ় হলুদের কাটাকুটি প্রেক্ষাপটের রুক্ষ রেখারা মানব-শরীরের পেলব রেখায় স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে যেন। কী আশ্চর্য চলন! মুগ্ধ হই আমরা। ধন্য শিল্পী। যদিও শেষের দিকের কাজে এই রৈখিক পেলবতা কিছুটা ম্রিয়মাণ; বয়সের কারণেই হয়তো। কিন্তু রোজনামচার শিল্প-স্বাক্ষরে রসিকের হৃদয় ভরে ওঠে আনন্দে, আলোতে।
শিল্পীর কথাতেই বার বার ফিরে আসি; আশ্রয় নিই বলা ভালো। হয়তো নিজের অনেক অক্ষমতা তার আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে পারি। এ-আড়াল রোজই শেখায় আমাদের। শিল্পযাপনের আশ্বাস দেয়, ভরসা জোগায় সুন্দরের কাছে থাকতে।
‘প্রতিদিনের লেখা আর রেখার চর্চা হলো প্রতিদিন ছুরিতে ধার দেওয়ার মতো। সারাক্ষণ এ-পাশ ও-পাশ করে ধার দিতে আলস্য এলে সে তার তীক্ষ্ণতা হারায়। প্রতিক্ষণ অভ্যাসের একটা ফলপ্রসূ দিক আছে’ (‘চিত্রকরের রোজকথা’, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়)।
দেবভাষা-কে ধন্যবাদ সেই ফলপ্রসূ দিকটার প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার সু্যোগ করে দেওয়ার জন্য।
ছবি ঋণ: দেবভাষা