এমনটা কিন্তু কথা ছিল না, সৌমিত্র। নিজেই ভেবে দেখুন। হ্যাঁ, বয়েস কারো উল্টো পথে হাঁটে না, বেড়েই চলে। তবু তো ভরা বসন্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অজস্র ফুলের সম্ভার ডালে ডালে ফুটিয়ে বাংলা ছায়াছবির রসিক দর্শকদের মনোহরণ করেই যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, শরীরটা একটু একটু করে বেসুরো গান গাইছে। তা সত্ত্বেও তো ‘কিং লিয়র’-এর মতো নাটকের মূল চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলার মতো নিষ্ঠা, উদ্যম আর সাহস দেখিয়েছিলেন। ইদানীং, যখন গড়পড়তা বাংলা ছবির হতশ্রী অবস্থা, আঁতুড়ে মরার ভাগ্যলিপি নিয়ে রাশি রাশি নতুন নতুন পোস্টার সপ্তাহে সপ্তাহে শহরের দেওয়ালগুলির শোভাবর্ধন করেই আবার সপ্তাহান্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে, তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই বড় বড় করে ছাপা হত আপনার মুখ। অর্থাৎ, জনপ্রিয়তায় আপনার ধারেকাছে কেউ নেই। সেই আপনি, যাঁর কাছে আমাদের অতুল প্রত্যাশা, কথা নেই বার্তা নেই, কোনও ঠিকানা না রেখে গিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
কত কথাই যে মনে পড়ে।
সালটা সম্ভবত ১৯৬৬। ‘একটুকু বাসা’ নামে মনোজ বসুর গল্প নিয়ে একটা ছবির চিত্রনাট্য সবে শেষ করেছি। নায়কের পার্ট কাকে দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে এল। সৌমিত্র তখন ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’ করে সকলের নজর কেড়েছেন। কিন্তু এ সবকটাই হল সিরিয়াস ছবি। আমার ইউনিটের দু-একজন একটু সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, ‘যাঁর কথা ভাবছেন তিনি খুবই পাওয়ারফুল অ্যাক্টর, সন্দেহ নেই, কিন্তু হালকা হাসির ছবিতে নায়ক হিসেবে কেমন মানাবে— একটু ভেবে দেখবেন।’
ভেবেচিন্তেই সৌমিত্রতে অটুট রইলাম। কিন্তু মুশকিল হল, ওঁর সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই। শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায়ের একজন সহকারী ছিলেন সে আমলে— নিত্যানন্দ দত্ত নাম— আমরা ‘নিতাইবাবু’ বলে ডাকতাম। ভারি ভালোমানুষ। সৌমিত্রকে নায়ক হিসেবে ভাবছি জানতে পেরে তিনি নিজেই এগিয়ে এসে আমাদের দুজনের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করে দিলেন। সে যুগটাই ছিল এইরকম। কারো কোনও সমস্যা দেখা দিলে অন্য ইউনিটের ছেলেদের এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বদভ্যেসটা একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি।
যাই হোক, ‘একটুকু বাসা’র চরিত্রলিপিতে সবার আগে উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম।
সে আমলে শুটিং করাটা আজকের মতন সমস্যাজর্জর ছিল না। শিল্পীদের ডেট জানিয়ে দিলেই হাঙ্গামা শেষ। ঠিক সময়ে আসা, ঠিক সময়ে যাওয়া, যতটা পারা যায় পরিশ্রম আর নিষ্ঠার প্রয়োগ— এগুলি ছিল অলিখিত অথচ স্বাভাবিক শর্ত। ‘একটুকু বাসা’র শিল্পী-তালিকা যথেষ্ট লম্বা। এঁদের বেশির ভাগই বাংলা ছবির বাঘা-বাঘা কমেডিয়ান। (যদিও ‘কমেডিয়ান’ শব্দটা আমার ঘোর অপছন্দ। আমার মতে এঁরা এক-একজন উঁচু মাপের চরিত্রাভিনেতা।) ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, জহর রায়, রবি ঘোষ, হরিধন মুখোপাধ্যায়, রেণুকা দেবী, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, অজিত চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও পাহাড়ি সান্যাল, সন্ধ্যা রায়, পদ্মা দেবী— এঁদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম, এঁদের সকলের মধ্যেই একটা অপূর্ব সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে—শুধুমাত্র ‘প্রফেশনাল’ সম্পর্ক নয়, ওসবের অনেক ওপরে এক ধরনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বয়সের ভেদাভেদ সেখানে গৌণ। বড়রা অক্লেশে কমবয়েসিদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করছেন। হাসির ছবিতে শট দিতে দিতে কতবার যে নিজেরাই মাঝপথে হো-হো করে হেসে ফেলে শট নষ্ট করে ফেলছেন তার কোনও হিসেব নেই। শুটিং জোনের বাইরে ওঁদের জমজমাটি আড্ডা। ‘সাইলেন্স’ ‘সাইলেন্স’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সহকারীরা ক্লান্ত। খুব অল্প দিনের মধ্যেই আবিষ্কার করা গেল যে, এই দলটির নবীনতম গুরুঠাকুরটির নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সেসব দিনগুলোর কথা আবছা আবছা মনে পড়ে, সৌমিত্র? মনে পড়ে কি, সকাল দশটায় কল-টাইম দেওয়া থাকলেও আপনারা সদলবলে মেক-আপ রুমে হাজির হয়ে যেতেন সকাল সাড়ে-সাতটা অথবা আটটার মধ্যে? কী ব্যাপার? না, নির্ভেজাল প্রাক-শুটিং আড্ডা।
মেক-আপ ম্যান আসতেন চন্দননগর থেকে। ন’টা নাগাদ পৌঁছে সাজঘর খুললেই ওঁর কাজ চলে যেত। কিন্তু, সৌমিত্রবাবু, আপনাদের এই আড্ডার জ্বালাতন সামলাতে বাধ্য হয়ে ওকে সাতটার মধ্যে এসে ঘর খুলে সব গোছগাছ করে রাখতে হত। একবার প্রশ্ন করেছিলাম, ‘শুধু শুধু এত সকাল সকাল এসে আপনারা কী মজা পান?’ উত্তর শুনে আমি হতবাক। ‘আপনি ডিরেক্টর। দেরি করে এলে বকতে পারেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় যদি আগাম-হাজিরা দিই তার জন্যে কিন্তু বকুনি দেওয়ার নিয়ম নেই।’
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
গুনে দেখলাম, মোট ১১টা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। দুজনের মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল তাকে ‘বন্ধুত্ব’ বললে সম্ভবত একটু বাড়িয়ে বলা হবে। সম্পর্কটা ছিল সখ্যের। খুব ঘন-ঘন যে দেখা হত, তা-ও নয়। কিন্তু যখন হত, সেই মুহুর্তগুলোর উষ্ণতা (ইংরিজিতে যাকে বলে warmth) কী ভাবে বাইরের পাঁচজনকে বোঝানো যাবে? সৌমিত্রর বেলায় এটা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক একটা বিষয়। কোনও একটা ছবিতে একজন ক্ষমতাবান শিল্পী নিজের ভূমিকাটি যথাযথভাবে বুঝে নেবেন, দরকার হলে চিত্রনাট্যের পাতাগুলি চেয়ে নিয়ে সংলাপ আর নীরব মুহূর্তগুলিতে তাঁর কী কী করণীয়, মনে মনে তার হিসেব কষে নেবেন, এর ভিতর নূতনত্ব কিছু নেই। কিন্তু ছায়াছবির একটা নিজস্ব ছন্দ আছে, অনেকটা সংগীতের মতো। সেই ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোথায় আলাপ, কোথায় জোড়, কোথায় ঝালা, আর সম্-ই বা কোথায়— এটা বুঝে অভিনয় করা সত্যিই দুরূহ। অভিনেতা যত শক্তিশালীই হোন না কেন, এ ব্যাপারে পরিচালকের মুখের দিকে তাঁকে তাকিয়ে থাকতেই হয়। সৌমিত্রর বেলায় দেখেছি, সামান্যতম খেইটুকু ধরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা, বাকিটা নিয়ে পরিশ্রম করার দরকার নেই। কারণ ও ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
এটা কখন হয়? যখন শিল্পী নিজের অভিনয়টা উপভোগ করেন। একটা আলাদা আলো তখন ঠিকরে বেরোতে থাকে তাঁর অভিব্যক্তিতে, কন্ঠে, চলা-ফেরায়। ‘সংসার সীমান্তে’, ‘গণদেবতা’, ‘চাঁদের বাড়ি’ অথবা ‘অমর গীতি’ থেকে বেশ কিছু নজির তুলে ধরা যায়, কিন্তু থাক। ‘অপুর সংসার’, ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’ বা ‘কোনি’ যাঁরা খুঁটিয়ে দেখেছেন, আশা করি তাঁরা এ ব্যাপারে সহমত হবেন।
সেই সৌমিত্র, আপনি, এভাবে কোনও নোটিস না দিয়ে চলে গেলেন? অভিনেতা তো বটেই, আপনার মতো এমন একজন ‘টিম ম্যান’কে হারাবার ক্ষতি আমরা কী ভাবে পূরণ করব? মনে পড়ে কি ‘গণদেবতা’র লোকেশন শুটিংয়ের সেই দিনগুলির কথা? বীরভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আমরা শুটিং করে বেড়াচ্ছি, ভোর চারটেয় উঠে তৈরি হওয়া, দিনভর দাপাদাপি, তারপর সন্ধে হলে প্যাক-আপ। ঋতুতে ঋতুতে কাজ, শিল্পীদের নির্দ্দিষ্ট কোনও ডেট দেওয়া যাচ্ছে না, কালবৈশাখী কবে আসবে, কাশের বন কবে আলো হয়ে থাকবে, কবে একই সঙ্গে পলাশ ফুটবে আর মহুয়া ফল ঝরবে (বছরে মাত্র চার-পাঁচদিন একই সঙ্গে ঘটনাটা ঘটে) — এর তো কোনও আগাম আন্দাজ নেই, তাই শিল্পীদের সঙ্গে কথা হয়েই আছে যে, যে কোনও দিন, বা রাতে, লোকেশনে ডাক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সব কাজ ফেলে তাদের সেখানে হাজির হতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না দৃশ্যগুলি সফলভাবে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে। আপনার মতো ব্যস্ত শিল্পী, হাতে অগুন্তি ছবি, আপনি কিনা রাজি হয়ে গেলেন? কেন? ‘দেবু ঘোষ’-এর চরিত্রটা ভিতর থেকে আপনাকে টেনেছিল বলেই তো?
