ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • পুরনো বই, নতুন সম্পর্ক


    নারায়ণচন্দ্র চক্রবর্তী (January 15, 2022)
     

    সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন অধ্যাপক নির্মাল্য আচার্য। আর নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয় ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সূত্রে। ইন্দ্রনাথবাবু ছিলেন সুবর্ণরেখা-র কর্ণধার। আমি ওখানে যেতাম, ওঁদের ভাল-ভাল অনেক বই আমি বাঁধাই করেছি। বিশেষ কোনও বই হলেই ইন্দ্রনাথবাবু আমাকে তলব পাঠাতেন আর ‘বাঙাল-বাঙাল-বাঙাল’ বলে ডাকতেন! ওইখানেই হত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার কাজ, নির্মাল্যবাবু যার সম্পাদক ছিলেন। ‘এক্ষণ’-এর বাঁধাই অবশ্য আমার কাছে কখনও হয়নি, কারণ ওটা ছিল পেপারব্যাক। কিন্তু নির্মাল্যবাবু আমাকে পছন্দ করতেন খুব। ওঁর সঙ্গেই সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি যাওয়া।

    সেটা ১৯৭৯-’৮০ সাল হবে। নির্মাল্যবাবু একদিন বললেন, সত্যজিৎ রায়ের কিছু পুরনো বই একটু বাইন্ডিং করে দিতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমাকে এনে দেবেন, করে দেব। কিন্তু উনি আমায় সঙ্গে করেই নিয়ে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই বিখ্যাত ঠিকানায়। সেখানে দেখলাম অনেক পুরনো-পুরনো বই, প্রায় একশো বছরের পুরনো বইও ছিল; কিন্তু তাদের কভার কিংবা টাইটেল পেজ ঠিক নেই, একেবারে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। একটি বই দিয়ে উনি জানতে চাইলেন, আমি ঠিকমতো করতে পারব কি না। কাজটা সহজ ছিল না; কিন্তু আমি সেই বই নিয়ে এসে মেক-আপ করে, অয়েল পেপার পেস্টিং করে রি-বাইন্ডিং করে দিয়েছিলাম। তার পর সে-বই হাতে নিয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎবাবু। এই হচ্ছে প্রথম আলাপের বৃত্তান্ত।

    এর পরও চার-পাঁচ বার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। প্রতি বারই নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে। অবশ্য অন্যত্র, যেমন কফি হাউসেও ওঁর সঙ্গে দেখা করেছি। কারণ সত্যজিৎবাবুর আরও বেশ কয়েকটি পুরনো বই আমাকে বাঁধাই করে দিতে হয়। অধিকাংশ বই-ই ছিল ইংরেজি। উনি বাইরে গেলে যেসব বই নিয়ে আসতেন, মানে, বেশিটাই ফিল্মের উপরে। যেমন একটা বই করেছিলাম, নাম মনে নেই আর, সেটাও ইংরেজি বই ছিল, আমি বাঁধিয়ে দেওয়ার পরে সুবর্ণরেখা থেকে ‘ঘাতক’ নামে সেটির একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। এই সব বইপত্র তো খুব স্পেশালাইজড, আমাকে দিয়ে বাইন্ডিং করাতেন বটে, কিন্তু উনি নজর রাখতেন যে ঠিক ভাবে হয়েছে কি না। কারণ অনেক বইয়েরই ফর্মা ঠিক ছিল না, এদিক-ওদিক আলগা হয়ে ছিল; সেগুলো আমাকে ঠিক করতে হত। গোটা বইটা খুলে, গুছিয়ে নিয়ে, নতুন ভাবে সেলাই মেরে সেসব পুরনো বই বাঁধাই করে দিতে হয়েছে।

