ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হেঁশেলের হিস্‌সা: পর্ব ১০


    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (December 10, 2021)
     

    মিষ্টান্ন মিতরে জনা: প্রথম পর্ব 

    পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ কথাটি বেশ কিছুদিন চলেছিল বটে, কিন্তু তার মূল অর্থ যাই হোক, হিন্দুস্তান আর চিনির মধ্যে অটুট এক আত্মিক বন্ধন, এমন অর্থ করলে ভুল হবে না, কারণ— ওই এরোপ্লেন বা প্লাস্টিক সার্জারির আঁতুড়ঘর হিসেবে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-কে নিন্দুকেরা মানতে না চাইলেও— কেলাসিত ইক্ষুনির্যাস, অর্থাৎ চিনির আদিভূমি যে আমাদের এই ভারতবর্ষ, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। চিনির সবচেয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস, মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ সিডনি মিনৎজ-এর Sweetness and Power: The Place of Sugar in Modern History (১৯৮৫)-তে এই সত্য দ্বিধাহীন স্বীকৃতি পেয়েছে। একটা নলখাগড়া টাইপের জিনিস থেকে ভারতীয়রা কোনও মৌমাছি ছাড়াই বানিয়ে ফেলছে ‘মধু’, তাজ্জব হয়ে সেই ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখেছিলেন আলেকজান্ডারের সেনাপতি নিয়ার্কাস। আর তার পরের কয়েক শতাব্দীতে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আরব বণিকদের হাত ঘুরে ‘মার্চেন্টস অফ ভেনিস’-এর হাতফেরতা হয়ে ইউরোপে চিনির অপ্রতিরোধ্য পদসঞ্চার, যদিও ক্রুসেডের ইউরোপীয় সৈন্যরাও মাঝেমধ্যে ঘরে ফিরতেন প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র ভূমি’ থেকে অত্যাশ্চর্য ‘মিষ্টি নুন’-এর ঝোলা নিয়ে। বস্তুত, সংস্কৃত ‘শর্করা খণ্ড’ থেকেই ফার্সি ‘শক্কর কন্দি’, আর তারই অপভ্রংশ ‘শুগার ক্যান্ডি’। এই জিনিসটিকেই কলম্বাস পৌঁছে দিলেন আমেরিকার দুই মহাদেশের ভূখণ্ডে, তার পর প্রথমে পর্তুগিজ আর তার পর ব্রিটিশরা চিনির লোভে তাদের পরিব্যাপ্ত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তুলল আখের আবাদ, কিউবা, জামাইকা, হেইতি, লুইজিয়ানা, মরিশাস, ফিজিতে অগণিত ক্রীতদাস বা চুক্তিমজুররা এক অসহনীয় জীবনে নিজেদের বিলিয়ে দিলেন, যাতে চা থেকে চকোলেট, সবই এক পরম মাধুর্যে আবিল হয়ে ওঠে। এই সিজনে আলতো করে নতুন গুড়ের সন্দেশটি মুখে ফেলার সময়েও আমাদেরও এই রক্তঋণটি স্বীকার করতে হবে বইকি!

    ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর মহাগ্রন্থ ‘বাঙালির ইতিহাস: আদি পর্ব’-তে জানিয়েছেন যে, প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি ছিল আখের ক্ষেতে পরিপূর্ণ, এবং বাংলাদেশের চিনি ও গুড় অন্য সবার কাছে সুবিদিত ছিল— বস্তুত তেরো শতকে মার্কো পোলো থেকে ষোলো শতকে পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তে বারবোসা, সবাই এখানকার সমৃদ্ধির পিছনে চিনির রফতানির অবদানের কথা বলেছেন। শুধু তা-ই নয়, গুড় থেকেই ‘গৌড়’ নামের উৎপত্তি! তাই বাঙালিজীবন ঐতিহাসিক ভাবেই মধুররস সিঞ্চিত। 

    প্রাক্ মধ্যযুগের বাংলায় মিষ্টি খাওয়ার চল নিয়ে খুব বেশি ঐতিহাসিক তথ্য আছে তা নয়, গবেষক তপোনাথ চক্রবর্তী তাঁর Food and Drink in Ancient Bengal নামের বইটিতে এ নিয়ে বেশি আলোচনা না করলেও, এটুকু মোটামুটি জানা যে, শেষপাতে একটু চিনি বা গুড় বা তালগুড় দিয়ে দুধভাত খাওয়ার প্রথা বহু পুরনো, তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দইও জুটে যেত। আর্যদের কাছ থেকে পাওয়া গেল পায়েস আর ঘন দুধ, অর্থাৎ ক্ষীর, তার সঙ্গে বাঙালির হাতে যোগ হল ময়দা, চালগুঁড়ো, দুধ, নারকোল, চিনি, গুড় মিশিয়ে হরেক রকম পিঠে। এই দিয়েই আদ্যিকালের বাঙালি চালিয়েছে বেশ কয়েকশো বছর। কিন্তু মধ্যযুগের গোড়া থেকেই দেখতে পাচ্ছি এক নতুন রমরমা। পনেরো শতকের গোড়াতেই চৈনিক সেনাপতি মা হুয়ান দেখেছিলেন, বাংলায় দানা-দানা চিনি আর নানান ফলের মোরব্বার খুব চল। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-তে কৃষ্ণদাস কবিরাজ অদ্বৈত আচার্যের গৃহে অভ্যাগত শ্রী চৈতন্যদেব যা যা খেলেন, তার এক অনবদ্য বর্ণনার শেষ দিকে, অর্থাৎ ওই মধুরেণ সমাপয়েৎ-এর জায়গাটায়, ক্ষীরপুলি, নারকেল, হরেক রকম পিঠে, ‘দুগ্ধ-চিড়া-কলা’, লাউয়ের পায়েস, ইত্যাকার বিরামহীন ফিরিস্তি দিতে-দিতে, বোধহয় খানিকটা অধৈর্য হয়েই, ‘চাঁপাকলা-দধি-সন্দেশ কহিতে না পারি’, বলে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন। তাঁরই ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’-এও ছিল সর-ননী-দই-খোয়ার পাশাপাশি ‘ক্ষীরাদি শর্করা লাড়ু মনোহরা’ সহ হরেক মিষ্টির বিবরণ। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে পার্বতীর কাছে শিবের রান্নার ফরমায়েশে তেতো, শুক্তো, শাকভাজা, ডাল-সহ নানান ব্যঞ্জনের কথা পাচ্ছি, কিন্তু মিষ্টিতে শঙ্করের রুচির কোনও পরিচয় নেই, যদিও ‘মোদক প্রধান রানা’ তাঁর ‘চিনির কারখানায়’ বানিয়ে চলেছেন ‘খণ্ড নাড়ু’, খেজুর গুড়ও বানানো হচ্ছে পাশেই। দীন চণ্ডীদাসের পদাবলীতেও দেখি কৃষ্ণের জন্মের পর খুশিয়াল রাখালরা বালগোপালকে দু’হাত ভরে দিচ্ছেন ‘শাকর মিঠাই আদি’ বা ‘চিনিচাঁপাকলা ফেনি’।

    তেরো শতকে মার্কো পোলো থেকে ষোলো শতকে পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তে বারবোসা, সবাই এখানকার সমৃদ্ধির পিছনে চিনির রফতানির অবদানের কথা বলেছেন। শুধু তা-ই নয়, গুড় থেকেই ‘গৌড়’ নামের উৎপত্তি! তাই বাঙালিজীবন ঐতিহাসিক ভাবেই মধুররস সিঞ্চিত।

    তার মানে দাঁড়াল কি এই যে, মোটামুটি ষোলো শতক অব্দি বাঙালির ‘ডেজার্ট প্ল্যাটার’ ওই কলা-নারকোল-চিনি-গুড়-ক্ষীর-বাতাসাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, তার কেরামতির দৌড় তার থেকে খুব বেশি এগোয়নি, তখনও? ভুল, কারণ এর কয়েকশো বছর আগেই তুর্ক-আফগানরা বাংলায় তাদের রাজ্যপাট জাঁকিয়ে বসেছে, আর ১৫৭৬ সালে তাদের হটিয়ে মুঘলরা। মুসলমান শাসকরা এক নতুন ঘরানার মিষ্টি নিয়ে এলেন, প্রাক্‌-মুসলিম দই-ক্ষীর-মন্ডার পাশাপাশি চালু হল নানা ধরনের ময়দা-সুজি-বেসন-চালগুঁড়ো-মুগডাল ইত্যাদি হরেক শস্যচূর্ণকে চিনি-ঘি-দুধে জ্বাল দিয়ে, তার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুরস্ক বা ইরানের মতো অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা আখরোট বা কাঠবাদামের (বা ষোলো শতকে পর্তুগিজ-অধিকৃত গোয়া থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকা কাজুবাদাম) সঙ্গে ওই অঞ্চলেরই কিসমিস (তুর্কি ‘কিশমিশ’ থেকে) মিশিয়ে চমৎকার সব হালুয়া তৈরি করা, যার থেকে মুসলিম ঘরানার মিষ্টান্নশিল্পীদের নাম হবে হালুইকর, বা হালওয়াই। মুঘলরা আমদানি করলেন আরও হরেক কিসিমের মিষ্টি— জিলিপি, অমৃতি, গুলাব জামুন, আরও কত কী, আর ইরানের ‘কুলফি’-র ভারতীয়করণও তাঁরাই করলেন, সে-কাজে ব্যবহৃত হল এ-দেশের উৎকৃষ্ট দুধে পেস্তা জাফরান, ইত্যাদি মিশিয়ে হিমালয়ের বরফ অথবা সোরা, অর্থাৎ সল্টপিটার, দিয়ে রেফ্রিজারেশনের কৃৎকৌশল। মুঘল বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা, আর হাবিবা আর হাফিজা খাতুনের যুগ্ম সম্পাদনায় ‘ঢাকাই খাবার’ নামের একটি চমৎকার বইতে পড়ি সতেরো শতকের ঢাকায় ছিল নানান গোত্রের হালুয়া, লাড্ডু, বালুশাহি, ‘শকরপাড়া’ (খাজার সমগোত্রীয়), ফালুদার রমরমা, আর দুধ-চাল-বাদাম-কিসমিস-এলাচ দিয়ে তৈরি ফিরনি বা শিরবিরিঞ্জ তো ছিলই। অ্যাপ্রিকট, কাজুবাদাম, জাফরান আসত ইরান থেকে। বস্তুতই, মধ্য এশিয়ার ইরান, তুরস্ক, আর তুরান— অর্থাৎ আজকের উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, যেসব জায়গায় মুঘলদের উৎপত্তি— অঞ্চল থেকে আসত মিষ্টির উপকরণ, রসুইয়ের কায়দা, ইত্যাদি। জানতেন কি যে, আমাদের সাতপুরনো গুলাব জামুন— বাংলায় যার রকমফের পান্তুয়া, কালোজাম, বা লেডিকেনি— আদতে ছিল মধ্য এশিয়ারই বাসিন্দা, ইরানে তার নাম ছিল বামিয়ে, তুরস্কে তুলুম্বা, আর আরব্য দুনিয়ায় তার বাহারি নাম লুকমৎ আল-কাদি (Luqmat al-Qadi), বা সংক্ষেপে লোকমা, আদতে হল তেলে ভাজা এবং মধুতে বা চিনির রসে ভেজানো ময়দার ফুলুরি, আমরা আমাদের নিজস্ব কায়দায় তাকে একটু ‘আপগ্রেড’ করেছি মাত্র।

    আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালে লেখা তাঁর ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ গ্রন্থে বাংলার একান্ত নিজস্ব খাদ্যসম্ভারে জায়গা দিয়েছেন যে জিনিসগুলিকে, তার লিস্টটি একবার দেখে নেওয়া যাক:

    ‘… খেজুরে গুড়, পাটালী, মুড়ী, মুড়কী; চালের গুঁড়া নারিকেল ক্ষীরের তৈয়ারী নানা পিষ্টক ও মিষ্টান্ন, বীরখণ্ডী, কদমা, খাজা, গজা, সীতাভোগ, মিহিদানা ইত্যাদি; ছানার তৈয়ারী মিষ্টান্ন, বাঙ্গালার নিজস্ব মিষ্টান্ন, নানা প্রকারের সন্দেশ, পানিতোয়া, রসগোল্লা।’

    মুঘলরা আমদানি করলেন আরও হরেক কিসিমের মিষ্টি— জিলিপি, অমৃতি, গুলাব জামুন, আরও কত কী, আর ইরানের ‘কুলফি’-র ভারতীয়করণও তাঁরাই করলেন, সে-কাজে ব্যবহৃত হল এ-দেশের উৎকৃষ্ট দুধে পেস্তা জাফরান, ইত্যাদি মিশিয়ে হিমালয়ের বরফ অথবা সোরা, অর্থাৎ সল্টপিটার, দিয়ে রেফ্রিজারেশনের কৃৎকৌশল।

    সুনীতিকুমারের এই তালিকায় উল্লিখিত মিষ্টিগুলির প্রত্যেকটিই বহন করে চলে উৎপাদন রীতি বা পাকশৈলীর আঞ্চলিক বৈচিত্রের বিপুল স্বাক্ষর। বাংলার, বিশেষ করে কলকাতার মিষ্টান্নশিল্পের সুবিশাল ঐতিহ্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যান করতে গেলে একটা আস্ত মহাভারত লিখতে হবে, শুধু রসগোল্লার ইতিহাস নিয়েই পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ রচনা সম্ভব। সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি, কিন্তু তার আগে যা বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে, তা হল মিষ্টি বানানোর এক সজীব ও পরিব্যাপ্ত আঞ্চলিক সংস্কৃতি, যা বিভিন্ন জেলা এবং মফস্‌সল শহরকে স্বকীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কখনও-কখনও কারিগরের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ভাস্বর হয়ে তাঁর নামটিকেই আশ্রয় করে আঞ্চলিক গৌরবকে উদ্ভাসিত করেছে কিছু-কিছু অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। তাঁর ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য রচনা’ নামের অনন্য বইটিতে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত মাহেশের মুকুন্দ ময়রার সৃষ্টি স্বনামধন্য ‘মুকুন্দ মোয়া’র সুখ্যাতি করেছেন, তার সঙ্গে একই গোত্রভুক্ত বর্ধমান জেলার ভাতার গ্রামের গোপাল ময়রার বানানো ‘গোপালগোল্লা’, বা বিশেষ ধরনের রসগোল্লা। দুটি ক্ষেত্রেই কুশলী কারিগররাই হয়ে ওঠেন আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতীকপুরুষ।

    তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারিগরের ব্যক্তিপরিচয় অজ্ঞাত, অঞ্চলই তার নিজস্ব মহিমায় স্বতঃমহীয়ান। নদিয়া জেলার প্রকৃত ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর চৈতন্যদেব না গোপাল ভাঁড় না কি কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া আর সরভাজা, তা নিয়ে বিতর্ক জমতেই পারে। একই কথা প্রযোজ্য বহরমপুরের (মুর্শিদাবাদ) লেডিকেনি (শোনা যায় ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ভাইসরয়-পত্নী লেডি ক্যানিং-এর সম্মানে বহরমপুরের খাগড়া বাজারের ময়রাদের হাতে তৈরি) আর ছানাবড়া, বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা, বিষ্ণুপুরের (বাঁকুড়া) মতিচুর— অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ বা ‘রাজকাহিনী’-তে যা কিনা শত্রুনিধনের জন্য সেঁকোবিষ মেশানোর ‘ফেভারিট মিডিয়াম’— সিউড়ির (বীরভূম) মোরব্বা, জয়নগরের নতুন গুড়ের মোয়া, ধনেখালির খইচুর, জনাইয়ের মনোহরা বা রসকরা, খানাকুলের ‘কারাকান্ডা’, শান্তিপুরের ‘খাসামোয়া’, মুড়াগাছার ছানার জিলিপি আর কাঁচাগোল্লা, কান্দির ‘রাধাপ্রসন্ন’ আর ‘শ্যামাপ্রসন্ন’, নাড়াজোলের (মেদিনীপুর) মুগের জিলিপি, বা ক্ষীরপাইয়ের (মেদিনীপুর) ‘বাবরশা’ সম্পর্কেও। মনে রাখতে হবে যে, আঞ্চলিক বাংলার এই অনন্যসাধারণ প্রদর্শনীর জন্য আঠেরো ও উনিশ শতকে আঞ্চলিক রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতার অবদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণনগর-মুড়াগাছা-নাড়াজোল-রাণাঘাট-কান্দির ভূস্বামীদের অকৃপণ উৎসাহ না পেলে স্থানীয় মোদককুলশ্রেষ্ঠদের অনেকেরই বহু অসাধারণ কীর্তি যে সৃষ্টির আলোক দেখে উঠতে পারত না, সে-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

    সেই সঙ্গে আর যে-বিষয়টি নিয়ে কোনও কথা হবে না, তা হল এই যে, গ্রাম-গঞ্জ-শহর-মফস্‌সল-কলকাতা মিশিয়ে ময়রাদের ‘অস্ত্রাগার’-এ প্রধান আয়ুধটি সংযোজিত হল সতেরো শতকে, যখন হুগলির চুঁচুড়া অঞ্চলের পর্তুগিজ সায়েবরা চিজের এক দুর্মর আকর্ষণের তাড়নায় দুধ কেটে ছানা বানালেন, যে ‘কর্তন’ হিন্দুধর্মে গর্হিত ছিল, হয়তো দুধ দেবভোগ্য বলেই। আর এই পৃথিবীকে আরও একটু বাসযোগ্য করে যাওয়ার কোনও এক অদম্য অঙ্গীকার থেকেই কোনও সায়েব নবজাতক এই ছানাকে একদিন চিনির রসে ডোবালেন, আর সেই মুহূর্তে ঘটে গেল এক আশ্চর্য বিপ্লব, ফরাসি বা রুশ বিপ্লবের থেকে যার তাৎপর্য খুব কম নয়। সেই বিপ্লবের গল্প আগামী কিস্তিতে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook