প্রতিচুম্বন
পুনরায় অদৃশ্য হবার আগে বরং প্রতিচুম্বনটি রেখে যাই
সন্ধেঘর, অনবদ্য লালচে মরারোদ, পাখিটির নিরুদ্বিগ্ন চোখ
আমার জলদগম্ভীর কণ্ঠ, তোমার ফরসা পায়ের ধুলো, তোমার ঐশ্বরিক নখ
বুকের মাঝের নদীটিতে আমার শান্ত নৌকোটি
এবং চিবুক বেয়ে চিবুকে হাওয়ায় হাওয়ায় লবণধারা বইছে ধীরে
মহম্মদ রফি ক্রমাগত গাইলেন, দুটি পোশাকের ঘুমের সময়ে
এইসব দেখছি
এইসব দেখছি, কেমন সরীসৃপ বালি মাখছে যুগলে
এইসব দেখছি আর শস্যদানা ফুরোচ্ছে আমার সূর্যের মতো
আমি দূরে দূরে হাঁটছি, হাঁটছি আর মাথার মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে দেহপর্যটনকথা
আমি পুনরায় হেঁটে বিপরীতদিকে সরে যাব মনস্থ করেছি
এও ভাবছি
যে অদৃশ্য হবার আগে সবুজাভ ত্বকে প্রতিচুম্বন দিয়ে যাব
একটি আশীর্বাদী চুম্বন দিয়ে যাব অদৃশ্য হবার আগে
লণ্ডভণ্ড করে ছুটছি
কী ভরসায় যে আমি ছুটছি
মহাদেশ থেকে মহাদেশে, খাল থেকে সমুদ্রে
সপ্তডিঙ্গা মধুকর ডুবিয়ে ফেলেও আমি ছুটছি
আমার গায়ের আঁশ খুবলে খাচ্ছে ভালোবাসা
মাংসে দাঁত বসাচ্ছে ভালোবাসা
আমি আপ্রাণ পালাচ্ছি দীর্ঘ তরুছায়াটির দিকে
একটি মুখ, একটি পাহাড়তলি, একটি অনন্য ত্রিভুজ খুঁজতে গিয়ে
আমি দেখলাম মেঘ গলে গলে পড়ছে গায়ে আমার
দড়ি-কলসি রাখা থাকছে প্রত্যেকটি টলটলে পুকুরঘাটে
কীসের ভরসায় যে আমি ছুটছি
আমার জন্য কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে ফুলের সিংহাসন
যেন ছিল, যেন ছিল, যেন আছে
যেন সুন্দরটি রাখা আছে মন্দিরের উঠোনে
যেন আঙুল রাখলাম সুকোমল নাভিতে তাহার
যেন এই অপেক্ষা সমাদৃত হবে একদিন সন্ন্যাসীভোগের দিনে
শব্দে শব্দে পুজো করছি ছিঁচকে তস্করের মতো
শব্দে শব্দে পাপকুঠুরি ভাঙছে
আর নিঃস্ব হলাম ধীরে
পৌনঃপুনিক বিষণ্ণচোখ নিয়ে দাঁড়াচ্ছি মাঝে মাঝে ঘোরতর উষ্ণপ্রস্রবণে
আবার ছুটছি, ঠোঁট নীচু করে আবারও দাঁড়াচ্ছি
এবং পালাচ্ছি আবার
কীসের ভরসায় যে আমি সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে ছুটছি
একটি কবিতা
একটি কবিতা আমার অসুখ সারাবে
একটি কবিতা আমায় মহীরুহ করবে
একটি কবিতা হবে আমার সন্তানমুখের মতো
একটি কবিতা কুলুঙ্গিতে প্রদীপ হয়ে জ্বলবে তাবৎ বাৎস্যায়ন রাতে
একটি কবিতা পঙ্গপালের শবের ওপর চাঁদ মাখাবে
একটি কবিতা প্রিয় নারীটির অভ্যাস হবে স্নানঘরে
একটি কবিতা দীর্ঘতম ছায়া ফেলবে কিশোরীপুকুর থেকে ঋতুশেষ বলিরেখায়
একটি কবিতা দোয়াতটিকে শেষবার গর্ভবতী করবে
একটি কবিতা লেখার শেষে আমি হাটে যাব মোহর ছড়াতে
একটি কবিতা মানুষকে গভীর দুঃখ দেবে
একটি কবিতা নক্ষত্রসহবাস শেষে তর্জমা করে দেবে আমার অস্তিত্বের
একটি কবিতা লিখব বলে আমি দুনিয়ার পাথর সরিয়ে কুয়োতে ফেললাম
একটি কবিতা নিথর শুয়ে থাকে বর্ষার আলে
একটি কবিতা দূরবর্তী রেললাইনে একা হেঁটে যায়, শেষ ট্রেনটি আসছে
একটি কবিতা, ওই একটিই লিখতে গিয়ে পাপের সিন্দুক ভাঙছি
একটি কবিতা আমাকে লোভাতুর সন্ন্যাসী করে তুলল
একটি কবিতা, হে শ্রেষ্ঠ কবিতা আমার, তুমি উপঢৌকন নাও আমার কঙ্কাল
আমায় কবর থেকে টেনে তোলো
একটি কবিতা, হে অবিসংবাদী শেষ সম্রাট
আমায় শান্তি দাও এইবার
বিগ্রহ বানিয়ে বানিয়ে হাতে মুখে অজস্র কাদার দাগ
বইতে পারি না আর
এইসব অপরাধ আমার?
তবে আমারই অপরাধ হয়েছে?
দু’পা বাড়ালে অস্থির পরি, আর দু’পা পরেই জলোচ্ছ্বাস
ধান ফলানো শেষ হলে এক গামলা পান্তাভাত খাব
এইটুকু মাত্র চাহিদা, সাথে শুকনো লঙ্কা ভেজে দিও
তাতেও তোমার অন্তরে আকাশ মুখভার করল?
বন্যাত্রাণে আমি পাঠিয়েছি বেশ কিছু কলার মান্দাস
আর কিছু চাতকপাখির দল
তারা মেঘকে গালাগালি দিয়ে পাঁজরে ফিরবে আমার
তোমার তাতেও রাগ?
কেন? আমি কি সমস্ত ডুবন্ত মানুষকে আগুন শেখাব?
সেইটেই হবে আমার শাস্তি?
কাঁটাঝোপের পাশ দিয়ে রাস্তা, সন্ধে হলে বিষাক্ত সাপ
তেমন তেমন ঘ্রাণ পেলেই ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করে
সাপের খিদে তেষ্টা নেই?
অনবদ্য রান্না করেছি কাঁকড়ার ঝাল, মৃত এখন সব
অথচ তেলঝালের মধ্যে দাঁড়াখানি ভাঙতে এত কষ্ট কেন হবে?
আমি কি বৃদ্ধ হলাম শেষমেশ?
মৃত হলেও, কামড়ে রক্তাক্ত হব না আমি?
এইসব আমার অপরাধ?
তাহলে স্বপ্নের মধ্যে তির্যক রোদ পড়ে কেন স্মৃতির ওপর?
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত