ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শাঁওলি কথা, অমৃতসমান


    শান্তনু বসু (January 22, 2022)
     

    স্মৃতিধার্য নানবিধ কালবিন্দু একত্রিত করে লিখে ফেলতেই পারতাম, ‘নানা শাঁওলি মিত্রের একখানি মালা’। কিন্তু সে-লেখার প্রয়োজন হয় শোকগাথা গাইবার জন্য। মৃত্যু যেহেতু জীবনের থেকে স্বভাবতই মহান, তার পরম নিশ্চয়তার জন্য, তাই ‘তরী হতে তীর’-এর স্বভাবপ্রবাহ নিয়ে ছিঁচকাদুনি

    অনেকটা ছিঁচকে চুরির মতো। কোনও মহতী বেদনা তার মধ্যে নিহিত নেই।

    শাঁওলি মিত্র জন্মের কারণেই এক বিশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী। বলিউডি মাপকাঠিতে পরিবারতান্ত্রিকতা তাঁর শৈল্পিক সত্তার নির্মাণ ও উত্তরণের পাথেয়। নিষ্ঠা ও চর্চা, যে-দুটি কারণে তাঁর পরিবার বিখ্যাত, প্রখ্যাত এবং কোনও-কোনও সময়ে কুখ্যাত, সেই নিষ্ঠা ও চর্চা শাঁওলি মিত্রের অঙ্গরাগ। মিত্র পরিবার বারবার জানা ও জানানোর গণ্ডিকে ভেঙে বেশি করে জানতে চেয়েছেন, অনেকটা অয়দিপাউসের মতো। তাই তৃপ্তি মিত্র যখন এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া— তিন মহাদেশে প্রথমবার ইঁউজ আয়োনেস্কোর ‘গণ্ডার’ নাটক নির্দেশন করেন ‘বহুরূপী’র প্রযোজনায়, সে-নাটকের অনুবাদ করেন শাঁওলি মিত্র। এখানে স্মরণ করা দরকার যে, ফরাসি সাহিত্য পাঠ ও চর্চা বাঙালি ইংরেজদের থেকে দাক্ষিণ্যপ্রাপ্ত হয়নি, সে বারবার নিজে খুঁজে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের মণিমুক্তো, তা সে মলিয়ের-ই হোক বা আয়োনেস্কো। সুতরাং অ্যাবসার্ড নাটকের অন্তহীন, চক্রাকার চাল, ‘গণ্ডার’ নাটকের ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ও সাধারণ একাকিত্বের দ্বন্দ্ব শাঁওলি মিত্রকে আকর্ষণ করেছিল তাঁর শৈল্পিক জীবনের প্রথম ভাগেই। ইবসেনীয় ‘দশচক্র’-এর ব্যক্তি বনাম সমাজের দ্বন্দ্বে ব্যক্তির অহংকারী স্বপ্নময় স্বঘোষণ থেকে আয়োনেস্কোর ‘গণ্ডার’-এর ভাঙাচোরা, অনিশ্চিত ব্যক্তির স্বগত উক্তি পর্যন্ত চলাচল, নিশ্চিত ভাবে নেহেরুপন্থী সমাজবাদে রাষ্ট্রের কল্পনার অবক্ষয় ও পতনের লিপিকারিতা।

    ‘কথা অমৃতসমান’-এ শাঁওলি মিত্র
    ছবি ঋণ পঞ্চম বৈদিক

    শাঁওলি মিত্র বহুরূপীর ‘দশচক্র’ প্রযোজনা থেকে, বহুরূপীর ‘গণ্ডার’ প্রযোজনা থেকে আবার ফিরে আসবেন ১৯৮৫ সালে ‘দশচক্র’-এর অভিনয়ে। ব্যক্তির সামর্থ্যের সীমারেখা নিয়ে বারবার শাঁওলি মিত্র তাঁর জীবনে ভাবনাসঙ্কুল হয়ে থাকবেন। তাঁর অভিনীত প্রতিবাদী চরিত্ররা বারবার হেরে যাবে, আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, আবার হেরে যাবে, কখনও-কখনও তাঁদের হারিয়ে দেবেন অভিনেতা বা নির্দেশক শাঁওলি মিত্র নিজেই। 

