১৯৮৬-৮৭ নাগাদ, মাত্র একবারই, সুধীর মিশ্র-র ‘ইয়ে উয়ো মঞ্জিল তো নহি’ ছবিটা দূরদর্শনে দেখানো হয়েছিল। স্মৃতি থেকে লিখছি শেষ দৃশ্যটার কথা, যেখানে তিনজন প্রবীণ মানুষ এক তরুণ আন্দোলনকারীকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলেন, যা পারলে তাঁরা যৌবনের এক বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতেন। ছবিটা শেষ হয় এঁদের একজনের সংলাপে, ‘চেষ্টা তো করেছিলাম’।
হয়তো ভারতের আর্ট ফিল্ম আন্দোলনকেও এই সংলাপটা দিয়ে ধরা যায়। এই আন্দোলন আমদের দিয়েছে অসামন্য সব সিনেমা, যা তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল হোম ভিডিয়োর প্রতাপে, তারপর কেবল টিভির দৌরাত্ম্যে, শেষে মাল্টিপ্লেক্সের আক্রমণে। এই ছবিগুলো একটা বড় বদলের পথিকৃৎ, আবার একইসঙ্গে ভারতের সার্বিক রুচি ও পরিবেশের স্রোতের শিকারও বটে।
মূলধারার সিনেমা নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে, ৭০ মিলিমিটারের হিট ছবির নিতান্ত পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতাদেরও স্মৃতিকথা ছাপতে প্রকাশকদের লাইন পড়েছে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে আর্ট ফিল্ম আন্দোলন নিয়ে খুবই কম বই লেখা হয়েছে। রোচনা মজুমদারের ‘Art Cinema and India’s Forgotten Future: Film and History In The Post Colony’ বইটি এই শূন্যস্থান ভরাট করার এক দুরন্ত প্রয়াস।
লেখক আর্ট ফিল্ম পরিচালকদের বলেছেন ইতিহাসবিদ, ‘যাঁরা ভারতের উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিকে আলোচনায় আনতে পেরেছেন, এবং সিনেমা-মাধ্যমে সেই সমস্যাগুলিকে ধরতে পেরেছেন, যা ভারতীয় ইতিহাসবিদদের বহু দশক ধরে ভাবাবে।’
তিনি আর্ট ফিল্মকে এমন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন যেখানে ভারতের উত্তর-ঔপনিবেশিক আখ্যান ফুটে উঠেছিল, বা তার ভবিষ্যৎ আন্দাজ করা হয়েছিল, তারপর দেখান, এই ঘরানার সিনেমা কতগুলো স্তম্ভে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নেহরুকে (বা নেহরুদের) আর্ট ফিল্মের শিকড় স্থাপনের বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য অনায়াসে দায়ী করা যেতে পারে, তা সে শ্রদ্ধেয় মারি সিটনকে ভাল ছবির দূত হিসেবে নিয়োগ করাই হোক, আর ফিল্ম এনকোয়ারি কমিটি, ন্যাশনাল আর্কাইভ, ফিল্ম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া গড়ে তোলার জন্যই হোক। সেই সময়কার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মারি সিটনকে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তাঁর ভাণ্ডারের ভাল ছবিগুলিকে নিয়ে, বড় শহর থেকে দূরে চলে যেতে। সেই জনতার মধ্যে ছবিগুলি দেখিয়ে সুরুচি গড়ে তোলার চেষ্টা করতে, যারা নাচা-গানার ভোজ ছাড়া সিনেমাকে আর কিছু বলেই ভাবতে শেখেনি।
আর্ট ফিল্মের আন্দোলনের কাহিনির আরও বহু আকর্ষণীয় চরিত্র রয়েছে। যখন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অনেকেই (সত্যজিৎ রায়ের মতো চলচ্চিত্র-নির্মাতা, চলচ্চিত্র-পণ্ডিতেরা, সরকার, সিনেমার সমঝদারেরা) তর্ক করে চলেন: সিনেমার নবতরঙ্গ ব্যাপারটা ঠিক কী, সেই সময়ের বহু বিচিত্র যুক্তিতর্ক, এমনকী পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের কাটাকুটি জেনে চমৎকার লাগে। এও জেনে ভাল লাগে, পিছন দিকে তাকিয়ে ১৯৬৯-কে ধরা হয় একটা বাঁকবদলের বছর, কারণ সেই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল বাসু চ্যাটার্জির ‘সারা আকাশ’, মণি কাউলের ‘উসকি রোটি’, এবং মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’। আন্দোলনের এই পর্যায়টাকে নিয়ে বইয়ের অধ্যায়টি খুব অন্যরকম, কারণ এটি দেখায় সত্যজিৎ এই সময়টায় তাঁর সন্দিগ্ধ ও এমনকী উগ্র লেখালিখিতে বারবার জিজ্ঞেস করছেন, এই নতুন তরঙ্গের ছবিতে ‘নতুন’ জিনিসটি আদৌ কোথায়। রোচনা এও দেখান, সাহিত্য ও শিল্পের আন্দোলনেরই সহোদর এই চলচ্চিত্রের আন্দোলন, এবং সব শিবিরের মধ্যেই নিবিড় যোগাযোগ, কারণ নির্মল বর্মা, মোহন রাকেশ বা প্রেমেন্দ্র মিত্র— এঁরা ছবির ভবিষ্যৎ-এর সঙ্গে নিজেদের যোগ করারও পরিকল্পনা করতেন।