    সত্যজিৎ রায়ের লেখা শংসাপত্র

    পুরনো বইগুলিকে নতুন রূপ দেওয়ার সময়ে তার প্রচ্ছদ নিয়েও ভাবিত হতেন উনি। কখনও আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এইটাতে কী মলাট দেবে? আমি দরকারমতো বলতাম। একবার মনে আছে, আমি বললাম, এই রকম হ্যান্ডলুমের কাপড় দেব। উনি সেটার স্যাম্পেল দেখতে চাইলেন। তার পর খাদি গ্রামোদ্যোগ ভবন থেকে কাপড় কিনে ‘জেল’ (আরবি ‘জিল্‌দ্‌’, অর্থাৎ বইয়ের মলাট ও তার ভেতরের দিক) বানিয়ে নিয়ে গিয়ে ওঁকে দেখালাম; সেটা ছিল বাফ কালারের কোরা সিল্ক। উনি দেখে বললেন, এ তো অনেক কস্টলি! আমি বললাম, আপনার বইও তো কস্টলি! আবার পুরনো বইয়ের অরিজিনাল কভারটা রাখার ব্যাপারেও অনেক সময়ে জোর দিতেন। তখন সেই ছেঁড়া-খোঁড়া পুরনো প্রচ্ছদের ফোটোপ্রিন্ট করিয়ে সেইটা আলাদা করে কভারে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হত। প্রথম বইটার ক্ষেত্রেই এ রকম করতে হয়েছিল। উনি তো দেখে উচ্ছ্বসিত, আমাকে বললেন যে— তোমার বুদ্ধি আছে! একটা অরিজিনাল জিনিসকে রাখতে হলে তার জন্য কী করা দরকার না-দরকার, সেই ভাবনাটা ওঁর ভাল লেগেছিল।

    উনি যে বইগুলো আমাকে দিতেন, আমি বাঁধানোর সময়ে সেগুলোতে বিশেষ ‘উইন্ডো পকেট’ করে দিতাম। মানে, নতুন বাঁধানো বইটায় সফ্ট কভার থাকত; আবার সেটাকে, উপরের হার্ড কভারে ‘জেল’ করে তার ভিতরে ঢোকানো হত। এই ‘উইন্ডো পকেট’ থাকলে বই নাড়াচাড়া করতে ও পড়তে খুব সুবিধে হয়। বইয়ের মধ্যে একটা অন্য রকমের কোয়ালিটি দেখা দেয়, বাইন্ডিংও আকর্ষণীয় হয়। এটাও উনি খুব পছন্দ করেছিলেন।

    আসলে, বইয়ের প্রতি সত্যজিৎ রায়ের বিরাট আকর্ষণ ছিল। আমি কোনও কাজ করে দেওয়ার পর সেই নিয়ে নানা কিছু জানতে চাইতেন— কী করে এই করলাম, কী করে ওই করলাম! যেমন, একটা ঘটনার কথা বলি। সাধারণত আমাদের এখানে বাইন্ডিং-এর সময় অ্যানিমাল গ্লু ব্যবহার করে লোকজন। কিন্তু তাতে বইয়ে পোকা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই কারণে আমি সিন্থেটিক রেজিন ব্যবহার করতাম। আবার অ্যানিমাল গ্লু কোথাও দিতে হলে, তার সঙ্গে গ্লিসারিন মিশিয়ে নিতাম। এতে পোকায় কেটে বই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে। এই কথা আমি সত্যজিৎবাবুকেও বলেছিলাম। আমার এই চেষ্টার জন্য উনি খুব প্রশংসা করেছিলেন; এও বলেছিলেন যে, বিদেশে সিন্থেটিক রেজিনই ব্যবহার করতে উনি দেখেছেন। আসলে দাম বেশি বলে আমাদের এখানে তার চল নেই। এই যে আমাদের হাতে কোনও হোয়্যার অ্যাবাউটস নেই, একটা সাধারণ ব্যাপার যে কী করলে বা কেমন বাইন্ডিং হলে একটা বই ভাল থাকবে, তা জানার আমাদের কোনও উপায় তখন ভারতে ছিল না— এই সব বিষয় নিয়েও ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল।

    আসলে এসব অনেক আগের কথা। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর। এখন যে সব ঠিকঠাক মনে পড়ছে, এমনও নয়। স্মৃতি থেকে খুঁজে খুঁজে তুলে ধরা আর কী! শুধু রি-বাইন্ডিং নয়, সত্যজিৎ রায়ের লেখা কয়েকটি নতুন বই বাঁধিয়ে দেওয়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। ইংরেজিতে ‘পথের পাঁচালী’-র চিত্রনাট্য ছেপেছিল সিনে সেন্ট্রাল। সে-বই বাইন্ডিং হয় আমার কাছে। ওঁর হাতে করা স্কেচও ছিল বইটিতে। এর পর ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকে বেরনো ‘আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস’ বাঁধাই করার জন্য উনি আমার নাম সুপারিশ করেন। সে-কাজও আমি করি। যদ্দূর মনে পড়ে, বাফ রঙের ভাগলপুর হ্যান্ডলুমের কাপড় দিয়ে করেছিলাম। সিল্ক আর কটন মেশানো, হালকা চকোলেটের টোন ছিল কাপড়ে। ফুল ক্লথ বাইন্ডিং – ওপরে নীল কালিতে নামটা লেখা ছিল সম্ভবত। ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। এর পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওঁর উপরে একটি বই করেছিল। বসুমতী প্রেস থেকে ছাপা হয় সেটি; প্রায় দশ হাজার কপি। সরকারি অফিসারকে সত্যজিৎবাবু বলেছিলেন, এটা নারায়ণকে দেবেন। তা, ওঁরা নারায়ণ-নারায়ণ খুঁজছেন, শেষে নির্মাল্যবাবুকে জিজ্ঞেস করায় তিনি আমার হদিশ বাতলে দেন। ওই বইটির বাইন্ডিংও আমার হাতে হয়। শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের উপরে ওঁর একটি কাজও আমি বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম।

    বইয়ের প্রতি সত্যজিৎ রায়ের বিরাট আকর্ষণ ছিল। আমি কোনও কাজ করে দেওয়ার পর সেই নিয়ে নানা কিছু জানতে চাইতেন— কী করে এই করলাম, কী করে ওই করলাম! যেমন, একটা ঘটনার কথা বলি। সাধারণত আমাদের এখানে বাইন্ডিং-এর সময় অ্যানিমাল গ্লু ব্যবহার করে লোকজন। কিন্তু তাতে বইয়ে পোকা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই কারণে আমি সিন্থেটিক রেজিন ব্যবহার করতাম। আবার অ্যানিমাল গ্লু কোথাও দিতে হলে, তার সঙ্গে গ্লিসারিন মিশিয়ে নিতাম। এতে পোকায় কেটে বই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে। এই কথা আমি সত্যজিৎবাবুকেও বলেছিলাম। আমার এই চেষ্টার জন্য উনি খুব প্রশংসা করেছিলেন; এও বলেছিলেন যে, বিদেশে সিন্থেটিক রেজিনই ব্যবহার করতে উনি দেখেছেন। আসলে দাম বেশি বলে আমাদের এখানে তার চল নেই।

    তবে একটা কথা বলতেই হয়, আমি ওঁর থেকে একটু দূরত্ব রাখারই চেষ্টা করতাম। ওঁর মতো বিরাট উচ্চতার মানুষের খুব ঘনিষ্ট হতে চাইনি। এতে যদিও আমার দিক থেকে কাজের খামতি কখনও হয়নি বা সম্পর্ক আলগা হয়নি। যখনই নির্মাল্যবাবু জানিয়েছেন, আমি হাজির হয়েছি। উনি একবার আমার কাজের পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গে মজা করে আমায় বলেছিলেন, এই রকম দুই টাকা পাঁচ টাকায় তোমার জীবন চলবে কী করে? তা, আমি হেসে বললাম, আমার এতেই চলে যাবে। উনিও হাসলেন। আরেক বার উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো অনেক কাজ করলে, তা তোমার শংসাপত্র-টত্র কিছু দরকার হবে না? আমি চুপ করে গিয়েছি, আমি আবার কী শংসাপত্র নেব! নির্মাল্যবাবু ছিলেন; উনি বললেন, হ্যাঁ, সে তো হলে ভালই হয়। তখন উনি গড়গড় করে ওঁর লেটারহেডে লিখে দিলেন। সেই সার্টিফিকেট আজও আমার কাছে যত্ন করে রাখা আছে।

    সত্যজিৎ রায়কে আমি ‘স্যার’ বলে ডাকতাম। আর বিজয়া রায়কে ‘মামনি’। মনে আছে, বিজয়া রায়ের ‘সঞ্চয়িতা’ বইটিও আমি নতুন করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম। উনি খুব জানতে চাইতেন আমার ছেলেবেলার কথা, চট্টগ্রামের বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা, কলকাতায় কী ভাবে চলে এলাম— সেই সব অতীত-বৃত্তান্ত। মনে পড়ছে, বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই লিকার চা আর ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটের স্মৃতি, গ্রীষ্মের দুপুরে ঘোলের শরবত। এত বছর পেরিয়ে গেল, এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি সত্যজিৎ রায়কে। স্বপ্ন দেখি, বই বাঁধিয়ে স্যারের হাতে তুলে দিচ্ছি।

    এই লেখাটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। অনুলিখন করেছেন সুস্নাত চৌধুরী।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook