গোলমেলে আত্মিক এবং তাত্ত্বিক সমস্যায় পড়েছি। ‘ক্রিসমাস’ এবং ‘খুচরো খাবার’— এ-দুটো একেবারে বিচ্ছিরি অক্সিমোরন হয়ে যাচ্ছ। আমার মতন খাইয়ে লোকের কাছে ‘ক্রিসমাস’ আর ‘খাবার’ সমার্থক। আর বহু ঠেকে এটা শেখা গেছে যে ক্রিসমাসের খাবার কখনও খুচরো হয় না— রাস্তার খাবার হলেও না; ‘অল্প খাব’, এই প্যানপ্যানে অ্যাটিটুড-টাই ক্রিসমাসের দিন বাক্সবন্দি করে, তালাচাবি দিয়ে রেখে আসা উচিত।
কলকাতার ক্রিসমাসের খাবারটা একটু গতানুগতিক হয়ে পড়েছে, জনমানসে ক্রিসমাস ব্যাপারটাই এখন যেন ‘নিউ মার্কেট উৎসব’। আমাদের ছেলেবেলায় নাহুমের কেক যে প্রচুর খেয়েছি, তা মনে পড়ে না— যদিও কেক খাওয়া হত প্রচুর। নানা ক্লাব এবং দোকান থেকে নিয়ে আসা ক্রিসমাস কেকের মাঝে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল মা-পিসিমাদের হাতে বানানো, একটু কাজু, একটু কাগজি বাদাম এবং অনেকটা কিশমিশ দিয়ে বানানো ‘বাটার’ কেক, যার স্বাদ আমি এখনও নানা ধরণের ‘হোমমেড’ বা ‘বুটিক’ বেকারির আমদানিতে খুঁজে বেড়াই।
সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে কেক-টেক বানানোর চল নিশ্চয়ই এখনও রয়েছে, হোক না তা ইন্সটাগ্রামে দুটো ছবি দেওয়ার খাতিরে। এ-সত্ত্বেও, ইদানীংকালে বন্ধুবান্ধব, বিশেষত বয়সে একটু ছোট বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ক্রিসমাস এলেই নিউ মার্কেটে সর্পিল এবং দুর্লঙ্ঘনীয় লাইনে দাঁড়িয়ে কেক কেনার যে হিড়িক – ‘শ্বশুরবাড়িতে চেয়েছে বস!’— পড়ে যায়, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
এটা ঠিক কবে, কীভাবে হল, জানি না, তবে ক্রিসমাসে আমি নতুন ধরনের খাবার খুঁজি। এবং একদম লাইনে দাঁড়াতে পছন্দ করি না। তাই গত এক দশকে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কল্যাণে পার্ক স্ট্রিটে যে ‘কলকাতা স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যাল’-এর আয়োজন করা হয়, এবং যেখানে খাবার খেতে গেলে লাইন পড়ে না, বা পড়লেও তা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়, আমার খুব পছন্দের ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং কিছুটা হলেও, অতিমারীর মুখে ছাই দিয়ে এই খাদ্য উৎসবটা (যেটা এ-বছর শুনছি পার্ক স্ট্রিট ছেড়ে পিক্নিক গার্ডেন-এ উঠে গেছে) যেন ক্রিসমাস খাবারের গতানুগতিকতাকে ভাঙছে। নানা কমার্শিয়াল খাদ্যবিক্রেতা এবং দোকানের স্টলের ভিড়ে এসে পড়েন কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবার, যাঁরা তাঁদের বাড়ির খাবারটাই খাদ্যপণ্য হিসাবে তুলে ধরেন— যা তাঁদের কাছে দৈনন্দিন হলেও, বেশির ভাগ খরিদ্দারের কাছেই একেবারে নতুন স্বাদের দুনিয়া খুলে ধরে। সময়ে না পৌঁছলে, প্রায় দশদিনব্যাপী এই খাদ্য উৎসবের একদিনও এঁদের খাবার চেখে দেখা যাবে না; স্টল বসানোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতে থাকে অ্যাংলো রোস্ট, পট পাই, ইয়েলো রাইস অ্যান্ড কোফতা কারি, পর্ক বালিচাও, সসেজ কারি, ক্র্যাব কারি, প্যান্থেরাস, কাটলেট, ক্রকে এবং অবশ্যই, অবশ্যই, ভিন্ডালু! নানা ধরনের কেক এবং পেস্ট্রির সঙ্গে পাওয়া যেতে পারে বাড়িতে বানানো চকলেট, মার্জিপান, কুকি এবং কুল-কুল। বিগত কয়েক বছর ধরে আমি (সঙ্গে ছেলে লেজুড়) এই সময়ে পার্ক স্ট্রিটে যাই শুধু এই খাবারগুলো চেখে দেখতে, কেননা এই হোম ডেলিভারি ইত্যাদির যুগেও খাস অ্যাংলো ঘরের খানা কলকাতার সব প্রান্তে দুম করে পৌঁছে যায় না।
এই নতুন স্বাদ খোঁজের চক্করে আমি, সৌভাগ্যবশত, সবচেয়ে বেশি ঘুরেছি পাহাড়ে, এবং তার মধ্যেও নাগাল্যান্ড আর শিলং-এ বেশি। ২০১০-এর দশকটায়, সাংবাদিকতা এবং আমার তখনকার ব্যান্ডের বেশ কিছু অনুষ্ঠানের দৌলতে আমি বারবার মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ডে যাই, যার মধ্যে কিছুবার ক্রিসমাস পড়ে যায়। পাহাড়ে ক্রিসমাসের মজাই আলাদা! আলোয় সাজানো চার্চ-গম্বুজ আর পরিষ্কার রাস্তার সারিতে বাকি বছরের অন্ধকার এবং অনিশ্চিত, সতর্ক আবহাওয়া যেন মাসখানেকের জন্য সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়, বিশেষত ডিমাপুর-কোহিমায়।
গোটা ডিসেম্বর মাস ধরে কোহিমা সেজে ওঠে হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল এবং তারপরে ক্রিসমাসের উৎসবের সাজে। হর্নবিলের অকুস্থল, পাহাড়ের গায়ে লাগানো ‘হেরিটেজ ভিলেজ’ বা ‘ঐতিহ্যবাহী গ্রাম’ কিসামা-য় প্রথম চেখে দেখেছি ‘ব্যাম্বুশুট পর্ক’, যাতে রাজা মির্চার পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম থাকা সত্ত্বেও (যেহেতু অ-নাগা অতিথিরাও তা খাবেন) দু’ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কানে আগুন এবং চোখে জল, দুই-ই অবলীলাক্রমে চলে এসেছিল। পরে, কোহিমার রাস্তার মোড়ে দাঁড়-করানো ঠেলাগাড়ি থেকে খেয়েছি হর্নবিল এবং ক্রিসমাস-স্পেশাল হাতে-গরম ভাজা রেশম পোকা, সিল্ক ওয়ার্ম, যা ওই হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় অমৃতসম মনে হয়েছে। প্রথাগত নাগা থালির (যাতে বহু নাগা উপজাতির দৈনন্দিন খাদ্যের একটা মিশ্রণ পাওয়া যায়) অংশ হিসাবে কোহিমাতেই প্রথম খেয়েছি স্টাফ করা পর্ক ইন্টেস্টাইন বা শূকর-অন্ত্র, বাঁশের ভাপে রাঁধা ট্রাউট মাছ এবং দেবান্ন লেভেল-এর আনারস। কোনোটাই অল্প খাইনি।
শিলং-এর ক্রিসমাসও অপরূপ সুন্দর। যেহেতু শহরের ভেতরেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হলে ছোট-ছোট পাহাড়চুড়ো পেরিয়ে যেতে হয়, ক্রিসমাসের শিলং-এর আলোকসজ্জা তাই বহুদূর থেকে চোখে পড়ে। ডিসেম্বর মাসের শেষের ঠান্ডাও তেমনই, জাঁদরেল এবং স্বাস্থ্যকর। ওই ঠান্ডায় খাসি স্পেশাল্টি জাডো-ডোহোনেইওং না খেলেই নয়— মুর্গি বা শুয়োরের রক্ত দিয়ে রান্না করা ভাত (জাডো) এবং তার সাথে কালো তিলবাটা দিয়ে তৈরি শুয়োর-কষা। লিখতে গিয়েই জিভে জল চলে আসছে। শিলং-এর স্মোকড পর্ক জগদ্বিখ্যাত; বন্ধু কিথ ওয়ালাং আমাদের প্রথম খাওয়ায় আখুনি, বা ফারমেন্ট করা সয়াবিন, দিয়ে রাঁধা স্মোক্ড পর্ক, যা নিয়ে একটা গোটা ‘খুচরো খাবার’-এর কিস্তি লেখা হয়ে যাবে।
এমন নয় যে, নতুন স্বাদ শুধু বাইরেই পেয়েছি। গত কয়েক বছরের ক্রিসমাসে বাড়ির খাবারের কথা উঠলে আমার কাছে সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় বন্ধু জয়নীর বাড়ির ক্রিসমাস ইভ্ ডিনার। মারি মাসি, জয়নীর মা মারি-ক্লড অলিভিয়ে, জন্মসূত্রে ফরাসি, কলকাতায় চার দশকের বাসিন্দা, প্রতি ক্রিসমাস লাঞ্চে একটা অতুলনীয় ক্রেম চিকেন রাঁধেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ক্রিসমাসে তাঁর বড় বউমা, ম্যোড্ বনার্জি, ‘পাইন্যাপল হ্যাম’ বলে এমন একটা বস্তু রেঁধে খাওয়ালেন যে কেউ আর নড়তে পারল না! রোস্ট করা আনারসে মোড়া সে-হেন হ্যামের স্বাদ আমার আজীবন মনে থাকবে।
কথায় আছে, কারো ক্রিসমাস, কারো পৌষ মাস। নতুন গুড়ের পুলিপিঠে ছাড়া ক্রিসমাস অসম্ভব। দেখে ভাল লাগে, শীতকালে এখন চারিদিকে পিঠেপুলি উৎসবের ছড়াছড়ি। পিঠে তৈরি মহা ঝামেলার কাজ; ভাল চাল, ভাল নারকেল, ভাল গুড় এবং ভাল দুধ, চারটের একটা ছাড়াও পিঠে হয় না, বিশেষত চিতৈ, পাটিসাপ্টা, ভাপা বা জামদানি ধারার পিঠে। বাংলাদেশে একসময় শিশু একাদেমি ১০৬ ধরনের পিঠের তালিকা প্রকাশিত এবং প্রদর্শিত করে। কলকাতায় উৎসব-কেন্দ্রিক পিঠের চল থেকে যদি দেখা যায় এই ঐতিহ্যবাহী ধারা অব্যাহত, তাহলে তা খুবই আশাপ্রদ ব্যাপার। আমার পিতামহী বেঁচে থাকতে, রবিবারের সকালের জলখাবারে দুটো জিনিস স্টেপল ছিল— কড়াইশুঁটির কচুরি-আলুর দম এবং নতুন গুড়ের পুলিপিঠে। আমার শীতকালের রবিবারগুলো থেকে ওই স্বাদটা মা-ঠাকুমারা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে হারিয়েই গেছে। আশা রইল, ক্রিসমাসে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন বাংলার এই বিশেষ খাবারের স্বাদটুকু আশভরে পায়। আত্মিক বা তাত্ত্বিক, যে-সমস্যাই হোক, ক্রিসমাসে সাত্ত্বিক আহারটায় তাহলে সমস্যা হবে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র