আরেকটি অধ্যায়ে দেখা যায়, বহু সিনেক্লাব এবং বিভিন্ন দল গড়ে উঠছে, যারা অন্যরকম ছবির প্রতি উৎসাহ তৈরির চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক ছবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় করাতে চাইছে। এখন আমরা সেই লোকদের উঁচুদরের সিনেমাবোদ্ধা ভাবি, যারা ‘মুবি’-র গ্রাহক। তখন, ব্যাপার এত সহজ ছিল না। এই বইতে বিশেষ করে কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি নিয়ে আলোচনা আছে, যাদের গতি ও প্রবণতা অনেকটাই ঠিক করে দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায় ও চিদানন্দ দাশগুপ্ত (এ বছর দুজনেরই শতবর্ষ), তাঁরা সদস্য নির্বাচন করছেন, কী সিনেমা দেখানো হবে তা-ও বছে দিচ্ছেন। সিনেক্লাবগুলোর ‘নাক-উঁচু-পনা’ প্রকাশ পেত, যখন একেবারে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছবি দেখার অধিকার পেতেন, বা শুধু কয়েকজন পরিচালককে নিয়েই আলোচনা হত, প্রধানত সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণাল। এই সিনেক্লাবের আলোচনা থেকে তপন সিংহ ও তরুণ মজুমদারের বাদ পড়াটা বেশ লক্ষণীয়।
যেভাবে ছবি খুঁজে বার করা হত এবং তা জোগাড় করা হত, তা রোমহর্ষক। সদস্যদের বাছাই করার ব্যাপারে অনেকটা খামখেয়াল দেখা যেত বটে (মেয়েরা প্রায় পুরোপুরিই বাদ থাকতেন) কিন্তু ছবি খোঁজার জেদ ও অধ্যবসায়ের ক্ষেত্রে এই ক্লাবগুলো ছিল তুলনাহীন।
রাম হালদার (‘কমলালয়’-এর মালিক এবং বইয়ের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র) মার্কিন অ্যামবাসাডর জন কেনেথ গ্যালব্রেথ-কে চিঠি লিখছেন, ‘আপনি আমেরিকার সত্যিকারের রাষ্ট্রদূত নন… এই দূতগুলো (চলচ্চিত্র) বরং অনেক বেশি কাজের কাজ করতে পারে… ভারতের চলচ্চিত্রমোদীদের মধ্যে।’
বইটির প্রথমার্ধ আলোচনা করে সিনেমা-সংস্কৃতির গড়ে ওঠা, সন-তারিখ, এবং উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই সংস্কৃতিকে দেখা হয় ফিল্মনির্মাতাদের পরিপ্রেক্ষিত থেকেও, আবার নতুন দর্শক তৈরির দিক থেকেও। দ্বিতীয়ার্ধটার মূল বিষয় সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ী। প্রত্যেক পরিচালকের জন্য একটা করে অধ্যায় বরাদ্দ হয়েছে, এবং লেখক খুব বিচক্ষণ ভাবে, প্রত্যকের শৈলীর একটি করে বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। তিনটির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায়টি ঋত্বিক সম্বন্ধে, যেখানে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে তাঁর সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে লেখা হয়েছে। সত্যজিতের অধ্যায়টিও উল্লেখযোগ্য, যেখানে লেখক ‘সীমাবদ্ধ’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও ‘জন-অরণ্য’ ছবির সমকালীনতা নিয়ে লেখেন, অপু ট্রিলজি থেকে পরিচালকের এই পর্যায়ে উপনীত হওযার যাত্রাপথটা অনেকটা বোঝা যায়।
বইটি শেষ হয় আর্ট ফিল্ম আন্দোলনের মৃত্যুর সঙ্গেই, এবং ভারতে একটা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ছবি প্রযোজনার সময়কে সেই বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেন লেখক, তাঁর মতে যে-সময় থেকে রাষ্ট্র নিজেকে আর্ট ফিল্মের পৃষ্ঠপোষণা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে শুরু করে।
লেখক টেলিভিশনকেও এই আর্ট ফিল্ম আন্দোলনের অবসানের একটি কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। যদিও, এই ছবিগুলির সঙ্গে দূরদর্শনের সম্পর্কটা একটা স্তরে সীমাবদ্ধ নয়।দূরদর্শনে প্রতি রবিবার দুপুর দেড়টায় একটা করে আঞ্চলিক ছবি, আর একটা সময়ে একটু গভীর রাতে একটা করে অন্যরকম ছবি, এই দেখে কিন্তু একটা গোটা প্রজন্ম সারা ভারতের সেরা কিছু আর্ট ফিল্মের স্বাদ পেয়েছে।
বইটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, আর অত্যন্ত মনোযোগী গবেষণার চিহ্নও স্পষ্ট, তবে কক্ষনওই তা লেখার গতিকে ভারাক্রান্ত করেনি। সাধারণ পাঠককেও প্রচুর ঘটনা এবং সাহিত্যগুণ দিয়ে বইটি মুগ্ধ করবে।
Art Cinema And India’s Forgotten Futures: Film and History in the Postcolony
Rochona Majumdar
Published by Columbia University Press (distributed by Penguin)
Pp 307