ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • যুদ্ধ কীসে হয়


    কবীর চট্টোপাধ্যায় (March 11, 2022)
     

    রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, এবং ইউক্রেনীয় মানুষের দাঁতে দাঁত চেপে দেশে বর্গী হানার বিরুদ্ধে আশ্চর্য রুখে দাঁড়ানোর কথা এতক্ষণে আমাদের ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এই যুদ্ধের যে বীজ, তা আদতে বোনা হয়েছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। এর পিছনে রয়েছে বহুদিনের এক বিরাট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস। তাকে একমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখতে যাওয়াটা বিপজ্জনক।

    তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে যে-ন্যারেটিভটি সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক ভাষ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তার পিছনে অনেকগুলো অপ্রিয় সত্য হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে। যেমন— ইউক্রেন নিয়ে পাশ্চাত্য (এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশের) সুশীল সমাজের যে বিপুল উদ্বেগ, যার অনেকটাই performative, তার একটা বড় কারণ এই যে, ইউক্রেন মূলত শ্বেতাঙ্গ দেশ। ইয়েমেনের উপর আমেরিকা এবং সৌদি আরবের যৌথ আগ্রাসন, বা প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের লাগাতার দখলদারি এবং একের পর এক যুদ্ধাপরাধ, এই প্রসঙ্গগুলো ইচ্ছে করেই চাপা দিয়ে দেওয়া হয় ইউক্রেনের রাজকাহিনি-সুলভ বীরপুরুষের আখ্যানের আড়ালে। কোনও-কোনও বিদেশি সাংবাদিক তো ‘না, ইউক্রেনের ব্যাপারে আমি ভগ্নহৃদয়, কারণ ওরা তো আমাদেরই মতো দেখতে’ মার্কা উক্তি করে এই বর্ণবৈষম্যকে প্রকটই করে ফেলেছেন। তবে এ-প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে গোটা উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজের ইতিহাস এবং নব্য-উদার যুগে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের দ্বিচারিতার ইতিহাস এনে ফেলতে হয়। আমি সে-প্রসঙ্গে যাব না। এখানে কথা বলতে চাই কিছু রাজনীতিবিদের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্লেষণ নিয়ে। যে-যুদ্ধের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র-বনাম-রাষ্ট্র আগ্রাসন এবং সাধারণ-শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা। তাকে খারাপ রাষ্ট্র বনাম ভাল রাষ্ট্রের আঙ্গিকে দেখতে চাইবার যে সমস্যাজনক রাজনীতি, তাকে চিহ্নিত করতে চাই। 

    কিছু লোকের তত্ত্বের বিষয়বস্তু: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই রাশিয়া তার প্রাক্তন সাম্রাজ্য উদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর থেকেছে, এবং মানবদরদি নেটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে উত্তর-সোভিয়েত জগৎকে সুন্দর করে সাজানোর চেষ্টা করছিল, তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে আবার সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ শুরু করেছে। মানে, দুষ্ট রাশিয়াই ছলে-বলে-কৌশলে নানা অসহায় দেশ দখল করে বসে আছে, আর সেই সব বেচারা দেশ অসহায় প্রজার মতো নেটোর দরবারে ধর্না দিলেও নেটো কিছু করেনি। অতএব এই যুদ্ধ আসলে একটি ‘সবল বনাম দুর্বল’ বাইনারি। এঁরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ, লুহানস্ক, দনেতস্ক অঞ্চলে রুশ-সমর্থক গোষ্ঠীরা যেন আচমকাই সক্রিয় হয়ে উঠল, যেন রুশদেশের সাম্রাজ্যবিস্তার ছাড়া তাদের ক্রোধের কোনও ইতিহাস নেই। তারা কীসের প্রতিরোধে সক্রিয় হল, এবং তার পিছনে শুধু ‘স্বতন্ত্র’ ইউক্রেন নয়, কোন পৃষ্ঠপোষকদের মদত ছিল— তা এই বিশ্লেষকরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। সেই এড়িয়ে যাওয়া ইতিহাসটুকু একটু তলিয়ে দেখলেই কিন্তু বোঝা যায়, এ-যুদ্ধ আগ্রাসী-আক্রান্তের সরল ইকুয়েশন নয়, বরং দুই পাওয়ার ব্লকের সর্বগ্রাসী খিদের অন্তিম পরিণাম।

    ইউক্রেনের কিছু অংশ কেন রাশিয়ার অংশ হতে চায়, সেটা জানতে হলে, কীভাবে এই ক্যু হয় তা জানাটা দরকার। সেই সময়ে ইউক্রেনে একটি আন্দোলন চলছিল, যে-আন্দোলন রুশ-বান্ধব ইয়ানুকোভিচের বিরূদ্ধে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে। এই আন্দোলনের নাম ‘ইউরোমাইডান’। এই আন্দোলনের মধ্যে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় মদতে কিছু ফ্যাসিবাদী, নিও-নাৎসি এবং বর্ণবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে স্বোভোদা বলে একটি অতি-দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এবং তাদের সামরিক অঙ্গ ‘রাইট সেক্টর’ পশ্চিমি মদতে (এর মধ্যে সিআইএ-ও ছিল) অস্ত্র নিয়ে একাধিক জায়গায় আক্রমণ চালায় এবং অবশেষে নির্বাচিত সরকারকে বহিষ্কার করে মিলিটারি ক্যু-র পদ্ধতিতে ইউক্রেনের দখল নেয়।

    ১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর নেটোর ক্রমাগত চুক্তিভঙ্গ এবং লিবেরাল ‘গণতন্ত্র’-এর নাটক দেখিয়ে ক্রমেই পূর্ব ইউরোপে অর্থনৈতিক উপনিবেশ তৈরি করার ইতিহাস নাহয় ছেড়েই দিলাম। সোভিয়েত যুগে ইউক্রেন-রাশিয়ার সম্পর্ক এবং উত্তর-সোভিয়েত যুগে ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক জগাখিচুড়ির ইতিহাস দেখলেই একটু আভাস পাওয়া যাবে। তবু অনেকে ২০১৪ সালকেই এই যুদ্ধের সূচনা বলে ধরে নিয়েছেন। আমিও তা-ই ধরতে চাই, তবে একটু অন্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত একটি সরকার ছিল, তার রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন। অনেকে বলছেন, ইউক্রেন ইউরোপের দিকে ঝুঁকে থাকার ফলে রাশিয়ার রাগ ছিল। ২০১৪ সালের একটু আগে কিন্তু ওই একই রাগ নেটো-র ছিল রুশপন্থী ইয়ানুকোভিচের উপর। ফলে ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রচ্ছন্ন মদতে এই নির্বাচিত সরকারকে বলপূর্বক সরিয়ে দেওয়া হয়, যে-ধরনের ক্যু বা আকস্মিক অভ্যুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাধিক দেশে ঘটিয়েছে। ইউক্রেনের কিছু অংশ কেন রাশিয়ার অংশ হতে চায়, সেটা জানতে হলে, কীভাবে এই ক্যু হয় তা জানাটা দরকার। সেই সময়ে ইউক্রেনে একটি আন্দোলন চলছিল, যে-আন্দোলন রুশ-বান্ধব ইয়ানুকোভিচের বিরূদ্ধে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে। এই আন্দোলনের নাম ‘ইউরোমাইডান’। এই আন্দোলনের মধ্যে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় মদতে কিছু ফ্যাসিবাদী, নিও-নাৎসি এবং বর্ণবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে স্বোভোদা বলে একটি অতি-দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এবং তাদের সামরিক অঙ্গ ‘রাইট সেক্টর’ পশ্চিমি মদতে (এর মধ্যে সিআইএ-ও ছিল) অস্ত্র নিয়ে একাধিক জায়গায় আক্রমণ চালায় এবং অবশেষে নির্বাচিত সরকারকে বহিষ্কার করে মিলিটারি ক্যু-র পদ্ধতিতে ইউক্রেনের দখল নেয়। ইয়ানুকোভিচের পর পোরোশেঙ্কো এবং ইয়াৎসেন্যুকের মতো দক্ষিণপন্থী অলিগার্কদের শাসকের আসনে বসানোর পিছনে এই ফ্যাসিবাদী দলগুলির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাদের মাথায় ছিল নেটো এবং আমেরিকার আশীর্বাদ। এই সময়ে ইউক্রেনে যে পশ্চিমি পাপেট সরকার বসানো হয়, সেই সরকারি জোটে স্বোভোদার মতো নাৎসি দলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদের নেতৃত্বে শুরু হয় কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক, মানবাধিকার কর্মী, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় এবং রুশ সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ। এরা জাতিগত ভাবে রুশ সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার শুরু করে, কারণ তাদের মতে ইউক্রেন শুধু ইউক্রেনীয়দের জন্য। মূলত পূর্ব ইউক্রেনের রুশপ্রধান অঞ্চলে এরা ভয়ানক অত্যাচার চালায়। ওডেসায় এক কুখ্যাত আক্রমণে নাৎসিরা একটি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেয়, তাতে ৪৮জন ইউনিয়নকর্মী মারা যান। শ্রতাই ব্যাপারটা শুধু রুশ গোষ্ঠীদের সক্রিয়তা নয়, তা আসলে একটি প্রতিরোধী শক্তি, মূলত নবীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং ইউক্রেনের হাত থেকে বাঁচতে রাশিয়ার আশ্রয় নিতে ইচ্ছুক।

    এবার, রাশিয়া কি সংখ্যালঘুদের স্বর্গ? পুতিন কি লেনিনের মতো সর্বহারাদের রাজনীতি করেন? মোটেও না। রাশিয়া যে কারণে ইউক্রেনের ওই পূর্বাঞ্চলের দখল নিতে চায়, তা সাম্রাজ্যবাদ। তবে ‘সাম্রাজ্যবাদ বনাম স্বাধীন দেশ’ মার্কা একটা মিথ খাড়া করে অনেকে যে বাইনারি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তার উল্টোদিকে অন্য ইতিহাসটাও বলা অত্যন্ত দরকারি। প্রশ্নটা নেটোর সাম্রাজ্যবাদ বনাম রুশ সাম্রাজ্যবাদের, এবং তার মাঝখানে ইউক্রেনের ক্লীব, পুতুল সরকারের, যারা নিজেদের সংসদ থেকে নাৎসিদেরও দূর করতে ভয় পায়। যে-লড়াই আসলে সাম্রাজ্যে-সাম্রাজ্যে লড়াই, তাকে সবল বনাম দুর্বল শ্রেণির লড়াই বলে অশ্রু-গদগদ ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রচেষ্টার পিছনে একটা স্পষ্ট নব্য-উদারবাদী মুনাফার প্রশ্ন আছে।

    মুনাফা, কারণ এই সবল-দুর্বল রূপকথার সাহায্যে সাম্রাজ্যকে গ্লোরিফাই না করলে প্রকৃত শ্রেণি-রাজনীতি এবং শ্রেণিসংগ্রামের ব্যাপারে জনমানসে একটা কৌতূহল জাগতে পারে। খানিকটা অবান্তর ভাবেই সোভিয়েত দেশের জুজু না দেখিয়ে যে মতামত প্রকাশ করা যায় না, সে-কৌতূহল কিন্তু এই মতামতকে বেশ বিপদে ফেলতে পারে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook