প্লট
ঘুঁতুঘুঁতু ঘুঁতু ঘুঁতু ঘুঁতু ঘুঁতু ঘুঁতু ঘুঁতু। বাইক চলে গেল। পুলিশ দৌড়ল তার দিকে, নম্বর নেওয়ার চেষ্টা করল। অনেক দূর চলে গেছে, আমি নিজেই আর দেখতে পাচ্ছি না। তাও কী যেন নোট করল। লাল সিগনালে না থামা, না কি প্রতিনিয়ত নিস্তব্ধ হয়ে আসা দুনিয়ায় অকারণ অশ্লীল শব্দ করে চলা? ওপরওয়ালার চাপে নির্ধারিত ধর্তব্যের কর্তব্যকম্ম করা কি না, তাও জানি না। সারাদিন রাস্তায় কত বীজাণু, সোলার পরমাণু, ডাউন বৃহস্পতি নির্গত যাবতীয় শুক্রাণু, সাদা হেলমেটে পতিত কাকের বিষ্ঠাণু মেখে ডিউটি করা কষ্টের কাজ। ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের জুলুমে নিম্নচাপের কাতরতা। প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড কম নাকি! শোনা কথা যদিও। ছরছর করে আর একটা বাইক গেল, জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর ছায়া ফেলে একটা কাক রাস্তা পেরোল। নো পার্কিং বোর্ডের ঠিক তলায় একটা কেঁদো গাড়ি থেমেছে, গতর নেড়ে আগু-পিছু করছে, ফুটপাথের দিকে ঘেঁষছে, সেদিকে পুলিশের নজর নেই। আমার কোনও চিন্তা নেই। মানুষ যে-কোনও জায়গাতে নিজেকে পার্ক করতে পারে, এই যেমন আমি এখন রেলিঙে ঠেস দিয়ে তিন মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছি। দুনিয়া শুষছি। পুলিশ কেন, কারুর কিছু বলার নেই।
ওদিকে পুলিশ একটা লোককে তাক করেছে। এমনি লোক। এতটাই যে, বর্ণনা করা যায় না। সে আসছে, কোথাও বিশেষ যেতে চায় বলে মনে হল না। ফাঁকা ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। কখনও চিন্তিত, কখনও মজারু, কখনও এমনি মুখ করছে। এটা চলছে কিছুক্ষণ অন্তর। বুঝতে সময় লাগল। বদলে যাওয়া ট্র্যাফিক-লাইট দেখছে সে। আমি ওকে দেখতে পেয়েছি তা দেখতে পেয়ে হেসে আঙুল তুলে দেখিয়ে আমাকে যেন বলতে চাইল, ‘কী কাণ্ড না!’ এই যে চোখাচোখি হয়েছে, এই যথেষ্ট। একটা হৃদ্যতা তৈরি হয়ে গেছে। লোকটা কাছে এসে আমাকে বলল, ‘দেশের পলিটিকাল হিস্টরিটা ভাবুন একবার, কত নেতা আসছে-যাচ্ছে, এটা দেখলে ব্যাপারটা জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়, তাই না?’ তারপর ঘুরে আবার হলুদ-সবুজ-লাল-হলুদ-সবুজ দেখতে লাগল। ‘ট্রাফিক-লাইটের আলোর সিকোয়েন্সের প্রোগ্রামিংয়ে একটু ভুল আছে, আগেকার তো!’ আমার জিজ্ঞাসু মুখ দেখে সে বলল, ‘হলুদটা খুব কম সময় থাকছে, এখন তো ওটাই বেশি থাকার কথা, কী, তাই না?’
আমি রেলিঙের ভেতরে, লোকটা এই মুহূর্তে একটু বিপজ্জনক ভাবে পিচের ওপরে। পুলিশ বেড়ালের মতো ওর দিকে এগোচ্ছে। ধরল ক্যাঁক করে, কী একটা বলল, আঙুল তুলে দেখাল। লোকটাও সম্মতি জানিয়ে ফুটপাথে ফিরে এসে দেওয়ালের ধারে দাঁড়াল। সেখানে একটা বাইক দাঁড় করানো আছে। পুলিশের হতে পারে। এবারে নজর পড়ল ওখানে আর একটা মোটামতো লোক উবু হয়ে বসে আছে। দু’হাতের আঙুলগুলো দিয়ে চৌকো ফুটোর মতো করে তার মধ্যে দিয়ে চারপাশ দেখছে। এও তার পাশে বসে পড়ল। আলোর খেলাটা ওকেও দেখানো হল। গুজগুজ করে কথা শুরু হয়ে গেল ওদের মধ্যে। আমি অবশ্য শুনতে পাচ্ছিলাম না। পুলিশ উদাস চোখে রাস্তা দেখছে, আবার কেউ একটা আসবে নিশ্চয়ই, ধরবে। যাদের এখানে ধরেছে, ধরে নিলাম এই দুজনকে, কেন কে জানে, ফাইন করেনি কিন্তু, অন্তত এখনও। তারা কেউ পালানোর চেষ্টা করছে না। পালিয়ে যাওয়া গরু-ছাগলকে ধরে বকাবকি করে এক জায়গায় পাঠিয়ে দিলে, দড়ি বেঁধে না দিলেও দেখা যায় দাঁড়িয়ে আছে, আর চলে যাচ্ছে না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওদের সঙ্গে বসতে। বসলে ওরা আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। পুলিশ রেগে যেতে পারে, এই দুজন তার সংগ্রহ। এই স্পেসটা আপাতত পুলিশের আওতায়। সেখানে দুম করে অনুপ্রবেশ বরদাস্ত করার কথা নয়। এরা রাস্তার পাগল বা পাতাখোর নয় আমি জানি, কারণ আমি তা নই। এদিক-ওদিক দেখে, যা হয় হবে দেখা যাবে ভেবে, আমিও উবু হয়ে বসলাম, তিন নম্বরে। দেখে পুলিশ রাগারাগি করল তো না-ই, ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, ওকে, ওখানেই বসে থাকো। বসতেই মোটা পকেট থেকে একটা চক বের করে সামনের ফুটপাথের ওপর আমাদের সামনে হাফ-সার্কেল করে অনেকগুলো লম্বা-লম্বা দাঁড়ি টেনে দিল। প্রথম লোক সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। আমিও নাড়লাম। মোটা হাসল।
এদের কেন জমা করা হয়েছে জানার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। দুজনকে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করেন?’ হলুদ বলল, ‘কী আনন্দ, এই বসন্ত, আজ তোমারই এ কুঞ্জের পারে, তুমি দাও সাড়া দাও, এসে নাও ডেকে নাও, কেন বসে আছ বন্ধ দ্বারে। নচিদার সুর। সবাই জানে পুলকদার কথা, আসলে কিন্তু আমি লিখেছিলাম।’ মোটা কিছু বলল না, আঙুল দিয়ে খড়ির দাগের ওপর আলতো করে হাত বোলাতে লাগল, মুছে-মুছে যাচ্ছিল কয়েকটা লাইন। বলল, ‘ফিলিম’। আমি কিছু বললাম না, কারণ আমি কিছু করি না। এরপর একটু চুপচাপ। পুলিশ আর তেমন তৎপর নয়, নিজের নোটবই দেখছে মন দিয়ে। কে যাচ্ছে-আসছে, নিয়ম মানছে কি মানছে না, তা নিয়ে আর উৎসাহী নয়। আজকে কোটা কমপ্লিট হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এরপর কী করবে? আমাদের মতো তিনজনকে গ্রেপ্তার করলে ওর খুবই মুশকিল হবে। টাকা চাইতে পারে, দেবার মতো কিছুই নেই আমার। তখন তো গ্রেপ্তার করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ঘড়ঘড় করে একটা লরি ঘুরল। ময়ূরের ল্যাজের মতো লোহার রড ঝুলছে পেছনে। রাস্তায় ঘষতে-ঘষতে আসছে। আওয়াজ শুনে মনে হল সে আর টানতে পারছে না। এই সময়ে এখান দিয়ে লরি নিয়ে যাওয়া একেবারে বেআইনি। পুলিশকে দেখে লরি তার দিকে এগিয়ে এসে স্টার্ট বন্ধ করে দিল। পুলিশ তাকে দেখে একটু যেন চমকে গিয়ে আমাদের দিকে পিছিয়ে এল। খালাসি জানলা দিয়ে মুখ বের করে হাত নেড়ে হউ-হউ করে ডাকছে। কিছু বলতে চায়, টাকা দিতে চায়, দিয়ে চলে যেতে চায়। সেটা হচ্ছে না, পুলিশ একটা ছাতিম গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। মোটা বলল, ‘ও এখন ইঞ্জিন স্টার্ট করবেই না। অনেক দূর থেকে আসছে। তেল নেই। পুলিশকে ধরেছে, টাকা নেবে, তেল ভরবে, তবে যাবে।’ হতেই পারে। হলুদ বলল, ‘পুলিশকে দিয়ে গাড়ি চালালে সবার পক্ষেই সুবিধের।’ আমাকেও কিছু বলতে হয়। ‘মাঝপথে অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেছে নির্ঘাত, আর কারুর কাছে যাবার নেই, তাই পুলিশের কাছে বিচার চাইছে।’ সবাই একমত হল সবার বক্তব্যে। বাইকটা দেখছিলাম। পুলিশের মতো নয়। মনে হয় এটা প্লেন ড্রেসে আছে।
লরির সঙ্গে চাপা বাকবিতণ্ডা চলছিল। ওপাশ থেকে ড্রাইভার নেমে এদিকে এসে ফোন বের করে রেগে-রেগে কাকে কী যেন বলতে লাগল। ফাঁকে-ফাঁকে পুলিশকেও। খালাসিও নেমেছে। সময় পাওয়ায় সে লরির তলায় ঢুকেছে। ‘লালবাজারে ফোন করে ড্রাইভার পুলিশের নামে কমপ্লেন করছে, কেস দেওয়া হয়নি বলে। দেরি করাচ্ছে বলে।’ আমি বললাম। হলুদ বলল, ‘ছন্দপতন অনিবার্য।’ মোটা চুপ। পুলিশ আমাদের দিকে আসছে এখন। আমরা ছাড়া ওর আর কে আছে? বুলফাইটের সময় ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ বলতে-বলতে খ্যাপাতে-খ্যাপাতে কখনও-কখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ষাঁড় একশো অশ্বশক্তি অর্জন করে পালটা আক্রমণ করে। ফুঁড়ে দেয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে। বেগতিক দেখলে ম্যাটাডোর দৌড়ে পালায়, বেড়া টপকে দর্শকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানেও সেরকম কিছু হতে চলেছে আন্দাজ করে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। মোটা ফট করে কয়েকটা বেড়া মুছে দিল। হলুদ দু’হাত তুলে বলে উঠল, ‘এসো এসো কাছে এসো, তুমি ছাড়া ফাঁকা এ জীবন, কবে হবে মধুর মিলন, এটাও পুলকদা, প্রসেনজিৎ ছিল।’ পুলিশ পুরোটা এল না, মাঝপথে দাঁড়িয়ে রইল। লরি স্টার্ট নিয়ে কয়েকবার গরগর করে হুমকি দিয়ে ফের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ আগেও এক-আধটা গাড়ি দেখা যাচ্ছিল, এখন রাস্তাটা একেবারে বদ্ধভূমি। সাবধানে এদিক-ওদিক দেখে, ধীর পায়ে পুলিশ গেল লরি অবধি। খালাসি হাত ঝুলিয়ে দিল। আমার মাথার শিরা দপদপ করছিল। পুলিশ কী যেন দিল ওকে। হলুদ বলল ‘ভরসা’, মোটা বলল ‘কেস’, আমি বললাম ‘খৈনি’। লরি চলে গেল। পা টেনে-টেনে পুলিশ ফিরে এল আমাদের কাছে। ঘেন্নাভরে নিজের জুতো দুটো খুলে ঝাড়ল। একটা ছোট পাথর পড়ল। ক্লান্ত ভাবে বলল, ‘সর না।’ আমরা ছোট হয়ে বসলাম। পুলিশও সেট হয়ে গেল বেড়ার মধ্যে। ঠান্ডা পড়ছে। রোদ্দুরটাও বেশ। অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোনও কথা বললাম না।
এরপর উঠে প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে চলে গেলেই হত। যাওয়া গেল না। পুলিশ শুধু জুতো নয়, চামড়ার বেল্টগুলো খুলে ফেলেছে। এখন তাকে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের মতো দেখাচ্ছে। সে এখনও ডিউটিতে আছে কি না জানি না। কিন্তু এরকম হয় নাকি? তার বন্দুকের কেস থেকে বেরোল নস্যির কৌটো। এক নাক টেনে ছল-ছল চোখে তাকাল সামনে। হলুদ সামনে থেকে সাদা গুঁড়ো আঙুলে তুলে লিখল, ‘পুষ্প’। দেখে মোটা ঘুঁতঘুঁত করে হাসল। বসে রইল পা ছড়িয়ে। এবারে আমার একটা সন্দেহ হল। এরা আসলে অন্য কেউ। ও তো পুলিশ নয়ই। অন্যরা দুপুরবেলা রাস্তায় বসে থাকবে কেন? এরা একটা চক্র হতে পারে। ওদের মনে হতে পারে একই কথা, আমাকে নিয়ে। ওদের হাব ভাবে কোনও প্রশ্ন বা সন্দেহ প্রকাশ পায়নি এখনও। আর একটু থাকি, নিশ্চয়ই বোঝা যাবে ব্যাপার-স্যাপার। এর মধ্যে মোবাইল চা-ওয়ালা এসেছে, প্লাস্টিকের ভাঁড় নামিয়ে দিয়ে চুপচাপ চলে গেছে। পয়সা চায়নি। কেউ দেয়ওনি। তার মানে চেনা লোক। এদের সবার চেনা। অর্থাৎ এরা পরস্পরের পূর্বপরিচিত। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ‘কী ব্যাপারটা কী’ বলা যায় না। অন্তত এখন। আপনি কে, তিনজনে জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর দিতে পারব না। বসে রইলাম। ভাল লাগছিল। পুজোর ব্যাপারটা যা হোক মিটে গেছে। বৃষ্টি আর হবে বলে মনে হয় না। ঠান্ডাটা গুটিগুটি এসেছে। ওইজন্যই রাস্তায় ঘুরতে সুবিধে হচ্ছে। পুলিশ তার বাইকের বাক্স থেকে একটা বড় খাতা বের করে নিজের পকেটের নোটবই দেখে-দেখে লিখছে। আড়চোখে দেখে সুবিধে হল না। মোটা আবার চক বের করেছে, চৌখুপি আঁকছে। একটার পর একটা। তার মধ্যে লরি আঁকল। দু’একটা ফিগার। পুলিশের সঙ্গে বাতচিতটাও। আমাদের রাস্তায় বসে থাকা। আশেপাশের দৃশ্য। বাড়ি। বারান্দা। হলুদ কিছু করছিল না।
রোদ্দুর ঘুরেছে, গায়ে পড়ছে না আর। সামনে ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনিতে পড়েছে। একজন টবের ফুলগাছে জল দিল। দড়িতে টাঙানো শাড়িটা টানটান করে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সবাই উঠল। আমিও। পা ধরে গিয়েছিল। একটু সরে গিয়ে, যেখানে রোদ আছে এখনও, সেখানে গিয়ে ফুসফুস-গুজগুজ করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। আমি যে আছি, আমাকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না, এমন নয়। একবার আমাকে দেখিয়ে পুলিশ মোটাকে কিছু একটা বলল। সেই খাতাটা সামনে ধরেই কথাবার্তা চলছিল। ‘আপনি কি এদিককারই?’ হলুদ আমাকে জিজ্ঞেস করল। এই জায়গাটা আমার পাড়া থেকে একটু দূরে। তাও মাথা নাড়লাম। আসলে আমি ওদের সঙ্গে থাকতে চাইছিলাম। জাস্ট জানতে চাইছিলাম ওরা কারা। পরিস্থিতিটা চালু রাখতে আমি অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলছিলাম। আমার কাছে যা জরুরি, সেসব বলার কোনও মানে হয় না। যাদের চিনি না তাদের কী বলব? ভয়ঙ্কর ঘটনা, মজার ব্যাপার, কিছুই বলার নেই। অথচ এখন শুনি লক্ষ-লক্ষ অপরিচিত মানুষ লিখে লিখে দেদার আড্ডা মারে। সামনাসামনি ক’টা জ্যান্ত লোকের কথার মধ্যে আমার জায়গা খুঁজে চলেছিলাম। ফোন থেকে বন্ধুত্বের আবেদন রাখতে হয় এখন। আমার ফোন আছে, কিন্তু ওসব নেই। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পকেটের মধ্যে আমার ফোন একবার চিঁ চিঁ করল, সকাল থেকে বেশ কয়েকবার করেছে, ধরিনি, গলা টিপে দিয়েছি। বললাম, ‘আজ আসি, ভাল লাগল।’ বলতেই, ‘আরে দাঁড়ান না’ বলায় ফের আটকে গেলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছিল।
একটা পুলিশের ভ্যান আসছিল। তার ছায়ার চেয়েও কালো গাড়িটা। পাশ দিয়ে সাঁ করে চলে গেলে অসুবিধে ছিল না। খুব আস্তে-আস্তে আসছিল। তাই দুশ্চিন্তা হল একটু। আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমার তো নেইই। সেটাকে দেখে পুলিশ বাইকের হ্যান্ডেলে তার খুলে রাখা হেলমেটটা আড়াল করল। অন্যরাও চুপ করে রইল। ভাবখানা হল, যেন দেখেইনি। ভ্যান চলে গেল। জাল-লাগানো জানলার মধ্যে কিছু লোক আছে। ভরদুপুরেও হাল্লাগাড়ি ঘোরে। ঠিক খুঁজে বের করে যাকে চাই। খপ করে তুলে নেয়। চলে যেতে পুলিশ বলল, ‘ওটা লাগবে একটা।’ আর একটা লোক এল, হাতে নানা রকমের ইংরিজি বই, চুরি করে ছাপা, খুব কম দাম, আমরা নেব কি না জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করছিল। ‘আপনাকে লাগবে’ বলায় সে দাঁড়িয়ে গেল। ঝোলার তলা থেকে আরও বই বের করে দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। সিগারেট খেতে-খেতে একটা অল্পবয়সি মেয়ে যেতে-যেতে ওদের দেখতে পেয়ে, ‘কৌশিকদা তোমায় অ্যামোন ক্যালাব না’ বলে চলে গেল। যেন তার কথা কানেই আসেনি এমন ভাব করল যার নাম কৌশিক। পুলিশ সম্ভবত। মেয়েটা একটু দূরে চলে যেতে চেঁচিয়ে ‘রাতে ফোন করিস’ বলতে, সেও হাত তুলল। আমি বইওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। কোন বইতে কী গল্প আছে সে তার পূর্বাভাষ দিতে লাগল। এর কোনওটাই আমি পড়িনি, তবে কয়েকজন লেখকের নাম শুনেছি। বইওয়ালা একটা বই সুপারিশ করল, ‘এটা নিন, সিনেমা হচ্ছে।’ যতই সস্তা হোক, বই কেনাটা এখন আমার সামর্থ্যের মধ্যে নয়। তাছাড়া রাস্তায় ঘোরা, ফুটপাথে আজেবাজে লোকের সঙ্গে গজল্লা করা মানুষের ‘দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি’ পড়া সাজে না। আমি ‘এটা তো পড়েছি, খুবই ভাল, এটাও অসাধারণ’ জাতীয় মন্তব্য করে ওকে হতোদ্যম করার চেষ্টা করছিলাম। ওইটুকু ঝোলা থেকে কত আর গোলাবারুদ বেরোবে?
স্টক ফুরিয়ে এসেছে প্রায়, সেই মুহূর্তে একটি বই বের করল, মলাট দেওয়া, নাম দেখা যাচ্ছে না। চাপা স্বরে শুনলাম, ‘ইন্ডিয়াতে এটা ব্যান, আমার কাছে এসেছে।’ বইটা না খুলে আরও অনেক কথা বলে গেল লোকটা। সাংঘাতিক ব্যাপার। খুল্লামখুল্লা লিখে দিয়েছে। লোকটা স্রেফ বই বেচে না, নিজে পড়ে-টড়ে। জানে। ‘অ্যান্টি এস্টাব্লিশমেন্ট, অ্যান্টি গভর্নমেন্ট, অ্যান্টি রুলিং পার্টি, অ্যান্টি পুলিশ’ এই অবধি বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘দেখি দেখি।’ আবার ওরা একটু আলাদা। পাতা উলটোচ্ছে। উত্তেজিত ভাবে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ‘এইটাই তো খুঁজছি।’ বইয়ের লোক আমাকে ফেলে ওদের কাছে এগিয়ে গেছে। আমি আবার একা হয়ে গেছি। এদিক-ওদিক দেখছি। আবার যদি সেই ভ্যানটা ফিরে আসে? নিষিদ্ধ বই বিক্রির খবর কি চাপা থাকে নাকি? ঝামেলায় জড়ানোর কোনও মানে হয় না। এক-পা দু-পা করে পিছিয়ে চম্পট দেবার তাল করতেই সবাই মিলে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলল। ‘আপনাকে লাগবে তো আমাদের। আপনিই তো মেইন ক্যারেক্টার। দ্য প্রোটাগনিস্ট। আপনাকে রিয়েল লাইফ ট্রাবলে ফেলে দেব আমরা, শুট করব। ক্যান্ডিড। স্ট্রেট ফ্রম দ্য স্ট্রিট। দ্য মুভি উইল ইভল্ভ ফ্রম র ডাস্ট, র ব্লাড, র শিট। তারই গ্রাউন্ড ওয়ার্ক, র মেটিরিয়াল প্রকিওর করা চলছে এখন। স্ক্রিন প্লে-টা দাঁড়াচ্ছিল না, এবারে আর প্রব্লেম নেই।’
এ তো দারুণ ব্যাপার, ভয়ের কী আছে, এমন একটা নির্ভীক মুখ করে রইলাম। পরমুহূর্তে ঘুরে এক দৌড়। অনেকটা এসে থামলাম। চোখ বুজে হাঁপাচ্ছিলাম। নিকুচি করেছে অভিনয়ের। যত্ত সব আঁতলামোর কারবার। আমার মাল আমি পেয়ে গেছি। লাল-হলুদ-সবুজ সব চমকাচ্ছে। দু’ঘণ্টায় নামিয়ে দেব। দু’হাজার শব্দ। আজ আমার লেখা জমা দেওয়ার শেষ দিন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র