চিনদেশে প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে লাল শেয়াল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। তার রং পালটে যায়, তার আরও বেশি লেজ গজায়। অতএব যথেষ্ট সময় উত্তীর্ণ হলে বুড়ো শেয়ালের গায়ের রং সাদা হয়ে ওঠে, এবং তার ন’টা লেজ পর্যন্ত গজাতে পারে। ন’টা লেজওয়ালা সাদা শেয়াল অবশেষে দৈব শক্তির অধিকারী হয়। কিন্তু মামুলি, একখানা লেজওয়ালা বনের লাল শেয়াল থেকে ন’টা লেজওয়ালা সাদা দৈবী শেয়াল হয়ে ওঠার এই যাত্রাকালে সে এক রহস্যময়, বহুরূপী প্রাণীর রূপ ধারণ করে। এ প্রাণী পুরুষ বা নারী, মানুষের হিতৈষী বা অনিষ্টকারী, দুই’ই হতে পারে। ক্রমে এই গোত্রের প্রাণীদের নিয়ে একাধিক উপকথার জন্ম হল। সেসব উপকথার পরতে-পরতে মিশে আছে অপকর্ম, প্রলোভন, শঠতা, এমনকী হিংস্রতারও নানা কাহিনি। সুদূর জাপান এবং কোরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল এইসব গল্প।
প্রাচীনতম চৈনিক গল্পগুলোয় ন’লেজওয়ালা সাদা শেয়ালকে কল্যাণময় শুভ শক্তির আধার হিসেবে কল্পনা করা হয়, পশ্চিমের দেবীর সঙ্গে তার যোগসূত্র। কিন্তু পরবর্তীকালের চৈনিক রূপকথায় এই শেয়াল হয়ে ওঠে এক অশুভ, অনিষ্টকারী জীব। মায়াবী পুরুষ শেয়াল নানা উপহারের সাহায্যে অল্পবয়সি মেয়েদের প্রলোভিত করে তারপর সেইসব উপহার চুরি করে তাদের কুলভ্রষ্ট করত। আবার মায়াবী নারী শেয়াল সম্রাটদের উন্মাদ করে দিত, তাদের একের পর এক নির্বোধ সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করত, যাতে তাদের সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা যায় এবং তাদের পতন ঘটে।
জাপানে সাধারণত শেয়ালরূপী আত্মাদের শুভ শক্তি হিসেবেই কল্পনা করা হয়। লোকবিশ্বাসে তারা ধান এবং ভাগ্যের দেবী ইনারির আজ্ঞাবাহী প্রাণী। নির্জন স্থানে মানুষ তাদের দেখা পায়। এদের নিয়ে লোক ঠকানোর বা শঠতার নানা গল্প আছে। যেমন একটি গল্পে এক বাদ্যকার একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, এমন সময়ে একটি পরিবার যাত্রাপথে তাকে থামিয়ে বলে, বাজনা বাজিয়ে তাদের মনোরঞ্জন করতে হবে। পরিবর্তে তারা তাকে খাবার এবং মদ খাওয়ায়। কিন্তু পরেরদিন সকালে উঠে বাদ্যকার বুঝতে পারে, সে আসলে একটি শ্মশানের মধ্যে বসে আছে, যেসব বস্তু সে খাবার জ্ঞান করে খেয়েছে, তা আসলে শেয়ালদের কুড়িয়ে আনা আবর্জনা। শেয়াল-রমণীরা পুরুষ মানুষের প্রেমে পড়ে তাদের বিয়ে করছে, এই মর্মেও অনেক গল্প পাওয়া যায়। তারা এক মনে স্বামীর সেবা করে, তবে যে-মুহূর্তে গ্রামের কুকুরেরা তাকে দেখে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে, সে মানুষের রূপ ছেড়ে স্বরূপ ধারণ করে। গোপন কথাটি ফাঁস হয়ে যেতেই তারা পালিয়ে যায়, কিন্তু তাদের সেই স্বামীরা তাদের জন্য মন কেমন করে বসে থাকে, কারণ তারা স্ত্রী হিসেবে বড়ই ভাল ছিল।
কোনও-কোনও গল্পে শোনা যায়, এই সব শেয়ালদের আত্মা বা প্রাণশক্তি আসলে আছে এক একটি মুক্তোর মধ্যে। এই মুক্তোগুলো হয় তাদের মুখে নয় তাদের লেজের ভিতর লুকোনো থাকে। একবার এই মুক্তো যদি কেউ হাতে পায়, তবে শেয়ালেরা তাদের হাত থেকে মুক্তো ফিরে পাবার জন্য তাদের যা বাসনা, তাই পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দেবে।
কিছু গল্পে দেখা যায়, শেয়ালেরা অন্য প্রাণীর রূপ ধারণ করছে, যাতে কোনো গরিব পরিবার তাদের বিক্রি করে কিছু পয়সা অর্জন করতে পারে। বিক্রি হবার পরেই তারা নিজমূর্তি ধারণ করে। এইভাবে একই পরিবার বারবার নানা রূপে তাদের বিক্রি করতে পারে, এবং ধীরে-ধীরে বিত্তবান হয়ে ওঠে। এইসব পরিবারদের বলা হয় শেয়ালের মালিক পরিবার। জাপানের গ্রামে সেকালে কোনও পরিবার আচমকাই বড়লোক হয়ে উঠলে তাদের শেয়ালের মালিক বলে আশঙ্কা করা হত, ভয় পেত লোকে। কারণ সবাই বিশ্বাস করত, তাদের বিপুল সম্পত্তির উৎস আসলে জাদুর সাহায্যে লোক ঠকানো।
কোনও-কোনও শেয়াল ইচ্ছেমতো যে-কোনও রূপ ধারণ করতে পারে, এমনকী গাছের রূপও। শিকারিরা জঙ্গলের মধ্যে যেখানে আগে কোনও গাছ দেখেনি, সেখানে আচমকাই নতুন গাছ দেখতে পেয়েছে, এমন গল্প শোনা যায়। এ-গাছগুলো যে আদৌ গাছ নয়, আসলে শেয়ালরূপী জীব, তা বুঝতে পেরে তারা গাছ লক্ষ করে তির ছুঁড়ত। পরেরদিন এসে দেখতে পেত, সেখানে গাছ নেই, তিরবিদ্ধ হয়ে মরা শেয়াল পড়ে আছে।