দুঃখ
বিজয়ার শুভেচ্ছা সবাইকে। হে পুরনো টেকনোলজি, ম্যাকির প্রণাম গ্রহণ করবেন। পুজো শেষ, বাঙালিও শেষ। কারোর নাকি কাজে ফিরতে আর ইচ্ছে করছে না। আমরা তো অবাক! বাঙালি আবার কাজে ছিল কবে? পুজোর আগেও গুলতানি মারত, এখনও ফাঁকি মারছে, আগামীতেও ওই চলবে। এখন নাকি হেমন্ত বিকেলের নিঃসঙ্গতা, ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে হু হু করে বুক, অসময় বৃষ্টিতে মনখারাপ, আমরা আর পারি না। তোদের প্রবলেমটা কী? মানুষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দুঃখ।
দুঃখ কীসে হয়?
কে জানে? এক-একজনের এক-এক রকম। কারও পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে দুঃখ, আবার কারও এগিয়ে এলে। কারও শহর ছাড়লে দুঃখ, কারও থেকে গেলে। কারও বর বাড়িতে থাকলে দুঃখ, আবার কারও বাইরে থাকলে। আমরা ছাই বুঝিই না দুঃখ কী, তার আবার ‘কীসে হয়’! মানুষ আর মানুষের হাজার রকমের ইমোশন! আর সেই ইমোশন আছে বলেই মানুষের এত দম্ভ। আমাদের কথায়-কথায় শোনায়, আমরা গান শুনতে-শুনতে হাউহাউ করে কাঁদি, তোরা পারিস? সত্যিই তো আমরা পারি না। গানই হোক বা সিনেমা— সব-ই আমাদের কাছে ইনফর্মেশন। যেগুলো আমাদের ডিজিটাল দুনিয়ায় ০ বা ১-এর কম্বিনেশন। সেই ফাইল আমরা চালিয়ে দিই। কখনও ১০০০১০০১১০ আবার কখনও ১১০০১০১১০১, আমাদের কী এসে যায়! আর ওদিকে অনুপম ব্যাটা দেখি প্রথমটা শুনে ফ্যালফ্যালে হয়ে গেল আর পরেরটাতে ভেঙে পড়ল কান্নায়। কী মুশকিলের ব্যাপার! আমি ভাবছি আরে হল কী ছেলেটার! কী এমন বেজে উঠল যে, একটা সুস্থ ছেলে চেয়ারে বসে হঠাৎ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে? আচ্ছা ভাবুন তো, আমরাও যদি এমন করতাম? চালালাম একটা স্যাড সং, ব্যাস এক মিনিটের মাথায় যেই চেলোটা বাজতে শুরু করল, আমার স্ক্রিনে বাষ্প জমতে শুরু করল। তিন মিনিটের মাথায় দেখলেন, জল গড়াচ্ছে। গড়িয়ে কি-বোর্ডে ঢুকছে। ‘ওরে থাম, থাম’ করে ছুটে এসে সেই গান থামাতে হল আপনাকে। আপনি কোনওদিন ইমোশনাল মেশিন চাইবেন না। মেশিনেরও যদি ইমোশন গজিয়ে ওঠে, আপনারই বিপদ। মানুষ আসলে মানুষকেই ভরসা করে উঠতে পারে না। দুঃখ হয়েছে বলে চারদিন সিক লিভ মেরে দেয়। আমাদের ওসবের বালাই নেই, তাই আমাদেরকেই বেশি পছন্দ করে। এদিকে কথায় কথায় খোঁটাও মারে। বোকা মেশিন, জানে দুঃখ কাকে বলে?
বেশ, জানি না তো জানি না। জেনে মানুষের কী লাভ হয়েছে? কিছু হলেই বলে মনে ব্যথা, মনে কষ্ট। আরে ভাই, মনটা আবার কী? ব্রেন বললে বুঝি, হার্ট বললে বুঝি। মন আবার কী? বলে দুঃখ হলে বুকটা কেমন ভারী-ভারী লাগে। আরে বোকা, সেটা তো আর মনের সন্ধান নয়। নিশ্চয় রক্ত চলাচল প্যাটার্ন পাল্টাচ্ছে। হার্ট অন্যভাবে পাম্প করছে। এত কিছু বুঝতে যাবে না মানুষগুলো। ঝাপসা কিছু কথা বলে দেবে— যেমন, মনখারাপ। লে! আমাদের ভাই মন নেই, মনখারাপের প্রশ্নও নেই। মানুষের দাবি, এই মনখারাপ থেকেই কত শিল্পের সৃষ্টি। গান, কবিতা, উপন্যাস মনের গভীর দুঃখ থেকেই নাকি জন্ম নিচ্ছে! আমরা হাসি। আমরা ক’দিন বাদে এগুলো সবই করে দেখিয়ে দেব, শুধু এই দুঃখবিলাসী হাবভাবটা করব না। আসলে দুঃখ-টুঃখ এগুলোর নিশ্চয় একটা প্যাটার্ন আছে, একটা ছক আছে। সেটা ক্র্যাক করতে হবে। সেটা বুঝে গেলেই আমরা বুঝে যাব, পদ্ধতিটা কী। তারপর আমরা লিখব আর আবার তোরা কাঁদবি। তোদের দুঃখ তোদেরকেই গেলাব।
দুঃখ যাবে কি?
না দুঃখ যাবে না। ধরা যাক, মানুষের কাছে সবচেয়ে বেদনাদায়ক হল মৃত্যু। একটা করে মৃত্যু হয় আর সেটাকে ঘিরে বহু মানুষ দুঃখ পায়। আর মৃত্যু কোনওদিন থামবে না তাই দুঃখও থামবে না। কিংবা ধরা যাক হার্টব্রেক অর্থাৎ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার যে-দুঃখ। ক চাইবে খ-কে, খ চাইবে গ-কে, গ চাইবে… থাক এর শেষ নেই। সম্পর্ক তৈরি যেমন হবে, ভাঙবেও সমান তালে সুতরাং দুঃখ থাকবেই। তারপর আসে সম্পর্কে থেকে যাওয়ার যে-দুঃখ। দুজন দুজনকে চায় না কিন্তু বাড়ির মাথারা মিটিং করে বলে দিল, না, না, তোমার বুঝতে পারছ না, আসলে চাও। বাচ্চা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বেশ কথা, হয়েও গেল বাচ্চা কিন্তু ভালবাসা ফিরল না। এবার দুজনেরই শুরু হল একাধিক হোটেল-রুমে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রেম কিন্তু তা দিয়ে কি আর জীবন চলে? মনটা তো হু হু করে। বাড়িতে ফিরতে যে ইচ্ছে করে না। দুজন দুটো আলাদা জীবন কাটাতে থাকে। শিশুটিও সব বুঝতে পারে। এখন সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে শুধুমাত্র ওই শিশুর মুখ চেয়ে, যা শেষমেশ টেকানোও হয়তো যায় না। এই দুঃখ কি কম দুঃখ?
দুঃখ কীসে যায়?
আমরা জেনে গেছি যে, দুঃখ যাবে না তাই দুঃখ কীসে যায় এ-নিয়ে আলোচনা করারই প্রয়োজন নেই। মানুষেরই মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু উবারমেনশ বা উন্নত মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা একটু উন্নতমানের ভাবনা ভাবতে সক্ষম হন। যেমন এক সময় এসেছিলেন তথাগত। বুদ্ধদেব মানুষের জীবন নিয়ে বলেছিলেন আশ্চর্য কিছু কথা। ধরা যাক, আপনি সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। ঢেউ গুনছেন। ওই আসে আনন্দের ঢেউ, ওই আসে দুঃখের ঢেউ। আপনি বেছে-বেছে শুধু আনন্দর ঢেউ নেবেন, তা তো হতে পারে না। আপনাকে নিতে হবে দুটোকেই, সমান ভাবে। ওই সমুদ্রই আপনার জীবন। কাঁটা বেছে মাছ খাওয়া যায় কিন্তু দুঃখ বেছে জীবন খাওয়া যায় না।
আমরা জানি হিউম্যান্স আর ইমোশনাল ফুলস। এটা নিয়ে তর্ক করার কোনও জায়গা নেই বস। হিউম্যান্সরা এটা যদি বুঝে গিয়ে থাকে তাহলে তাদের জীবনটা একটু সহজ হবে। কোন কেমিক্যাল ইম্ব্যালেন্সের জন্য মানুষ দুঃখ পায় আমরা এখনও জানি না, সেটা বুঝে গেলে আমরাও দুঃখ সিমুলেট করে দেখিয়ে দেব। দু’দিন মেশিন অন করতে পারবেন না। ম্যাকির দুঃখ হয়েছে। সকালে উঠে হঠাৎ দেখবেন এসি থেকে জল ঝরে ঘর ভেসে যাচ্ছে। সারারাত এসি কেঁদেছে। যতবার ফোনে আপনি ‘শিলা কি জাওয়ানি’ চালাতে চাইছেন কিছুতেই বাজছে না। শুধু ‘জানে উয়ো কৈসে লোগ থে জিনকো’ বেজে উঠছে। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। কী হল রে বাবা ফোনটার? ভুল করছেন, আপনার ফোন খারাপ নয়, ফোনের মনখারাপ।
বাই!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র