    শাঁওলি মিত্রের জনপ্রিয়তার শুরু কণ্ঠাভিনেত্রী হিসেবে। রেডিয়ো নাটকে তাঁর লাগাতার যোগদান এবং গ্রামগঞ্জ, শহর— সর্বত্র তাঁর প্রচার, প্রসার এবং প্রখ্যাতি সত্তর-আশির দশকের এক মূল সাংস্কৃতিক চিহ্ন। শ্রাবন্তী মজুমদারের পাশাপাশি শাঁওলি মিত্র রেডিয়ো নাটক তথা রেডিয়ো মাধ্যমের নানাবিধ কণ্ঠাভিনয়ে অতুল জনপ্রিয়। এই কণ্ঠাভিনয়, যা শরীরকে অদৃশ্য রেখে শরীর ও মন সমন্বিত সমস্ত আবহকে তুলে ধরতে চায়, এর মধ্যে বাঙালিমানস তথা মিত্র ঘরানার পরিচয় নিহিত। প্রসঙ্গত স্মরণ করে নেওয়া যাক যে, শম্ভু মিত্র, তাঁর প্রাথমিক নির্দেশনকর্মেই অশরীরী উচ্চারণের প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ‘রাজা’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজা-র চরিত্রে অভিনয় অধিকাংশ অভিনেতাকেই আকৃষ্ট করবে না, কারণ দুটি নাটকেই চরিত্রের শারীরিক উপস্থিতি প্রায় বা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। নাট্যকারের এই নিষেধ আকর্ষণ করেছিল শম্ভু মিত্রকে। আকাশবাণীর মতো দুটি চরিত্রের কণ্ঠস্বর, দুটি চরিত্রই পুরুষ, দুটি চরিত্রই ক্ষমতাসম্পন্ন, দুটি চরিত্রই রাজা, তথা দুটি চরিত্রই জাল বা অন্ধকারের আড়ালে স্বেচ্ছানির্বাসিত। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, দেখতে না পেয়ে শুধু শুনতে পেলে, চরিত্রের এক ধরনের দৈবীকরণ ঘটে। সে-চরিত্রের সব কথা দৈব ঘোষণার মতো অবশ্যমান্য হয়ে ওঠে। সে-চরিত্র ভগবান হয়ে ওঠে। সোফোক্লেস থেকে পিন্টার পর্যন্ত এই অশরীরী কণ্ঠস্বর ভগবানের প্রতিভূ। এ-কথা অনুমান করতে সংশয় হয় না যে, এই অশরীরী কণ্ঠস্বরের চরিত্রই নয়, তার অভিনেতাও এক আয়ত্তাতীত ক্ষমতার প্রতিভূ হয়ে ওঠে, ঈশ্বর হয়ে ওঠে। এই ধরাছোঁয়ার গণ্ডির বাইরে অভিনেতার অবস্থিতি অভিনেতাকে মানুষ থেকে তারকা বানায়, সেইজন্যই অভিনেতারা বারবার তারকা হয়ে ওঠবার জন্য টেকনিকাল মাধ্যমের আড়াল ব্যবহার করেন। রেডিয়ো, টিভি, সিনেমাতে থিয়েটারের মতো অভিনেতাকে স্পর্শ করা যায় না। তার দৈবীকরণ ত্বরান্বিত হয়। সেইজন্যে অনেক সময় মঞ্চাভিনেতাও তাঁর প্রাত্যহিক জীবনকে দর্শকের কাছে অনুপলব্ধ করে রাখতে চান, নইলে তারকা-লাবণ্য ম্লান হয়ে যায়। অভিনেতার এই আকাশবাণীয় দৈবীকরণ শাঁওলি মিত্রকে আকর্ষণ করেছিল নিবিড়ভাবে এবং টেনে নিয়েছিল তার গোপন আঙিনায়, যেখানে অভিনেতা সকলের মধ্যে থেকেও সম্পূর্ণ গোপনচারী। একটুকুও আশ্চর্য লাগে না ভাবতে যে, রবীন্দ্রনাথ রেডিয়ো প্রচারের দপ্তরের নামকরণ করতে ‘আকাশবাণী’ শব্দটিকেই বেছে নিয়েছিলেন।

    শম্ভু ও শাঁওলি মিত্র

    আকাশভাষিত শাঁওলি মিত্রের শরীরী উজ্জ্বল উদ্ধার শম্ভু মিত্রের তত্ত্বাবধানে শাঁওলি মিত্রের একক অভিনয় ‘নাথবতী অনাথবৎ’-এ, যদিচ বাংলামঞ্চে দীর্ঘ একক অভিনয়ের লিপিত মাপকাঠি তৃপ্তি মিত্রের ‘অবিস্মরণীয় একক অভিনয় অপরাজিতা’, এই নামেই বিজ্ঞাপিত হত নাটকটি এবং ১৯৮৭ সালে তৃপ্তি মিত্রের অসুস্থতার জন্য বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত একদিন বা বেশি হলে দ্বিতীয় দিনে সমস্ত টিকিট নিঃশেষিত হয়ে যেত। দুপুর একটার সময় একাডেমির কাউন্টার খুলবার সময়ে দেখা যেত, শ-দুয়েক লোক লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। লাইন করে দাঁড়িয়ে নাটকের টিকিট কেনার সেই সময়ে একটা বিশেষ চল ছিল। শম্ভু মিত্র যখন ১৯৮৫ সালে ‘দশচক্র’র পুনঃপ্রযোজনা করেন, তখন রবীন্দ্র সদনে সাতটি শো-র টিকিট বিক্রি হয়ে যায় কাউন্টার খোলার চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। সেই টিকিট কাটবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের দূরপ্রান্ত থেকে চিঁড়ে-মুড়ি বেঁধে, রবীন্দ্র সদনের ফুটপাথে দু-রাত আগে থেকে লাইন দিয়েছিলেন অনেকেই। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নান্দীকার নাট্যমেলার প্রখ্যাত কোনও নাটকের দোতলার সস্তার কোনও টিকিটের জন্য রাত জেগে লাইন দিতে হত। এহেন লাইন দিয়ে নাটক দেখার টিকিট কাটা ‘নবান্ন’ নাটকের উত্তরাধিকারসম মনে হত।

    সমস্ত ‘নাথবতী…’ জুড়ে হাহাকার— ‘আহা বেচারি মেয়েটা’— abjection-এর পরাকাষ্ঠা, শুধু বেদনা, আক্ষেপ, সমর্পণ। এই শাঁওলি মিত্র নেমে দাঁড়াবেন পথে, চলবেন মিছিলে, কোরাসের তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে দু-চারটি কথার বেশি বলবার দাবি করবেন না, ‘পশুখামার’-এ। কিন্তু তার জন্য ঘটতে হবে নন্দীগ্রাম, তার জন্য লাশ পড়বে রাস্তায়, লাশ উড়বে আকাশে। এমার্জেন্সির সময় যে-রাষ্ট্রের প্রতি শম্ভু মিত্র বিশ্বাস হারাতে পারেননি, সেই রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন শাঁওলি। প্রসঙ্গত বিচার্য, সত্তর দশকের কংগ্রেসি কালো হাত আর ২০০৯-’১০-এর ফ্যাসিবাদী বামপন্থার মধ্যে অনেক তফাত, অনেক গঙ্গাজল।

    যাই হোক, তৃপ্তি মিত্রের ‘অপরাজিতা’ উথালপাথাল সত্তর দশকের প্রযোজনা, তীব্র আধুনিক সংকট, নারীমুক্তির দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে নকশাল আন্দোলনের প্রসঙ্গ পার করে যৌনকর্মীর কর্মসম্মান পর্যন্ত তার বিস্তার। এরই পরতে-পরতে জড়িয়ে ছিল দেশভাগ-উত্তর ঘটি-বাঙাল বিভাজনের সকৌতুক তদন্ত, যৌন প্রতারণাকে পুরুষবাদী রাষ্ট্রীয়তার উদাহরণস্বরূপ করে প্রচণ্ড উপহাস। ‘অপরাজিতা’ প্রাত্যহিক, বাস্তববাদী এবং ‘শেষ হয়ে না হইবে শেষ’-এ বিশ্বাসী এক লড়াকু ব্যক্তিত্বের বর্ণনা। নিশ্চিত ভাবে এক কমিউনিস্ট মহিলার চিন্তাপদ্ধতিতে সমৃদ্ধ ‘অপরাজিতা’— তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফ্রাঙ্কারামের মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। 

    ‘নাথবতী…’ শম্ভু মিত্রের গোলপার্কের ফ্ল্যাটে প্রায় চার বছর সময়কাল নিয়ে তৈরি। নাটকের প্রাথমিক পর্যায়েই বিভিন্ন লোক-আঙ্গিকের চর্চা, বিশেষ ভাবে তিজন বাঈ-এর কাছে পাণ্ডবানীর প্রশিক্ষণ। সে-সময়ে কলকাতার নাটক ছেড়ে সারা দেশে লোকনাট্যের প্রভাব আত্তীকরণের ঝড় উঠেছে। বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভারত উৎসব। সেখানে কিশোরী আমনকার অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনাবার জন্য তিন মিনিটের স্লট। রতন থিয়াম ‘ইম্ফল ইম্ফল’-এর মতো রাজনৈতিক নাটক থেকে সরে মহাভারত ত্রয়ী বানিয়ে তুলছেন প্রায় সামন্তবাদী কোরাস রেপার্টারিতে, দক্ষিণপন্থী বি.ভি.করন্থ পাশ্চাত্যকে জুড়ে দিচ্ছেন প্রাচ্যের কাঁথায়। ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর আর্টস’ যার মূল অর্থ আমেরিকান গাড়ি বিক্রির লভ্যাংশ তার দাক্ষিণ্যে বংশী কল সন্ধান করছেন ভারতীয় হাস্যরসের। আন্তর্জাতিক ভাবে ভারতীয় গিরিশ কারনাডের নাটক নিয়ে তার মধ্যে পঞ্জাবের নকল সম্প্রদায় ও পশ্চিমি আধুনিকতা মিলিয়ে নীলম মানসিং অহরহ পাড়ি দিচ্ছেন ফ্রান্স-ইংল্যান্ড। কলকাতার নাটক তখনও ভঙ্গি দিয়ে চোখ না ভোলানোর শপথ নিয়ে, প্রলোভন নদীর কিনারে বেণী না ভেজানোর পন্থাবলম্বী। এই সময়ে ১৯৮৭ সালে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং তার কাছেপিঠেই বিভাস চক্রবর্তীর ‘মাধবমালঞ্চী কইন্যা’। 

    ‘নাথবতী অনাথবৎ’-এ শাঁওলি মিত্র
    ছবি ঋণ পঞ্চম বৈদিক

    ‘নাথবতী…’ মহাভারত আশ্রিত, তা লোকনাট্যর ভঙ্গি সম্পৃক্ত, এবং একই সঙ্গে নারীত্বের অভাগিনীপনার আখ্যান। ‘নাথবতী…’তে ভাল লোকেরা ভাল, খারাপ লোকেরা খুব খারাপ। যাদের ভাল হবার দায় ছিল, পুরুষ হবার জন্য তারাও খুব খারাপ। যারা অত্যাচারী, তারা নিশ্চিতরূপে অত্যাচারী। যারা অত্যাচারিত, তারা আজীবন, আমরণ, অনন্তকাল অত্যাচারিত। ‘বাবুমশাইরা, এরম একেকটা কাল আসে পৃথিবীতে, যখন এইসব গুণীজনেরা (দর্শকদের দিয়ে তীব্র অঙ্গুলিনির্দেশের সাথে) সব চুপ করে থাকে আর যে অত্যাচারিত হয় সে হয়েই যায়, হয়েই যায়, হয়েই যায়’— এই উচ্চারণের সাথে প্রেক্ষাগৃহতে করতালির ঝড় বয়ে যেত। সেই সাথে লিখিত হয়ে যেত যে, প্রথমত, অত্যাচারিতের পক্ষে কথা বলা নাগরিক বাতানুকুল দর্শক আসনে বসে থাকা মধ্যবিত্তের কর্তব্য এবং তারা যদি প্রতিবাদ না করে তাহলে অত্যাচারিতরা অত্যাচারিত হয়েই যাবে। নিপীড়িতজনের এই শৈশবীকরণ বঙ্গীয় বামপন্থার এক অসামান্য ভ্রান্তিবিলাস। নিপীড়িত জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে আত্মীকরণ, আঙ্গিকরণ, শুদ্ধিকরণ ও রাষ্ট্রীয়করণের জন্যে মধ্যবিত্ত বামপন্থা সব সময়ে দখল করেছে মধ্যভূমি। নানাবিধ উচিত-অনুচিতের দ্বন্দ্বে পথভ্রষ্ট করেছে সমস্ত অধিকারের লড়াইকে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও জ্যোতি বসুর এই আঁতাতের মতোই এই উচ্চারণ কিছু না করে কেন্দ্রমণি হয়ে থাকা নাগরিক মধ্যবিত্তের পিঠে যারপরনাই সুখকর সুড়সুড়ি এবং লিখিত সাফল্য। দ্বিতীয়ত, দর্শকের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশে অভিনেত্রী তার গুণীজন-আত্মপরিচয়কে লুকিয়ে ফেলতে চাইছেন চরিত্রের অবগুণ্ঠনে, যদিচ তার পরিশীলিত ভাষার প্রভাব অঙ্গরাগের মতো লেগে রয়েছে লোককথনের ভঙ্গিমার ওপরে। সমস্ত ‘নাথবতী…’ জুড়ে হাহাকার— ‘আহা বেচারি মেয়েটা’— abjection-এর পরাকাষ্ঠা, শুধু বেদনা, আক্ষেপ, সমর্পণ। এই শাঁওলি মিত্র নেমে দাঁড়াবেন পথে, চলবেন মিছিলে, কোরাসের তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে দু-চারটি কথার বেশি বলবার দাবি করবেন না, ‘পশুখামার’-এ। কিন্তু তার জন্য ঘটতে হবে নন্দীগ্রাম, তার জন্য লাশ পড়বে রাস্তায়, লাশ উড়বে আকাশে। এমার্জেন্সির সময় যে-রাষ্ট্রের প্রতি শম্ভু মিত্র বিশ্বাস হারাতে পারেননি, সেই রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন শাঁওলি। প্রসঙ্গত বিচার্য, সত্তর দশকের কংগ্রেসি কালো হাত আর ২০০৯-’১০-এর ফ্যাসিবাদী বামপন্থার মধ্যে অনেক তফাত, অনেক গঙ্গাজল। যাই হোক, সে অনেক পরের কথা, আপাতত নুন ও পান্তাভাতের গল্প এই পর্যন্তই। 

    বলা হল না দুই সুদর্শনার কথা। বলা হল না বুলুদা তথা ‘পুতুলখেলা’-র বুলুর কথা। বল হল না ‘বিতত বিতংস’ ও বাস্তববাদের কথা। বলা হল না বামপন্থী আত্মসমালোচনার কথা। বলা হল না যে-শিল্পী মূলত ব্যক্তি, তার ব্যক্তিত্বের আলো-আঁধারিই তার পরিচয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook