বড়দিনের সঙ্গে ক্রিসমাসের গান, বা ক্রিসমাস ক্যারল, সমার্থক, যেমন সমার্থক ক্রিসমাস ট্রি আর মিসলটো। ক্যারল গানের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, যা খ্রিস্টধর্মে এসে পড়েছে পেগান, বা পৌত্তলিক ধারায় মকরক্রান্তি উদযাপনের সঙ্গীত থেকে।
খ্রিষ্টধর্মের গোড়ার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, যিশুখ্রিস্টের জন্ম এবং জন্মের পরের উৎসব উদযাপনের উদ্দেশ্যে গাওয়া ক্যারল গানগুলো আদতে ল্যাটিনে লেখা হয়েছিল, পরবর্তীকালে ধর্মের বিস্তারের সঙ্গে-সঙ্গে যা সারা পৃথিবীতে এবং বহু সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিসমাস উপলক্ষে এই গান গাওয়ার ট্র্যাডিশন তাই বহু বহু শতাব্দী পুরনো।
খ্রিষ্টান বন্ধু এবং পড়শিদের আশেপাশে বড় হয়েছি, তাই ছোটবেলা থেকেই বড়দিনে ক্যারল গান শোনা আমার বেড়ে ওঠায় গেঁথে রয়েছে। শীতকাল এলেই আমার কিছু পছন্দের ক্যারলের কোমল, মৃদুমন্দ সুর যেন আমার কানে বেজে উঠতে থাকে, ইউলটাইডের মেজাজ ছড়িয়ে পড়ে আমাদের বাড়িতে।
ইতিহাসের নথিভুক্ত প্রথম ক্রিসমাস ক্যারলের নাম ‘এঞ্জেল’স হিম’ (Angel’s Hymn), লেখা ১২৯ খ্রীষ্টাব্দ। এত প্রাচীন ক্যারলের সুর বা কথা, দুটোর কোনোটাই সঠিক জানা যায় না। বাইবেলে পাওয়া যায়, যিশুর জন্মের সাথে-সাথে দেবদূতেরা ‘গ্লোরি টু গড ইন দ্য হাইয়েস্ট’ (‘Glory to God in the highest’) বলে সাধুবাদ জানায়— যার ল্যাটিন অনুবাদ হল ‘গ্লোরিয়া ইন এক্সেলসিস ডিও’ (‘Gloria in Excelsis Deo’)। অবাক ব্যাপার, এরই সারমর্ম আমার সবচেয়ে পছন্দের ক্যারলের কথায় পাওয়া যায়— ‘এঞ্জেলস উই হ্যাভ হার্ড অন হাই’ (‘Angels We Have Heard on High’). ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই ক্যারল ফরাসি ভাষায় অনূদিত এবং প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে। অ্যাংলো-আইরিশ পাদ্রি জেমস চ্যাডউইক এর ইংরেজি সংস্করণ লেখেন আরও পরে, ১৮৬২ সালে— যদিও তাঁর সংস্করণকে অনুবাদের বদলে ‘অনুপ্রাণিত’ বলাই ঠিক হবে।
প্রথম ক্রিসমাস ক্যারল ১২৯ খ্রিস্টাব্দে গাওয়া শুরু হলেও, নেটিভিটি, বা খ্রিস্টজন্মের ঘটনা এবং নানা দৃষ্টিকোণ উদযাপন করে লেখা এবং গাওয়া ক্যারলের পুরোদস্তুর ‘কালেকশন’ কিন্তু মাত্র ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে দেখা যায় না। ধরে নেওয়া যায়, এই সময় থেকেই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ক্যারল গানের প্রচলন বিশ্বের বহু কোনায় শুরু হয়।
কিছু উপাখ্যান
ক্লাসিকাল গিটার শেখার শুরুর বছরগুলোতে, আমাদের কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু জনপ্রিয় ক্যারল আমি বাজাতে শিখেছিলাম। শান্ত, সহজ সুরের এই ক্যারলগুলো আমি আজও, পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতের জগতে দু’দশক কাটানোর পরেও, বাজাতে ভালবাসি।
‘সাইলেন্ট নাইট’ (Silent Night) আমার খুব প্রিয় ক্যারল; দুশো বছরের পুরনো এই ক্যারল খুব জনপ্রিয়, ক্রিসমাস উপলক্ষে প্রায় সবাই গেয়ে থাকেন, আমরা বাড়িতে বাচ্চাদের ঘুমপাড়ানি গান হিসাবে ‘সাইলেন্ট নাইট’ মাঝে-মাঝে বাজিয়ে বা গেয়ে থাকি। এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, আমার মতে ‘সাইলেন্ট নাইট’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মর্মস্পর্শী একটা সুর, অসাধারণ তরলতায় গড়া একটা গান। আমার একক পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল গিটার অনুষ্ঠানে আমি ‘সাইলেন্ট নাইট’ বাজিয়ে থাকি।
‘সাইলেন্ট নাইট’-এর চেয়ে পুরনো, এবং বর্তমান যুগের খুবই জনপ্রিয় আর একটা ক্যারল হল ‘হার্ক! দ্য হেরাল্ড এঞ্জেলস সিং’ (Hark! The Herald Angels Sing), যা রচনা করেছিলেন জার্মান পিয়ানিস্ট এবং কম্পোজার ফেলিক্স মেন্ডেলসোহন। ইদানীং বহু নিউ-এজ সঙ্গীতশিল্পী দেখছি এই গানটা নিয়ে মেতে উঠেছেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় ডিস্কো ব্যান্ড বনি এম-এর ‘মেরি’জ বয় চাইল্ড’ (Mary’s Boy Child) নামের গান এই ক্যারল অবলম্বনেই তৈরি, এবং হয়তো এই গানটার কারণেই ‘হার্ক! দ্য হেরাল্ড এঞ্জেলস সিং’ সারা বিশ্বে প্রচুর শ্রোতা খুঁজে পেয়েছে।
‘উই থ্রি কিংস অফ ওরিয়েন্ট আর’ (We Three Kings of Orient Are) ক্যারলটা আমি কোনোদিন ক্লাসিকাল গিটারে ট্রান্সক্রাইব করতে চাই। বেশ জনপ্রিয় ক্যারল হওয়া সত্ত্বেও কিছু বছর আগে অবধিও আমি এটা শুনিনি; প্রথম শুনলাম ইউটিউবে কিংস কলেজ কয়্যার-এর উপস্থাপনায়। একটা বিষণ্ণ, মধ্যপ্রাচ্য-ঘেঁষা সুরের (এর কারণ কি সেই তিন ‘ওরিয়েন্টাল’ রাজা?) থেকে অনায়াসে একটা বনেদি খ্রিস্টান হিম বা স্তোত্রের সুরে বাঁধা এই ক্যারলটা খুব ইন্টারেস্টিং; এর মায়াবী, পরিবর্তনশীল সুরের জন্য ক্যারলটা সঙ্গে-সঙ্গে আমার কানে লেগে যায়।
এই প্রসঙ্গে, অসাধারণ লিরিক এবং সহজ সুরের জন্য আমার মন কেড়ে নেওয়া ক্যারল, ১৯৪১ সালে লেখা মার্কিন কম্পোজার ক্যাথরিন কেনিকট ডেভিসের ‘দ্য লিট্ল ড্রামার বয়’ (The Little Drummer Boy)-এর কথা বলতেই হয় । শিশু যিশুর জন্যে কোনো উপহার কিনে আনতে অক্ষম, হতদরিদ্র এক ঢোল-বাজিয়ে বালকের কথা লেখা এই ক্যারলে, যার বাজনা শুনে যিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। উপকথায় বলা হয়, উপহারের বদলে, যিশুর জন্ম উদযাপনে এই দরিদ্র বালক তার সব ক্ষমতা দিয়ে বাজনা বাজিয়ে গিয়েছিল।
একটা স্বতঃস্ফূর্ত অনন্যতায় বাঁধা ‘দ্য লিট্ল ড্রামার বয়’ সাধারণত গুরুগম্ভীর ক্রিসমাস ক্যারলের সুর থেকে বেশ কিছুটা আলাদা, এবং শৈশবের সারল্য অসাধারণভাবে পেশ করা এই ক্যারল ভীষণ জনপ্রিয়। এখানে কনভেন্ট স্কুলগুলোর ক্রিসমাস উদযাপনে প্রায়শই দেখা যায় যে ক্লাসের সবচেয়ে মিষ্টি বাচ্চাটি ‘ড্রামার বয়’-এর ভূমিকায় অভিনয় করছে!
রিফর্মার মার্টিন লুথার কিং-এর লেখা ক্যারল ‘আ মাইটি ফোর্ট্রেস ইজ আওয়ার গড’ (A Mighty Fortress Is Our God) সচরাচর ক্রিসমাস ‘মাস’ বা পড়শির বাড়িতে ক্রিসমাস উৎসবে গাওয়া হয় না। লুথেরিয়ান ট্র্যাডিশনে গাওয়া এই স্তোত্র প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্মীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। বহু নামজাদা পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল কম্পোজার লুথার-এর এই স্তোত্রের উপর ভিত্তি করে নিজেদের সঙ্গীত রচনা করেছেন। যোহান সেবাস্টিয়ান বাখ রচনা করেছিলেন চার্চ কয়্যারের ‘ক্যান্টাটা’, বা কোরাল ক্যান্টাটা ‘আইন ফেস্টে বুর্গ ইস্ট উঞ্জের গট্’। ১৯৩০ সালে মেন্ডেলসোহন তাঁর সিম্ফনি ৫-এর চতুর্থ চলন রচনা করেন এই স্তোত্র অবলম্বনে; এই হিম-এ অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসি কম্পোজার ক্লড ডিবুসি তাঁর পিয়ানো ডুয়েট ‘অঁ ব্লান্শ এ নোয়া’ রচনা করেন।
ব্রিটিশ কম্পোজার ভিক্টর হেলি-হাচিনসন-এর রচিত ‘ক্যারল সিম্ফনি’ (Carol Symphony) অপেক্ষাকৃতভাবে অজ্ঞাত, কিন্তু অসাধারণ সুন্দর আর একটা ক্যারল, যেটা আমি খুবই ভালবাসি। চার মুভমেন্ট বা চলনে লেখা এই ‘সিম্ফনি’ বস্তুত কিছু জনপ্রিয় ক্রিসমাস ক্যারলের একটা একত্রীকরণ বলা যেতে পারে, যেখানে আছে ‘ও কাম অল ইয়ে ফেথফুল’ (O Come All Ye Faithful), ‘গড রেস্ট ইয়ে মেরি জেন্টলমেন’ (God Rest Ye Merry Gentlemen), ‘কভেন্ট্রি ক্যারল’ (Coventry Carol ) এবং ‘দ্য ফার্স্ট নোয়েল’ (The First Noel)। গানগুলো হেলি-হাচিনসন-এর লেখা না হলেও, যে নৈপুণ্যে তিনি প্রতিটা ক্যারলকে একের পর এক সুরে বেঁধে এই সিম্ফনি তৈরি করেছিলেন, তা অনবদ্য।
অখ্যাত ক্যারলের কথায় মার্কিন কম্পোজার উইলিয়াম হেনরি ফ্রাই-এর ‘সান্তা ক্লজ সিম্ফনি’ (Santa Claus Symphony) বলা যেতে পারে লুকানো হিরে-বিশেষ; ১৬৯ বছর আগে লেখা এই সিম্ফনি অর্কেস্ট্রাই সম্ভবত প্রথম, যেখানে সদ্য-উদ্ভাবন করা স্যাক্সোফোন-এর ব্যবহার দেখা যায় (ফ্রাই-এর রচনার মাত্র এক দশক আগে যার জন্ম)!
ভাবছেন বোধহয়, আপনার সবচেয়ে প্রিয় ‘জিঙ্গল বেল্স’ (Jingle Bells) নিয়ে কোনও কথা এখনও বলা হল না কেন? এই অতিকথাটা এবার ভাঙার সময় হয়ে এসেছে। ‘জিঙ্গল বেল্স’ ক্রিসমাস ক্যারল নয়, যদিও ক্রিসমাস উপলক্ষে গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে এটা হামেশাই গাওয়া হয়ে থাকে। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, ‘জিঙ্গল বেল্স’-এ ক্রিসমাসের কোনও উল্লেখই নেই, না আছে যিশুখ্রিস্টের জন্মে-সংক্রান্ত কোনও নেটিভিটি দৃশ্যের কথা। আছে শুধু এই উৎসব-উদযাপন কালের সারমর্মের কথা, ‘সিজন’-এর ‘স্পিরিট’-এর কথা। ক্রিসমাসের সহজ এবং প্রিয় এই গানটা আমি আমার নতুন ছাত্রছাত্রীদের শেখাই।
শেষের কথা
৫ জানুয়ারির পর যেমন ক্রিসমাসের সাজসজ্জা আর ঘরে রাখতে নেই, তেমনই নাকি ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর আর ক্রিসমাসের গান গাওয়া ‘অনুচিত’। মজার কথা, সাজসজ্জা খুলে নেওয়া হলেও, এবং এই কুসংস্কার সত্ত্বেও, ক্রিসমাস ক্যারল কিন্তু সারা বছর জুড়েই গাওয়া হয়ে থাকে— কেননা এই গানের সুর আমাদের উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করে তোলে (আমি নিজেই এই দোষে দোষী)। আসুন, আজ ক্রিসমাসে আমরা ক্রিসমাস ক্যারল গাই, শুনি, আমাদের অন্তরাত্মাকে এই অসাধারণ গানেগুলোর সুরে-সুরে ভরিয়ে তুলি।
ফিচার ছবি: ‘দ্য ক্রিসমাস ট্রি’; অ্যালবার্ট চেভালিয়ে টেলার, ১৯১১