মার্গসংগীত আর পৃষ্ঠপোষকতা
ভারতীয় মার্গসংগীতের পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে, যদিও বহু ব্যক্তি ও সংস্থা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগেকার কালে পৃষ্ঠপোষকরা অনেকরকম ভাবে সাহায্য করতেন শিল্পীদের, শিল্পীরাও আবার অনেকরকম ভাবে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতেন। আজকাল সংগীতের ছাত্রছাত্রীরা অতীতের সেই সব গল্প শোনে, পৃষ্ঠপোষকরা তাঁদের পছন্দের শিল্পীকে দামি দামি রত্ন উপহার দিয়েছেন, গ্রাম-জমিদারি দান করেছেন, বা মহান সমস্ত উপাধি দিয়েছেন। এখনকার দিনে শোনা যায়, ধনী পৃষ্ঠপোষক কোনও ক্রিকেটার বা গায়ককে বাড়ি-গাড়ি উপহার দিয়েছেন। তবে, এগুলো কতটা সত্যি আর কতটা গল্প, বলা মুশকিল। শিল্পীরা কখনও-সখনও একটি সম্পূর্ণ রাগ বা বন্দিশ পৃষ্ঠপোষকের বন্দনায় উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যেই যেমন তিক্ততা সৃষ্টি হয় কখনও, তেমনই পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পীর মধ্যেও মাঝেমাঝে হয়, আর তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে।
অনেক সময় মনে হতে পারে, পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে বোধহয় অনুগ্রহ ছাড়া কিচ্ছু নেই। দাতা-গ্রহীতা সম্পর্কটির মধ্যে, গ্রহীতা কি শুধু বিনা প্রতিবাদে শিল্প সরবরাহ করে যাবেন, আর হাঁটু গেড়ে ভিক্ষা নিতে অভ্যস্ত হবেন? না কি সম্পর্কটা ক্রমে এমন জায়গায় পৌঁছবে, যেখানে পৃষ্ঠপোষক অত্যন্ত সমঝদার হবেন এবং শিল্পীর জটিল সংগ্রামে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তা করবেন? অবশ্য বুঝতে হবে, অনেকরকমের পৃষ্ঠপোষক আছেন, শিল্পীর সহায়তা বিষয়ে তাঁদেরও ধারণাও অনেকরকম। এবং সেই পৃষ্ঠপোষকরা তাঁদের মতো করে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারেন বা হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারেন, আর চূড়ান্ত ব্যর্থও হতে পারেন।
একবার এক সম্ভাব্য পৃষ্ঠপোষকের বন্ধুর বন্ধু আমার কাছে এলেন। সেই পৃষ্ঠপোষক হিন্দুস্তানি সংগীতের জন্য অনেককিছু করতে চাইছিলেন, কিন্তু তাঁর এক উদ্ভট চাহিদা ছিল। তাঁর জন্মস্থান বা পরিবারের নামে মার্গসংগীতে একটি নতুন ‘ঘরানা’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি তা করা হয়, তবেই তিনি ‘পৃষ্ঠপোষক’ হবেন। অদ্ভুত প্রস্তাবটি শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়ে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম, একটি ঘরানা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন বেশ কয়েক প্রজন্ম সেই নির্দিষ্ট ঘরানার বৈশিষ্ট্য মেনে গান-বাজনা করেন। তাহলে আমাদের জীবদ্দশায় একটা ঘরানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে কী করে? একটুও দমে না গিয়ে সেই ভদ্রলোক আমায় বললেন, ‘একটু অন্যরকম করে ভাবুন না, যাকে বলে ‘আউট অফ দ্য বক্স’, আর অন্তত ঘরানার নামটা ঠিক করে ফেলুন। যদি পরে কেউ কখনও সেই ঘরানার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে না চায়, তা হলে আমি বা আপনি কেউই গালি খাব না, কারণ আমরা তো তদ্দিনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছি!’
একবার এক বিনয়ী ভদ্রমহিলা আমায় এমন কয়েকটি প্রস্তাব দিতে অনুরোধ করেন, যাতে শিল্পীরা উপকৃত হতে পারেন। আমি অত্যন্ত যত্নে খাটাখাটনি করে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাঠাই। তখন সেই ভদ্রমহিলা বলেন তিনি একটা বিরাট গালভারী নামের সংস্থার প্রধান, এবং এর মধ্যে একটা প্রস্তাব তাঁরা অবিলম্বে মিটিং করে বেছে নেবেন। বছরখানেক কেটে গেলেও যখন কেউ যোগাযোগ করলেন না, আমি ধরেই নিলাম কোনও প্রস্তাবই ওঁদের পছন্দ হয়নি। কিন্তু তারপরেই মহিলা ফোন করলেন, বললেন এত দেরির জন্য দুঃখিত, তবে বয়স্ক শিল্পীদের জন্য আমি যে প্রস্তাবটি দিয়েছি, তা তাঁদের পছন্দ হয়েছে। এরপর লম্বা লম্বা ফোনালাপ আর প্রচুর ই-মেল চালাচালি হল বহু বহু মাস ধরে, শেষে একজন শিল্পীকে নির্বাচন করা হল। শিল্পীটি অত্যন্ত উঁচুদরের, আশ্চর্য বিরল সব রাগও ছিল তাঁর আয়ত্তে, আর সেই সময় তাঁর স্বাস্থ্য ও স্বরও খুব চমৎকার। কিন্তু আমায় জানানো হল, বোর্ড মেম্বারদের জড়ো করে বোর্ড মিটিং করা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। কারণ তাঁরা খুবই ব্যস্ত সব মানুষ, শিল্পের জন্য সময় বার করা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন। ফলে আরও অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেল। সেই শিল্পীর বয়স হল, তিনি ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং শেষে মারা গেলেন। সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা আর তাঁর কাছে পৌঁছলো না।
জীবনের এই দুটি অভিজ্ঞতা সবার সামনে তুলে ধরে আমি কিন্তু কারও অবদানকে খাটো করে দেখাতে চাইছি না। মার্গসংগীতের যাঁরা নিবেদিত পৃষ্ঠপোষক, তাঁরা অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও মর্যাদার সঙ্গে অসামান্য কাজ করেছেন। আমার উদ্দেশ্য শুধু এইটুকু দেখানো, অনেকরকমের পৃষ্ঠপোষক হন, আবার বিভিন্ন ধরনের শিল্পীও হন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
 
															 
							



