আমার মতে, ১৯৭০-এর কলকাতার পটভূমিতে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’, ওঁর সব কাজের মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্চারিত হওয়া ছবি। অথচ এই ছবি সেই সময়ের কর্পোরেট জগতের এমন কিছু দিকের উপর আলো ফেলেছে, পুঁজিবাদের দাপটে ব্যক্তি চরিত্রের পতনের কথা বলেছে, যা আজও যেন সমসাময়িক। কলকাতায় যাকে সেই সময় বলা হত বক্সওয়ালা এক বিশ্ব, আজও অন্য নামে তা সর্বব্যাপ্ত।
‘সীমাবদ্ধ’ ছবির বাংলা এক ক্রান্তিকালের বাংলা। একদিকে সমকালীন সমস্যা থেকে গা বাঁচানো এলিট বাঙালি। রেসকোর্সে ঘোড়া ছুটছে, মিস শেফালির ক্যাবারে সম্মোহিত রাখছে উচ্চবিত্তকে। কর্পোরেট পুঁজি একটি শ্রেণীর সুখ ও সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে ক্রমশ। অন্যদিকে মধ্যরাতের নৈঃশব্দ খানখান করে বোমার শব্দ।
পাটনার এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা যুবক শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি সিনেমার কেন্দ্রে। যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা টেনে ল্যাম্প আর ফ্যান উৎপাদক একটি ব্রিটিশ মালিকানার সংস্থায় সেলস ম্যানেজারের পদ পর্যন্ত পৌঁছেছে। সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সামনে যাবতীয় মোহ-মায়া নিয়ে গাজরের মতো ঝুলছে ডিরেক্টরের পদটি। শ্যামলেন্দু বিবাহিত, ছেলে দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে পড়াশুনো করে। বাবা-মায়ের থেকে দূরে সে বড় হচ্ছে। এক কথায় যাকে বলে বক্সওয়ালা দম্পতি— তারা সেরকমই এক যাপনে অভ্যস্ত। যেখানে রয়েছে ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গলফ কোর্স, সপ্তাহান্তে পার্টি, এবং ছকে বাঁধা ওঠাবসা। এই রুটিনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যে জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না তাদের ঘিরে গড়া ওঠা জগতের অন্তঃসারশূন্যতাকে।
সেই সময়ের কলকাতা উত্তাল। রাজনীতি, বিপ্লব, হত্যা, অবিশ্বাস আর মধ্যরাতে বেজে ওঠা সাইরেন। দেওয়াল লিখনে দিন বদলের ডাক। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুলিশের দমননীতি। শ্যামলেন্দুর পরিবার এই উত্তাল স্রোতের থেকে গা বাঁচিয়ে নিজেদের তৈরি করে স্বর্গে স্বেচ্ছাবন্দী। শুধুমাত্র তাঁদের সাততলার ফ্ল্যাটে মধ্যরাতে বোমার শব্দ ভেসে আসে।
এই পরিবেশে পাটনা থেকে আসে শ্যামলেন্দুর শ্যালিকা সুদর্শনা। সাইকোলজিতে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময় কাটানোর জন্য তার কলকাতায় আসা। আমার করা অন্যতম সেরিব্রাল চরিত্র এই সুদর্শনা। সে একদিকে বুদ্ধিমতী, স্পর্শকাতর অন্যদিকে তমনই কৌতূহলী ও উৎসুক চারপাশটাকে জানার জন্য। শ্যামলেন্দুর ইঁদুর দৌড়, কলকাতার অস্থির সময়টাকে বোঝার জন্য। বারবার প্রশ্ন করে সে শ্যামলেন্দুকে কার্যত একটা আয়নার সামনেই যেন দাঁড় করিয়ে দেয়।
মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) এই ছবির কাস্টিংয়ে চমক দিয়েছিলেন চ্যাটার্জি দম্পতির ভূমিকায় আনকোরা মুখ (বরুণ চন্দ এবং পারমিতা চৌধুরী) এনে। কিন্তু শ্যালিকা সুদর্শনা চরিত্রের জন্য আমাকেই ভেবেছিলেন। আমার ততদিনে ওঁর সঙ্গে চারটে ছবি করা হয়ে গিয়েছে। আজ ভাবতে বসলে মনে হয়, সুদর্শনা চরিত্রটির জটিলতা, বিভিন্ন সূক্ষ্ম এক্সপ্রেশনের কথা বিবেচনা করে সেই সময় আমার উপর ভরসা রেখেছিলেন মানিকদা। তাছাড়া চরিত্রটির সঙ্গে আমার অভিনীত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং বিশেষ করে ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনীত চরিত্রটির মূল সুর, যেন কোথাও একটা বাঁধা ছিল। ‘নায়ক’ ছবিতেও অরিন্দম মুখার্জির ভিতরকার স্খলনের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে চিরন্তন বিবেকবোধের এক স্থিরবিন্দু তৈরি করেছিল সাংবাদিক অদিতি সেনগুপ্ত। এখানেও যেন অনেকটা তাই।
‘সীমাবদ্ধ’ ছবির বেশ কিছু দৃশ্যে অন্তঃসারশূন্য বক্সওয়ালা জগতের ছবি তৈরি করেছেন মানিকদা। রেসকোর্স, সুইমিং ক্লাব, এবং সবচেয়ে বেশি করে ককটেল পার্টির সিকোয়েন্স-এ। পার্টির মাঝখানে শ্যামলেন্দুর বাড়ি এসে হাজির হন তাঁর বৃদ্ধা বাবা-মা, যাঁরা নিতান্তই বাঙালি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। তাঁদের ছেলে-বৌমার পশ্চিমি আদবকায়দার দুনিয়ায় একেবারই বেমানান। তৈরি হয় তাঁদের ঘিরে অস্বস্তির বলয়।
‘নায়ক’ ছবিটির সঙ্গে তুলনা টেনে আবারও বলতে হয়, ‘নায়ক’-এর শেষে এসে সাংবাদিক অদিতি সাক্ষাৎকারটি ছিঁড়ে ফেলে দেয়। হতভম্ব নায়ক অরিন্দমকে বলে, ‘মনে রেখে দেব।’ কিন্তু ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির শেষে বেচারি সুদর্শনার ‘মনে রেখে দেওয়ারও’ কিছু থাকে না। ‘নায়ক’-এর অরিন্দমের পাঁজরের তলায় বিবেকের প্রছ্ন্ন আঁচ ধিকধিকি করে জ্বলছিল। কিন্তু ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দুর বক্সওয়ালা জীবনে সেটুকুও নেই। নিজের উন্নতির জন্য সে চরিত্র বা বিবেকের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও উদযাপনের সময় যে চোখ মেলাতে পারে না সুদর্শনার চোখে। দু’হাতে মুখ গুঁজে তাকে বসে থাকতে হয় পরাজিত মানুষের মতো।
অর্ধশতাব্দী পার করার পরেও ‘সীমাবদ্ধ’ সমসাময়িকই থেকে গিয়েছে। পুঁজিবাদ, ক্ষমতায়ন এবং কর্পোরেট যাপনে ব্যক্তিসত্তার নৈতিক পতনের শব্দ আজও প্রাসঙ্গিক এবং তীব্রতর। এই ছবির কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন তাই আজও একই রকম।