ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হেঁশেলের হিস্‌সা: পর্ব ৯


    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (November 12, 2021)
     

    কারি-রাইস না চায়েগ্রম্?
     

    সত্যজিৎ রায়ের ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ গল্পটিতে সাহেব-প্রীতিতে সদাচ্ছন্ন রঞ্জনবাবুর কথা মনে আছে, উনিশশো সত্তরে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় যাতায়াত করতে-করতে যিনি তাঁর বাল্যের রেলভ্রমণের সময়ে খাওয়া কেলনারের কারি-রাইস আর কাস্টার্ড পুডিং-এর স্মৃতিতে বুঁদ হয়ে যান? সেই সত্তর দশকের গোড়াতেও, ফার্স্ট ক্লাসেও, ট্রেনের থালি খাওয়ার কথা ভাবলে তাঁর কান্না পেত বলে তিনি টিফিন ক্যারিয়ার ভরে সঙ্গে নিয়েছিলেন লুচি-তরকারি। ব্যারামগ্রস্ত বারীন ভৌমিক যখন ফার্স্ট ক্লাসের বদলে এসি-তে ট্রাভেল করছেন, তখন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা অনেক সাদাসিধে— ভেজিটেরিয়ান, নন-ভেজিটেরিয়ান, দিশি আর ওয়েস্টার্ন-স্টাইল, ব্রেকফাস্টে পাঁউরুটি-মাখন, ডিমের অমলেট। এই ত্র্যহস্পর্শ— এক হাতা ট্যালট্যালে টোম্যাটো স্যুপ, একটা বিশীর্ণ ব্রেডস্টিক, আর একটা মাখনের চিপলেটের ত্র্যহস্পর্শের মতোই— আমাদের ভ্রমণজীবনের এক ধ্রুপদী অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

    তিরিশের দশকেও অভিজাত ট্রেনে, বিশেষ করে ফার্স্ট ক্লাসে ট্রাভেল করলে খাওয়া-দাওয়ার জৌলুসই ছিল অন্য রকম। দিল্লি কালকা মেল, বোম্বাই মেল, পাঞ্জাব মেল, তুফান এক্সপ্রেস, আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের মতো দূরপাল্লার ট্রেনেই শুধু নয়, ঝাঁ-চকচকে রেস্টুরেন্ট কার ছিল আসাম মেল (শিয়ালদহ থেকে পূর্ব দিনাজপুরের পার্বতীপুর অব্দি), এমনকী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পেরিয়ে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী হয়ে সিরাজগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত নাতিদ্রুত গতিতে চলা সুর্মা মেল, বা গোয়ালন্দ ঘাট-অভিমুখী চট্টগ্রাম মেলেও। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কেটারিং সার্ভিস চালাতেন মদের ব্যবসায়ী আর রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমের মালিক জর্জ ফার্ডিন্যান্ড (জি.এফ.) কেলনার, ভারতে রেলভ্রমণ চালু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যিনি জার্মানি থেকে কলকাতায় এসে গাঁটছড়া বাঁধেন জনার্দন দাঁ নামে এক নির্ভেজাল বাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কেলনারের সুবাদে দার্জিলিং মেলের ইউরোপীয় যাত্রীদের প্রাতরাশে মিলত ফ্রুট জুস, বেকন অ্যান্ড এগ্স‌, সেই সঙ্গে টোস্ট আর কফি। ইতিহাসবিদ লিজি কলিংহ্যাম লিখেছেন ভারতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত ‘কারি’-র এক স্বাদু জীবনীগ্রন্থ— Curry: A Tale of Cooks and Conquerors— তার সঙ্গে জেনিফার ব্রেনানের ব্রিটিশ ভারতে সাহেবদের রান্নাবান্নার বইটি (Curries and Bugles: A Memoir and Cookbook of the British Raj) মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, ইউরোপীয়রা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে প্ল্যাটফর্মে ‘লাঞ্চ, লাঞ্চ’ হাঁকডাক শুনে কামরা থেকে নেমে উঠে বসতেন ডাইনিং কারে, সেখানে তাঁদের সার্ভ করা হত ‘কোল্ড মিট’-এর ছদ্মবেশে আগের রাতের রোস্টের লেফটওভার। তুলনায় ডিনার অবশ্য অনেক কেতাদুরস্ত— সেখানে স্যুপ, ফিশ ফ্রাই, মাটন কিমা দিয়ে তৈরি সরু একটি হাড় দিয়ে ফুঁড়ে-দেওয়া কাটলেট, চিকেন বা মাটন রোস্ট, সঙ্গে কাস্টার্ড, পুডিং বা সুফলে। এই ঘরানা থেকেই জন্ম নেবে ব্রিটিশ ভারতে ট্রেনের ডাইনিং কার আর রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমের ক্লাসিক রান্না, বাঙালি রসুইকরদের অমর অবদান, রেলওয়ে মাটন (বা ল্যাম্ব) কারি, যেখানে মাংসের ঝোলের গরগরে ঝাঁঝকে স্তিমিত করে সাহেবদের রসনা-উপযোগী করে তোলার জন্য মেশানো হত দই, বা— বিশেষত ট্রেন দক্ষিণাভিমুখী হলে— নারকোলবাটা। ব্রিটিশ আমলের ‘ডাকবাংলা’ স্টাইলের রান্নাতেও এই শৈলীরই নির্ভুল ছাপ।

    কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা স্বতন্ত্র, উর্দি-পরা খানসামারা রেল কোম্পানির ঝকঝকে সাদা পাত্রে তাঁদের জন্য পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে আনতেন না। তাই সেখানে, যদি অর্ডার না দিয়ে পরে থালি না মিলত, তবে খানিক ‘ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে’ গোছেরই ব্যবস্থা ছিল, যে-রীতি এখনও চলছে। বাড়ি থেকে নিয়ে এলে লুচি-আলুর দম বা আলুকপির ছেঁচকি, পরোটা-মাংস, আলুর পরোটা ও আচার আর হকারদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে ঝালমুড়ি, চানা মসলা, মুমফলি, শসা, বাসি, গ্যাস-বেরিয়ে-যাওয়া ‘সিইদ্ধ ডিম’, বর্ধমান স্টেশন হলে সীতাভোগ-মিহিদানা, লখনউতে গুলাবি রেউড়ি, মথুরাতে প্যাঁড়া। আর হরেক রকম ফল-টল তো পাওয়াই যায়। ১৯০৯ সালে সাহেবগঞ্জ লুপের ট্রেনে ঠেসে কাঁঠাল খাওয়ার পর অখিল সেন নামের এক ভদ্রলোকের পেটটি জানান দেয়, আমোদপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের কোণে জরুরি কর্মটি সেরে নিতে না নিতেই গার্ড বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে নেওয়ায় তাঁকে লোটা আর ধুতি সামলে দৌড়তে গিয়ে এক বেমক্কা হোঁচট খেতে হয়। ‘… I am fall over and expose all my shocking to man and female women on plateform … This too much bad …’— শোনা যায় সর্বসমক্ষে ‘প্রকটিত’ অখিলবাবুর সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে ডিভিশন অফিসারের কাছে লেখা এই ক্রুদ্ধ চিঠিটিই (এখন দিল্লির রেল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত) রেলযাত্রী আমজনতার জন্য শৌচালয়ের জনক।

    ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কেটারিং সার্ভিস চালাতেন মদের ব্যবসায়ী আর রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমের মালিক জর্জ ফার্ডিন্যান্ড (জি.এফ.) কেলনার, ভারতে রেলভ্রমণ চালু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যিনি জার্মানি থেকে কলকাতায় এসে গাঁটছড়া বাঁধেন জনার্দন দাঁ নামে এক নির্ভেজাল বাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কেলনারের সুবাদে দার্জিলিং মেলের ইউরোপীয় যাত্রীদের প্রাতরাশে মিলত ফ্রুট জুস, বেকন অ্যান্ড এগ্স‌, সেই সঙ্গে টোস্ট আর কফি। 

    ১৯২৭ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর কাবুল ভ্রমণের যে অনবদ্য বর্ণনা আপনারা ‘দেশে বিদেশে’তে পড়েছেন, সেখানে দেখি ‘ইউরোপীয়ান থার্ড’ গোত্রের এক কামরায় তিনি এক ‘নেটিব ফিরিঙ্গি সায়েবের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছেন, আর দুজনেই চুবড়ি থেকে বের করে খাচ্ছেন একই জিনিস— শিককাবাব, ঢাকাই পরোটা, মুরগি-মুসল্লম, আলু গোস্ত (আলীসায়েবের ক্ষেত্রে জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে কেনা, নেটিব সায়েবের ক্ষেত্রে তাঁর ফিঁয়াসের বানানো)। এই গল্প, আর তার পরে অপর্যাপ্ত খানাপিনা সহযোগে জাঠ-শিখ-পাঠানের মেহমানদারি উপভোগ করতে-করতে আলীসায়েবের অবিস্মরণীয় ভ্রমণের বিবরণ পড়ে যদি মনে হয় যে, ট্রেনে এই রকম বেরাদরি ছিল খুব স্বাভাবিক, তা হলে ভুল হবে। ব্রিটিশ ভারতে চলমান ট্রেন ও রেল স্টেশন, সর্বত্রই খাবার ও পানীয়ের জোগাড় করতে হত জাতপাত ও ধর্মের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, যদিও সীমিত পরিসরে বর্ণপ্রথা ও স্পর্শদোষের বিধিনিষেধ সর্বদা মানা সম্ভব হত না, স্বাভাবিক ভাবেই। তবুও স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে ইউরোপীয়দের আলাদা আয়োজন ছাড়াও, পৃথগন্নের ব্যবস্থা ছিল শুধু হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যেই নয়, নিরামিষাশী আর আমিষভোজী হিন্দুদের মধ্যেও। স্টেশনে ট্রেন থামলেই ‘হিন্দু চা, মুসলিম চা’— হাঁক পেড়ে ছুটতেন বিক্রেতারা, যদিও অনেক সময়েই সেই সব হাঁকডাকের আড়ালে ভিন্নধর্মী যাত্রীদের গলা ভিজত একই অমৃতসুধায়।

    উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ায়, নীলকর সাহেবদের মতোই টি-প্ল্যান্টারদের শোষণে আসামের চা-শ্রমিকরা যখন জর্জরিত, তখন প্রতিবাদে সোচ্চার হতে শুরু করেন জাতীয়তাবাদী আর শ্রমিক নেতারা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তো চা-কে এক স্বাস্থ্যনাশা এক ‘বিপজ্জনক মাদক’ বলে আখ্যাই দিলেন। এরই বিপরীতে এক মোক্ষম জনসংযোগের ফন্দি এঁটে প্ল্যান্টার সাহেবরা ছাড়লেন নানান রেল স্টেশনে জম্পেশ সব বিজ্ঞাপন— ‘চা পানের উপকারিতা’, যেখানে ঘোষিত হল ‘জীবনী শক্তির উদ্দীপক’ এবং ‘মাদকতা শক্তি’-রহিত এই ‘সুস্বাদু পানীয়’-এর ‘ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, প্লেগ, অবসাদ’ ইত্যাকার রোগ দূর করার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা, বা পৈতেধারী হিন্দু ব্রাহ্মণ, ফেজ-পরিহিত মুসলিম, আর পাগড়িশোভিত শিখকে একই ফ্রেমে ধূমায়িত পেয়ালা হাতে বসিয়ে চা-পানের মাধ্যমে ‘সম্পদ, স্বাস্থ্য ও সুখ’ অর্জন করার প্রলোভন দেখানো। বালিগঞ্জ, দমদম, বা নৈহাটির স্টেশনের চায়ের দোকানে টিনের পাতে এই সব বিজ্ঞাপন আজও দৃশ্যমান। জাতিগঠন, সাম্প্রদায়িকতা, ঔপনিবেশিক প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির এইসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই রেল স্টেশনের এই ‘চায়েগ্রম্’-এর এক গণতান্ত্রিক পানীয় হয়ে ওঠা, রাত আড়াইটেয় গয়া বা চক্রধরপুর বা কটক স্টেশনে-দাঁড়ানো ট্রেনের জানালার হাতায় সন্তর্পণে নামিয়ে-দেওয়া যে পানীয়ের ভাঁড়ের মধ্যে মিশে থাকে আমাদের নশ্বর, অর্থহীন জীবনের পরমকাঙ্ক্ষিত সব মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট।

    স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ভারতে এইসব পৃথগন্ন-ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটলেও আমজনতার খাবার জোগাতে হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল কম নয়। স্বাধীনতার মুহূর্তে এবং তার অব্যবহিত পরে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষবিধ্বস্ত দেশে খাবারের জোগান ছিল অপ্রতুল, চাল ছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল, সেই সময়ে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে এম মুনশির স্ত্রী লীলাবতী ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অল ইন্ডিয়া উইমেনস ফুড কাউন্সিল, আর পরের বছর রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সেই সংস্থার হাতেই তুলে দেন রেলযাত্রায় ‘অন্নপূর্ণা ডাইনিং কার’-এর মাধ্যমে সীমিত সামর্থ্যের রেলযাত্রীদের জন্য সস্তায় খাবার (প্রধানত পুরি-সবজি) জোগানোর ভার। সেই খাবারের মান নিয়ে অবশ্য সংসদে সমালোচনা কম হয়নি, আর তার পর থেকে এই মান নিয়ে বিতর্ক ভারতীয় রেলের পিছু ছাড়েনি কখনও। কখনও সিএজি অডিট, কখনও সাধারণ যাত্রী, কখনও সামাজিক মাধ্যম। রেলমন্ত্রীরা মাঝেমধ্যে লিট্টি-চোখা, মাটির ভাঁড়ে চা বা মাঠঠা দই, পুরি-সবজি খাইয়ে যতই লোকের মনোরঞ্জন করতে চান, জনগণেশ আর অডিটকে কখনও খুশি করা যায় না। এই বছর রেলকর্তাদের উদ্যোগে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী বিপ্লব, ভারতীয় রেলে প্যান্ট্রি কার উঠে গিয়ে এখন শুধু আই.আর.সি.টি.সি.-র ‘ই-কেটারিং’, যেখানে ট্রেনে উঠে একবার ফোন ডায়াল করলেই আপনার সিটে ক্যাসেরোলে করে খানা পৌঁছে যাবে, অথবা অ্যাপ-ভিত্তিক ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের মতো আপনি সিটে আনিয়ে নিতে পারেন লম্বা তালিকা থেকে আপনার পছন্দসই রেস্টুরেন্টের খাবার, সে রাজস্থানি থালিই হোক বা চিকেন বিরিয়ানি। আর এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও দিনে লাখখানেক টাকা খরচ করে প্যালেস-অন-হুইলস-এ চড়তে পারলে আপনার ভাগ্যে জুটবে আমন্ড বা চিকেন লেমন স্যুপ, চিকেন মেয়োনিজ বা অরেঞ্জ বিটরুট স্যালাড, সেই সঙ্গে ফ্রায়েড ফিশ উইথ ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ অ্যান্ড টার্টার সস, স্পিনেচ পাস্তা, বেকড ভেজিটেবল প্রিন্সেস, ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক, আর দিশি খানা চাইলে কান্দাহারি পুলাও, ডাল মাখনি, বাটার চিকেন বা পনির মহারানি, আলু গোবি আদ্রকি, সঙ্গে সেই চিরচেনা গুলাবজামুন।

    ১৯০৯ সালে সাহেবগঞ্জ লুপের ট্রেনে ঠেসে কাঁঠাল খাওয়ার পর অখিল সেন নামের এক ভদ্রলোকের পেটটি জানান দেয়, আমোদপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের কোণে জরুরি কর্মটি সেরে নিতে না নিতেই গার্ড বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে নেওয়ায় তাঁকে লোটা আর ধুতি সামলে দৌড়তে গিয়ে এক বেমক্কা হোঁচট খেতে হয়। ‘… I am fall over and expose all my shocking to man and female women on plateform … This too much bad …’— শোনা যায় সর্বসমক্ষে ‘প্রকটিত’ অখিলবাবুর সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে ডিভিশন অফিসারের কাছে লেখা এই ক্রুদ্ধ চিঠিটিই (এখন দিল্লির রেল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত) রেলযাত্রী আমজনতার জন্য শৌচালয়ের জনক। 

    আমি যখনই বাল্যে ও কৈশোরে বর্ধমান জেলার মফস্‌সল শহর থেকে ট্রেনে কলকাতা এসেছি, এক দুঃখী মুখের হকার ভদ্রলোককে দেখেছি ক্ষীরমোহন বলে এক রকম মিষ্টি ফিরি করতে— আমার মনে আছে প্রাইমারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করতে-করতেই সেই মিষ্টির দাম বেড়ে দাঁড়াল টাকায় ষোলোটা থেকে পাঁচ সিকে প্রতি পিস, মূল্যবৃদ্ধি ভদ্রলোককে বিশীর্ণ করে দিল, পাক ধরাল তাঁর চুলে। কেলনারের কারি-রাইস খাওয়ার সৌভাগ্য আমার না হলেও হাওড়া স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে একাধিক বার খেয়েছি ধপধপে সাদা রেল কোম্পানির ক্রেস্ট দেওয়া প্লেটে বাটি-উপুড়-করা স্তূপাকৃতি দেরাদুন রাইস আর হালকা গরম মশলার খুশবুদার মাটন কারি। একবার গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার সময় সন্ধেরাতে পাটনা নাকি টাটানগর, এখন ভুলে গেছি, কোনও একটা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের রিফ্রেশমেন্ট রুমের সামনে আমাদের কামরা দাঁড়াতেই কুড়ি মিনিটের স্টপেজের সুযোগ নিয়ে ঝাঁ করে নেমে খেয়ে নিলাম ভাত-ডাল-ডিমের ঝোল। আরেকবার পুরী থেকে ফেরার টিকিট না থাকায় কোনওক্রমে ভুবনেশ্বর পৌঁছে ধৌলি এক্সপ্রেস ধরলাম, কিন্তু সকাল থেকে পেটে কোনও দানাপানি পড়েনি, গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে দিয়ে এক সম্পূর্ণ হকারশূন্য ট্রেনে পেটে প্রজ্বলিত ক্ষুধা নিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম, আর আমাদের পাশের সিটের পরিবারটি এক পেল্লায় সাইজের টিফিন ক্যারিয়ার থেকে বের করলেন এক বিঘত সাইজের পাবদা মাছের ঝাল। হয়তো আমাদের লোলুপ দৃষ্টি দেখেই এই সহৃদয় সহযাত্রীরা আমাদেরও অফার করেছিলেন, এক ক্ষুধাক্লিষ্ট, মলিন হাসির সঙ্গে সেই অফার প্রত্যাখ্যান করার বুকচাপা কান্না এখনও মনে আছে।

    তবে রেল শুধু নেয়ই না, দেয়ও অনেক অপ্রত্যাশিত দান। অনেক দিন আগে স্কলারশিপের ইন্টারভিউয়ের জন্য অনেক কষ্টে টিকিট জোগাড় করে দিল্লির ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম, কিন্তু তখন উত্তর ভারতে মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে, ভোররাতে কানপুরের আগেই কয়েকটা ছোকরামতো ছেলে এসে ট্রেন থামিয়ে তার ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাইপটা কেটে দিয়ে চলে গেল। চোদ্দো ঘণ্টা পড়ে রইলাম হেমন্তের শিশিরভেজা উত্তরপ্রদেশের গমের খেতের ধারে। ডাইনিং-এর হাসিখুশি ছোকরাটি বলল, ‘স্যার, দেরি হবে, লাঞ্চের তো এমনিতে ব্যবস্থা নেই, ডিমভাত লাগিয়ে দিই?’ আমরা সমস্বরে বলে উঠি, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ কিন্তু বিকেল চারটে নাগাদও যখন ট্রেন নট নড়নচড়ন, সে আবার হাসিমুখে এসে বলল, ‘স্যার, ডিনারেরও তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে, এখান থেকে উ-ই-ই দিকে একটা হাট বসে, বলেন তো কিছু আনাজপাতি নিয়ে আসি?’ তারপরের দৃশ্যটা আমার এখনও মনে আছে। পড়ন্ত সূর্যের নীচে ঝিরঝিরে হাওয়ায় ঈষৎ বেঁকে-দাঁড়ানো বাতানুকূল (এখন পূর্বা) এক্সপ্রেসের পাশে আদিগন্ত গমের খেত চিরে ধরে বাজারের থলি হাতে ছেলেটি হাটের পানে চলতে-চলতে বিন্দুবৎ বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’-তে সবুজে আকীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে আগন্তুকের ধীরে-ধীরে চলে যাওয়ার মতো। ভোর চারটেয় নয়াদিল্লি স্টেশনে পৌঁছে দৌড়তে-দৌড়তে ইন্টারভিউয়ে যাওয়া হল। ক্লান্ত ও বিস্রস্ত ছিলাম বটে, কিন্তু অভুক্ত নয়। উত্তরাপথের সেই রেলপথ-সীমান্তবর্তী নগণ্য হাটের বাঁধাকপির তরকারির স্বাদ এখনও ভুলিনি।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook