ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫৪


    বিমল মিত্র (March 18, 2022)
     

    পর্ব ৫৩

    পালি হিলের বাড়িতে পৌঁছে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। যা অসুস্থ হয়েছিল গুরু, সারা রাস্তা আমি একটু ভয়ে-ভয়েই ছিলুম। শেষ পর্যন্ত যে বোম্বেতে ওর বাড়িতে ওকে নিয়ে পৌঁছতে পেরেছি, এটা ভেবেই খুব হালকা লাগছিল। যাক, কিছুদিনের মধ্যেই গুরু সুস্থ হয়ে উঠল। আবার স্টুডিও যেতে শুরু করল। আমিও নিশ্চিন্ত হলুম।

    গুরু তখন খুব খুশি। চারদিক থেকে ছবিতে তার নায়ক হবার অফার আসছে। কে আসিফের ‘লাভ অ্যান্ড গড’ ছবিতে অভিনয় করছে তখন। নিজের ফিল্ম স্টুডিওতেও ছবির কাজ পুরোদমে চলছে। সে সব ছবির এডিটিং নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলবার পর্যন্ত অবসর নেই তখন তার। তবু তারই মধ্যে একটু ফাঁক পেলেই বলে— চলুন বিমলবাবু, একটু ঘুরে আসি। ঘুরে আসা মানে রামজী গাড়ি চালাবে আর পেছনের সিটে আমরা দুজনে বিশ্বের সাহিত্য আর গল্প আলোচনা করব। তারপর পছন্দ মতো ফাঁকা জায়গা বা গুরুর কোনো বন্ধুর বাড়ি চলে যেতাম।

    এদিকে উনিশে আগস্ট এসে গেল। গুরুর মেয়ে নীনার প্রথম জন্মদিন।
    কত খুশির দিন। সকাল থেকে গুরু টেলিফোনে একের পর এক কাকে কীসব অর্ডার করতে লাগল। কাউকে ফুলের অর্ডার, কেকের অর্ডার, ড্রেসের অর্ডার, ডেকোরেশনের অর্ডার। সে একেবারে এলাহি বন্দোবস্ত।

    আমি চুপ করে বসে গুরুকে দেখছিলাম। গুরু হঠাৎ আমার দিকে তাকিতে বললে— আর একটু অপেক্ষা করুন বিমলদা, হয়ে গেছে আমার, আর তিনটে জায়গায় ফোন করেই আমি আপনার কাছে এসে বসছি—

    — না-না, আপনি কাজও করুন, আপনাকে একলা সবদিক সামলাতে হচ্ছে, কত কাজ আপনার। আমি ঠিক আছি।

    সত্যি তো কত কাজ গুরুর। গীতা লন্ডনে গেছে গান গাইতে। কত আশা, কত স্বপ্ন তাদের একটা মেয়ে হবে বলে। আশ্চর্য, আজ গীতা কোথায়, আর সেই মেয়ে কোথায়?
    সন্ধেবেলা হোটেল থেকে থরে-থরে খাবার এল, মিষ্টি এল। গুরু অতিথিদের আপ্যায়ন করতে লাগল। গুরু দত্ত ফিল্ম স্টুডিওর সমস্ত লোক এসেছে। সস্ত্রীক শচীন দেববর্মণ, কে আসিফ সাহেব, দেবানন্দ, ওয়াহিদা এবং আরও অনেক অচেনা লোক। প্রত্যেকের সঙ্গে গুরু আমার আলাপ করিয়ে দিলে। আমি আবার এই সব পরিবেশে একটু আড়ষ্ট হয়ে যাই। যাই হোক আমি, শচীন দেববর্মণ, নবেন্দু ঘোষ এককোণে বসে গল্প করতে লাগলাম। আর দূরে একটা টেবিলে দেখলাম গুরু নিজের বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে হৈ-হৈ করে শ্যাম্পেনের বোতল খুলছে। চারদিকে ফুলের গন্ধ, আলোর রোশনাই, তার মধ্যে গুরুর পরিতৃপ্ত মুখটা দেখে আমারও বুকটা ভরে উঠেছিল।

    এদিকে উনিশে আগস্ট এসে গেল। গুরুর মেয়ে নীনার প্রথম জন্মদিন। কত খুশির দিন। সকাল থেকে গুরু টেলিফোনে একের পর এক কাকে কীসব অর্ডার করতে লাগল। কাউকে ফুলের অর্ডার, কেকের অর্ডার, ড্রেসের অর্ডার, ডেকোরেশনের অর্ডার। সে একেবারে এলাহি বন্দোবস্ত


    পরের দিন সকালে গুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— কাল রাত্তিরে গীতাদির কোনো ফোন আসেনি লন্ডন থেকে?

    গুরু বললে— ও করবে ফোন? গীতার কি মনে আছে নাকি যে কাল নীনার জন্মদিন?

    পরে অবশ্য গুরুর মা বলেছিল, কাল রাত দশটার সময় গীতার ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। অনেকক্ষণ ধরে মেয়ের কথা, পার্টির কথা, বাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করেছে।
    হঠাৎ একদিন গুরু বললে— চলুন বিমলদা, বাড়িতে ভালো লাগছে না, অন্য কোথাও বসে আমরা গল্পের আলোচনা করি।

    আমি তো অবাক। এত সুন্দর বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব। এত বিশাল বাড়ি, সুন্দর সাজানো ছিমছাম সংসার। এখানে কেন ওর মন লাগছে না? অসুবিধেটা কি? কে বোঝাবে ওকে! ও যা ডিসিশন নেবে তার থেকে ওকে নাড়ায় কার সাধ্যি!

    জুহু হোটেলের একটা ঘর সত্যি-সত্যিই ভাড়া নেওয়া হল। ষাট টাকা রেট। সমুদ্রের ধারে, বেশ নিরিবিলি। দুখানা খাট, বিছানা, বালিশ পাতা। সঙ্গে আমাদের মাল-পত্র কিছুই নেই। আমরা এসেছি গল্পের প্লট বানাতে। এও আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। জীবনে এত গল্প, এত উপন্যাস লিখেছি, কিন্তু এমন করে কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে, ধূপ-ধুনো দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে টাকা খরচ করে কখনও প্লট বানাইনি।

    গুরু বললে— কি গল্প করা যায় বলুন?

    আমি গুরুর কথায় উত্তর দিলাম না। আমি তখন অন্য কথা ভাবছি। কেন অত বড় বাড়ি, অত অবসর, অত বড়-বড় ফাঁকা ঘর থাকতে গুরু হোটেলের ঘর ভাড়া করলে। বাড়িতে তার কিসের অশান্তি? গীতা লন্ডনে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে তার কোনও অশান্তি নেই। দুটো ছেলে, একটা মেয়ে। মনে আছে একদিন গুরু বললে— আজকে আপনাকে ঘণ্টা দুয়েক একলা থাকতে হবে—

    বললাম— তাতে কি হয়েছে? আপনি আপনার কাজ করুন না—

    গুরু কৈফিয়তের সুরে বলল— ইনকাম ট্যাক্স উকিল অ্যাটর্নিরা আমায় খেয়ে ফেলবে—

    আমি আর বাধা দিইনি তাকে। সেদিন সন্ধেবেলা স্টুডিও থেকে এসে একলাই হোটেলের ঘরে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি একা গীতা ঘরে এল।

    বললাম— আসুন, কেমন আছেন?

    লন্ডন থেকে ফিরে সেই প্রথম গীতার সঙ্গে নিরিবিলিতে দেখা। গীতা বললে—ভালোই কেটেছে—

    বললাম— আপনার মেয়ের জন্মদিনের উৎসবে আমরা খুব ফুর্তি করেছি। পেট ভরে খেয়েছি—

    সে-কথার ধার দিয়ে গেল না গীতা। বললে— জানেন বিমলদা, প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা উপায় করে নিয়ে এলাম লন্ডন থেকে, হাতে একটা টাকাও নেই আমার—
    বললাম— পঁচিশ হাজার টাকা এ কদিনে সব খরচ করে ফেললেন?

    গীতা বললে— কি করব? আমার হাতে টাকা থাকে না।

    বললাম— তা বলে একসঙ্গে পঁচিশ হাজার টাকা উড়ে গেল? কি করলেন অত টাকা?

    গীতা বললে— যে চাইলে তাকে দিয়ে দিলুম। জীবনে অনেক টাকা উপায় করেছি। জীবনে এক-এক বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছি। অথচ আমার হাতে আজ একটা টাকা নেই—

    –যাদের টাকা দিলেন তাঁরা কারা?

    গীতা বললে— বন্ধু-বান্ধব। কেউ স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেছে, কারো ছেলের অসুখ, কারো সংসার চলে না। গান গেয়ে টাকা উপায় করেছি শুনে সবাই ধার চাইতে লাগল, আমি আর ‘না’ করতে পারলাম না—

    মনে আছে, গীতার কথা শুনতে-শুনতে সেদিন আমার সমবেদনা হয়নি গীতার ওপর। সহানুভূতিও হয়নি। কে জানি না মনে হয়েছিল, গীতা বোধহয় ঠিক গৃহিণী হবার জন্যে জন্মায়নি। সে শিল্পী, শিল্পীর ধর্মই সে পালন করেছে কেবল। তাকে চালনা করবার জন্যেই একজন মানুষের দরকার। সে মানুষ সে কেমন করে পাবে? গুরুও যেমন বেহিসেবী, গীতাও তেমনি বেহিসেবী হলে কেমন করে চলে?

    লোকে বলে গুরু দত্তর জীবনে সব চেয়ে বড় অভিশাপ তার গীতার সঙ্গে বিয়েটা! কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল, তা আমি কেমন করে বোঝাব। আসলে ওয়াহিদা রেহমান কেবল একটা উপলক্ষ্য। গীতা যদি আর একটু হিসেবী হত, আর একটু কড়া হাতে গুরুর জীবনের রাশ টেনে ধরত, তাহলে হয়তো আর আমাকে এই রাত জেগে ‘বিনিদ্র’ লিখতে হত না।

    যাই হোক, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, পরদিন সকালে দেখি গুরু অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। আমি তাকে ডেকে ওঠালাম।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook