ঘটি-বাঙালের রান্নাযুদ্ধ
ষাট ও সত্তরের দশকে আমার বাল্যে ঘটি-বাঙালের রেষারেষির উত্তাপ আমাদের চলমান জীবনে ভাল রকমই ছিল। দু’আড়াই দশক আগে দেশভাগের বাস্তুহারারা ‘এপার’-এর জীবনে থিতু হওয়ার আগেই এসে গেছিল শরণার্থীদের এক নতুন প্রবাহ। ‘ডার্বি’ বা ‘এল ক্ল্যাসিকো’ টাইপের সব নাম তখন চালু হয়নি বটে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচকে ঘিরে আকচা-আকচি একটা ফুটন্ত দাবদাহের মতো চলত, ইলিশ আর চিংড়ির প্রতীকী প্রতিস্পর্ধার বাজার তখনও যায়নি, দেশভাগ-উত্তর শরণার্থীরা এ-বঙ্গে ‘নতুন ইহুদি’ হিসেবে অনেক সময় যে-গঞ্জনা সহ্য করতেন, তার ক্ষোভ উগরে দিতেন ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে মোহনবাগানের সাপোর্টারদের ‘ছারপোকা’ বলে সম্বোধন করে। এখন অবশ্য সে-রামও নেই, সে-অযোধ্যাও নেই, আমরা রাত জেগে টেলিভিশনে ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার ফুটবল লিগ দেখি, আইএসএলের ‘এসসি ইস্টবেঙ্গল’ বনাম ‘এটিকে মোহনবাগানের’ ম্যাচে ভিড় হয়তো এখনও হয়, কিন্তু ঘটি ও বাঙালের মহারণের সেই ব্যঞ্জনাটি হারিয়ে গেছে। তবু, এই দুই রন্ধনশৈলীর যে বর্ণময় ইতিহাস আমাদের খাদ্যরুচিকে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে আমরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিতে যেতে পারি না।
পূর্ববঙ্গের কথা যেসব স্মৃতিকথায় আছে, সেখান থেকে স্থানীয় খাদ্যরুচির বেশ খানিক আভাস মেলে। রানী চন্দের ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’তে যেমন রয়েছে ঢাকা সদর থেকে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী হয়ে বিক্রমপুরে মামাবাড়ি যাওয়ার সময় নৌকোয় মাঝিদের হাতে হলুদবাটা-কাঁচালঙ্কা দিয়ে ইলিশমাছের ঝোল (পাতলা ইলিশের ঝোল দিয়ে নৌ-ভোজনের কথা ‘জীবনের জলছবি’তে লিখেছেন প্রতিভা বসুও), আর মামাবাড়ি পৌঁছে ঢেঁকিশাক, গিমাশাক, পানিকচু, কচুর লতি, বেতের কচি ডগাসেদ্ধ, শাপলার ডাঁটা, ইত্যাকার খাবার খাওয়ার কথা, খালবিল-নদীনালা পরিবেষ্টিত গ্রামাঞ্চলে যা ছিল সুলভ। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’তে তিরিশের দশকের কুমিল্লায় মামাবাড়ির আদরের সুখস্মৃতি প্রস্ফুটিত হয়েছে রুই কাতলা চিতল মহাশোল চিংড়ি পাবদা বাচা পার্শে দিয়ে সাজানো এক মৎস্যমহোৎসবে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর আত্মকথা ‘নীরবিন্দু’তে গ্রামীণ ফরিদপুর সম্পর্কে যা লিখেছেন তা বরিশাল ইত্যাদি অঞ্চল সম্পর্কেও প্রযোজ্য – বাড়িঘর প্রায়ই হত নাবাল অঞ্চলে, তাই বর্ষায় পুকুর ভাসিয়ে ঘরের আঙিনায় চলে আসত পুঁটি ট্যাংরা শোল কই খলসে শিঙি মাগুর ছাড়াও হাজার কুচো মাছ। জলবেষ্টিত সেই বাল্যে ছ’বছর বয়স হওয়ার আগেই তিনি যে বঁড়শি ছাড়াও বাঁশ বা বেতের তৈরি পলো বা ওচার সাহায্যে মাছ ধরতে শিখে যাবেন, তাতে তাই আশ্চর্যের কিছু নেই। হরিআনন্দ বাড়রীর ‘আমার বিক্রমপুর’-এ রয়েছে সকালে পান্তাভাত ও আগের রাতের উদ্বৃত্ত মাছের ঝোল থেকে শুরু করে দিনে চার বার মাছ-ভাত খাওয়ার কথা, যা পূর্ববঙ্গের অনেক জায়গাতেই ছিল ‘টিপিক্যাল’। আমার দাদুর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে পড়েছি যে, কই শিঙি মাগুর খলসে চিংড়ি ধরনের ছোট মাছ ওজনে বিক্রি হত না, হত ‘কুড়ি’ দরে, যে ‘কুড়ি’র ‘ইন্টারপ্রিটেশন’-এর অদলবদল ছিল পূর্ববঙ্গের নৈমিত্তিকতারই অংশ। নীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁদের বাল্যে ‘কুড়ি’ ছিল আসলে বত্রিশ, তার উপর আবার মিলত এক-আধটা ফাউ। এই প্রাচুর্যের কারণে মাছের তেলের বড়া, মাছের ডিমের টক, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক বা শাপলা, মাছের শুক্তো, এ-সবই ছিল বাঙালদের সিগনেচার রান্না। নিরামিষের মধ্যে বাঙাল রন্ধনশৈলীর সিগনেচার টিউন পাওয়া যাবে উচ্ছে দিয়ে তেতোর ডাল, বা ঝোল-তরকারিতে ধনেপাতার ব্যবহারের মধ্যে– যে-ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উত্তর ভারতের অনেক মিল। বস্তুত প্রতাপকুমার রায় তাঁর ‘মহাভোজ রাজভোজ’ বইটিতে চল্লিশের দশকের কাশীতে ছাত্র থাকার সময় হস্টেলের খাবারে ধনেপাতার উত্তর ভারতীয় অতিব্যবহারকে বিজাতীয় মনে করেছিলেন, তখনও পর্যন্ত তাঁর পশ্চিমবঙ্গীয় রসনারুচি এই স্বাদে অভ্যস্ত ছিল না।
তুলনায় মাংস খাওয়া হত কম, কারণ রোজকার বাজারে মাংস ছিল অমিল, পুজো বা উৎসবের পাঁঠাবলিই শুধু এই সুযোগ এনে দিত কালেভদ্রে। তবু অনেকদিন পর্যন্ত মাংসভক্ষণে পশ্চিমবঙ্গীয় মহিলাদের অনীহার পাশাপাশি পূর্ববঙ্গে মাংস যে একেবারে অচল ছিল তা নয়। পাঁঠার বিকল্পদের মধ্যে বেশ চলত পুকুরের হাঁস– রেণুকা দেবী চৌধুরানীর লেখায় রয়েছে ময়মনসিংহে তাঁর শ্বশুরালয়ের রান্নাঘরে চালান হওয়ার আগে বেশ কিছুদিন হাঁসকে শুধু দই খাইয়ে তার মাংস নরম করার এক অকরুণ প্রয়াসের নির্মোহ বিবরণ। ‘বাঙাল’-এর মাংসভোজের ইতিহাসে আর যে-প্রাণীটি বার বার নিজেকে আত্মাহুতি দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছে, সে হল ‘কেঠো’ বা ‘কাউঠ্যা’, অর্থাৎ ছোট কাছিম, কার্তিক-অগ্রহায়ণে পূর্ববঙ্গের অসংখ্য খালবিলে যারা ঘুরে বেড়াত। পূর্ববঙ্গের বহু আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় পড়েছি কেঠো রেঁধে খাওয়ার কথা, রানী চন্দের বইতে পড়ে চমৎকৃত হয়েছি যে পূর্ববঙ্গের গৃহস্থের বাড়ির পিছনের দিকে সাজানো হত হজম-করে-ফেলা কেঠোর খোল দিয়ে তৈরি-করা এক বহুবর্ণ প্রদর্শনী, স্থানীয় সিঁধেল চোরদের জন্য যা ছিল এক অলুক্ষুণে টোটেম।
মনপ্রীত জানেজা তাঁর Transactions in Taste: The Collaborative Lives of Everyday Bengali Food নামের বইটিতে ঘটি-বাঙাল রান্নাবান্না-খাওয়াদাওয়ার এক চমকপ্রদ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা যে রান্নায় অপেক্ষাকৃত বেশি চিনি দেন, তা পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশিদের কাছে প্রতিভাত হয় এই ব্যঞ্জনায় যে, তাঁদের কথাবার্তা মিষ্টি, কিন্তু সেই মধুর ব্যবহারের পিছনে আছে কুশলী চিন্তার ছক। বিপরীতে, ‘ওরা সব রান্নাতেই ঝাল দেয় বেশি’– এই ধরনের বাক্যবন্ধের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে এই ধারণা যে, পূর্ববঙ্গীয়/ বাঙাল/ বাংলাদেশি/ মুসলিমদের মেজাজ তিরিক্ষি, তাঁরা বেশি ঝগড়াটে। এখানেই শেষ নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পোস্ত-প্রীতির যেমন নিষিক্ত হয়েছে এমন ধারণা যে পোস্ত দিয়ে ভাত খেয়ে অলস দিবানিদ্রায় গা এলিয়ে দেওয়াই কর্মবিমুখ ‘ঘটি’-র স্বভাব। এর বিপরীতে মোচা ও থোড় ঘন্টের মতো ‘লেবার ইনটেনসিভ’ রান্নার সঙ্গে ‘বাঙাল’দের আইডেনটিফাই করার মধ্যে পূর্ববঙ্গীয় মহিলাদের পরিশ্রম আর কর্মপটুত্বের এক স্বীকৃতি রয়েছে, যেমন রয়েছে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে চিতল মাছের মুইঠ্যা তৈরি করার মধ্যেও। বাঙালি মুসলিম রান্নায় পেঁয়াজ-রসুনের ব্যবহার নিয়েও এরকম সাধারণীকৃত ধারণা রয়েছে– ‘ওরা সব কিছুতে পেঁয়াজ রসুন দেয়, এমনকী ইলিশ মাছেও’, ধরনের বহুলপ্রচলিত বাক্য খাদ্যরুচির মাধ্যমে ‘ওরা’ আর ‘আমরা’র বিভাজন রচিত হয়ে চলে।
পূর্ববঙ্গের বহু আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় পড়েছি কেঠো রেঁধে খাওয়ার কথা, রানী চন্দের বইতে পড়ে চমৎকৃত হয়েছি যে পূর্ববঙ্গের গৃহস্থের বাড়ির পিছনের দিকে সাজানো হত হজম-করে-ফেলা কেঠোর খোল দিয়ে তৈরি-করা এক বহুবর্ণ প্রদর্শনী, স্থানীয় সিঁধেল চোরদের জন্য যা ছিল এক অলুক্ষুণে টোটেম।
কিন্তু স্থির প্রত্যয়ে জানি, অনন্ত বিশ্ববীক্ষার অধিকারী আমরা বাঙালিরা, তাই আমাদের মধ্যে অনেকে ইলিশ মাছে যদি পেঁয়াজ দেন, তা নিয়ে এত ছুঁৎমার্গের কী আছে সেটা আমার বোধগম্য হয় না। বস্তুত, এ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ নেই, অনেক হিন্দু বাঙালি ইলিশ মাছ রাঁধতে পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করেন, ভাপা ইলিশ ও ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাকে রসুনের ব্যবহার তো বহুবিস্তৃত, আর উত্তরবঙ্গের কোনও-কোনও জেলায় তাজা ইলিশের অভাবে নোনা ইলিশ, আর চট্টগ্রাম, সিলেট, বা নোয়াখালির দিকে ইলিশ-শুঁটকিতে তো পেঁয়াজ-রসুন অপরিহার্য। বস্তুত, জেনে আদৌ অবাক হবেন না প্লিজ যে, প্রজ্ঞাসুন্দরীর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’-এর আমিষ খণ্ডটিতে ইলিশের মুষ্টিমেয় রেসিপিগুলির বেশ কয়েকটিতে পেঁয়াজ হাজির, রাজশাহীর দিঘাপতিয়ার জমিদারগৃহিণী কিরণলেখা রায়ের ‘বরেন্দ্র রন্ধন’-এ পেঁয়াজ-সংযোগে ইলিশের কালিয়া এক অনন্য উপস্থিতি, আর ‘ময়মনসিঙ্গি মাইয়া’ রেণুকা দেবী চৌধুরানীর ‘রকমারি আমিষ রান্না’য় পেঁয়াজ-রসুনই ঝোল-ঝাল-রসা-স্টু-কারি-ফ্রাই-রোস্ট সহ ইলিশের রকমারি অবতারের চড়নদার। তাই বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সম্পদের জাতধর্মগোত্রকুল নিয়ে বাজে তর্কে জল ঘোলা না করে তাকে রান্নাবান্নার এক ‘ইনোভেশন হাব’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই, সততই, চালাতে হবে।
এই সবের পাশাপাশি ঘটিদের রান্নাবান্নার মাইলফলক বলতে বিউলির (অর্থাৎ কলাইয়ের) ডাল আর পোস্তকে বাদ দিই কী করে? প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে মুদ্গ, মসুর, আর মাষ (কলাই)-এর নিয়মিত উল্লেখ থাকলেও, বাংলায় প্রথম বিউলির ডালের উল্লেখ দেখি কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-এর মধ্যলীলায়, যেখানে সার্বভৌম পঞ্চব্যঞ্জনের মধ্যে মহাপ্রভুকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন ‘মাষ বড়া’। এর পর ‘কাট টু’ ১৮৩১, যেখানে বাংলায় প্রথম প্রকাশিত রান্নার বই, বর্ধমানের রাজপরিবারের আনুকূল্যে প্রকাশিত ‘পাকরাজেশ্বর’-এর একটি কোণে জায়গা করে নিয়েছে মৌরি আদা হিং ও শেষে একটু ঘি-ছড়া দেওয়া– অথবা রকমভেদে দারচিনি লবঙ্গ কুঙ্কুমবাটা দেওয়া– মাষকলাইয়ের বিউলি, যে-রেসিপিতে তিন দশক পরের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এ যোগ হবে ঘৃতভর্জিত পলাণ্ডু, অর্থাৎ পেঁয়াজ। মোটামুটি ভাবে এই দুই ভিন্ন প্রকরণের– পেঁয়াজ দিয়ে বা পেঁয়াজ ছাড়া– কলাইয়ের ডালের রেসিপি পাচ্ছি বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক-প্রণালী’তেও। পেঁয়াজের ব্যবহার অতঃপর নিশ্চয়ই স্তিমিত হয়ে আসবে, তাই প্রজ্ঞাসুন্দরী বা কিরণলেখা বা রেণুকা দেবী চৌধুরানীর রান্নার বইতে এই ডাল প্রাণ পেয়েছে শুধু আদা-মৌরি-হিং-এর ত্র্যহস্পর্শেই। তবে পূর্ববঙ্গ, অধুনা বাংলাদেশের কোনও-কোনও জায়গায় আছে ইলিশমাছের মাথা দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল রাঁধার কায়দা।
আর আলুপোস্ত ঝিঙেপোস্ত পটলপোস্ত পেঁয়াজপোস্ত পোস্তর বড়া আজ যতই দুই গোত্রের বাঙালিরই হৃদয়হরণ করুক না কেন, তার সঙ্গে যে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে আফিম সেবনের বিষাক্ত ইতিহাস, সে-কথা ভুললে চলবে না। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনর অঞ্চল থেকে আরব বণিকদের হাত ধরে আফিমের ভারতে আগমন, অনেক দিন ধরেই ওষুধ ও ‘পেইনকিলার’ হিসেবে এর ব্যবহার চলত, তবে মুঘল অভিজাতশ্রেণিই সম্ভবত প্রথম গোষ্ঠী যাঁরা মাদক হিসেবে আফিম সেবনের পাশাপাশি পপির বীজ বেটে কোর্মার ‘গ্রেভি’কে ঘন করার চেষ্টা শুরু করেন। আর আঠেরো শতকের শেষ থেকে পর্তুগিজদের দেখাদেখি সদ্য-বিজিত বাংলায় ইংরেজরা ব্যাপক ভাবে চাষ করতে শুরু করেন আফিম, যার নেশা চিনেদের ধরিয়ে দিয়ে সেই পরিব্যাপ্ত মাদকাসক্তি থেকে লুটে-নেওয়া মুনাফা দিয়ে কেনা হবে চিনের অতুলনীয় চা, সিল্ক, বা পোর্সিলেন। চিনের রাজতন্ত্র উনিশ শতকে এই বলগাহীন মাদকাসক্তিকে প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় আফিমব্যবসা নিষিদ্ধ করলে সেখানে লেগে যাবে রক্তক্ষয়ী ‘আফিম যুদ্ধ’, কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই সময়েই পপির ‘ফেলাছাড়া’ বীজকে বেটে তাকে অসামান্য, অ-মুঘল প্রাত্যহিক রান্নায় ব্যবহার করতে শুরু করল বাঙালি। প্রথম দিকে অবশ্য পোস্তদানা ভাজা বা বাটা ব্যবহার হত চাটনির উপকরণ হিসেবে, তেঁতুল বা আমচুরের সঙ্গে, কখনও-বা নারকোলবাটা সহযোগে, যেমন দেখি বিপ্রদাসের বইয়ে। আলু বা ঝিঙে সহযোগে ‘চচ্চড়ি’ হিসেবে তার অত্যাশ্চর্য ‘মেকওভার’ সম্ভবত উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে। সবিস্ময়ে লক্ষ করি, যশোরের ডিএনএ শরীরে নিয়েও যে প্রজ্ঞাসুন্দরী রান্না শিখেছেন এপার বাংলার ঠাকুরবাড়িতে, তাঁর নিরামিষ খণ্ডের পোস্ত চচ্চড়িতে কিন্তু টিপিক্যাল পশ্চিমবঙ্গ-স্টাইল পাঁচফোড়ন নেই, আছে তিন ফোড়ন। অথচ ‘বাঙালবালা’ রেণুকা দেবী চৌধুরানীর বইতেই দেখছি পাঁচফোড়ন সহযোগে আলুপোস্তই শুধু নয়, রয়েছে ঝিঙেপোস্ত, পটলপোস্ত-সহ পোস্তর পাঁচমিশেলি প্রসার, ঠিক রাঢ়বঙ্গে যেমন রান্নার স্পেশাল কদর। তাই পেঁয়াজ ও ইলিশমাছের সম্পর্ক নিয়ে অহেতুক তর্কের মতোই, কলাইয়ের ডাল আর আলুপোস্তর মতো এক সম্মিলিত ও সীমানাহীন বৃহৎবঙ্গের কবচকুণ্ডল নিয়ে ঘটি-বাঙালের কাজিয়া লাগানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে মুদ্গ, মসুর, আর মাষ (কলাই)-এর নিয়মিত উল্লেখ থাকলেও, বাংলায় প্রথম বিউলির ডালের উল্লেখ দেখি কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-এর মধ্যলীলায়, যেখানে সার্বভৌম পঞ্চব্যঞ্জনের মধ্যে মহাপ্রভুকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন ‘মাষ বড়া’।
শেষ পর্যন্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের রান্নাবান্না-খাওয়াদাওয়ার কথা আলোচনা করতে গেলে অনিবার্য ভাবেই বোম্বেটেদের কথা এসে পড়ে। ভাবছেন এ আবার কী– আজকের দিনেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু-কিছু মিসোজিনিস্ট সদস্য বলেন বটে যে, কলহপ্রিয়া রমণীদের হাতের রান্নার স্বাদ বেশি হয়, কিন্তু তা বলে বোম্বেটে? শুনলে অবাক হবেন যে, নদীমাতৃক বঙ্গদেশে জলপথে যাতায়াতের ইতিহাসে যেসব রান্না অবিনাশী মিথের মর্যাদা পেয়েছে– যেমন গোয়ালন্দ চিকেন কারি– তাদের স্বাদ ও গন্ধের এক অনিবার্য উপকরণ হল জলদস্যু হার্মাদের ডিএনএ। এই চমকপ্রদ সম্পর্কের বীজ লুকিয়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন ব্রহ্মদেশের আরাকান অঞ্চলের ইতিহাসের মধ্যে। ষোলো শতকে ওই দ্বীপময়, সমুদ্রবেষ্টিত অঞ্চল দখল করেছিল পর্তুগিজরা, আর তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চলে ব্যাপক লুঠপাট চালাত স্থানীয় ‘মগ’ বোম্বেটেরা, যার থেকে ব্যাপক অরাজকতা বোঝাতে ‘মগের মুল্লুক’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি। আওরংজেবের সময় মুঘলরা আবার এই অঞ্চলের দখল নেয়, অতঃপর এই জায়গাটি বেদখল হয়ে চলে যায় ব্রহ্মদেশের হাতে। তারও বহুদিন পরে, ১৮২৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। চা এবং বর্মা টিকের ব্যবসার স্বার্থে ব্রিটিশরা গড়ে তুলল রেল সংযোগ আর স্টিমার ফেরি সার্ভিস। এমনিতেই তাঁদের রান্নার হাত ছিল বেড়ে, উপরন্তু লুঠেরা বোম্বেটে থাকার সময় পর্তুগিজ আর ওলন্দাজদের কাছ থেকে মগরা শিখেছিলেন ইউরোপীয় রান্নার হরেক করণকৌশল। তাই অবিভক্ত বাংলা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিস্তৃত অংশে একদা-বোম্বেটে মগদের চাকরি পাকা হল প্রধানত স্টিমারের বাবুর্চি হিসেবে, তাঁদের হাতের গুণেই সুরভিত হয়ে উঠত নারায়ণগঞ্জ চাঁদপুর বরিশাল মাদারিপুরের যাত্রাপথ, যে অবিস্মরণীয় গোয়ালন্দ চিকেন কারির স্বাদ গ্রহণ করেও তাকে নিজেদের রান্নাঘরে একই সৌরভে মুকুলিত করতে বিক্রমপুরের রন্ধন পটীয়সী গুণবতীরা কেন অপারগ, সে নিয়ে খেদ জানিয়েছিলেন স্বয়ং সৈয়দ মুজতবা আলী । বস্তুত ‘যবন’-এর খাদ্য মুরগি সম্পর্কে পুরনো সংস্কার সরিয়ে অনেক হিন্দুর সেই ভাবেই ‘দেশ’-এর পথে যাত্রাকালে সেই প্রথম অবিস্মরণীয় কুক্কুটভক্ষণ। শুনেছি দেশভাগের আগে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও, পদ্মা-যমুনার সঙ্গমস্থল গোয়ালন্দ ঘাট থেকে অন্য পারে আরিচা ঘাট– একদা যা ছিল উত্তরবঙ্গ ও অসমে যাতায়াত করার প্রধান পরিবহণ কেন্দ্র– পর্যন্ত স্টিমার ফেরিতেও মিলত ওই অঞ্চলের অনন্যসাধারণ পদ্মার ইলিশের ঝোল, যদিও সেটা মগরাই রাঁধতেন কি না জানি না। এই মগদের মধ্যে কেউ-কেউ ঔপনিবেশিক কলকাতার সায়েবি ক্লাবগুলিতেও রসুইকরের চাকরি পান, তাঁদের ঐতিহ্য মেনেই এখনও এসব জায়গায় কখনও-সখনও মেনুতে আবির্ভূত হয় অসামান্য গোয়ালন্দ স্টিমার ফাউল, ডাকবাংলা চিকেন, মাদ্রাজ ক্লাব কোর্মা বা রেলওয়ে মাটন কারি। তাই খানিক বঙ্কিমি কায়দায়, কিছুটা সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ গায়ে মেখেও বলতেই হয়, মগরা আদতে হার্মাদ বটে, কিন্তু রাঁধে অমৃত।
এ-কথা অনস্বীকার্য যে, ‘বাঙাল’ রান্না বলতে যা যা আলোচনা করলাম, সেগুলি প্রধানত বিগত দিনের পূর্ববঙ্গের প্রধানত হিন্দু ভদ্রলোকের পারিবারিক হেঁশেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাংলাদেশের বাঙালি মুসলিমদের বহুবিচিত্র ও পরিব্যাপ্ত রন্ধনশৈলীর আলোচনা করতে গেলে আরেকটা মহাভারত লিখতে হবে। বিশেষ করে সেই অঞ্চলের রকমারি কায়দায় শুঁটকি আর ভর্তা রান্নার এক বর্ণময় ও মমতামাখানো ইতিহাস। সেই ইতিহাস অন্যত্র বলা হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আপাতত আমাদের বিমিশ্র, প্রাকারহীন হেঁশেল ভরে উঠুক এপার-ওপার দুই পারের কূলপ্লাবী ঐশ্বর্যে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র