হঠাৎ গুরু খাটে উঠে বসল। অফিসে একটা টেলিফোন করল ম্যানেজার গুরুস্বামীকে। আবার হয়তো তার মনে পড়ে গেছে বাইরের জীবনের কথা, বাড়ির কথা, গীতার কথা, স্টুডিওর কথা। কী সব অনেক কথা গড় গড় করে গুরু টেলিফোনে বলে গেল। আমি কিছু বুঝলুম না।
ইতিমধ্যে হোটেলের বয় এসে দুপ্লেট লাঞ্চ দিয়ে গেল। একটুখানি সেটাতে মুখ দিয়ে গুরু প্লেটটা সরিয়ে রাখলে। বললে—ভালো লাগছে না কিছু, চলুন চলে যাই—
বললাম— গল্প? গল্পর কি হল—
গুরু বললে— এখানে ঠিক মন বসছে না। এ জায়গাটা তত ভালো নয়। কাল চলুন পাওয়াই লেকে যাব মাছ ধরতে। মাছ ধরতে-ধরতে গল্প বানাবো, সেটা খুব নিরিবিলি জায়গা— চলুন, এখন উঠি—
আমিও উঠলাম। আবার গাড়ি চলল পালি হিলের দিকে—
মাঝখান থেকে ষাট টাকা খরচ হয়ে গেল। আর দশ টাকা বখশিস।
পরের দিন পাওয়াই লেক-এ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল। রতন মাছ ধরার ছিপ নিয়ে এল। মাছের চারও নিয়ে এল। সকালবেলা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম রামজীকে নিয়ে।
গাড়ি চলছিল। আমি দুপাশের রাস্তা দেখতে-দেখতে ভাবছিলাম— এ আমরা কোথায় চলেছি কে জানে! নিরিবিলিতে গল্প করার জন্য যাচ্ছি। আমি তো গল্প লেখার জন্য পছন্দ করি একটা নির্জন ঘর। কিন্তু গুরুর খেয়ালে পাওয়াই লেক-এ মাছ ধরতে-ধরতে গল্পের প্লট ভাবতে হবে।
গুরু বললে— এবারে ‘বাহারে ফির ভী আয়েঙ্গী’-র স্ক্রিপ্টটা নিয়ে কাজ শুরু করব। তারপর আপনার সঙ্গে যে গল্পটা ফাইনালাইজ করব, সেটা নিয়ে পুজোর পর আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসব। আপনি পুজোর পর একটু বেশি সময় নিয়ে বোম্বে আসবেন এবারে।
বললাম— চেষ্টা করব, তবে আর একটা বড় উপন্যাস-এর প্লট আমার মাথায় আছে সেটাও একটা ধারাবাহিক আরম্ভ করার পরিকল্পনা আছে।
পাওয়াই লেক-এ গিয়ে দেখি নৌকো নিয়ে দু-চারজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা বোধহয় মাছ ধরতেই এসেছে। নৌকোয় বেড়াতে-বেড়াতে দেখলাম একটা নৌকোয় জনি ওয়াকারের ভাই তার বন্ধু নিয়ে মাছ ধরতে এসেছে আর একটা নৌকোয় শচীন দেববর্মণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের দেখে নিজেদের নৌকোটা আমাদের নৌকোর পাশে পাশে বাইতে লাগলেন। কোথায় নির্জনতা, কোথায় নিরিবিলি! আমাদের গল্পের প্লট মাথায় উঠল। পালিনাকায় আবার ফিরে এলাম। এরপর আমি ভেবে দেখলাম আর এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। যে কোনো কারণেই হোক গুরুর মন ভীষণ চঞ্চল আছে এখনও। যদিও আপাত দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই এখন তার। গীতা ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে, ছেলে তরুণ সুস্থ হয়তে বাড়ি ফিরে এসেছে।
কিন্তু গুরুর মনের খবর বোধহয় ভগবান ছাড়া কারুর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এর দুদিন পরেই আমি কলকাতায় ফিরে আসি। কথা হয়েছিল পুজোর পরে গুরু আবার আমায় বোম্বেতে ডাকবে। কিন্তু হায়, তখন বুঝিনি এই আমাদের শেষ দেখা, এরপরে আমাদের আর জীবনে কোনোদিন দেখা হবে না।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত