ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শিকড়: পর্ব ২


    অপরাজিতা দাশগুপ্ত (March 25, 2022)
     

    পর্ব: ১

    রফিকদের বাড়ি ছিল পলাশির কাছে কোনও একটা গ্রামে। সেই গ্রামের নামটা বহু চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না নয়নতারা। অথচ রফিকের চেহারাটা দিব্যি মনে পড়ল তাঁর। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সের চেহারা। আর নয়নতারা নেহাতই কিশোরী। পনেরো কি ষোলো। 

    বড়দা তখন শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে, দু’তিন সপ্তাহ অন্তর বাড়ি আসে। একদিন সন্ধেবেলা বড়দার সঙ্গে রফিকদাও এসেছিল বাড়িতে। রফিক আল-নূর। রফিকদা এক বছরের সিনিয়র ছিল বড়দার চেয়ে। রফিকদার নাম তার আগে থেকেই শুনেছিল নয়নতারা। সেই প্রথম দেখল। অবিন্যস্ত দাড়ি, চুলগুলো একটু লালচে প্রায় ঘাড় অবধি, লম্বা, রোগা একটা ছেলে। বড়দার চেয়ে একটু বড়। কিন্তু দেখলে ছোট মনে হয়। ওর চোখের মণি পুরো কালো নয়, একটু যেন বাদামি। সেই সময় বাড়িতে ফোন ছিল না। ছেলের সঙ্গে যে অন্য একজন ছেলেও আসবে, জানা ছিল না একেবারেই। মা আর ঠাকুমার মধ্যে চোখে-চোখে কথা হয়েছিল। বড়দা-ছোড়দার ঘরেই মেঝেতে ঢালাও বিছানা করা হয়েছিল। ছোঁয়াছুঁয়ি, জাতবিচার এসব তাঁদের বাড়িতে ছিল না। রফিক দু’একবার আসার পরেই ঘরের ছেলে হয়ে গেছিল। হয়েছিল কি? কিশোরী নয়নতারা তবে একদিন মধ্যরাতে কেন শুনে ফেলবে মা-বাবার নিভৃত কথোপকথন? মা বেশ অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘খোকা যে বারবার এই ছেলেটাকেই কেন বাড়িতে আনে, বুঝতে পারি না।’

    ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেই আনে। কেন কী হয়েছে?’ বাবা বলেছিলেন।

    ‘কিছু হওয়ার কথা বলছি না। ছেলেটা তো এমনিতে ভালই। ভদ্র ব্যবহার। কিন্তু মুসলমান তো! জাত, ধর্ম, সংস্কার তো পুরোপুরি বিসর্জন দিইনি এখনও।’

    বাবা কি বিরক্ত হয়েছিলেন? বলেছিলেন, ‘আঃ! আস্তে কথা বলো। পাশের ঘরে ওরা শুনতে পাবে। এত উদ্বেগের দরকার নেই। শুধু একটু সাবধানে থাকবে। ঘি আর আগুন পাশাপাশি হলে কখন দপ করে জ্বলে ওঠে, বলা তো যায় না!’

    বাবা কী বলতে চাইছিলেন, খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারেনি নয়নতারা। ও পাশের খাটে কাঠ হয়ে শুয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল বাবা-মা’র এত টেনশনের জন্য তার নিজের কোনও ভূমিকা আছে কি না। বাড়িতে দাদু, বাবা, দাদার বাইরে প্রথম পুরুষ ছিল রফিকদা। রফিকদা যখনই আসত, গল্পের বই নিয়ে আসত নয়নতারা আর অবুর জন্য। ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘হীরা-মানিক জ্বলে’, ‘মিসমিদের কবচ’ ও রাশিয়ান রূপকথার বই। প্রতিটি বইয়ে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় লিখে দিত, ‘অবুসোনা আর রাণুসোনাকে রফিকদাদা’ ৷ প্রথমে কিছুই মনে হয়নি নয়নতারার। তারপর কীভাবে যেন বদলে গেল সব। হঠাৎ এক শুক্রবার স্কুল থেকে ফিরতে-ফিরতে নয়নতারা আবিষ্কার করল ভিতরে-ভিতরে সে অপেক্ষা করছে কখন রফিকদা আসবে। বালিকার মনের প্রগলভতা ক্রমে বদলে যাচ্ছিল কিশোরীবেলার গোপন দুঃসহ আত্মআবিষ্কারে। রফিকদার উপর ওদের দুই ছোট ভাইবোনের দৌরাত্ম্যের সীমা ছিল না। সেই রফিকদা বড়দার সঙ্গে ঘরে ঢুকলে নয়নতারা হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে যেত। বড়দা অবাক হয়ে বলত, ‘কোথায় যাচ্ছিস রাণু?’

    ‘আসছি একটু’ বলে যেন পালিয়ে বাঁচত নয়নতারা। রফিকদা কি বুঝতে পেরেছিল কিছু? একদিন বড়দাদের ঘরে বসে কী একটা বই পড়ছিল ও। পর্দার ফাঁক দিয়ে অপলকে ওকে দেখছিল নয়নতারা। হঠাৎ রফিক চোখ তুলতে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর সঙ্গে। একটু কি অবাক হয়েছিল ও? ‘রাণু কিছু বলবি? আয়…’ নয়নতারা অগত্যা বাধ্য হয়েছিল ঘরে ঢুকতে, চোর যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। কিছুই না বললে ও পড়ে ফেলবে রাণুর মন। তাই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা জিজ্ঞেস করছিল, তুমি কি এখন আরেকবার চা খাবে?’ রফিক একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না পনেরোর কিশোরী, যেন রফিক ওর পুরো নিরাবরণ চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে। রফিকের মুখে ঈষৎ হাসির আভাস— ‘নাঃ! এখন আর চা খাব না। মাসিমাকে বলে এসেছি রান্নাঘরে গিয়ে। তোর দাদা পাড়া বেড়িয়ে ফিরলে খেতে বসব। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।’

    আড়মোড়া ভাঙতে-ভাঙতে ওকে খুব গম্ভীরভাবে লক্ষ করছিল রফিকদা। রফিকের ছুঁচলো চিবুক, ফুরফুরে দাড়ি। লালচে লম্বা চুল, ফর্সা রং আর কটা চোখের মণিতে যিশুখৃষ্টের আদল। ওর অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে গভীর জলের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল নয়নতারা। খুব আস্তে-আস্তে এক নিরুচ্চার লুকোনো রসায়ন গড়ে উঠছিল ওর সঙ্গে রফিকের। এত নিভৃত সেই রসায়ন যে, বাড়িতে অন্য কারোরই তা নজরে পড়েনি। রফিকদার এত বন্ধু বড়দাও বুঝতে পারেনি কিছু। পারলে নিশ্চয়ই নিজেই শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবার প্রস্তাব দিত না। ‘মা, রাণু আর অবু তো বোটানিক্‌সে যায়নি। তোমরা সবাই মিলে একদিন চলো শীত থাকতে-থাকতে’, বড়দা প্রস্তাব করেছিল। ঠিক হয়েছিল ছোড়দা একদিন ওদের ছোট দুই ভাইবোনকে পৌঁছে দেবে বড়দার হেফাজতে। তারপর বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে ওরা বাড়ি চলে আসবে। দুপুর-দুপুরই ওখানে পৌঁছে গেছিল ওরা। ছোড়দার কী যেন কাজ আছে। ও থাকতে পারবে না। ঘুরতে বেড়িয়েছে বলে শাড়ি পরেছে নয়নতারা। কোঁকড়া-কোঁকড়া একমাথা চুল ঝুপসি হয়ে আছে মাথায়। দুই ভুরুর মাঝখানে একটা ছোট্ট কুমকুমের টিপ। রফিকের চোখে একটা মুগ্ধতা টের পাচ্ছিল নয়নতারা। ওর ভিতরে একটা শিহরন জাগছিল রফিকের চোখে চোখ পড়তেই। একটু ঘোরার পরই অবুর প্রচণ্ড প্রাকৃতিক বেগ এল। বড়দা গজগজ করতে-করতে ওর হোস্টেলে নিয়ে গেল ওকে। ‘তোরা ঘোর। রাণুকে বেনিয়ান ট্রি-টা দেখিয়ে নিয়ে আয় রফিক। আমি অবুকে বাথরুম করিয়ে নিয়ে এসে ওখানেই মিট করব তোদের।’

    ওরা চলে গেলে চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে ওরা পৌঁছে গেছিল শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছটার কাছে। যার আদি শিকড় হারিয়ে গেছে চিরতরে। অসংখ্য ঝুরি নেমে নেমে মোটা হয়ে মাটিতে নেমেছে শিকড়ের সন্ধানে।

    একটু-একটু হাঁফাচ্ছিল ষোলোর কিশোরী। ফাল্গুনের শেষেই বেশ গরম পড়ে গেছে। ও আড়চোখে দেখেছিল রফিকের ফর্সা মুখখানা আরও গরমের চাপে লাল হয়ে গেছে। একটা মোটা গুঁড়ির পাশে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। রাণুর চোখ নীচু। রফিক নিস্পন্দ হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বাদে বলেছিল, ‘রাণু, তুই হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেছিস। আমি লক্ষই করিনি।’

    ‘তুমি কিছুই লক্ষ করো না রফিকদা। কিচ্ছু বোঝো না তুমি।’ নয়নতারার মনে হচ্ছিল নিজের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ও প্রত্যক্ষ করছে এই অবাস্তব দৃশ্যের চিত্রনাট্য।

    ‘রাণু! প্লিজ শোন। তাকা আমার দিকে।’ খুব অসহায় একটা আর্তি নিয়ে বলছিল রফিক— ‘লক্ষ্মীসোনা। বেশি সময় নেই। অমরেশরা যে কোনও সময় ফিরে আসবে। তার আগে তোকে কতগুলো কথা বলা দরকার। যদি সবটা না বলতে পারি, সময় না থাকে, সেইজন্য তোকে একটা চিঠি লিখে এনেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দ্যাখ।’ ও জামার বুকপকেট থেকে একতাড়া কাগজ বার করছে।

    সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছে না নয়নতারা। রফিকদা চিঠি লিখেছে ওকে? যার জন্য ভিতরে-ভিতরে পাগল হয়ে আছে, এক টনটনে ব্যথায় ভরে আছে মন, সেও তাহলে…

    থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে ষোলো বছরের মেয়েটার। রফিকের হাত থেকে চিঠি নিয়ে ও চালান করে দিচ্ছে বুকের ভিতরে ব্লাউজের ফাঁকে। চিঠি দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে রফিকের আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর আঙুলগুলো। রফিক হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে ওর হাতের তালু। ‘এ কী! একদম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে তোর হাতটা! পাগলি মেয়ে একটা। ভয় পেয়েছিস?’

    ‘তুমি বুঝতে পেরেছিলে রফিকদা? তুমি…’ রফিকের হাতের একটা চাপে বন্ধ করে দিচ্ছে ওর মুখ। ‘চুপ। সব বুঝেছি আমি প্রথম থেকে। এ-সময় কোনও কথা বলতে নেই। এটা একটা আশ্চর্য মুহূর্ত। আ রেয়ার গিফ্‌ট ফ্রম গড। এই সময় উপলব্ধি করার সময়। সারা জীবন খুঁজেও এই ঐশ্বর্য ভাগ্যে জোটে না।’ ওর হাতে অল্প একটু চাপ দিয়েছিল রফিক। প্রথম স্পর্শ। শেষ স্পর্শও। যদিও তখন তা বুঝতে পারেনি রাণু বলে বোকা মেয়েটা। নতুন ভালবাসা সুগন্ধি মোড়কে ধরা দিয়েছিল তার কাছে। তার ঘ্রাণ নিতেই ব্যস্ত ছিল পাগলি মেয়ে। বড়দা ফিরে এসেছিল অবুকে নিয়ে।

    ‘উফ! এ-ছেলেটা লাইফ হেল করে দিল। যেই বড় বাথরুম শেষ হল, তখন বলে আইসক্রিম খাব। তারপর আইসক্রিম খাওয়া শেষ হতে তার আবার বাথরুম পেল। তোরা নিশ্চয়ই ওয়েট করে-করে বোর হয়ে গেছিস? চল, চল বটগাছের স্ট্রাকচার তো এতক্ষণে মুখস্থ হয়ে গেছে। এবার বাড়ি চল। রফিক, তোর ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েছিস তো?’

    তোড়ে কথা বলছিল বড়দা। ‘তাড়াতাড়ি কর। দেরি হলে মা’র মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে। কাল আবার দোল। দেখে এলাম হোস্টেলের ছেলেরা হুল্লোড় মাচাচ্ছে।’

    রফিকদা খুব মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘আজ আর তোদের ওখানে যাব না অমরেশ। আমার একটু কাজ আছে।’ ওর বাদামি চোখের মণিতে একটু বিষণ্ণতার আভাস বড়দার চোখে অবধি ধরা পড়েছিল।

    ‘হ্যাঁ রে! তোকে এরকম ডিপ্রেস্‌ড লাগছে কেন? শরীর খারাপ করল না কি?’

    ‘না না, জাস্ট কতগুলো পেন্ডিং কাজ’ অজুহাত দিয়েছিল ও।

    নয়নতারা অন্যদিকে তাকিয়ে গভীর অভিনিবেশ সহকারে বটগাছটা পর্যবেক্ষণ করছিল। ফেরার সময় বড়দা মাথা নাড়াতে-নাড়াতে বলছিল, ‘কী হল বল তো কেসটা? রফিকটা আজ এল না কেন? রাণু, তোরই বা কী হল? এত চুপচাপ কেন সবাই?’

    ‘ওরা চলে গেলে চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে ওরা পৌঁছে গেছিল শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছটার কাছে’

    অবু ফিক করে হেসে বলেছিল, ‘বড়দা, দিদিভাই বোধহয় গম্ভীর ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছে। কী গম্ভীর!’

    নয়নতারা ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল, ‘তুই চুপ কর তো! আমাকে তোমরা অসম্ভব উচ্ছ্বসিত হয়ে আমোদ করতে দ্যাখো বুঝি সবসময়?’

    ওর কথার ধরনে বড়দা হেসে ফেলেছিল। নয়নতারা বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। চুপচাপ, অন্তর্মুখী। বড়দা বাড়ি গিয়ে ন্যাড়াপোড়ার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে ছোট্ট খিঁচটুকু কর্পূরের মতো উবে গেছিল ন্যাড়াপোড়ার আগুনের সঙ্গে।


    কত বছর পরে যে নয়নতারা দমদমে এলেন! পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলার পর ফ্ল্যাট উঠল— তাও হয়ে গেছে বছর পঁচিশেক। এই পঁচিশ বছরে ভাইয়ের সংসারে নয়নতারা যে কতবার এসেছেন তা হয়তো এক হাতের কড় গুনেই বলা যায়। তাও অবু থাকতে বছরে একবার ভাইফোঁটা দিতে আসা হত। ভাই চলে যাবার পর যোগাযোগটা একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। অবু চলে যাবার পর এই প্রথম এলেন নয়নতারা। কৃষ্ণা আর মুনা বিজয়ার পর একবার হলেও আসে। মুনাই ড্রাইভ করে নিয়ে আসে মাকে। আজও মুনার গাড়িতেই গেছেন নয়নতারা। বিশেষ একটা কারণ আছে বলেই এতদিন বাদে এসেছেন তিনি। নয়তো গল্ফ গার্ডেন্স-এর বাসা থেকে তাঁকে নড়ানো যায় না বিশেষ।

    যতবারই এই ফ্ল্যাটবাড়িতে আসেন, কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে ভিতরটায়। মনে হয় আস্ত একটা বাড়ি, যার দেওয়ালের প্রতিটি ইঁট একদা তাঁর বেঁচে থাকার অংশ ছিল। তার জায়গায় মাথা তুলেছে বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ির জঙ্গল। আশপাশের বাড়িগুলোও ভাঙা পড়েছে এই বিরাট রিয়েল এস্টেটের চক্করে। পনেরো তলায় একই ফ্লোরে বড়দার একটা ফ্ল্যাট আর কৃষ্ণা আর মুনার ফ্ল্যাটদুটো। ওদের ফ্ল্যাটদুটোর মাঝখানে জোড়া লাগানো। একটা ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটে যাতায়াত করা যায়। মুনার ফ্ল্যাটের সামনের বড় একটা অংশ ঝোলানো টেরেসে কনভার্ট করা। এর উপরেই ছাদ। সর্বোচ্চ তলা বলে এই টেরেসটা অন্য ফ্ল্যাট থেকে দেখা যায় না। বরং একটা প্রাইভেসি আছে। মুনার ঘরের গেস্টরুমেই থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে তাঁর। মুনা খুব আমুদে মেয়ে। মা-মেয়ে দুজনেরই অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ও প্রথমেই বলে দিয়েছে, পিসিমণি এত বছর পর আসছে, আমার ফ্ল্যাটেই থাকবে। ফ্ল্যাট অবশ্য নামেই আলাদা। গতকাল আসার পর থেকেই কৃষ্ণা এসে আড্ডা জমিয়েছেন। ননদ-ভাজে বহুদিনের জমা কথা বলছেন অনর্গল। দোলের দিন বেরনো অসুবিধা বলে, আগের দিনই কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরার পথে মুনা নিয়ে এসেছে পিসিকে। পৌঁছতে-পৌঁছতে প্রায় ন’টা বেজে গেছিল। টিঙ্কু রান্না করে রেখেছিল। টিঙ্কু মেয়েটি ভারি হাসিখুশি। মা-মেয়ের বাড়ির ডাস্টিং, রান্না করা, অ্যাকোয়াগার্ড থেকে জল ভরে রাখা, সব কাজের জন্যই ওরা টিঙ্কুর ওপর নির্ভরশীল। কৃষ্ণা আর নয়নতারা পাশাপাশি বসে টিঙ্কুর রান্না করা ইলিশ মাছ খাচ্ছিলেন।

    ‘মাছটা বেশ টেস্টফুল না দিদিভাই?’

