২০০৬ সালের মে মাস। ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে নতুন এক বন্ধু, অমল। ভারি অবাক হয়ে শুনলাম তার গল্প। অমল বলল, তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। তার নাকি এক কঠিন রোগ হয়েছে, তাই অমলের সঙ্গী একমাত্র তার ঘরের জানলাটা। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি তো যখন খুশি বেরিয়ে পড়তে পারি, বিকেলে মাঠে যাওয়া, বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ফুটবল, গরমের ছুটিতে বন্ধুর বাড়ি, প্রতি শনিবার নাট্যমঞ্চে কত রকম মুখের ভিড়… এসব শুনে অমল হেসে উড়িয়ে দিল। সে বলল, ‘বাড়িতে থেকেও যে বেরিয়ে পড়া যায় না, এ-কথা কে বলেছে তোমায়?’ তারপর বলতে থাকল কত মুখের কথা, যারা রোজ দেখা দিয়ে যায় তাকে। তার জগতে বন্ধুদের কোনও নাম, পদবি বা বয়স নেই। দেশ-বিদেশ ঘোরার জন্য অমলের লাগে না কোনও পাসপোর্ট বা ভিসা, লাগে না কোনও নাগরিকত্বের প্রমাণ, লাগে শুধু একটা মন।
সব শুনে অমলের এই গৃহবন্দি জীবন কীরকম রূপকথার মতো মনে হল। সত্যি কথা বলতে, রূপকথার থেকেও ঢের বেশি রঙিন, ঢের বেশি সত্যি। হন্তদন্ত হয়ে অমলকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের চারপাশের মানুষ কেন তার মতো সহজভাবে ভাবতে পারে না… কিন্তু সে-উত্তর আর এল না। এবার সত্যিই ঘুম ভাঙল, উঠে দেখি অমল চলে গেছে, শুধু পড়ে আছে একটা বই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’। ভীষণ মন খারাপ হল। তবে আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম আর কিছুদিন পরেই। দেখলাম আরও কিছু মানুষ অমলের মতো ভাবতে পারে, তাই তো আমার বাবা বইয়ের শব্দগুলোকে টেনে বার করে ফেললেন মঞ্চের উপর, নতুন এক রঙে আঁকলেন অমলের ছায়া, আর আমিও ভীষণ আনন্দে ছুটলাম সেই ছায়াকে ধরব বলে।
‘স্বপ্নসন্ধানী’ নিবেদিত ‘ডাকঘর’ প্রযোজনার প্রথম অভিনয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোতে। তারপর বিভিন্ন মঞ্চে, বিভিন্ন শহরে। প্রায়ই দেখতাম বহু মানুষের চোখে জল। অবাক লাগত, অমল তো বলছে মুক্তির কথা, ভালবাসার কথা। এসব সহজ কথা শুনে কেউ কাঁদে না কি? কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়, অমলের বয়স একই রয়ে গেল, শুধু বুড়ো হয়ে গেল চারপাশটা। অমলের চিঠি এখন পরিণত হয়েছে ই-মেলে আর ডাকঘরের নতুন নাম এখন ইনবক্স, এই ডাকঘরে অপেক্ষার কোনও জায়গা নেই। সময়ের বদলের সাথে বদলেছে মানুষের মনটাও। মানুষকে ভালবাসার চেয়ে মানুষকে ঠকানো হয়ে গেছে ঢের বেশি সহজ। মানুষ হওয়ার প্রমাণ না হলেও চলবে, দেশে থাকতে গেলে নাগরিকত্বের প্রমাণ এখন অনেক বেশি জরুরি!
এখন যদি কোনও কিশোর অমলের মতো, দইওয়ালার সাথে দই বেচতে চায়, তাহলে তাকে বাড়ি থেকে হয় নিয়ে যাওয়া হবে মনোবিদের কাছে, না হলে সেই দইওয়ালাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে ছেলেধরা হিসেবে। আর কিছুদিন পর মনে-মনে বেরিয়ে পড়ার ওপরেও জারি হবে নিষেধাজ্ঞা, শোনা যাচ্ছে ‘এ আই’ নামক কিছু একটা নাকি তৈরি হয়েছে, যা কারফিউ জারি করতে পারে মনের ভেতরেও। তবে আচমকা আবার আবির্ভাব ঘটল অমলের, কিন্তু এবার শুধু আমার বাড়িতে নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সে।
আজকে ঘরবন্দি সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক, ঘরবন্দি রাজা নিজেও। ২০২০-তে হঠাৎ এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে চার দেওয়ালের ভেতরে আটকে পড়লাম আমরা। রাস্তাঘাট থেকে গাড়ি উধাও, আর জেব্রা ক্রসিংয়ে রাস্তা পার হচ্ছে জেব্রা, হরিণ, হাতি, আর আকাশে বিমানের বদলে উড়ছে শুধুই পাখির দল। দামি-দামি সব দোকানপাট ছেড়ে কিছুদিনের জন্য আমাদের সবথেকে কাছের বন্ধু হয়ে উঠল ছোট্ট সবজির গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাওয়া পাড়ার সবজিওয়ালা। প্রতিদিন আসে সে, ঠিক সেই দইওয়ালা বা প্রহরীর মতো। জানতাম অমল চলে যাবে আবার, জানতাম কেটে যাবে এই সময়টা, আমরা আবার ভুলে যাব অপেক্ষার অর্থ, আমাদের সমাজে হয়তো কখনওই এসে পৌঁছবে না রাজার চিঠি। কিন্তু ভাবিনি, এতটা তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে যেতে পারি এই অতিমারীর সাথে মোকাবিলার অভিজ্ঞতা, যা শিখিয়েছে আমাদের সহিষ্ণুতা, আবশ্যকতা, অনির্দেশ্যতার অর্থ। আনলক প্রক্রিয়া শুরু হতে-না-হতেই ধেয়ে এল এক নতুন অতিমারী, ‘mass ডিমেনশিয়া’র অতিমারী, শুরু হল নতুন এক অধ্যায়, যা আরও অসিহষ্ণু, আরও ভয়ঙ্কর। আফগানিস্তান জুড়ে শুরু হল লকডাউন, তালিবানদের বন্দুকের নলের সামনে। কুম্ভমেলায় মেতে ওঠা আনন্দের তালে আর গণতন্ত্রের সবথেকে বড় উৎসবে, ভোটের সংখ্যার পাশাপাশি বেড়ে চলল লাশের সংখ্যা, গঙ্গাসাগরে উপস্থিতি জারি থাকলেও স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বন্ধ করা হল। একদিকে কিয়েভে দেখা গেল বাচ্চাদের হাতে রাইফেল, আর অন্যদিকে অসমে একটি গ্রামে ‘এভিকশন’ প্রক্রিয়া কার্যকরী করতে গিয়ে সেনাদের গুলিতে মেরে ফেলা এক গ্রামবাসীর মৃতদেহের ওপর বার-ছয়েক লাফাল এক ফোটোগ্রাফার। ক্ষুধার তালিকায় ভারতবর্ষ পিছিয়ে গেল আরও কয়েক ধাপ, ছ’বছর ধরে তৈরি হওয়ার কথা যে ভ্যাকসিন, সেটা তৈরি হল ছ’মাসে, আর আমরা একে অপরকে জানালাম হ্যাপি নিউ ইয়ার, কেটে গেল দুটো বছর, বেশি কিছু বোঝার আগেই। শুধু সারা পৃথিবীর অল্পসংখ্যক কিছু পরিবারের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স-এ আরও কতগুলো শূন্য যোগ হল, আর বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে বেছে নিল সিলিংফ্যান থেকে ঝুলতে থাকা দড়ির ফাঁস। আমাদের শোক জ্ঞাপন চলতে থাকবে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাল টুকটুকে হার্টব্রেকের ইমোজি দিয়ে। আবার নতুন একটা বছর শুরু।
‘ডাকঘর’-এর অনেকগুলি প্রযোজনার মধ্যে সবথেকে মন ছুঁয়ে গিয়েছিল বিখ্যাত মণিপুরি নাট্যপরিচালক কানহাইয়ালাল-এর প্রযোজনাটি। সেখানে আমার দেখা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পরিচালকের স্ত্রী) সাবিত্রী হাইসাম অভিনয় করেছিলেন অমলের চরিত্রে, তাঁর বয়স তখন ৬০-এর ঘরে। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, ছোট্ট অমলকে তিনি কীভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজের ভেতরে! এই লকডাউনের সময়টা আমাদের দেখাল এক নতুন সমাজের চেহারা। রবীন্দ্রনাথের নাটকে ‘রাজা’র অর্থ ভীষণ আলাদা, ডাকঘর বা বিসর্জনের রাজা আমরা কখনও পাব কি না জানি না, তবে এই সময় অমলকে নিজেদের ভেতর বাঁচিয়ে রাখাটা বড্ড জরুরি। রাজা হওয়ার চেয়ে দূত হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজনীয়, ঢের বেশি সুখের। ইদানীং রোজ ছাদে উঠে আকাশটাকে দেখছি, শুনতে পাচ্ছি সেই লোকটার লেখা কিছু শব্দ, সেই লোকটা, যার কাছে ইস্কুল যাওয়াটা ছিল আন্দামান জেলে যাওয়ার মতো, শুনতে পাচ্ছি অমলের শব্দ:
‘আজি যত তারা তব আকাশে
সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥
নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে
তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত আমারি অঙ্গে বিকাশে॥’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র