চারপাশে সার্কাসের ধুম
শীত এলে এখনও সার্কাসের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা যখন বেড়ে উঠছি, কৈশোর যখন আমাদের ভরপুর, সে-সময়ে শীতের শহরে সার্কাস আসার ব্যাপারটা বেশ রমরমে ছিল। তার জন্যে একটা অপেক্ষা থাকত সকলের মনে, একটা চাপা আঁচের মতো সে-অপেক্ষা জ্বলত, কবে শহরের দেওয়ালে, পাঁচিলে, বাসের পিছনে পোস্টার দেখতে পাওয়া যাবে সার্কাসের। মধ্যবিত্তের জীবনে, আজ মনে হয়, অপেক্ষার চেয়ে বড় ঐশ্বর্য আর কিছু ছিল না। অনেক সময় সেই অপেক্ষার রং স্বয়ং প্রাপ্তিকেও ছাপিয়ে যেতে পারত।
সার্কাসের জন্যে ছিল সেইরকমই এক অপেক্ষা। শহরে শীত পড়ে গেছে, মোড়ের দোকান আলো করে কমলালেবুরা হাজির, ওদিকে নানা দোকানের বাইরে জয়নগরের মোয়া আর ঝোলা গুড়ের অস্থায়ী শামিয়ানা, এই তো সেদিন টুবলাইরা চিড়িয়াখানায় পিকনিক করে এল। শীত একেবারে টগবগ করছে শহরের রাজপথে। এমন সময়ে কোনও-না-কোনও সার্কাস জাঁকিয়ে বসল শহরের এক প্রান্তে। সে-সময় অবশ্য অন্তত দু’খানা জমাটি সার্কাস আসতই। একখানা অবশ্যই তাঁবু ফেলত পার্ক সার্কাস ময়দানে, আরেকখানা সিঁথির মোড়ে। দ্য গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাস, দ্য গ্রেট রাশিয়ান সার্কাস, জেমিনি সার্কাস বা অজন্তা সার্কাস, এরাই ঘুরেফিরে আসত। আর সে-সময়ে এদের নামডাকও ছিল দেদার।
প্রথমবার কোথাও একটা হোর্ডিং বা পোস্টার দেখামাত্র মনে-মনে একটা উত্তেজনা শুরু হয়ে যেত। এসে তো গেল। আমি দেখব কবে? পাড়ায়, আমাদের কচিকাঁচাদের মধ্যে তখন কোনও প্রতিযোগিতার বোধ ছিল না। কিন্তু খুশির জিনিস কেউ আগে পেয়ে গেলে বাকিদের মনখারাপ হতই একটু। তাই টুম্পা বা রাজা আমার আগে সার্কাস দেখে এসে গল্প শোনালে মন নিভে আসত। কেবল ভাবতাম, বাবা কবে নিয়ে যাবে? কবে সেই মহার্ঘ ময়দানে পড়বে আমার ছোট্ট পায়ের ছাপ? কবে সেই যাযাবরদের ধুলো আমারও চোখে এসে জুড়ে বসবে?
এই যে একখানা আজব মায়া ছিল সার্কাসকে ঘিরে, আশ্চর্য এক আকর্ষণ ছিল যে, তা সম্ভবত এই কারণে, আমি কেন জানি না ভাবতাম, সার্কাসে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, যাঁরা সার্কাস চালান, তাঁদের জীবনটা আমাদের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর আর রোমাঞ্চকর। কেমন দিব্যি তাঁরা এক শহর থেকে অন্য শহরে বেড়িয়ে বেড়ান, কেমন চমৎকার তাঁবু পেতে থাকা খাওয়া করেন, কেমন দুর্দান্ত খেলা দেখিয়ে কেটে যায় তাঁদের জীবন। এইসব ভাবতাম। আমাদের মতো রোজ সকালে স্কুল যেতে হয় না, বছরের শেষে পরীক্ষার ভয় নেই, রোজ সন্ধেয় অন্ধকার নামার আগে বাড়ি ফেরার নেই। কিছুই নেই এসবের। সেই লাগামছাড়া জীবনের প্রতি এক অমোঘ টান ছিল আমার। যতদিন না বুঝতে পেরেছি, সার্কাসও আসলে লাগামেরই খেলা। কেবল তার যন্ত্রণা রাংতা দিয়ে মোড়া বলে, দূর থেকে উপহারের মতো দেখায়।
এসব অনেক পরে বুঝেছি বলেই, ভারি ভাল লাগত সার্কাস। মুখ ফুটে বলবার অবকাশ তো ছিল না বাবাকে, খুব চাইতাম যেন একটা সার্কাস অন্তত দেখতে নিয়ে যায়। যেতও। কোনও একখানা রোববার হয়তো দুপুরে খেতে বসে জানান দিল, আজ সন্ধের শো-এ সার্কাস দেখতে যাওয়া। সে যে তখন কী আনন্দের ব্যাপার, আজ আর তা বলে বোঝানো যাবে না। যাওয়া মানে, আমার আর বাবার যাওয়া। মা ওসবের মধ্যে নেই। দুপুর থেকেই ভাবতাম, কী কী খেলা দেখতে পাব। শেষমেশ সন্ধের আগে-আগে একটা মোটা সোয়েটার চাপিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়া। এই যে বেরিয়ে পড়লাম একবার, এখান থেকেই কিন্তু সার্কাস শুরু। অপেক্ষা করতাম, যদি বাবার সঙ্গে দেখে পাড়ায় কেউ জিগ্যেস করে, কোথায় যাচ্ছি। তাহলে সামান্য হেসে, ‘এই তো, সার্কাস দেখতে’ বলবার গৌরবটা পেয়ে যাওয়া যাবে। আমরা দক্ষিণের বাসিন্দা, তাই পার্ক সার্কাস ময়দানই সাব্যস্ত হত প্রতিবার। এই যে গড়িয়া থেকে একখানা বাসের জানলার ধার পেয়ে পার্ক সার্কাস অবধি পৌঁছনো, এইটাই ছিল আমার কাছে সান্ধ্য চড়ুইভাতির মতো।
পার্ক সার্কাসের মোড়ে বাবার হাত ধরে নামতেই টের পেতাম, বুকের ভিতর একটা ধুকপুকুনি তৈরি হচ্ছে। একটু দূরে, রাস্তার ওপারেই দেখা যাচ্ছে ময়দানের সাজ। আলোর মালায় সেজে উঠেছে তার শরীর, যেন একটা মাঠ গা-ভর্তি গয়না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধেবেলা। আর মাঠের মাঝখানে, এই দূর থেকেও, দেখা যাচ্ছে সার্কাসের তাঁবুর মহান চূড়া। যেন দেশ জিততে এসে সম্রাট ফেলেছেন তাঁর শামিয়ানা। ভিড়ের রাস্তা পেরিয়ে যখন পৌঁছতাম, টিকিটঘরের সামনে লম্বা লাইন। বাবা সাংবাদিক মানুষ, তাই আমাদের একটু খাতির ছিল। টিকিট বলাই থাকত ম্যানেজারের ঘরে। বাবা বুকপকেট থেকে বার করে পরিচয়পত্র দেখাতেই দ্বাররক্ষী সসম্মানে সরে দাঁড়াতেন। তখন যে কেমন একখানা অপার্থিব ভাললাগা হত, সে বলে বোঝানো মুশকিল।
মাঠ ঘেরা হয়েছে গোল করে, টিনের সব চৌকো পাটাতন দিয়ে। তার গায়ে সার্কাসের নানান খেলার রঙিন ছবি আঁকা। সেগুলো দেখতে-দেখতে এগোতাম, আর ভাবতাম, সত্যিই আর একটু পরে চোখের সামনে এই সমস্তটা ঘটতে দেখা যাবে? সহজ সত্যিকেই তখন কত অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারত ছোট্ট মন, আজ ভাবি। ঝলমলে ছোট-ছোট আলোয় চারপাশ তখন জমজমাট। তারই মধ্যে কোনও খাঁচায় শিম্পাঞ্জি, কোনও খাঁচায় ঘোড়া, কোনও খাঁচায় ভালুক আটকে। আর বাঘ? আর সিংহ? তারা আছে কোন খাঁচায়? তাঁবুতে ঢোকার আগে ইতিউতি তাকাতাম, যদি কেশরের এক ঝাপটা, যদি ডোরাকাটার এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায়! দেখতে যদি না-ও পাই, গন্ধেই টের পাওয়া যেত, আশেপাশেই তাঁরা আছেন বটে।
এরপর তো একের পর এক খেলা মুগ্ধ হয়ে দেখা। ট্র্যাপিজ হোক বা ম্যাজিক, বাঘের খেলা হোক বা আগুনের, এক মুহূর্ত অন্য কোনও দিকে তাকানোর ফুরসত হত না। সার্কাস শেষ হয়ে গেলে অবশ্য মনটা খারাপ হয়ে যেত ভারি। তাঁবুর দরজা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দর্শকের দল একে-একে আলাদা পথিক হয়ে যাচ্ছেন, এ-দৃশ্যে মন মানতে চাইত না কিছুতেই। আর সেই কারণেই হয়তো, বাবা পার্ক সার্কাসের কোনও এক মোগলাই রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ত আমাকে নিয়ে। একটা রুমালি রুটি আর একটু রেজালা, ব্যাস, তাতেই অনেকখানি মন-ভালর মশলা মেশানো থাকত।
এখন দূর থেকে, যেন জন্মেরও ওপার থেকে সেই গন্ধ পাই। কমলালেবুর পাশে বাঘের গন্ধ, কেক-পেস্ট্রির পাশে রেজালার সুবাস, সব মিলেমিশে একটা ছোটবেলাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ঠিক সার্কাসের হোর্ডিং-এর মতোই। খেলা ফুরোলে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে না আর…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র