    ‘হ্যাঁ, নাগের বাজারের আগে ডান পাশে ওই যে মাছের বাজারটা ছিল, সেটা আছে এখনও?’ নয়নতারা জিজ্ঞেস করলেন।

    ‘কী জানি দিদিভাই! তোমার ভাই যতদিন ছিল, বাজারে গিয়ে দেখেশুনে কিনত। একদিন নাকি মাছওয়ালা বলেওছিল, বাবু, আপনারা যতদিন আছেন, ততদিনই এরকম টিপে-টিপে দেখে, কানকো তুলে মাছ কিনবেন। এরপর তো কেউ এসবের ধার ধারবে না। সেই শুনে বাড়ি এসে ওর কী রাগ! জলজ্যান্ত বেঁচে আছি, ছাত্র পড়াচ্ছি, চাকরি করছি, ব্যাটা বলে কিনা আপনারা যতদিন আছেন! কেন, আমাকে দেখে কি থুত্থুড়ে বুড়ো বলে মনে হয়?’ কৃষ্ণা হেসে বলছে, ‘অথচ দ্যাখো, কী অদ্ভুত ব্যাপার! মাছওয়ালার মুখের কথাটাই সত্যি হল। ষাট বছর হতে-না-হতে লোকটা চলে গেল। রিটায়ারমেন্টের পর দু’মাসও কাটেনি। কৃষ্ণা একটা লম্বা শ্বাস ফেলল— ‘আর সত্যিই আমিও এখন আর বাজারে গিয়ে মাছ-সবজি কিছুই কিনি না। বেশিরভাগই মুনা অনলাইনে আনায়। সবজি তো অর্গ্যানিক ছাড়া আসেই না এখন। কী না কী সব কেমিক্যাল মেশানো থাকে সস্তার সবজিতে। তাই চার গুণ দাম দিয়ে একটা কোম্পানির অর্গ্যানিক প্রোডাক্ট আনায়। আর একটা চেনা মাছওয়ালাকে ফিট করেছে। সে সপ্তাহের মাছটা শনিবার সাপ্লাই দিয়ে যায়। ইলিশটা অবশ্য মুনা ডায়মণ্ডহারবার থেকে নিয়ে এসেছে। প্রচণ্ড সস্তা আর ফ্রেশ। ওদের প্রোডাকশন টিম কোনও ছবির রেকি করতে গেছিল ওখানে। ফ্রেশ ধরা মাছ দেখে অনেকটা নিয়ে নিয়েছে মুনা। তুমি যাবার সময় দিয়ে দেব কয়েকটা পিস, বুম্বা, সুতপাদের জন্য।’

    ‘মুনা নিজে খেতে বসবেই না? শুধু মাছটাও তো খেতে পারত?’ নয়নতারা বললেন।

    ‘ও বাবা!’ কৃষ্ণা ঠোঁট উল্টোচ্ছেন, ‘মুনার প্রচণ্ড বায়নাক্কা। তোমাকে তুলতে গিয়ে ওই যে তোমার ওখানে খেয়েছে, ব্যাস ওতে ওর ডিনার হয়ে গেছে। সাতটার মধ্যে যা খাবার খেয়ে নেয় ও। তারপর ষোলো ঘণ্টা কিচ্ছু দাঁতে কাটে না। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। তার পরে জিম, অ্যারোবিক্স, এসব তো আছেই। একটা মিষ্টিও ছুঁয়ে দেখে না। ক্যালোরি বেড়ে যাবে। এই যে এত মিষ্টি এনেছ, একটাও হয়তো খাবে না ও।’

    ‘ও না খেলে না খাবে। তুমি খেয়ো আস্তে-আস্তে। টিঙ্কুকে দিও। তোমার বাড়িতে লোকজনও তো আসে খুব। তাদের দিও।’

    ‘হ্যাঁ, মুনার বন্ধুবান্ধব, প্রোডাকশনের লোকজন— আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। ওরাই হইচই করে খাবে। আমার তো হাই সুগার জানোই। খুব মেপে খেতে হয়।’

    খাওয়ার পর কৃষ্ণার অংশের প্রশস্ত বসার ঘরে বসে গল্প চলছে। কৃষ্ণা বলল, ‘দিদিভাই, বেইলিজ খাবে না কি একটু? খেয়ে দেখবে?’ 

    ‘বেইলিজ কী?’ নয়নতারা শুধালেন।

    ‘লিকিওর। বেসটা হুইস্কি। সঙ্গে ক্রিম থাকে।’ কৃষ্ণা মুনার কাছ থেকে লব্ধ জ্ঞানে অনেক কিছু জানে। জীবনে কখনও মদ ছুঁয়ে দেখেননি নয়নতারা। তাঁর ছোটবেলায় মদ্যপানকে পাপ বলে মনে করা হত। বোধহয় বাংলা সিনেমার লম্পট ভিলেনরা মদ খেয়ে নেশায় চুর হবার স্টিরিওটাইপটার জন্যই।

    ‘কী জানি! খাইনি তো কখনও।’ একটু অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলছেন নয়নতারা।

    মুনা কী একটা খুঁজতে এসে মা আর পিসির কথোপকথন শুনে বক্তৃতার ঢঙে বোঝাচ্ছে পিসিকে, কেন যে কোনও নিষিদ্ধ জিনিসই জীবনে একবার হলেও চেখে দেখা উচিত। ‘যদি না খাও, তবে তো সারা জীবন ওই স্বাদটা জানাই হবে না পিসিমণি।’ মুনা মজা করতে পারে খুব। অবুটা ছিল মিচকে। তার সঙ্গে যৌবনের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস মিশেছে মুনার মধ্যে। কী ফ্রি আর ইজিগোয়িং এখনকার প্রজন্মটা, সেটা মুনাকে দেখে আরও একবার বুঝতে পারছেন নয়নতারা।

    প্রায় ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে ছোট্ট দুটো গ্লাসে বেইলিজ আইরিশ ক্রিম ঢেলে নিয়ে আসছে মুনা। কী সুন্দর গ্লাসদুটো!

    ‘আর নট দে কিউট? এগুলোতে লিকিওর খেতে হয়।’ মুনা বলছে।

    ‘সব মদের আলাদা-আলাদা গ্লাস বুঝলে দিদিভাই। বিয়ারেরগুলো লম্বাটে মাগ। ওয়াইনের গ্লাস আলাদা। রেড এক রকম, হোয়াইট আরেক রকম। হুইস্কির জন্য আবার বেঁটে-মোটা গ্লাস।’ কৃষ্ণা বলতে থাকে।

    ‘মা তুমি বরং এক কাজ করো। যে দু’দিন পিসিমণি থাকবে, সে-সময়টা তুমি ড্রিঙ্কস সার্ভিং-এর গ্লাস এবং ইন জেনারেল পার্টি ডু’জ অ্যান্ড ডোন্টস-এর বিষয়ে একটা ক্র্যাশ কোর্স দিয়ে দাও।’ চোখ সরু করে বলে মুনা।

    কৃষ্ণা এবার লজ্জা পেল। ‘যাঃ, এসব কি আর আমাদের ছাপোষা গেরস্ত ঘরে জানার কথা? দিদিভাই গ্লাসটা অ্যাপ্রিশিয়েট করল, তাই বলছি আর কি!’

    ‘এখনও তো আসলি মালটাকেই অ্যাপ্রিশিয়েট করেনি পিসিমণি। পিসিমণি খাও, খাও। ছোট্ট করে একটা সিপ দাও। তবে তো মজাটা আসবে।’

    ছোট্ট একটা চুমুক দেন নয়নতারা। মিষ্টি অথচ ঝাঁঝালো, ঘন একটা তীব্র স্বাদের তরল গলা দিয়ে নেমে যায় নয়নতারার।

    ‘কী বুঝলে?’ মাস্টারের মতো জানতে চায় মুনা।

    ‘প্রচণ্ড ঝাঁঝ। কড়া বেশ। একটু কষকষে আবার মিষ্টিও আছে। ঠিক বুঝতে পারছি না।’ নয়নতারা বলেন।

    মুনা মুচকি মুচকি হাসে, ‘বুঝবে, বুঝবে। যত খাবে, একটু-একটু করে বুঝবে। আস্তে-আস্তে ইট উইল গ্রো অন ইউ। লাইক লাভ। বুঝলে? প্রেমে যেমন ঝাঁঝও আছে, একটু কষটা, কিন্তু মিষ্টিও থাকে তেমনি। মিঠেকড়া ব্যাপারটা টেস্ট না করলে অজানাই থেকে যায়। প্রেমের মতোই। অ্যাকোয়ার্ড টেস্ট।’

    ‘তুই খাবি না?’

    ‘না গো পিসিমণি। ক’মাস ধরে এইসব সুখ বর্জন করেছি আমি। স্যাচুরেটেড উইথ এভরিথিং গুড ইন লাইফ। কোনও কিছুরই ওভারডোজ হয়ে যাওয়া ভালো নয়। এত হাই ক্যালোরি ইনটেক সহ্য হবে না আমার। তোমরা গল্প করো। আমি একটা কাজ ওয়াইন্ড আপ করি, কেমন?’ মুনা নিজের ঘরে চলে যায়।

    কৃষ্ণার সঙ্গে বসে চুকচুক করে আইরিশ ক্রিম খেতে-খেতে এটা-ওটা নানা কথা মনে পড়ে নয়নতারার। যে সাবেকি বাড়িতে মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল, আজ ঠিক সেই জায়গায় মাথা তুলেছে এই ফ্ল্যাটবাড়ি, যার পনেরো তলায় সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে বসে বহুদিন আগের সেট করা রুলগুলো ভাঙছেন তিনি। অবশ্য জীবনে তো অনেক যুক্তিহীন নিয়মই ভেঙে যাচ্ছে এখন। এই যে তাঁরা দুই বিধবা ননদ-ভাজে খাবার টেবিলে বসে একটু আগে আরাম করে ইলিশ মাছ-ভাত খাচ্ছিলেন, পঞ্চাশ বছর আগে তাও কি সম্ভব ছিল? নয়নতারার এখনও মনে আছে, বাড়িতে দাদুর এক দূর সম্পর্কের বোন এসেছিলেন বড়দা না কার পৈতে-তে। অল্পবয়সে বিধবা সেই মহিলা মাছ খেতেন। মা পরিবেশন করার পরে ঠাকুমার কাছে গজগজ করেছিল, সম্পর্কে পিসিশাশুড়ি ওই মহিলার পাতে মাছ পরিবেশন করতে হয়েছে বলে। তাঁদের ব্রাহ্মণ বাড়িতে এসব নিয়মের বেশ আতিশয্য ছিল তখনও। তার দশ-বারো বছর পরে নয়নতারার বিয়ের সম্বন্ধ দেখার সময় নিয়মের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়েছিল। অমলজ্যোতিকে দেখে বাবা মন্তব্য করেছিলেন, ‘সৎপাত্রই একমাত্র বিবেচ্য, মেয়ে বামুনের ঘরে পড়ল না কায়েতের ঘর করল, তাতে কিছু যায় আসে না। ছোড়দা আর অবু দুজনেই অসবর্ণ বিয়ে করেছিল।’

    নয়নতারার লিকিওরটা খেতে এবার বেশ ভাল লাগছে। কানদুটো গরম হয়ে গেছে। একটু-একটু নেশায় বেশ ফুরফুরে লাগছে তাঁর। বেশ রঙিন বলে মনে হচ্ছে চারপাশটা। সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে দূরে দু-একটা রঙিন ফুলে ভরা গাছ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। কৃষ্ণা অন্য একটা সোফায় শুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। একটু-একটু নাক ডাকছে ওর। থাক, ওকে আর ডাকার দরকার নেই। ঘুমোক বেচারি। নয়নতারা উঠে পা ঘষটে-ঘষটে তাঁর জন্য সাজিয়ে রাখা গেস্টরুমটাতে চলে যাচ্ছেন। নিজের বাড়িতে হলে সকাল-সকাল উঠে পড়েন। এ-বাড়িতে কাল একটু দেরিতে উঠবেন ঠিক করেই রেখেছেন। মুনা আদর করে বলেছে, ‘পিসিমণি, এটার জমিতে তো এক সময় তোমার বাপের বাড়ি ছিল। এখনও ট্রিট দিস প্লেস অ্যাজ ইওর বাপের বাড়ি।’ পাল্টে যাওয়া নতুন বাপের বাড়িতে দুগ্ধফেননিভ নরম গদিতে শুয়ে পুবের আকাশটা অনেকখানি দেখতে পাচ্ছেন নয়নতারা। প্রায় পূর্ণ চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে দিগন্তরেখার অনেক উপরে। নয়নতারার বিছানায় শুয়ে মনে পড়ল আজ ছিল আটই মার্চ। ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্‌স ডে। পৃথিবী জুড়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। প্রতিবাদ করছে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক ব্যবহারের, যুগসঞ্চিত শৃঙ্খলার পাথর সরিয়ে সোচ্চার হচ্ছে সমানাধিকারের দাবিতে, প্রথা ভাঙছে, ভেঙে যাচ্ছে তাদের বাড়তে না-দেওয়ার জন্য সযত্ননির্মিত কাচের দেওয়াল। গ্লাস সিলিং ভেঙে ভারতবর্ষের মেয়েরাও আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিস্পর্ধার। আজ শুধু মেয়েরাই ট্রেন চালিয়েছে, এক ঘণ্টার জন্য বিমানবন্দরের এ.টি.সি. ছিল পুরোপুরি মহিলাদের হাতে, পার্ক সার্কাস থেকে শাহিনবাগ অবধি ধর্নায় বসেছে, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে মেয়েরা, তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার দাবিতে। মুনা খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল এসব বলার সময়।

    পূর্ণিমা-ছোঁওয়া চাঁদের দিকে তাকিয়ে এসব কথাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। নয়নতারা হিসেব করার চেষ্টা করছেন ঠিক কত বছর আগে দোলের আগের সন্ধেয় সেই কিশোরী শেষবার রফিকদাকে দেখেছিল। তারপর দোলের দিন যখন পশ্চিমে সূর্যাস্তের আভা পুরো সরে যায়নি, আর পুব আকাশে বিশাল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, ঠিক সেই সময়ে বাড়ির ছাদে বসে খুলেছিল চব্বিশ ঘণ্টা যত্ন করে লুকিয়ে রাখা রফিকদার চিঠি। রফিকদা কি একটু আতর মাখিয়ে দিয়েছিল কাগজে? না কি নয়নতারারই মনের ভুল? হয়তো ভালবাসলে বুকের ভিতর অমন গন্ধ হয়। সেই সুগন্ধ, যা ছড়িয়ে যেতে থাকে চিঠির মধ্যে, হাওয়ার মধ্যে, দূরদূরান্তরে।

    কাল আটান্ন বছর পরে দেখা হবে রফিকদার সঙ্গে। রফিকদা দেখতে চেয়েছে নয়নতারাকে। জানতে চেয়েছে সে কেমন আছে। মুনা তাই স্কাইপ ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেবে দুজনের। রফিকদাকে এই তিরাশি বছর বয়সে কেমন দেখতে হয়েছে কে জানে? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে নয়নতারার, রফিকদা কেমন আছে। সেই রফিকদা, যে পাঁচ পাতা জোড়া একটা বিশাল চিঠি লিখেছিল নয়নতারাকে। সেই পাঁচ পাতা পরবর্তী দু’তিন বছর ধরে পড়ে-পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছিল সেই মেয়েটার।

    – – – – – – – –

    ঘুমিয়ে পড়েছেন নয়নতারা, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তিনি। জ্যোৎস্না পড়েছে তাঁর বলিরেখাদীর্ণ ঘুমন্ত মুখের উপর।

    বহুদিন বাদে বাপের বাড়ির জমিটির সংলগ্ন ফ্ল্যাটে রাত কাটাচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন দেখছেন আটান্ন বছর আগের সেই বাড়ির ছাদের। ঠিক একইরকম রয়েছে ছাদটা। সময়ের শ্যাওলা ছুঁতে পারেনি ছাদটাকে। দুটো মোড়া টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। কিশোরী মেয়েটার শ্যামলা মুখে ঝুপসি হয়ে থাকা চুলগুলো উড়ে এসে ঢেকে দিচ্ছে কপাল, চোখ। অদূরে বসে থাকা যুবকটির ঘাড় অবধি লাল চুল, বাদামি চোখের মণিতে বিষণ্ণতা জমাট বেঁধে আছে, নয়নতারা একাগ্র ভাবে তাকিয়ে আছেন দৃশ্যটির দিকে। সূর্যাস্তের রেশ একটু লেগে গেছে পশ্চিম আকাশে। পুবের আকাশে দোলপূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে লালচে থালার মতো। অল্প-অল্প হাওয়া দিচ্ছে দক্ষিণ থেকে। খুব আরাম লাগছে নয়নতারার। রাণু নামের কিশোরী আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেছিলে রফিকদা?’ রফিকদা হাত বাড়িয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলোয়, ‘ধুর পাগলি! এই তো আমি তোর কাছেই আছি…’

    ‘তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে বলে আর বড় হইনি। দ্যাখো সেই একই রকম রয়ে গেছি।’

    রফিক হাসছে। স্বপ্নের মধ্যে ওর বিষণ্ণ হাসি।

    তাও কাঁদে কেন অবুঝ পাগলি মেয়েটা? ঘুমের ঘোরে বালিশ ভিজে যাচ্ছে নয়নতারার। হাতড়ে-হাতড়ে সমানে খুঁজে চলেছেন সেলফোনটা। টুম্পাকে ফোন করতে হবে। ছোট্ট মেয়েটা সমানে ঘ্যানঘ্যান করে পাগল করে দেয়। ফোন করে ওকে বলবেন, ‘বাড়ি ফিরে তোকে একটা চমৎকার গল্প বলব রে টুম্পা।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook