সাধারণ বছর যেমন যায়, অতিমারীর বছর স্বাভাবিক ভাবেই তার চেয়ে আলাদা। মানুষ এরকম অভাবিত বিপদে পড়লে প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তারপর খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেষ্টা করে, জীবনের মূল্য ১০০ শতাংশ বোধগম্য হয় হঠাৎই, আর জীবন তো থেমে থাকেই না। অতএব শেষমেশ মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে অতিমারীকে সঙ্গে রেখেই বেঁচে থাকার তাগিদ তৈরি হতে থাকে। আর সেই তাগিদের একটা অংশ হল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সৃষ্টি। ভয়ানক সময়ের মধ্যে তৈরি হওয়া সেই সব শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে কখনও বেঁচে থাকে অতিমারীর তথ্য, স্মৃতি, কখনও নুন-ছাল ওঠা দগদগে সত্যি। আবার কখনও শিল্প-সাহিত্য মানুষকে বিনোদনের কাছে পৌঁছে দিয়ে, মুহূর্তকাল আতঙ্ক থেকে রেহাই দিতে সমর্থ হয়। কিন্তু যত ভয়ানক সময়ই হোক, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি কখনও থেমে থাকে না। কখনও হয়ে ওঠে হাতিয়ার, কখনও সচেতনতার মাধ্যম, কখনও আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের নরম কুঠুরি।
১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তরে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। বাংলা তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অন্তর্গত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন না খেতে পেয়ে, ম্যালেরিয়ায়, বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন। তখনও মানুষ পরিযায়ী হয়েছেন। গ্রাম থেকে শহরে। ভাতও নয়, ভাতের ফ্যানের আশায় রাস্তায় রাস্তায় আকুল হয়ে ভিক্ষে করেছেন। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘অশনি-সংকেত’ সিনেমাটা করার সময় আমার মাথার পেছনে ছেলেবেলার সেই মর্মান্তিক ভিক্ষের আওয়াজটা বাজত মনের ভেতর, ‘ফ্যান দাও, একটু ফ্যান দাও’, আমি অভিনয় করব কী, ছটফট ছটফট করতাম।’ সত্যজিৎ রায় ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি করেছিলেন বহু পরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসটি লেখেন ১৯৫৯ সালে। দুর্ভিক্ষের ১৫ বছর পর।
কিন্তু সেই দুঃসময়ে একজন চিত্রশিল্পী বৃহত্তর বাংলার এই দুর্ভিক্ষের চেহারাকে তাঁর আঁকায় ধরে রেখেছিলেন। চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবি পৃথিবীর কাছে জলজ্যান্ত তথ্য এবং যন্ত্রণার প্রমাণ হয়ে রয়ে গিয়েছে। আর অসামান্য শিল্পে তো উত্তীর্ণ হয়েছেই। বাংলার দুর্ভিক্ষ আর ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের ঔদাসীন্য বাংলাকে কোন পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছিল, তা চিত্তপ্রসাদের ছবিই প্রমাণ করে দেয়।
১৯১৮-১৯২০ সালে, যখন স্প্যানিশ-ফ্লু উজাড় করেছে পৃথিবী, তখন অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত শিল্পী গুস্তাভ ক্লিমট মারা যাচ্ছেন (১৯১৮), আর তাঁর যন্ত্রণাদীর্ণ ছবি এঁকে রাখছেন তাঁর শিষ্য ইগন শিল। নরওয়ের শিল্পী এডওয়ার্ড মুংখ নিজের স্প্যানিশ ফ্লু-আক্রান্ত (ও কোয়ারান্টাইন-বদ্ধ) আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন স্প্যানিশ ফ্লু-র আগে, পরেও। এই কোভিড বা লকডাউন নিয়েও সারা পৃথিবীতে প্রচুর ছবি আঁকা হয়েছে, কবিতা লেখা হয়েছে (গুলজারের লেখা এই বিষয়ে কবিতা ডাকবাংলাতেই প্রকাশিত হয়েছে), সিনেমা হয়েছে। বোঝা যায়, যুদ্ধই হোক আর মহামারী, দুর্ভিক্ষই হোক আর ভূমিকম্প, মানুষের কল্পনা আর কার প্রয়োগ থেমে থাকে না, থেমে থাকে না অন্য মানুষের তার দিকে তাকিয়ে থাকার ও তা উপভোগের ক্ষমতাও।
ডাকবাংলা যখন এক বছর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল, তখন আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি খুব সঙ্গিন। চারদিকে অসুস্থতা, মৃত্যুর মিছিল, অনিশ্চয়তা, বুরবক বনে যাওয়া মানুষ। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য বেঁচে থাক। এই সময়টা কেবল কোভিডের সময় হিসেবে নয়, কোভিডের ফলে নতুন ভাবনার, নতুন ভয়ের ও বিবর্তনের সময় হিসেবেও ধরা থাক।
কোভিডের আগে আমরা ক’জন জুম-মিটিং করতে জানতাম? ক’জন জানতাম অন-লাইনে থিয়েটার করা যায়? এবং বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন জায়গা থেকে একটা চৌখুপির মধ্যে যোগ দিয়ে জীবনকে বয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন? ক‘জন জানতাম, অতিমারী উপেক্ষা করেও সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান-ধর্মঘট করা যায়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করা যায়? গুলজার কোভিডের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে নিয়ে আসেন তাঁর স্মৃতি, যেখানে দেশভাগের ফলে তাঁকে চলে আসতে হয়েছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এইভাবেই এক বিপদ মনে করায় অন্য বিপদকে, এক উত্তরণ পথ দেখায় অন্য উত্তরণের। অতিমারীর ফলে বদলে যায় শিল্পের প্রযুক্তি, অতিমারী চলে যাওয়ার পরেও সেই প্রযুক্তি হয়তো অন্য দিগন্ত খুলে দেবে। কিছু সৃষ্টি থেকে যাবে এই সময়ের প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে, আর কিছু সৃষ্টি দেখাবে এই সময়কে পেরিয়ে বা এড়িয়ে কীভাবে অক্ষত অমলিন পথে বয়ে গেছে কত শিল্পীর ভাবনা।
কেবল কোভিড-সংক্রান্ত শিল্প-সাহিত্যই তৈরি হচ্ছে এমনটা তো নয়, মানুষ নিজের বাঁচাকে সহস্রভাবে উদযাপন করতে চায়। তাই এই সময়েও সে নিজের পছন্দের শিল্প নিজেই বেছে নেয়। যার মূল্য কোনও অংশে কম নয়। পরে যখন ফিরে এই সময়টাকে বিশ্লেষণ করা হবে, এই সব শিল্পই কোনওভাবে আসন নেবে সেই সভায়, কারণ নথিও মূল্যবান, আবার আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত পৃথিবীর স্নিগ্ধ গানও।
ডাকবাংলাও যেমন অনেক চাপান-উতোরের মধ্যে দিয়ে গেছে এই এক বছর, তেমনই সৃষ্টির আনন্দের সঙ্গেও নিয়ত যুক্ত থেকেছে। এই উল্লেখযোগ্য সময়ের দায়িত্ববান সাক্ষী থাকাটাও কালের গায়ে একটা উল্লেখযোগ্য আঁচড়।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র