আদর্শ ‘টিম ম্যান’ যে আপনাকে বলছি, তা কি অকারণে? অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তবে আপাতত মোটে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। ‘গণদেবতা’ প্রসঙ্গেই। সেদিনটার কথা মনে পড়ে? দিন নয়, প্রায় সন্ধে-রাত তখন। সারাদিন শুটিংয়ের ধকল গেছে, শিল্পীদের বলা হল যে যার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার, বা বলা ভাল, আমার প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের কিছু জরুরি কাজ তখনও বাকি। প্রতিদিনই এ সময়ে একটা ভ্যান নিয়ে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হয়, বিপদসঙ্কুল অনেকটা পথ পেরিয়ে একটা বিশেষ জায়গায় পৌঁছতেই হবে, কারণ সেখানে, কাঁকসার জঙ্গলের মাঝখানে আমাদেরই আর্ট ডিপার্টমেন্টের প্রায় ১৫-১৬জনের একটা দল দিনরাত তাঁবু গেড়ে একটা সেট তৈরি করছে। ‘বিপদসঙ্কুল’ বলছি, কেন না সময়টা সত্তরের দশক, উত্তাল রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক আন্দোলন মানুষের মনে এতটাই ত্রাসের জন্ম দিয়েছে যে মাঝ-দুপুর থেকে রাস্তাঘাট শুনশান, জনমানবের দেখা নেই, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ, যে-যার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়ে সেখানেই উৎকন্ঠায় প্রহর গুনছে। বোলপুরে বড়রাস্তার মোড়ে ‘দালাল এম্পোরিয়াম’-এর সামনে কয়েকটা কাটা মুন্ডু ঝুলছে— এ দৃশ্যও দেখা গেল। কাকসার জঙ্গলে, যেখানে আমাদের ছেলেরা কাজ করছে, জায়গাটার নাম হেদেগোড়া— আসলে ছিল লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে একটা আদিবাসী গ্রাম, কিন্তু আজ আর গ্রাম নেই, বাসিন্দারা পালিয়ে অন্যত্র নিজেদের বসত গড়ে নিয়েছে, পড়ে আছে শুধু জীর্ণ ঘরবাড়িগুলোর কঙ্কাল, যা কিনা মেরামত করে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানেই চিত্রায়িত হবে সেই দৃশ্য, যেখানে ছিরু পাল গায়ের ঝাল মেটাতে একটা গ্রামের পুরো বায়েন পাড়া পুড়িয়ে সাফ করে দেবে।
প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে আমাদের শিল্প-নির্দেশক সুরেশচন্দ্র চন্দ্র ওই ভয়াবহ জায়গাতেই নিজেদের ক্যাম্প বানিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু আশেপাশে কোনও বাজার নেই তাই আমাদের কাজ হল রোজ সন্ধের পর চাল-ডাল-তেল-নুন-মাছ-সবজি বয়ে নিয়ে ওদের ওখানে পৌঁছে দেওয়া। নইলে বেচারিরা না খেয়ে মরবে।
সেদিনও, সেই সন্ধে রাতে, ভ্যানগাড়িতে আমরা মালপত্র ওঠাচ্ছি, আর মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে রওনা দেব, এমন সময় আপনি, সৌমিত্র, হঠাৎ এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তাহলে আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।’
কতরকম ভাবে বোঝালাম, এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ওঁর পক্ষে একেবারেই ঠিক নয়, আমরা কিছুতেই এ ব্যাপারে সায় দিতে পারি না, কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রশ্ন আসে
—‘তাহলে আপনারা যাচ্ছেন কেন?
— ‘বাধ্য হয়ে।’
— ‘তাহলে ধরে নিন, আমিও তাই।’
বলে টুক করে আপনি গাড়িতে উঠে বসলেন।
তারপরে সেই লম্বা রাস্তা। গাড়িতে হেড লাইট জ্বালানো চলবে না। এগারো মাইলের মোড় থেকে বাঁয়ে বাঁক। ঘন জঙ্গল। অন্ধকারে পথ গুলিয়ে ফেলা। শেষ পর্যন্ত একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় গাড়ি পার্ক করে, টর্চের আলোয় খুঁজে খুঁজে জায়গামতন পৌঁছনো। আপনাকে দেখে ওদের উল্লাস, মাটির ভাঁড়ে গরম চা— মনে পড়ে এসব? ক্যাম্পের ঘেরাটোপের মধ্যে লম্ফের আলোয় আপনার সেই গান গেয়ে ওঠা—
‘নিজের হাতে নিজে বাঁধা ঘরে আধা বাইরে আধা –
এবার ভাসাই সন্ধ্যাহাওয়ায় আপনারে— ’
মনে পড়ে, এসব?
‘টিম ম্যান’ বলতে এর বাইরে আর কী বোঝায়, আমার জানা নেই।