পালামৌ-র ফরেস্ট বাংলোর উঠোনে ‘স্টেটসম্যান’ কাগজ দাউ দাউ করে জ্বলছে। শেখর বলে, ‘সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ।’ পর্দা জুড়ে আগুন। কিন্তু এই আগুন এক মিথ্যে বিভ্রম মাত্র। সভ্যতার বিষ তাদের শিকড় পর্যন্ত নেমেছে। প্রশ্ন হল, কোন অরণ্যকে খুঁজছে তারা?
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির ক্রেডিট টাইটেলে শব্দের ফাঁকে ফাঁকে এক দ্রুত চলমান ভাসা-ভাসা মায়া-অরণ্যের আভাস। এই অরণ্য কি তবে শুধুই এক লিটারারি কনস্ট্রাক্ট? সঞ্জয় যাওয়ার পথে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পড়ে কেন? সে কি তবে সেটিকেই পুনর্নির্মাণ করতে চাইছে?
মহুয়ার রস খাওয়ার সময় অসীম বলে, ‘যত উঠছি, তত নামছি।’ অন্ধকারে একটি কালো ট্রেন আরও অন্ধকারে চলে যায়।
কোথা থেকে এল এই ট্রেন? কোনও আলো নেই কেন? আমাদের মনে পড়বে ‘পথের পাঁচালী’-তে দাওয়ায় বসে বাবার কাছে লেখাপড়া করতে করতে অপুর প্রথম রেলগাড়ির আওয়াজ শোনা এবং পরে রেলগাড়ি দেখার স্মৃতি, যা এক সুদূর নাগরিক সভ্যতার উদ্ভাস বয়ে এনেছিল। পরে ‘অপুর সংসার’-এ সেই অপু চরম বিষাদে ট্রেনে আত্মহত্যা করতে চায়। ট্রেনের পেটের মধ্যে তুলে ধরা হয় ‘নায়ক’ ছবির আত্মিক সংকট। আর আজ? এই কালি-লেপা ট্রেন কি শুধুই এই চার যুবকের বিষণ্ণ অবচেতন লিবিডো? একবুক অন্ধকার হাহাকার?
একটি শিশু (জয়ার ছেলে) হঠাৎ বন্দুকের গুলির মতো প্রশ্ন করে, ‘তোমরা— কে?’ চারজন থমকে যায়, দলের ভাঁড়টি অনিশ্চিতভাবে তোতলায়, বলে, ‘আমরা মানুষ’!
গভীর রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মাতালদের স্যানিটারি নাচ। সভ্যতার রিক্ততা অন্ধকার অরণ্যকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। আমরা শুনি, ‘হামলোগ সব VIP হ্যায়! Ve—ry Important Pee-pul’, যা মদমত্ত অবস্থায় স্পষ্টতই ‘ইম্পোটেন্ট’-এর মতো শোনায়। আমাদের মনে হয় আঁরি মিচোলো যেমন বলেছেন, সময়ের খিঁচুনিকে ধরতে চাইছেন সত্যজিৎ। এই ভয়ঙ্কর অসহায় চিত্রকল্প সভ্যতা ও অরণ্য সম্পর্কে অন্ধকারে যে প্রশ্ন তোলে তা সেলুলয়েড ছিঁড়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। যেন জালে বাঁধা কয়েকটি মানুষ, সত্যজিতের সার্চলাইটের সামনে অনিয়তাকার পদার্থের মতো কম্পমান।
ছবির ‘রাজনৈতিক’ পাঠকদের বলি, সাঁওতাল মেয়েদের সম্পর্কে প্রাক-নির্ধারিত ধারণা নিয়ে তারা এসেছিল। ছবি শুরু হয়েছিল সঞ্জীবচন্দ্রের উনিশ শতকে রচিত ক্লাসিক ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’ (১৮৮১-১৮৮২)-র বসুমতী সংস্করণ থেকে উচ্চস্বরে পাঠ দিয়ে। পাঠ করেছিল নারী-লাজুক সঞ্জয়, অর্থাৎ তাদের অরণ্য অভিযানের একটি প্রধান অন্তর্লীন কারণ ছিল ‘কক্ষ, বক্ষ উন্মুক্ত’ সাঁওতাল নারী, যা তাদের বিশ-শতকী অগভীর ও কৃত্রিম নাগরিক ধারণার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সঞ্জয় উচ্চকণ্ঠে পড়ে যায়, ‘বাঙালার ভাঁটিখানায় সেইরূপ মাতাল দেখা যায়, পালামৌ পরগণায় কোন ভাঁটিখানায় তাহা দেখিলাম না। আমি পরে তাদের আহার-ব্যবহার সকলই দেখিতাম, কিছুই তাহারা আমার নিকট গোপন করিত না।… কিন্তু স্ত্রীলোকদের কখন মাতাল হইতে দেখি নাই, অথচও তাহারা পানকুণ্ঠ নহে। তাহাদের মদের মাদকতা নাই একথাও বলিতে পারি না। সেই মদ পুরুষেরা খাইয়া সর্বদা মাতাল হইয়া থাকে।’
শেখর: বাবা, Western society…মেয়ে-পুরুষ সকলেই ড্রিঙ্ক করছে…
সঞ্জয়: মেয়েদের description শুনবি?
শেখর: বল।
সঞ্জয়: ‘সকলেই আবলুশের মতো কালো, সকলেই যুবতী—’
শেখর: মানে? Eternal youth?
সঞ্জয়: সকলের কটিদেশে একখানি করিয়া ক্ষুদ্র কাপড় জড়ানো, সকলেরই কক্ষ বক্ষ আবরণ শূন্য।
শেখর: হরে, তুই বাংলো থেকে বেরোসনি।
পরে সাঁওতাল মেয়ে দুলিকে (সিমি) দেখে শেখর বলবে: ‘মিস ইন্ডিয়া! ফোঁস করে ওঠে মাইরি!’
সময়গ্রন্থি পেরিয়ে নৃতাত্ত্বিক প্রতিস্থাপন যে পরিবর্তিত পৃথিবীতে রাজনৈতিক ভাবে ভুল হতে পারে, এ ধারণা এই যুবকদের ছিল না। সাঁওতাল মেয়েরা (শেখরের ভাষায় ‘peculiar’ টাইপের) যখন ঘর পরিষ্কার করতে ঢোকে, চারজন শহুরে মানুষের অস্বস্তিকর gaze এবং চেষ্টিত সংলাপ তাদের সীমাহীন অসংযুক্তিকে তুলে ধরে। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে সত্যজিতের ক্যামেরার সামনে খোলসের নীচে তাদের ঔপনিবেশিকতা-ছিন্ন সত্তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাদের মেকি, নিরালম্ব, ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব অরণ্যসকাশে মেশে না। একটি অদৃশ্য বেড়া অলঙ্ঘনীয় ভাবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
শেখর: ইয়ে রাস্তা পালামৌ যাতা?
পেট্রলওয়ালা: হাঁ বাবু।
শেখর: উঁহা জঙ্গল হ্যায়, জঙ্গল?
পেট্রলওয়ালা: হাঁ বাবু।
সঞ্জয়: তুই যে জঙ্গল জঙ্গল করে হেদিয়ে গেলি।
তারা জঙ্গলে হাঁটে টুরিস্টের মতো।
শেখর: Sunset! …এরকম Sunset কোথায় দেখা যায় বল তো!
সঞ্জয়: পৃথিবীর যে কোনও জায়গায়, কলকাতায় তো বটেই।
শেখর: Western বইয়ে। না রে, হরি?
হরি: Burt Lancaster-এর একটা বইয়ে ছিল।
এই বিপ্রতীপতা সারা ছবিতে এক বিপন্ন শূন্যতা সৃষ্টি করে যা সমাজ-ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক। যে-লুকনো ক্ষত থেকে নিঃশব্দে পুঁজ গড়িয়ে পড়ে, কেবলই গড়িয়ে পড়ে।
গাস্তঁ রবের্জ-এর মনে হয়েছে, সত্যজিৎ রায়ের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ (১৯৯১)-এ সভ্যতা সম্পর্কে যেসব তীক্ষ্ণ নৃতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার মেঘলা পূর্বাভাস ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকের গোড়ায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০)-তে আগেই উপস্থিত ছিল। সত্যজিতের বীক্ষণের সামনে নাগরিক সভ্যতার স্খলমান মুখোশমালা ধীরে ধীরে শূন্যতার এক ভয়ার্ত চিত্রপট তৈরি করে।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এদেশে সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে ‘অবহেলিত’ (তাঁর নিজের ভাষায়) ছবিগুলির মধ্যে একটি, এদেশে বিস্তর চালিয়াতকে আমি না-বুঝে গালমন্দ করতে শুনেছি; আর অন্যদিকে, অতলান্তিকের এপারে ও ওপারে (‘a rare wistful movie that proves it’s good to be alive’) বিশ্বচলচ্চিত্রের এক ঘোষিত অবিসংবাদিত ক্লাসিক, পাশ্চাত্যের প্রায় যে-কোনও গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম-ইন্সটিটিউটে যা পড়ানো হয়। সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে (১৯৭৭) এক সাক্ষাৎকারে দেশি ও পশ্চিমী সমালোচনার মৌলিক পার্থক্য কী জিজ্ঞেস করায় সত্যজিৎ বর্তমান আলোচককে বলেন :
Indian critics usually judge films (and mine are no exception) on the basis of its content. This is apparent even when the critics inject comment about editing, photography, mood, tempo etc. The approach, in other words, is a literary one. Western critics, as a rule, judge a film in its totality. That is why, a film like Aranyer Din Ratri (one of my best in my opinion) goes down well with foreign critics and is all but ignored by local ones.
(‘Palette’, St. Xavier’s College, Kolkata, 1977)
কথাগুলি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্র-সমালোচক পলিন কেল-এর মনে হয়েছে এটি সত্যজিতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি, ‘স্বচ্ছ এবং অন্তহীনভাবে সমৃদ্ধ’, যেটি দেখার জন্য ‘জেমস অ্যাগির বেঁচে থাকা উচিত ছিল, তা তাঁর স্বপ্নপূরণ করত।’ অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর) আর অসীমের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) কথোপকথনকে চলচ্চিত্রে নরনারীর গভীরতম সংলাপ বলে চিহ্নিত করেছেন কেল। আর তাঁর ‘দি অপু ট্রিলজি’ গ্রন্থে রবিন উড ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র স্নানের দৃশ্যটিকে চলচ্চিত্র-ভাষার উপস্থাপনার জ্যামিতিক সূক্ষ্মতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নমুনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘In fact, one would rate this lucid, ironic and superlatively graceful film among the very best of his work’, লিখেছেন পেনেলোপি হুস্টন।
কোনও আপাত মিল না থাকা সত্ত্বেও এ ছবির আঙ্গিকে ‘চারুলতা’-র মতো ছন্দ ও বিন্যাসের চুলচেরা নিপুণতা খুঁজে পেয়েছেন পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞেরা। অপু ট্রিলজি এবং প্রথম পর্বের অন্যান্য ক্লাসিকের চেয়ে ‘ঢের বেশি আত্মবিশ্বাসী’ সত্যজিৎ এখন সূক্ষ্মতা আর ভারসাম্য নিয়ে অনায়াসে পিয়ানোর রিডের মতো খেলা করছেন, মনস্তত্ত্ব আর শব্দ-নৈঃশব্দ্য মিশে যাচ্ছে প্রায় অবিশ্বাস্য এক সাবলীলতায়। ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর পর সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এই ছবিতে (যেরকম বাঁক-বদল ‘অপরাজিত’-র পর থেকে নিয়মিত সত্যজিতের বৈশিষ্ট্য) জীবন আর মানুষকে বিভিন্ন তল ও দিক থেকে বিচার করার তুঙ্গ-ক্ষমতা চিত্রশিল্পী পিয়ের বনার-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর ছবির সাংগীতিক কাঠামোর কথা, যেখানে ‘জ্যামিতিক শর্তগুলো পালন করে’ একটি সুর রন্দোর মতো ফিরে ফিরে আসে এবং নতুনতর ব্যঞ্জনায় বেজে ওঠে। ‘চারুলতা’-র সাড়ে চারশো-র বদলে এখন সাড়ে আটশোর বেশি শট। সত্যজিৎ ইচ্ছে করলে কীভাবে পুরনো ছক নয়-ছয় করে বোড়ে উলটে দিতে পারেন, তা আমরা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, বা ‘শতরঞ্জ..’-এ দেখেছি। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে তাঁর ক্ষিপ্রগতি চরিত্রায়ন এমন এক দ্রুত-লয় মোৎসার্টীয় সূক্ষ্মতায় পৌঁছয় (পেনেলোপি হুস্টনের ভাষায়, ‘exact pitch and balance’), যা সমস্ত পর্দা-ভাস্কর্যকে ছাপিয়ে যেতে চায়।
কলকাতা থেকে পালামৌ-তে ছুটি কাটাতে আসা চারজন সমবয়সি ভিন্নধর্মী যুবককে সত্যজিৎ comédie humaine-এর ভঙ্গিতে নির্মোহ ভাবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রাখেন, তাঁর ক্লাসিকাল ক্যামেরা-চোখের সামনে তাদের কৃত্রিম মুখোশ নিজেদের অজান্তে আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির মতোই শহর থেকে বাইরে প্রকৃতির পশ্চাদ্পটে টেনে এনে আতসকাচের নীচে রেখে, কিন্তু আরও বেশি চলৎপ্রবাহে, রনোয়ার-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘রুলস অফ দ্য গেম’-এর মতো। ‘পথের পাঁচালী’ থেকেই মাঝে মাঝে অনেক চরিত্রকে একযোগে মেলে ধরতে চেষ্টা করেছেন তিনি, বিশেষ করে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য়, তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে একটি ‘ensemble film’, যেখানে প্রায় সবসময়ই (এবং ভারতীয় ছবিতে হয়তো একমাত্র তাঁর ক্ষেত্রেই) একটি পার্শ্ব-চরিত্রও তুলসী চক্রবর্তী বা পাহাড়ী সান্যালের মতো বহুমাত্রিকতায় এঁকে দিতে পারে জীবনের চিহ্ন আর একটি পূর্ণতার বোধ।
একটি পুরুষ ও একটি নারীর পরিবর্তে চারজন পুরুষ এবং তিনজন নারী মিলে সবসুদ্ধ সাতজন আলাদা ধরনের এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে গ্রহণ করতে বাঙালি দর্শক প্রস্তুত ছিল না। চেখভ-এর ‘চেরি বাগান’ অথবা ‘তিন বোন’ নাটকের মতো জীবনধর্মী সাবলীলতায় সরল গতির বহুমুখী প্রতিধ্বনিময় আখ্যান নির্মাণ করা দুরূহ কাজ। তোতলানো রেঞ্জার সাহেব থেকে চৌকিদার এবং তার অনুপস্থিত ও অসুস্থ বউ একটি বহুকৌণিক ও মানবিক চিত্রভাষার ‘pure cinema’-র অংশ হয়ে থাকে। সত্যজিতের অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে মোৎসার্ট আর রনোয়ারের উত্তরাধিকার এক সূক্ষ্ম তারে মিশে যায়। ঘটনাহীন, কাহিনিহীন এক শূন্যতাকে বুনন করেন সত্যজিৎ। হাস্যরস এবং সিরিয়াসনেস মিশে যায়। চিত্রকল্পগুলি নিঃশব্দে জমাট বেঁধে থাকে।
তৈরি হয় নাগপাশের মতো নানা ছোট-বড় বৃত্ত। অরুণ মিত্রের কবিতার পংক্তি মনে পড়েঃ ‘সরলতা, তুমি আমাকে ফেলে কোন গহ্বরডিহায়?’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ওই চারজন যুবকের আদি বাসস্থান, মাসিক আয় এবং পারিবারিক আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ, কলকাতায় কোথায় থাকে তারা? যে-বিষয়ে সুনীল বিশেষ কিছু ভাবেননি। প্রথমে ট্রেনের কথাই ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। সুনীলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হাওড়া স্টেশনে কোথায় দেখা করবে তারা? তারা কি বাসে-ট্রামে, না ট্যাক্সিতে আসবে? বছরের ওই সময় পালামৌ-র গাছপালায় কত পার্সেন্ট পাতা ঝরে যায়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফ্রান্সের এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি এসব প্রশ্নের কথা চিন্তাও করেননি। সত্যজিৎ নিজে যেভাবে চরিত্রদের পুনর্নির্মাণ করবেন তার কিছু সূত্র তাঁর নোটবুক থেকে উপস্থাপন করেছেন অ্যান্ড্রু রবিনসন। আমরা লক্ষ করব, চরিত্রের বাকভঙ্গি, কথা, না-কথা, শব্দ, নৈঃশব্দ্য, পুঙ্খানুপুঙ্খ শরীরভাষার সঙ্গে তা মিলে যাচ্ছে। এক বিশেষ সময়ে এদের মনকে মনস্তত্ত্ববিদের মতো বুঝতে চেষ্টা করেছেন তিনি। ছবির পর ছবিতে এই চরিত্র-বীক্ষণ তাঁকে বিশ্বচলচ্চিত্রে অন্যতম পুরোধা করেছে। (এরিক রোড তাঁর চলচ্চিত্রের ইতিহাস বইয়ের ‘আন্তর্জাতিকতা’ অধ্যায়ে তাঁকে বার্গম্যান ও কুরোসাওয়ার সঙ্গে পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত এক নতুন দিশারি বলে অভিহিত করেন। শান্তিনিকেতনে পড়া পল রথার বিখ্যাত ‘ফিল্ম টিল নাও’ বইয়ের রিচার্ড গ্রিফিথ-কৃত নতুন সংস্করণের শেষতম বাক্যে তাঁকে আর কুরোসাওয়াকে হলিউডকে অতিক্রম করা বিশ্বের দুই শ্রেষ্ঠতম চিত্রনির্মাতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে)। তপন সিংহ যে মৃত্যুর আগে দূরদর্শনে বলেছিলেন, সারা জীবন তাঁর স্বপ্ন ছিল চলচ্চিত্রের পর্দায় ‘একটি চরিত্র তৈরি করা’, ‘যা আমাদের দেশে একমাত্র সত্যজিৎবাবু পেরেছেন’, তার হদিশ এখানে পাওয়া যাবে।
সত্যজিতের শুটিং নোটস :
অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়): চারজনের মধ্যে পয়সাওলা। একসময় সচ্ছলতা নিয়ে খানিক বিবেক-দংশন ছিল, কিছু (বামপন্থী) রাজনীতিও করে থাকবে, কিন্তু এখন একটি এস্টাবলিশমেন্টেরই অংশ। মেয়েদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তাদের সঙ্গে ব্যবহারের একটি প্রক্রিয়া তার আয়ত্তে, বেশ কিছু নারী-হৃদয় জয় করে থাকবে। কিন্তু এখনও বিয়ে করেনি। একটা ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আছে, কবিতার দিকে ঝোঁক। ভাল জামাকাপড় পরে— সে-বিষয়ে সচেতন। দামি সিগারেট খায়। আজকাল আর হালকা ম্যাগাজিন ছাড়া কিছু পড়ে-টড়ে না। বেড়াতে এসেছে, কারণ ১) সে তার নতুন গাড়ি চালিয়ে দেখতে চায় [ছবিতে এই নতুন গাড়ির ব্যাপারটা নেই]। ২) কর্পোরেট সেক্টরের ইঁদুর-দৌড় থেকে খানিকটা দায়মুক্ত হওয়ার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে।
সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়): এককালে অসীমের মতো রাজনীতি করত। কিছু মূল্যবোধ এখনও অবশিষ্ট রয়ে গেছে। মূলত চুপচাপ, সংকুচিত, ফলে আপসপ্রবণ। মেয়েদের বিষয়ে লাজুক। পড়াশোনার ঝোঁক। অনেক বিষয়ে জ্ঞান আছে। সহজ জীবন চায়, সুন্দরী মেয়েদের দিকে নজর আছে, কিন্তু যৌনতার ব্যাপারে সাহসী নয়। হয়তো সম্বন্ধ করে বিয়ে করবে। বেড়াতে বেরিয়েছে কারণ ১) জায়গা দেখতে ভালবাসে। ২) বিশ্রাম প্রয়োজন।
হরি (শমিত ভঞ্জ): মূলত খেলোয়াড়। ইন্টেলেকচুয়াল নয়। এক ধরনের সহজ বালকসুলভ আকর্ষণ আছে, যা কোনও কোনও মেয়ের ভাল লাগতে পারে। তার নিজস্ব শ্রেণির মেয়ের সঙ্গে হয়তো তার স্থায়ী জোট সম্ভব ছিল— কারণ মানুষটি আসলে ভাল। তার এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ আছে, যা সে বাইরের বিষণ্ণতার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায়। বেড়াতে যাওয়ার কারণ: সে প্রত্যাখ্যানকারী প্রেমিকাকে ভুলে যেতে চায়।
শেখর (রবি ঘোষ): উপভোগবাদী, সব কিছুতেই খুশি, হাস্যরস ভালবাসে, হতাশ (খুব সহজেই নৈরাশ্য দেখাতে পারে), একসঙ্গে অনেক কিছু করে, আপাতদৃষ্টিতে অভিযানপ্রিয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খানিকটা গোঁড়া। [ ছবির শুরুতে গাড়িতে পালামৌ আসতে আসতে সে-ই কিন্তু বলেছিল: ’তোদের এই প্ল্যান-ফ্যান না করে আসাটা… আগে থেকে চিঠি লিখে একটা ব্যবস্থা করা যেত না?’ অসীম উত্তর দিয়েছিল, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ লক্ষনীয় যে সেই আবার বলে: ‘আমার আবার স্কচ ছাড়া…’] আরও ছ’ইঞ্চি উচ্চতা বেশি হলে সে লেডিজ ম্যান হত। আপাতত সে মেয়েদের সঙ্গে দ্রুত বন্ধুত্ব করতে পারে, উপদেশ দিতে পারে, হ্যান্ডশেকের ভান করে মেয়েদের হাত ধরতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে নিজের ভূমিকায় সে খুশি, তার মনের মধ্যে কী হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। বেড়াতে আসার কারণ: বন্ধুরা তার সঙ্গ চায় সকলকে চাঙা রাখার ক্ষমতার জন্য।
‘আপাতদৃষ্টিতে’ শব্দটি খেয়াল করুন। সত্যজিতের অসাধারণত্ব এখানেই। মানুষকে পর্যবেক্ষণের সময়, নানা মাপের তুলি আর রং নিয়ে কাজ করেন তিনি। সামান্যতম সূক্ষ্মতা তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। পাশ্চাত্যে যে সমালোচকেরা এই ছবিতে চেখভীয় স্বচ্ছতা পেয়েছেন, তাঁরা সবসময় ধরতে পারেননি এর আলো-আঁধারি, ব্যক্ত-অব্যক্তের রহস্য। পলিন কেলের ভাষায়, ‘Satyajit Ray’s films can give rise to a more complex feeling of happiness in me than the work of any other director…No artist has done more than Ray to make us re-evaluate the commonplace.’ অপর্ণার বইগুলি দেখে অসীম বলে, ‘আপনাকে ঠিক বোঝা গেল না।’ এই না-বোঝা তাঁর চরিত্রগুলিকে গভীর ও জীবন্ত করে তোলে।
অতি সাধারণ ছোট ছোট অভিব্যক্তি, যেমন কুয়োতে অর্ধনগ্ন হয়ে চার যুবকের স্নান করার দৃশ্যে প্রতিটি প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য বিভিন্ন চরিত্রের ভিতর অবধি আলো ফেলে। ‘প্রকৃতির কোলে’ স্নান করার মুহূর্তে (এও এক বিভ্রম) সুন্দরী ও বিদুষী অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর) এবং জয়া (কাবেরী বসু) গাড়ি করে হরির ওয়ালেট ফেরত দিতে আসে (যা চুরি করার সন্দেহে ইতিমধ্যেই হরি লখাকে মেরেধরে তাড়িয়ে ছিল)। যুবকদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়: সঞ্জয় ঝটিতি কুয়োর পেছনে লুকোয়। সাবান-মাখা অবস্থায় খালি-গায় আন্ডারওয়্যার পরা বিব্রত অসীম অসহায় ভাবে চেয়ে থাকে। সমান বিব্রত শেখর-রূপী রবি ঘোষকেই অবস্থা সামলে নিয়ে বিকট পাশ্চাত্য অনুকরণে (প্রত্যেক বিদেশি সমালোচক শেখরকে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বর্জ্য পদার্থ হিসেবে অভিহিত করেছেন) ভদ্রতা করতে হয়। রবিন উড এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের দৃশ্যসংস্থাপনকে:
…একটি শটে ইমেজের সামনের দিকে গাড়িটিকে দেখা যায়। অপর্ণা পেছনের সিটে পর্দার ডানদিকে, যুবকদের দিক থেকে তার চোখ সরানো, মুখে স্বভাবগত দুর্বোধ্যতা। গাড়ির অন্য পাশে শেখর, মুখে অনুগ্রহধন্য হাসি, অথচ ভীষণ বিব্রত। পেছনের অংশে ইমেজের বাঁ দিকে দণ্ডায়মান অসীম গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে অপর্ণার সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু ভীষণ অসুবিধেয় পড়েছে। দূরে পশ্চাদ্ভূমিতে কুয়োর পেছনে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সঞ্জয় সম্পর্কে আমরা আগাগোড়া সচেতন; যদিও তাকে দেখা যাচ্ছে না, পর্দায় তার অদৃশ্য উপস্থিতি যথেষ্ট শক্তিশালী। পর্দার বাঁ ও ডান দিকে অসীম ও অপর্ণার অবস্থান পশ্চাদ্ভাগ-সম্মুখভাগ বরাবর একটি কাল্পনিক কর্ণ তৈরি করেছে। ফলে ইমেজটির সযত্ন নির্মাণ সকলের সলজ্জ নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শেখরের সদুদ্দেশ্য-জাত অতিশয়োক্তির বাড়াবাড়িকে তুলে ধরছে; সেই সঙ্গে অপর্ণার মুখ ঘুরিয়ে রাখা যুবকটি (অসীম) সম্পর্কে তার সচেতনতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কাজেই, দর্শকের প্রতিক্রিয়া একই সঙ্গে বিভক্ত হয়ে পড়ছে হাস্যরস আর স্পর্শশীলতায়, শটটির প্রতিটি বৈশিষ্ট্য অন্যটিকে প্রভাবিত করার দরুন যা সম্ভব হয়েছে। ভারসাম্য আর প্রতি-সংযোগের এই সূক্ষ্ম সাযুজ্য অসংখ্যবার ফিরে আসে এই ছবিতে, মোৎসার্টের সঙ্গে সত্যজিতের অন্তরঙ্গতা যেখানে ‘চারুলতা’-র চেয়েও স্পষ্ট। (‘অপু ট্রিলজি’, রবিন উড, মুভি পেপারব্যাকস, ১৯৭১, বাংলা অনুবাদ: চিন্ময় গুহ। ১৯৯২, পারুল প্রকাশনী, ২০১২)
রবিন উড আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন: ‘সত্যজিতের ছবিতে ক্যামেরার অবস্থান, গতিবিধি এবং সম্পাদনা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক নয়, এদের একটি মুখ্য সৃষ্টিশীল ভূমিকা আছে। ফলত, সামগ্রিক ফলটি শুধু অ-সাহিত্যিক (non-literary) নয়, অ-নাটকীয়ও (non-theatrical) বটে।… পৃথক, এমনকী পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে এই এককালীন সচেতনতা মোৎসার্টের অপেরার একটি বিশেষ গুণ।’ এই বহুকৌণিক সূক্ষ্মতা সত্যজিতের চিত্রভাষার প্রাণ।
সাংগীতিক স্থাপত্যে জ্যামিতিক বৃত্তের কথা ভাবুন। শুধু কুয়োর বৃত্ত নয়, বৃত্তাকারে বসা বিখ্যাত মেমরি গেম, ক্যামেরার বৃত্তাকার উন্মোচনের বিদ্যুৎঝলক, যেটি এই ছবির মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে পাঠযোগ্য। অপর্ণা এবং অসীমের মেধা ও মস্তিষ্কনির্ভরতা, লেবার অফিসার সঞ্জয়ের ছদ্ম-মার্কসবাদ, খেলোয়াড় হরির মেঠো সরলটা, শেখরের নির্বাচিত নাম ‘অতুল্য ঘোষ’ অথবা বিষয় হিসেবে ‘পোয়েট, ফিলজফার’-কে জকি-র সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া একটি সামাজিক পটচিত্রের মতো।
এর পর আছে সাঁওতাল নাচের নৃতাত্ত্বিক বৃত্ত, যার মধ্যে কখনও মিশে যেতে পারবে না চার যুবক। যে বৃত্তকে ঘিরে সত্যজিতের ক্যামেরার লেন্স চার যুবকের গভীর স্নায়ুশিরায় প্রবেশ করে। অরণ্য সমীপে চার যুবকের এই মর্মান্তিক ব্যর্থতা যে তৎকালীন ছদ্ম-বাম দর্শক বোঝেনি, তার জন্য কৌতুকে নাক কোঁচকানো ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা?
নাচের বৃত্তের সঙ্গে নাগরদোলার ঘূর্ণায়মান বৃত্ত। এবং তারপর সবক’টি চরিত্রের ছড়িয়ে যাওয়া, এবং সত্যজিতের অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নেমে আসা। এক মুখোশ-পরা একজিকিউটিভ, এক মুখোশ-পরা ছদ্ম-মার্কসবাদী, এক জুয়াবাজ। এক মেকি প্রেমিকার মেকি আভরণকে প্রত্যাখ্যান করা বিষণ্ণ একাকী খেলোয়াড়।
শেখরের জুয়ার বৃত্ত। যার কাছে আত্মাকে বন্ধক দিয়েছে সে। সমস্ত হাসি-মজার অন্তরালে এক শূন্যতা। ক্যামেরা তাকে দেখে। আসলে সে একা।
দুলি (সিমি গারেওয়াল) আর হরি। অন্তঃসারশূন্য, মেকি সভ্যতার মুখোশকে ঘৃণা করা (ছবির শুরুতে তপতী অর্থাৎ অপর্ণা সেনের পরচুলা খুলে নিয়েছিল সে) এবং অপর্ণা-জয়ার থেকে সচেতন ভাবে দূরে থাকা হরির পক্ষে দুলির প্রতি এই অমোঘ আকর্ষণ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এত সঠিক যে আমরা বিস্মিত হই না, হয়তো খানিকটা নিশ্চিন্ত হই। কিন্তু আমরা হতবাক হয়ে দেখি ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে হরি বলছে: ‘তোরা চুলে কী লাগাস রে?’ সে ঝুঁকে পড়ে দুলির চুলের গন্ধ শোঁকে। হরি: ‘তোর জন্য কী আনব জানিস— কলকাতা থেকে? বল তো…’ দুলি: ‘কী করে জানব?’ হরি: ‘আরেকটা চুল। তোর এই চুল—তার ওপর আরেকটা চুল। তুই সেটা পরবি মাথায়।’
কী সাংঘাতিক এক মনস্তাত্ত্বিক জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে আছে সে। আর তাকে নির্মোহ ভাবে নিরীক্ষণ করছে সত্যজিৎ রায়ের লেন্স! যে মেকি-চুল উপড়ে নিয়েছিল এক মেকি মেয়ের, সে-ই চাইছে এক প্রকৃতি-দুহিতার নকল চুল! কী জটিল এই সর্বগ্রাসী মিথ্যে সভ্যতার থাবা! বুঝতে অসুবিধে হয় না, কেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ বিশ্বচলচ্চিত্রে এক মাইলফলক বলে বিবেচিত। অতঃপর তার প্রতি মিথ্যে চুরির অভিযোগের জন্য, নিজে থেকে এগিয়ে এসে সাহায্য করতে চাওয়া পালামৌর ছেলে লখা তাকে আঘাত করে প্রতিশোধ নেয়। এবং ওয়ালেটটি সত্যি সত্যি চুরি করে। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়াটি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র জটিল অঙ্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
সাঁওতাল রমণী নিয়ে প্রশ্ন তোলা পণ্ডিতকে বলব, এ ছবি চার যুবকের স্নায়ুশরীরে এঁটে থাকা মুখোশ ভেদ করার গল্প, তিনজন নারী সত্যজিতের অনেক ছবির মতোই সেই অমোঘ প্রাকৃতিক উন্মোচন-প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
জয়া ও সঞ্জয়।
জয়া: বলুন কেমন দেখাচ্ছে। …হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কী— বলুন!
সঞ্জয়: ভ্-ভাল!
জয়া: হ্যাঁ—ভাল! আপনি কি ভূত দেখছেন?…ভূতই তো! স্বামী মরে গেলে তো শুধু স্বামীই মরে না…আমার স্বামী সুইসাইড করেছিল জানেন? …আপনার নার্ভাস লাগছে?
সঞ্জয়: ন্-না—
জয়া: আমার লাগছে।
জয়া সঞ্জয়ের বাঁ হাত নিজের বুকের ওপর রাখে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কাপের কফিতে সর জমে। সরের আবরণ। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও মেকি বহিরঙ্গ। আর যন্ত্রণা। ‘স্বামী মরলে তো শুধু স্বামী মরে না…’ যে সঞ্জয় জয়ার জন্য মেমরি গেমের সময় বালিশ আনতে গিয়ে আয়নায় এক ঝলক মুখ দেখেছিল, যে মেমরি গেমের সময় কার্ল মার্কস আর মাও ৎসে তুং-য়ের নাম বলেছিল, সে এখন ভগ্নদূতের মতো পালায়।
গাছের সামনে অসীম ও অপর্ণা। (আমাদের মনে পড়বে গাছ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এক অবিস্মরণীয় উক্তি: This was the tree which has its inner harmony and inner movement of life in its beauty, its strength, its sublime duty of endurance, its pilgrimage to the unknown through the tiniest gates of reincarnation. The Religion of Man, Rabindranath Tagore) গাছের স্তব্ধ প্রসারিত মূল, অনন্ত শিকড়। যে সংলাপকে মানব-মানবীর গভীরতম সংলাপ বলে মনে করেছেন পলিন কেল।
অপর্ণা: আমার যখন বারো বছর বয়স, তখন আমার মা আগুনে পুড়ে মারা যান। মনে আছে— তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি— একবার এখানে এসেছিলাম— বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছি— দেখলাম, দূরে আকাশের গায়ে, বনে আগুন লেগেছে।— সেই আগুন দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
চৌকিদারের স্ত্রীর এত অসুখ! খবর নেননি।
এ যেন ছবির কবিতা। রনোয়ার ও মোৎসার্ট তো বটেই, সংস্কৃত রসশাস্ত্র থেকে এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞান সত্যজিৎকে আলোকিত করেছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। অসীমের আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ থেঁতলে দেওয়ার পর অপর্ণা (এর আগে মেমরি গেম-এ ইচ্ছে করে হেরে গিয়েছিল সে) একটি পাঁচ টাকার নোটের জলছাপে তার ফোন নম্বর লেখে। অরণ্যানীর মধ্যে দাঁড়িয়ে টাকার নোটের জলছাপে একটি ফোন নম্বর! অপর্ণা কি বাণিজ্যের কাছে সমর্পিত নষ্ট অনুভূতির দিকে ইঙ্গিত করছে? এই একটি ডিটেল সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে এক জীবনশিল্পীর বিশ্ববীক্ষা হয়ে ওঠে।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র চেয়ে (মনীষার স্বাধীন সিদ্ধান্ত, পর্বতমালার ওপর থেকে মেঘ সরে যাওয়া, আকাশ জুড়ে সূর্যস্নাত নেপালি ছেলেটির অপূর্ব উদাত্ত গান) অনেক বেশি ভারী ও কালো এক শূন্যতা অরণ্য থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যুবকেরা, বিশেষত চিন্তাশীল অসীম আর সঞ্জয়। গাস্তঁ রবের্জ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘অসীমের সাঁওতাল নাচ ভাল লাগলেও সে ‘আগন্তুক’-এর অনিলার মতো নাচে যোগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না।’ এ তো সত্তরের দশকের গোড়ার ছবি। সত্যজিতের ছবিতে ভায়োলেন্স বাইরে থাকে না, থাকে ভেতরে, লিখেছেন শার্ল তেসঁ, তাঁর ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ প্রকাশিত ‘সত্যজিৎ রায়’ নামক গ্রন্থে।
ত্রিপাঠী পরিবারের পাঠানো টিফিন কেরিয়ার ভরা ডিম দিয়ে শেষ হয় অরণ্যের সঙ্গে এই ধূসর সংযোগ। চৌকিদার গেট বন্ধ করে দেয়। প্রতীক হিসেবে ধরলে (বিষয়ের এত কাছে বলে সত্যজিতের প্রতিটি খুঁটিনাটি প্রতীকী হয়ে ওঠে) তা কি কিছু নতুন উপাদান যুক্ত করল জীবনে? কিছুই তো নষ্ট হয় না। সময়গ্রন্থি পার হয়ে ফাঁকফোকর পার হয়ে জীবন বহমান।
দেখতে পাচ্ছি, অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মাতালদের টুইস্ট। বেদনার্ত, অসহায়, নিরালম্ব, কম্পমান চারটি প্রাণী।
ফরেস্ট বাংলোর সেই ছোট আয়নাটি তাকিয়ে আছে। আমরা শুনতে পাচ্ছি, সদাশিব ত্রিপাঠীর (পাহাড়ী সান্যাল) কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের গান ‘কে ডাকে আমারে’, যা অরণ্যের আকাশে ছড়িয়ে যায়। আর কেবলই অনুরণিত হতে থাকে।
ছবি সৌজন্য: ঋদ্ধি গোস্বামী