কিন্তু সংসারে কেউ বিশ্বাস করত না যে গুরু চরিত্রবান। সিনেমা করা যার ব্যবসা তার কি আবার চরিত্র ভালো থাকতে পারে নাকি? তামা–তুলসী হাতে নিয়ে দিব্যি করলেও আমি তা বিশ্বাস করব না—
এ সন্দেহও যেমন একদিকে, অন্য দিকে আবার তেমন প্রীতি। গীতা তো গুরু দত্তকে খুশি করতেই চাইত বার বার। গীতা ভাবত সে যেমন গানের জগতে বিখ্যাত, গুরু দত্তও তেমনি তার নিজের কর্মজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং হিংসে–দ্বন্দ্ব–রেষারেষির প্রশ্নই সেখানে নেই। গীতা বলত— জানেন বিমলদা, আমি ও সব ব্যাপারে প্রথম প্রথম কানই দিতুম না। ভাবতাম নাম–ধাম হলে তার একটু বদনামই হয়— কিন্তু বাইরের সমাজের মানুষেরা আমার চোখে আঙুল দিয়ে যে দেখিয়ে দিতে লাগল। তাই তখন থেকেই সন্দেহ করতে লাগলুম—
জিজ্ঞেস করলাম— তারা কারা?
গীতা বললে— তাদের সবাইকে কি আমি চিনি যে নাম বলতে পারব?
বললাম— তারা কি আপনার বাড়ি এসে খবরা–খবর বলে যেত?
গীতা বললে— হ্যাঁ, অনেকে চিঠি লিখতো আমাকে। বেনামী চিঠি। কেউ কেউ লিখতো আপনার স্বামীকে অমুক মেয়ের সঙ্গে একসাথে ঘুরতে দেখেছি, দুজনে অমুক তারিখে অমুক হোটেলে এক ঘরে রাত কাটিয়েছে— এমন কত উড়ো খবর, কত উড়ো চিঠি যে দিত—
বললাম— আপনি সেগুলো বিশ্বাস করতে গেলেন কেন?
গীতা বললে— সহজে তো বিশ্বাস করতে চাইনি, কিন্তু ক্রমে ক্রমে যে সবই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল—
তারপর একটু থেমে আবার বললে— জানেন, এখানে সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয় বিরাট জাঁকজমক করে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথও আমার চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল—
জিজ্ঞেস করলাম— বন্ধ হয়ে গেল কেন?
গীতা বললে— হয়তো গিয়েছি সেখানে, হঠাৎ পাশ থেকে একদল ছেলে চেঁচিয়ে উঠল— ওই দেখ, গীতা দত্ত যাচ্ছে, গুরু দত্ত আসেনি। গুরু দত্ত গীতা দত্তকে ছেড়ে অমুকের সঙ্গে ফুর্তি করছে—
বললাম— অমুক মানে কে?
বললে— তার নাম করবেন না। কাউকে যেন বলবেন না এসব কথা—
বলে আমাকে যে নামটা বললে তা আজ ছাপার অক্ষরে এখানে প্রকাশ করতে পারব না। অনেক কথাই গীতা বলত যা এখানে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাঁরা সবাই বেঁচে আছেন। সুতরাং সে–সব কথা বলা সত্যিই বিপজ্জনক!
আমার কাছে কথা বলতে বলতে গীতা অনেক সময় কেঁদে ফেলতো। আর আমি অসহায়ের মতো তার সব কথাগুলো শুনে যেতাম আর মনে মনে ভাবতাম এরই নাম বোধহয় খ্যাতি, এরই আর এক নাম খ্যাতির বিড়ম্বনা।
গীতা বলত— এখানকার সিনেমা–কাগজগুলোও তেমনি। গুরু দত্তকে আর একজন অভিনেত্রীকে জড়িয়ে যে সব মুখরোচক কাহিনী তারা প্রচার করত, তা পড়ে আমার লজ্জায় আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হত—
আমি বলতাম— আপনি গুরুকে সে–সব কাগজ দেখাতেন না কেন?
গীতা বলত— দেখিয়েছি, ও রাগ করত দেখালে। মনে হত ও ওসব পছন্দ কত না। আমাকে বলত— ওসব কাগজ পড়ো না—
বলতাম— তা আপনি সে–সব কাগজ পড়তেনই বা কেন?
গীতা বলত— বা রে, তারা যে আমার চোখে পড়বার জন্যে সে–সব ডাক–খরচা দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিত—
এসব কথা শুনে আমি আর কি বলব? মনে আছে, আমি শুধু সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করমা গীতাকে। বলতাম— গীতাদি, আমি বোধহয় আপনার চেয়ে বেশি চিনি গুরুকে। আমার কথা বিশ্বাস করুন, গুরু সচ্চরিত্র। গুরু মহৎ, গুরু মহৎ শিল্পী। সমস্ত বোম্বাইতে গুরু দত্তের মতন আর কজন লোক আছে জানি না, কিন্তু আমি গুরু দত্তের মতন একজনের সাক্ষাত–সংস্পর্শে এসেছি বলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করি—
কিন্তু গীতাকে দেখে মনে হত আমার কথায় গীতা যেন সান্ত্বনা পাচ্ছে না। আমার কথায় গীতার চোখের জল কিন্তু এক ফোঁটাও শুকোত না। তার চোখ দিয়ে তেমনি ঝর–ঝর করে জল পড়ত একই রকম ভাবে।
***************************
মাদ্রাজে গুরুর সামনে বসে গল্প করতে করতে এই সব কথাগুলোই কেবল মনে পড়ত। ভাবতাম এ–মানুষটা যে হাসে, অভিনয় করে, গল্প করে এটাই তো একটা বিস্ময়! আর এ মানুষটা যে ঘুমোতে পারে না, এটাই তো স্বাভাবিক! যদি ঘুমোতে পারত তাহলেই আমি হয়তো বেশি অবাক হতাম।
কল্পনা করে নিতাম সে–মানুষটার মাথার ভেতর হাজার ভাবনার পাহাড়। মাসে চল্লিশ হাজার টাকা খরচের দায়। সিনেমার শিল্পী হিসেবে সুনাম রক্ষা করবার গুরু দায়িত্ব, আর তার ওপরে আছে সংসারের কুটিল–জটিল সম্পর্ক। সে এমন এক সংসার যেখানে অর্থের অভাব নেই, কিন্তু পরমার্থের আশা–আকাংক্ষা, আকাশ–কুসুম।
এক–একদিন গুরুর মুখের হাসি দেখে কান্নাই পেত! মনে আছে আগের দিন রাত বারোটা পর্যন্ত হাসি–গল্পের মধ্যে কেটেছে। আমরা যে যার ঘরে ঘুমোতে গিয়েছি। পাশাপাশি ঘর। সকালবেলা আমি আর আমার স্ত্রী উঠে চা খাচ্ছি। কিন্তু সাতটা বাজল আটটা বাজল। গুরুর গীতারও দেখা নেই। ভাবলাম কি হল? তবে কি দুজনেই তখনও ঘুমোচ্ছে?
এমন তো হয় না কখনও। বরাবর ঘুম থেকে উঠেই ওদের সঙ্গে দেখা হয়। গীতা আসে, গুরু আসে। খানিকক্ষণ পরেই আমি আর গুরু তৈরি হয়ে নিয়ে স্টুডিওতে চলে যাই। তারপর আমার স্ত্রী আর গীতা দুজনেই কখনও বেড়াতে যায় সান্তাক্রুজে, কখনও কমলা নেহরু পার্কে, কখনও এর–ওর বাড়ির দিকে। বড় আরামে সে দিন কাটে গুরু দত্তের। মন দিয়ে তখন গল্প করে, মন দিয়ে তখন কাজ করে, মন দিয়ে অভিনয়ও করে। সন্ধেবেলা আবার দুজনে বাড়িতে ফিরে এসে সিনারিও লিখতে বসা হয়। কিন্তু সেদিন বেলা দশটা বেজে যাওয়ার পরও কারোর দেখা নেই দেখে আমরা অবাক হয়ে ভাবছি, এ কি হল?
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে হাজির। বাগানে ভেতর। গাড়িতে কেউ নেই। খালি গাড়ি। গাড়িটা গীতার। ড্রাইভার সোজা আমাদের কাছে হাজির।
এসে বললে— বউদি, দিদিমণি আপনাকে সান্তাক্রুজে যেতে বলেছে—
—দিদিমণি? দিদিমণি ও–বাড়িতে নেই?
ড্রাইভারের মুখের চেহারাটা কেমন বদলে গেল। বললে— দিদিমণি কাল রাত দুটোর সময় এ–বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে—
—সে কি? কেন গেল? কি হয়েছিল?
ড্রাইভার বললে— তা জানি না, দিদিমণির কাছেই সব শুনবেন—
জিনিসটা কেমন যে হতবাক করে দিলে আমাদের। কিছুই বুঝতে পারলাম না, কেন গীতা রাত্রে এখান থেকে চলে গেল। অথচ আগের দিন রাত বারোটা পর্যন্ত তো কিছুইউ জাওনতে পারা যায়নি। ক–ঘন্টার মধ্যে এমন কি ঘটতে পারে, যার জন্যে গীতা এ–বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হল। যদি গুরুর সঙ্গে দাম্পত্য–কলহই হয়ে থাকে, রাত্রে তো তার আভাসও পাইনি।
গৃহিণী জিজ্ঞেস করলে— দিদিমণি এ–বাড়িতে আসবে না?
ড্রাইভার বললে— সান্তাক্রুজে গেলেই আপনি সব বুঝতে পারবেন—
আরও রহস্যজনক মনে হল। গৃহিণী বললেন— তুমি এখন চলে যাও, একঘন্টা পরে আমাকে এসে নিয়ে যেও, আমি স্নান করে তৈরি হয়ে থাকব—
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। গেট–এ লালা ছিল। গাড়িটা চলে যেতেই সে দরজা বন্ধ করে দিলে আবার।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত