ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শূন্যের মাঝারে ঘর


    জয়দীপ মিত্র (January 15, 2022)
     

    গঙ্গাসাগর মেলাকে তার ঠিক ঠিক ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক-ইউফোরিক পরিপ্রেক্ষিতে চিনতে শিখেছি যে-মানুষটির জন্য, তিনি কোনও অর্থেই মুখে মেধা ও মননের মাস্ক পরেন না। তিনি এমনি বিষয়ী মানুষ, নাম মধুসূদন বাগ। 

    দ্বীপবাসী বললেই যে একরকম বিচ্ছিন্নতা ও নির্বাসিত অভিমানের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মধু বাগকে দেখলে সেটি হবার উপায় নেই। মধু ঘোর কালো, তাঁর কাঁধ চওড়া, তিনি খাড়া ছ’ফুটের ওপর। মুঠির ঘের ও চোয়ালের গড়ন দেখলেই বোঝা যায় তিনি লেঠেল পুরুষ, ভাবালুতা তাঁর ধাতে নেই। চার প্রজন্ম আগে মধুদার পূর্বপুরুষ ঘাটালের কাছাকাছি কোনও গ্রাম থেকে সর্বহারা হয়ে সাগরদ্বীপের নরহরিপুরে চালান হন। এই জবরদস্তি পরিযাণের জন্যই নরহরিপুর গ্রামের প্রায় সবটা নিয়ে মধু ও তাঁর জ্ঞাতি-গুষ্টি এখনও টিকে আছেন। অবশ্য তাতে সুন্দরবনে যে কোনও ঝড়ের পর নোনামাটিতে উজিয়ে আসা শতাব্দীপ্রাচীন সেই প্রথম পুরুষটির প্রতি মধুদার হিংস্র মুখ-ছোটানো ঠেকানো যায় না। এহেন পরিস্থিতিতে আমার বন্ধু বরুণ একবার মধুদার ফোন কান থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হঠাৎ শিউরে উঠে বলেছিল, ‘বাপ রে, খিস্তির এক-একটা সিনট্যাক্স দেড় ফুট লম্বা।’

    মেলার সময়টা ছাড়া অন্য সময়ে নরহরিপুর গ্রামে গেলে মধু বাগকে মনে হতেই পারে একজন বিস্তারধর্মী গৃহস্থ। দু’একর ধানিজমির পাড়ে তুলসীমঞ্চ আগলে রাখা মাটির তিনটে বাড়িকেও যথেষ্ঠ লক্ষ্মীশ্রী-মাখা মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, এই মনে হওয়া পুরোটাই ভাঙনের মাটিতে বটগাছের ঝুরি নামানোর বিভ্রম। নিজেরা খাওয়ার পর উদ্বৃত্ত ধান ফড়েকে বেচে নগদ যা হাতে আসে, তা আলু-ডাল-তেলেই ফুরোয়। কৈশোর কোনওক্রমে পেরিয়েই মধুদার দুই ছেলে তাই চলে গেছে গুরগাঁও আর ত্রিবান্দ্রম— তারা নির্মাণকর্মী। মধুদাও চাষের কাজ থাকে না যখন, তখন প্রতি রবিবার আরও অনেকের সাথে কলকাতায় ফলপট্টিতে এসে ম্যাটাডোর বোঝাই করে আখ নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেন সাগরদ্বীপের বাজারে বাজারে। এরপরেও আপদে-বিপদে মোটামুটি মানুষ হয়ে টিকে থাকার জন্য বাড়তি যেটুকু নগদ লাগে তার জোগান দেন কপিলমুনি— বাৎসরিক গঙ্গাসাগর মেলায়।

    মধু বাগের মতো চরাচরব্যাপী জলের মাঝখানে একচিলতে ধানিজমি বুকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষকেই আমার মনে হয় ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের কালিবান, যাদের অর্ধেক মানুষের আর বাকি অর্ধেক দানবের। টেম্পেস্ট-ও তো এখন বহুমাত্রিক— তা আমফান ও যশ যতটা, লকডাঊনও ততটাই। প্রধানমন্ত্রী টিভির পর্দায় ফেরারি আসামির মতো নাকমুখ গামছায় ঢেকে এসে যথাযথ নাটকীয়তায় লকডাউন ঘোষণা করার দেড়মাস পরে মধুদার দুই ছেলে ধুঁকতে-ধুঁকতে কপর্দকশূন্য অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। এখনও তারা বাড়িতেই। মধুদার ফলের ব্যবসা আবার শুরু হয়েছে, কিন্তু আমফান ও যশের ধাক্কায় জমিতে ফলন নেমেছে অর্ধেকের নীচে। মধুদার লেখাপড়া-করা জামাই কাজ করত কোয়েস্ট মল-এ, লকডাউনে চাকরি খুইয়ে সে কচুবেড়িয়া বাজারে সেলুন খুলবে বলে আপাতত পুঁজির অপেক্ষায়। কালিবান যে প্লাবন চিনত, তা ডোবাত হয়তো, কিন্তু ভাসাত না। এখন কোন কালো-জাদুতে দাসত্ব রুখবে আজকের কালিবান?

    পাঁচদিন আগে মধু বাগের যে ফোনটা পাই তা প্রাবল্যে ছিল অর্ধেক নয়, পুরোটাই দানবিক— ‘মেলা বন্ধ হচ্ছে না কি দাদা? জানো কিছু? মেলা বন্ধ হলে এমনিই মরে যাব যে।’ শূন্যে ঘর বাঁধা একজন মানুষের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ার ভয় আমাকে টলিয়ে দেয়। দু’লক্ষ ১২ হাজার মানুষ থাকেন গোটা সাগর ব্লকে। আর এই কোভিডের ঝামেলার আগে ২০১৯ সালে গঙ্গাসাগর মেলায় তীর্থযাত্রী এসেছিলেন ১৫ লক্ষ। তাই সোজা হিসেবে, মেলার সময়ে প্রতি সাগরদ্বীপবাসী পেয়ে যাচ্ছেন অন্তত সাতজন আয়ের-সম্ভাব্য-উৎস, মধু বাগের মতো ভেঙেচুরে যাওয়া পরিবারগুলোর কাছে যারা ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও প্রয়োজনীয়। নিজের যুক্তিবাদী সত্তাটাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি যদিও, তবু মনে মনে বলেই ফেলি — হোক। মেলা হোক।

    ভক্তি তরঙ্গ

    অবশ্য ফোনে মধুদাকে বিষম জরুরি যে কথাটা বলা হয়নি, সেটা হল— মরার ভয় কোরো না মধুদা। কালিবানরা মরে না তো, শুধু নাটকের শেষ দৃশ্যে মায়াবী আলোয় আরও মায়াবী হয়ে মিলিয়ে যায়।

    সমবেত শীতবোধ

    গঙ্গাসাগর মেলা বলতেই প্রথম যে অনুভূতিটা আমার সর্বাঙ্গে জাঁকিয়ে বসে তা নেহাতই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য— প্রবল শীত।

    যতবার গেছি, প্রতিবারই এসপ্ল্যানেড বাসগুমটি থেকে সাগরমেলার সরকারি বাস ধরতে বিকেল পেরিয়ে গেছে। ফলে জোকা পেরোনোর আগেই অন্ধকার, আর আমতলা পেরোতেই ঘন শীত। চলন্ত বাসের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে এসে ছুরির মতো শাণিত হাওয়া ফালাফালা করেছে মুখ-চোখ, কিছুটা বোধহয় হৃদয়ও। কারণ ঠিক এই পর্যায় থেকেই চারপাশের রেজাই-কম্বল মুড়ি দেওয়া মানুষজন পরিপাটি পুঁটলি, সেফটিপিন-বেঁধানো রেক্সিনের ব্যাগ, টোল খাওয়া ঘটি, ঝকঝকে গামছা ইত্যাদি নিয়ে আমার কাছে ক্রমশ আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। নাগরিক মগজ নিয়ে সংসর্গে ও সমন্বয়ে যাওয়া বড় সহজ কম্মো নয়, কিন্তু তবুও দেখি বুদ্ধের ভূমিস্পর্শমুদ্রায় মধ্যমা ছুঁয়ে আছে হিমে-ভেজা ধুলো। শীতের তাড়নায় আরও বেঁধে-বেঁধে বসা মহিলাদের দল থেকে কান্নার মতো অস্পষ্ট ও আকুতিময় গান কানে এলে, এখনো নিজের মধ্যে অচেনা এক কম্পন টের পাই। অথচ, সমস্ত কিছুর প্রতি অদ্ভুত মমত্ববোধে আচ্ছন্ন হতে হতেও আমি নিজের রাশ টেনে ধরতে চাই কেন?

    অনেকদিন ধরেই জেনে এসেছি নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা, মার্কসের আফিম। সদ্য পড়েছি শশী তারুর কেন ‘ইনক্লুসিভ অ্যান্ড টলারেন্ট’ না হয়ে ‘ইনক্লুসিভ অ্যান্ড অ্যাকোমোডেটিভ’ হওয়ার জন্য হিন্দুধর্মকে ‘বধাই’ দিচ্ছেন, ও নিজেকে হিন্দু বলছেন। এই সমস্ত মাথাভারী তত্ত্ব অ্যামার মনের লিবারাল ঝোঁকটাকে স্বস্তি দিয়েছে হয়তো, কিন্তু সংশয় কাটায়নি। কঠোরভাবে নিজেকে নিরীশ্বরবাদী ভাবলেও বহু মানুষের যৌথ, অতীন্দ্রিয় আবেগ অন্তত ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত আমার মনকে দোলাত ঠিকই। যদিও এখন এই আবেগের আভাসমাত্র দেখলে আমি আশঙ্কায় কাঁপতে থাকি। আমার আরও শীত করতে থাকে।

    রাজস্থানের সতীশ কানওয়ারের সাথে আলাপ হয়েছিল এরকমই চলন্ত বাসে। চুরু জেলার কোনও গ্রামের আটজন হাসিখুশি বৃদ্ধাকে নিয়ে মুখিয়া সতীশবাবু চলেছেন সাগরমেলায়। ত্বক ও পোশাকের জেল্লা দেখে দিব্যি বোঝা যায় এঁরা সম্পন্ন ভূস্বামী, অর্থাৎ, শ্রেণিগতভাবে, কড়া ফিউডাল। অথচ দেখলাম তীর্থযাত্রীর শ্রেণিহীন হওয়ার যে নিয়ম আছে এঁরা তা দিব্যি মেনে চলেছেন— বাকি সকলের সাথে এই মহিলারাও গান গাইছেন মরম ঢেলে, সমের কাছটায় এসে সতীশবাবুও হেঁড়ে গলা কোরাসে মেলাচ্ছেন। একফাঁকে সতীশ কানওয়ার জানালেন, তাঁদের সেই বছর সাগরমেলায় আসার মূল কারণ গত দু’বছরের অনাবৃষ্টি। যজ্ঞটজ্ঞ করে পুরোহিত বিধান দিয়েছেন, হরিদ্বার, প্রয়াগ, কাশী ও সাগরদ্বীপে বহতা গঙ্গার জল গ্রামে নিয়ে এসে জমিতে ছড়িয়ে দিলে অনাবৃষ্টির অভিশাপ কাটবেই। এতগুলো মানুষকে স্রেফ ঢপ দিয়ে দেশটা লম্বালম্বিভাবে পরিক্রমা করতে প্ররোচিত করার জন্য পুরোহিতকে যথেচ্ছ গালি দিলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, এই সারমন এতজন মহিলাকে গ্রাম-সমাজের চোখের আড়ালে একান্ত নদীর কাছে নিয়ে যাওয়ার অছিলা নয় তো? মানুষের নদীর কাছে যাওয়া তো আবহমানকালের কাব্য। স্বয়ং নাস্তিক নেহরুও উইলে লিখেছিলেন, তাঁর চিতাভস্মের একটুখানি যেন এলাহাবাদের সঙ্গমে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, কারণ গঙ্গার কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য তাঁর কাছে না থাকলেও তিনি মনে করেন এই নদী এই দেশের অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে বহমান। 

    উইল লেখার সময়ে সেই ভবিষ্যতের গেরুয়া চেহারাটা নেহরু আন্দাজ করতে পারেননি নিশ্চয়ই। পারলে হয়তো চিতাভস্ম ছাইগাদায় ফেলতে বলতেন।

    জোয়ারের জলযান

    হারউড পয়েন্টে বাস থেকে নেমে টিকিট কেটে জেটিতে ওঠার বহুদূর লম্বা গ্যাংওয়ের মুখটায় এসে প্রতিবার আটকে যাই। ভাটা চলছে। লঞ্চ ছাড়বে জোয়ার এলে।

    জোয়ার আসতে আসতে অবশ্য ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। কামড়ে ধরা ঠান্ডায় চা খাই বারচারেক। এপারের মানুষ— যাঁরা প্রায় সকলেই মেলার সময়ে দোকান লাগান হারউড পয়েন্টে— ভাটা ও জোয়ারের মধ্যবর্তী এই সময়টা শুষে নিতে চান প্রাণপণে। ত্রিপল-বাঁশের অস্থায়ী দোকানের ভিতরে-বাইরে দেদার ভিড়, অকাতরে বিকিয়ে যায় সবজি-ভাত, পরোটা, ঘুগনি, জিলিপি, চাউমিন, এমনকী মোমো। অসংগঠিত এই ব্যবসার পুরোটাই পারবারিক ভেঞ্চার, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ চাষির অর্থকরী বিকল্প শ্রমদান। একবার বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা মেয়েকে ফ্রকের ওপরে নামমাত্র সোয়েটার গায়ে দিয়ে মাঝরাতে ঘুমচোখে কাঁপতে-কাঁপতে রিনরিনে গলায় খদ্দের ডাকতে দেখে ওর দোকানেই ঢুকে পড়ি। দোকানটা— মেয়েটাও— রাজনগর গ্রামের বিপুল সামন্তর। গরম অমৃতি খেতে খেতে শুনলাম, আগের বছর দোকান দিয়ে বিপুলবাবুর লাভ হয়েছিল ১২ হাজার ৭০০ টাকা— ‘এখানে-ওখানে দিয়েথুয়ে হাতে ছিল, ধরেন, ন-হাজার। ক্যাশ।’ খরিফের ফলন ভাল না হওয়ায় পুরো ক্যাশটাই উদরে গেছে। এবার ‘সবদিক সামাল-সুমাল দিতি পারলে’ আগামী শীতে ঐ ছোট্টো মেয়েটার একটা গরম জ্যাকেট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে শুনলাম।

    আলোর ঠিকানা

    হারউড পয়েন্ট ও সাগরদ্বীপের মাঝখানে দরিয়া অকূল মনে হলেও তা গঙ্গা নয়— গঙ্গার শাখানদী, নাম মুড়িগঙ্গা। এ-নদী পেরোতে ভরা জোয়ারেও এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। টিমটিমে আলো জ্বেলে খোলা লঞ্চ রাত্রির জোয়ারে ভেসে গেলে এক অনন্তযাত্রার অনুভূতি হয়। লঞ্চের ধাতব মেঝে আরও ঠান্ডা, তার ওপরেই জড়ামড়ি করে মিশে থাকা ভিন্ন ভিন্ন মানবশরীর প্রথম কিছুক্ষণ ঝিম মেরে নিশ্চল হয়ে থাকে। এপারের জেটির আলোগুলো কুয়াশা শুষে নেওয়া মাত্র লঞ্চের জান্তব গোঁ-গোঁ উপশব্দ ছাপিয়ে একটা অন্যরকম অনুরণনের শব্দ জেগে ওঠে। শূন্যে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীন ভেসে যাওয়ার লিরিকাল ভবিতব্যকে ভয় পেয়েই যেন হঠাৎ সবাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে স্লোগান দিতে থাকেন— গঙ্গা মাইয়া কি জয়, কপিল মুনি কি জয়। এক চাহনিতে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রকে পুড়িয়ে দিতে পারেন যে মুনি, তিনি কয়েক লক্ষ দেহাতি মানুষের তরল বিশ্বাসে বছরে একবার গলা ভেজাতেও পারেন নিশ্চয়ই।

    স্লোগানে গলা ক্লান্ত হয়ে এলে শুরু হয় গান। ঝিঁঝির ডাকের মতো প্রাকৃতিক হয়ে গান ভাসতে থাকে যত্রতত্র। সর্বত্র। একবার শুনেছিলাম কুহকমোড়া নদীর বুক থেকে একটা করতালের শব্দ উঠে এসে মিশে যাচ্ছে গানে। হয়তো কাছেই ভাসছিল আরও একটা লঞ্চ, রাত্রে অতি ঘন কুয়াশায় তাকে দেখা যাচ্ছিল না, আর সেও দেখতে পাচ্ছিল না আমাদের, তবু সেই লঞ্চের কোনো রসিক করতাল হাতে ছুঁয়ে যাচ্ছিল অচিন সুর। অস্পষ্ট নদীর ওপর এই শব্দে শব্দর যোগ আত্মা দিয়ে আত্মা ছোঁয়ার মতোই গভীর মনে হয়েছিল।

    দু’ফেরতা খড়ের বিছানা

    দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সমস্ত প্রাইভেট বাস, ভ্যান, অটো, টেম্পো মেলার সময়টায় সাগরদ্বীপে খেপ খেলতে হাজির হয় বোধহয়। কচুবেড়িয়া ফেরিঘাটের বাইরে যাচ্ছেতাই গোলমাল, কে ঘাড় ধরছে কে ব্যাগ টানছে বোঝাই যায় না। ঝামেলা কাটিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরদ্বীপের মেলার প্রান্তটায় পৌঁছই যখন, তখন সচরাচর রাত আড়াইটে। দেখি সামনে কয়েক হাজার হোগলাপাতার ছাউনি সৈন্যশিবিরের মতো সারিবদ্ধ, সুবিন্যস্ত। চতুর্দিকে অজস্র আলোর স্তম্ভ আর নজরমিনার, সেই সাগরের জল পর্যন্ত প্রতিটা বালির কণা ঝকমক করছে। মেলার অনুষঙ্গে এতটা স্পষ্টতা কীরকম যেন ঠিক মানায় না। প্রথমবার মেলায় এসে দেখেছিলাম আলোর ভোল্টেজ কমিয়ে দলা দলা হিম নেমে আসছে বালির ওপর, আর অনেক দূরে প্রায় ঢেউয়ের কাছে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন এক নাগা সন্ন্যাসী— তার পিছনে অসীম অন্ধকার।

    প্রথমবার মেলায় গিয়ে এই হোগলার ছাউনি ব্যাপারটার সাথেও পরিচয় হয়। আমাদের পিঠে সরকারি ছাপ নেই, পকেটে প্রেসকার্ড নেই— তাই হোগলাই ভরসা। আগে সাগরদ্বীপের লোক মেলার বেশ ক’দিন আগে বালির ওপর খানিকটা এলাকা ঘিরে ফেলে নিজের নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতেন। তাঁদেরই কাউকে কিছু টাকা দিয়ে, তাঁর কাছ থেকে কঞ্চির ফ্রেমে সাঁটা হোগলাপাতার তেকোনা ছাউনি ও তলায় বিছোনোর জন্য খড়ের আঁটি কিনে, তীর্থযাত্রীরা তাঁরই নিয়ন্ত্রণে থাকা গণ্ডির ভিতর শিবির পাততেন। এখনও, জল পর্যন্ত বালুকাবেলা কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হলেও, নিয়মটা বোধহয় একই আছে। ‘হোগলা ফেলা’র এই প্রক্রিয়া বোঝবার জন্য আমরা দুই বন্ধু ইতস্তত ঘুরছি যখন, তখনই প্রথম আলাপ মধুসূদন বাগ-এর সঙ্গে। এবং মধুদার সাম্রাজ্যে আমাদের সেই প্রথম প্রবেশ— ‘আপনারা আমার এখানেই থাকেন। হোগলার ওপর প্লাস্টিক চাপায়ে দেব, হিম লাগব না। দু-ফেরতা করি খড় পাতি দিচ্ছি, তার ওপর চাদর বিছায়ে নেন। আর টয়লেট চাপলি হুইই ঝাউবন।’

    বৈতরণি পার

    মধুদা তাঁর দুই নাবালক পুত্রকে নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে আমাদের আস্তানা খাড়া করে দিলেন। তারপর বউদির গুছিয়ে দেওয়া তিনটে চায়ের কেটলি আর কাগজের কাপ হাতে তিনজন তিনদিক নিলেন। সারাদিনে অন্তত ১০০ কেটলি চা করেন বউদি, এছাড়া আমাদের মতো আশ্রিত মানুষজন, যাঁরা ওঁদের কাছেই খান, তাঁদের জন্য রান্নাবাড়া আছে। বউদির জিম্মায় ব্যাগ রেখে, দু’ভাঁড় ফুটন্ত চা জমিয়ে খেয়ে, শুধু ক্যামেরা হাতে নিয়ে আমরা দুজনও ভিড়ে যাই মেলায়।

    বিসর্জনের গল্প

    আবহাওয়া-উদ্বাস্তু বা ক্লাইমেট-রিফিউজি বলা হয় যাঁদের, তাঁরা কপিল মুনিকে তাঁদের পেট্রন সেন্ট হিসেবে মেনে নিতেই পারেন। ভাঙনের কারণে কপিল মুনি ঠাঁইনাড়া হয়েছেন বারেবারে। আপাতত তাঁর আশ্রয় যে-মন্দিরে, সেটির গঠনশৈলী যে আমার দেখা ভারতবর্ষের বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে কদর্যতম— এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই। মেলার সময়ে এই মন্দিরকে আবার টুকরো-টুকরো আলোর মালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়। যেন লাখো মানুষের ভেজা দৃষ্টির সামনে ঈশ্বরকে ফেশিয়াল না করিয়ে দাঁড় করালে তিনি অশুদ্ধ হতেন।

    কপিল মুনির মন্দিরের গায়েই কমল ঘোষের ফুল-ঘট-নামাবলি-কমণ্ডলু (প্লাস্টিকের)-বাতাসা-ধূপের দোকান। আগে বাড়ি থেকে একটা তক্তপোশ বয়ে এনে কমলবাবু তার ওপর পসরা সাজাতেন, এখন কমলবাবুর ছেলে ফাঁপা পাইপের মাথায় স্বচ্ছ ফাইবারের ছাদ চাপানো একটা পাকা স্টল ম্যানেজ করেছে। মেলার তিন-চার দিন আগে কমলবাবু বা তাঁর ছেলে বাগড়ি মার্কেট ও জগন্নাথ ঘাট থেকে বিস্তর মাল জোগাড় করে আনেন। ফুল তাজা রাখার জন্য ডুবিয়ে রাখেন বাড়ির পিছনের ডোবায়। ডিম্যান্ডের চাপে ফুল অবশ্য একটু বাসি হলেও কেটে যায়। মাঝারিরকম সচ্ছল কমলবাবুর জমিতে ‘জন খাটে’ যারা, মেলার কয়েকদিন তাদের ঝুড়িভর্তি ফুল দিয়ে জলে পুণ্যার্থীদের মধ্যে নামিয়ে দেন কমলবাবু। এদেরই একজনকে কয়েকবার দেখেছি ভোর হওয়ার অনেক আগে গলায় ঝুড়িভর্তি ফুল ঝুলিয়ে সমুদ্রের পাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পরে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি লোকটি বোবা। ওর ঝুড়িতে ফুলের ভিতরে গোঁজা থাকে একটা জ্বলন্ত কেরোসিনের কুপি। চরাচরে সেটাই একমাত্র আলো।

    সত্যিই দেখবার মতো মন্দিরের পিছনে নাগা সন্ন্যাসীদের গুহার মতো কুঠুরিগুলো। আসলে একটাই টানা বারান্দাকে দরমা-পিচবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে ভাগ করে করে স্বতন্ত্র খোপগুলো তৈরি করা হয়েছে। পার্টিশনের গায়ে আবার ক্যালেন্ডার থেকে কেটে নেওয়া অজস্র দেবদেবীর চনমনে ছবি সাঁটা। নাগারা শৈব, অথচ গঙ্গাসাগরে দেখেছি এঁদের স্টলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো ছবিটা করালবদনী কালীর। ভক্তের মনের একটা অস্বস্তিকর, আধো-জাগতিক ভয় নাগা সন্ন্যাসীদের মূল ক্যাপিটাল, তাই ভয়ের লোকাল সিম্বলকেও যথোচিত ব্যবহার করতে নাগারা পিছপা হন না। তবে কুম্ভমেলায় দলে বহু বহুগুণ ভারী হওয়ায় এঁদের যে দাঙ্গাবাজ রূপটা দেখেছি, সাগরমেলায় স্বভাবতই সেটা দেখিনি— এখানে এঁরা কেমন স্মিতমুখে ন্যাংটো হয়ে বসে গাঁজা খাচ্ছেন, সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া অনন্ত জনস্রোতের মাথায় চামর বুলিয়ে টাকা নিচ্ছেন। এমনকী কেউ খুচরো পয়সায় প্রণামী দিলেও বাপ-মা তুলছেন না।

    ধর্মের মৌতাত

    ‘টয়লেট চাপায় হুই ঝাউবনে’ গিয়েছিলেন রামপ্রসাদ সাউ, ফেরার সময়ে দিক ভুল করে অন্যদিকে চলে গেছেন, এখন ভিড়ের মধ্যে দলের কাউকে দেখতে না পেয়ে দিশেহারা অবস্থা। একজন ভলান্টিয়ার তাঁকে শান্ত করে নিয়ে এসেছেন ‘ভোলে ভাটকে’ শিবিরে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে ‘বিহার কা আরা জিলা মে রহনেওয়ালে রামপ্রসাদ সাউ, উমর ৭৫ সাল…।’ বারদুই ঘোষণার পরেই দূর থেকে কয়েকজন ছোকরা ও মহিলাকে আলুথালু হয়ে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। একজন পেটমোটা পূলিশ বললেন— ‘দাদুর বোধহয় মালকড়ি আছে, তাই এত ইয়ে। নইলে থোড়াই আসত। যাদের কিচ্ছু নেই, ছেলেমেয়ের গলগ্রহ, তাদের কতজনকে চুপচাপ ছেড়ে দিয়ে চলে যায় জানেন না তো। মেলার পর দ্যাখেন না হাওড়া স্টেশনে বুড়োবুড়ি দেহাতি ভিখিরি কত বেড়ে গেছে?’

    এই পুলিশি সিনিসিজম অসহ্য মনে হলেও পরে জেনেছি কথাটা আংশিক ঠিক– অর্থাৎ  আগে প্রায়ই এমন ঘটত, এখন ঘটে না বললেই চলে। ৩০-৪০ বছর আগেও গ্রামসমাজে অর্থনীতির ভিত এমনই পলকা ছিল যে পরিজন-বিসর্জন ঘটত আকছার। মধুদা বললেন, ‘বুড়োবুড়ি তো তাও একরকম, ৮০-৮৫ সাল অবধিও দেখেছি হারিয়ে যাচ্ছে শুধু বাচ্চা মেয়েগুলো। বুঝলে না, মেয়েকে খাওয়াবে না বলে ফেলে রেখে পালিয়েছে। ভোলে-ভাটকে ক্যাম্পে উঁকি দিলে দেখতে কত মেয়ে ভয়ে, ঠান্ডায় নীল হয়ে বসে আছে, কাঁপছে ঠকঠক করে, কাঁদতেও ভুলে গেছে। কারোর গায়ে একটা গরম কিচ্ছু নেই। ছাড়বেই যখন, তখন সোয়েটার পরিয়ে ছাড়বে কেন? সোয়েটার তো দামি জিনিস। বুঝলে তো?’ বুঝলাম। কাঁপলাম। নীল হয়ে গেলাম। সন্তানকে সাগরের জলে দিয়ে আসার রূপকটা স্পষ্ট হল।

    মায়ার শরীরে বড় কান্না লেগে আছে

    প্রজাপতির মতো দু’হাতে দুই রঙিন শাড়ির দু’প্রান্ত চেপে ধরে যে-মহিলারা আশ্চর্য টিমওয়ার্কে চুল ও শাড়ি শুকিয়ে নেন, তাঁদের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালেই মনের ভার লাঘব হয়। শ্রেণিগত অপরিচয়ের কারণে আগে ভাবতাম এঁরা এতই গরিব যে দুটোর বেশি শাড়ি নেই— একটা কাচেন, অন্যটা ধারণ করেন। পরে বুঝেছি, গঙ্গাসাগরের মতো দূরতর দ্বীপে এখন তীর্থ করতে আসেন যাঁরা, তাঁরা গরিব তো ননই, অনেকেই রীতিমতো রইস। এঁরা শাড়ি শুকিয়ে নেন ভিজে শাড়ি ব্যাগে ভরবেন না বলে। নদীর সাথে নারীর এক চিরকালীন বন্ধুত্ব আছে বলেই কি না কে জানে, গঙ্গাসাগরে দেখেছি জলে নেমে দাঁড়ালেই যে কোনো বৃদ্ধার শরীর থেকে জীর্ণতার খোলস ধুয়ে যায়, আর ম্যাজিকের মতো বেঁচে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাঁর আজন্ম আড়াল করা মুখ। এক অনবদ্য ফেমিনিনিটি নদীর মতোই বইতে থাকে যেন। আসলে এই অবগাহনে ধর্মের ব্যাপারটা খুবই গৌণ— মুক্তির জন্য এঁদের সামগ্রিক আকুতি যেমন। এঁদের যে কাউকে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন চিরকাল গঙ্গা মাইয়ার কাছে এঁরা চেয়ে এসেছেন স্থিতাবস্থা, জন্মান্তরব্যাপী এক স্টেটাস কুয়ো— অর্থাৎ আগামী জন্মেও দাও এই জন্মের উঠোন-আঙিনা, এই জন্মের স্বামী-সন্ততি, এই জন্মের শৈশববেলা, এই জন্মের স্মৃতি ও প্রেম। শুদ্ধাচার ও পাপবোধ সংগঠিত ধর্মের শরীর হতে পারে, কিন্তু তা মায়ায় গড়া মানুষের মন নয়। 

    স্বীকার করি আর না-ই করি, আমি আর আপনি কিন্তু মেকলের সন্তান। আমাদের বেড়ে ওঠায় ও পোক্ত হওয়ায় অনাবৃষ্টি ছিল না কখনো। আমি আর আপনি যে স্বাধীনতা নিয়ে নাস্তিক হতে পারি, আরা জেলার রামপ্রসাদ সাউ তা পারেন না। তাঁর খিদে-ঘুম-মাটি-ঘাস সমস্ত কিছুতে জীবাণুর মতো নিঃশব্দে মিশে যান ঈশ্বর। নিজের জীবনবোধ দিয়ে সেই ঈশ্বরকে লালন করতে পারলে তিনি কালিবানের অর্ধেক মানব, না পারলে সঙ্ঘের দানব। মনে রাখতে হবে, মানব অথবা দানব হয়ে কালিবানই কিন্তু মঞ্চে থাকে। আমরা আড়ালে থেকে তার ওপর আলো প্রক্ষেপ করতে পারি মাত্র।

    পথের পসরা

    ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার্স ফোরাম অন রিলিজিয়ন অ্যান্ড পাবলিক লাইফ’ একটা সমীক্ষা করে জানিয়েছিল, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মোট ১৬.৩ শতাংশ ঘোষিতভাবে নাস্তিক। আর গোটা পৃথিবীতে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তাহলে হিন্দুধর্মের বিপরীতে এবং গোটা পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে নাস্তিকেরা সংখ্যালঘু নন। বিশ্বায়নের পর অর্থনীতি যখন গোটা পৃথিবীকে একই দর্শনে দেখছে, তখন মানুষের বিশ্বাসের বিশ্বায়নও যে আজ বাদে কাল ঘটবে এটা ধরে নেওয়া যায়। আর এই বিশ্বাসের বিশ্বায়ন ঠেকিয়ে রাখতেই তোলা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের জিগির— মানুষকে অসীম থেকে পেড়ে এনে কুয়োয় ফেলার ছক। তবে মানুষের বিশ্বাসের ভিত তো ধর্ম নয়, তা হল মানুষের বোধ। স্বাভাবিক জল-হাওয়ায়, অভাবে-অনটনে, গ্রীষ্মে ও শীতে জড়িয়েমড়িয়ে বাঁচতে বাঁচতে যে বোধ জন্ম নেয় মানুষের বুকে, তা-ই তাকে বিবেক দেয়, তার ব্যক্তিগত ধর্মটাও দেয়। নদীর কাছে এসে আরও অনেকটা মায়া চেয়ে নিয়ে যায় যে মানুষ, তার বোধে কখনো ঘুণ ধরবে বলে মনে তো হয় না। বোধ থেকেই তো বোধি। বুদ্ধের যেমন। 

    পৌষ সংক্রান্তির ভোরে ডগডগে প্রথম সূর্যের আলোয় লাঠিটা বগলে চেপে ধরে সাগরে ডুব দিচ্ছিলেন হরিরাম পাণ্ডে। একটু দূরে গুরুর ছবি মাথায় নিয়ে খোল-করতাল বাজাতে বাজাতে জলে নামছিলেন সাদা ধুতি-শাড়িতে সাজা একদল শিষ্য। ঝলমলে লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে কোমরজলে দাঁড়িয়ে উচ্ছল খুশিতে নেচে উঠছিল। তবু অপার প্রাপ্তির সমস্ত আনন্দস্বর ডুবিয়ে আমার কানে এল অশীতিপর হরিরাম পাণ্ডের প্রায় স্বগতোক্তি– ‘আখরি কাম হো গ্যয়া বাবা।’ 

    এই অন্তিম কাজটির পরে থাকে কী? স্টেটাস কুয়ো? নির্বাণ ?

    একবার মেলার পরের দিন বাসের ছাদে বসে কচুবেড়িয়া ফিরছি। দু’পাশের গাছের প্রশাখা ছপটির মতো সাঁৎ-সাঁৎ করে তেড়ে আসছে, আমরা সবাই ‘ডাক’ করছি। একবার একটু দেরি করে ফেলায় ঝাপট খেলাম, এবং চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সামলে নিয়ে বুঝলাম, ডালের বাড়ি মাথায় না লেগে, লেগেছে চশমার ডাঁটিতে। এবং চশমাটি উড়ে গেছে।

    বাস একটু থামতে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে পিছনে তাকালাম। মনে হল ফাঁকা মেলার মাঠের একটুখানি তখনও দেখা যাচ্ছে। যেন দেখলাম, বালির ওপর কিছুটা কাত হয়ে গেঁথে আছে একটা পোড়া বাঁশ, আর বাঁশের ডগায় পরিত্যক্ত নিশান। আর দেখলাম বোতলকুড়ানি একটা বাচ্চা ছেলে নিশানটা আবার সোজা করার জন্য বাঁশের গোড়ায় লাথি মারছে। লাথি মেরেই যাচ্ছে।

    ছবি সৌজন্যে: জয়দীপ মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook