ঠা ঠা করে চেঁচিয়ে কাঁদছিল রেবতীর ছেলে। মোজেস সরেন। এমনিতে ভারি হাসিখুশি উচ্ছ্বল স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে জ্বলজ্বলে কালো ছেলেটি। পরে মাদার সুপিরিয়রকে কৈফিয়ত দিচ্ছিল রেবতী— ‘সবসময় পোশ্ন, এখনি গির্জায় খাবার দিয়া কহিলু যিশুর দেহ আর গিলিবার দিয়া কহিলু যিশুর রক্ত, পুরোহিত কহিল— যিশুর দেহার রক্ত নিয়ে নে। সেইলা হামরা খামো কেনে? হামরা কি যিশুখোর? হামরা কি ডাকিন?’
মাদারের মুখ উদ্বিগ্ন অথচ স্নিগ্ধ, মৃদু একটি নাতিশীতোষ্ণ হাসি কপালে-গালে স্থির, জোড়া চোখের মণি ঘিরে বয়সের ধূম্রজাল তবু খুব দীপ্তি। সাক্ষাৎ দেবী। বলে রেবতী সবসময়। মাদার হাসিমুখে বললেন, ‘এই প্রশ্ন আমিও তো করেছি শৈশবে। যিশুর দেহই যে জীবনময় খাদ্য, তা বুঝবার বয়স তো ওর হয়নি। শিশুরা প্রভু যিশুর বড় প্রিয়, মোজেসকে মেরো না!’
লম্বা করে ঘাড় কাত করে রেবতী, মুখটায় বসন্তের অজস্র দাগ। চলে যায় নিজের কুঁড়ের দিকে। ওই সামান্য কান্নাকাটি-চেঁচামেচি ছাড়া আর তেমন কোনো আওয়াজ হবে না আশ্রমে। কান পাতলে রোদের উত্তাপে পাকতে থাকা ফলমূল আর আনাজে মৌমাছিদের গুনগুন শোনা যাবে এত নিরালা। ‘আরাধনা’ আশ্রম। মাদার বলেন, এর নাম হওয়া উচিত ছিল— ‘চির আরাধনা’। এটি অবিরাম আরাধনা সংঘ, সমস্ত দিবারাত্রি এখানে সন্ন্যাসিনীরা প্রার্থনা করেন।
রেবতী কি আর অত বোঝে? জন্ম-জন্মান্তর ধরে তাদের একটিই আরাধনা ছিল, নরকের কুণ্ডের মতো চিরকাল পুড়তে থাকা পেটের আগুন নেভানো। প্রশ্ন সে তেমন করে না, কখনোই করেনি। এমনকী অ্যাগ্নেস চলে যাবার পরেও তো তার মনে প্রশ্নের উদয় হয়নি যে তার বউ কোথায় গেল, কার হাত ধরে চলে গেল, চলেই যে যাবে তা যেন কেমন করে জানত সে। যেন জানতই আরেকরকম নরককুণ্ডের আগুন নিভুনিভু করছিল অ্যাগ্নেসের বুকে, ভেংচি কেটে সে রেবতীকে বলত— ‘শিলপাটার মতন কড়া কড়া মুখগেনা তোর…তাকাইবারে যাচ্ছে নাই!’ মুখের দিকে তাকানোর দরকার হয়না যেসব মুহূর্তে, সেইসব সময়ও তো কম নয় এজীবনে। অতএব যতদিন ছিল, সুখেই ছিল তারা। অন্তত রেবতীর খাতায় সেই সময়টুকুর শিরোনাম ‘সুখ’।
কেন যে তারা ছেলেটার নাম রেখেছে মোজেস, ঈশ্বরের সাথে তর্ক করে অভ্যস্ত মোজেসের নামটা দেওয়া ঠিক হয়নি। রেবতীর ছেলের নাম হওয়া উচিত ছিল সলোমন, এই বিরলে ঘাসপাতা গাছ ফুলের সাথে ফুলগাছে আসা পাখির সাথে ভাববিনিময় করবে। মোজেসকে রেবতীর নাতি ভেবে ভুল করে লোকে, অ্যাগ্নেসকেও যেমন রেবতীর মেয়ে ভেবে ভুল করত তারা। আহা, লোকের কথায় কান দিলে কি চলে! ‘কর্ম্মসূত্রে বদ্ধ যেন তসরের পোক’… রেবতী খুরপি চালিয়ে ফুলের কেয়ারির মাটি আলগা করে আগাছা টেনে টেনে তোলে, কোঁকড়ানো ফার্ন লাগায়। এমনিতে বাগানের কাজ করতে সিস্টারদের জুড়ি নেই, সিস্টার মারিয়া, সিস্টার সিসিলিয়া, সিস্টার লুসিয়া। কাজও যে তাদের আরাধনা। গোবরসারের সাথে খৈল মেশায়, শক্ত মাটির ঢেলা পিটিয়ে ভাঙে, পটলের পুরুষফুলের পরাগ জলে মিশিয়ে মেয়েফুলে ঢালে। একটা পুরুষগাছের সাথে হেসেখেলে পল্লবিত হয় দশটা স্ত্রী পটলগাছ। নরম রোদে সরস সবুজ পটলের নধর গায়ে মিহি আভার মতো ফুটে ওঠে সাদা ডোরা, তাতে ঘুরে বেড়ায় কালো পিঁপড়া। সবজি বাগানের পাশে আগে একটা চাপকল ছিল, কেমন ককানোর শব্দ ছাড়তে ছাড়তে কল্লোল তুলে জল আসত তাতে। তারও আগে ছিল একটা পাতকুয়ো, ভারি মিষ্টি ঠান্ডা জল। একটা অপঘাতে মৃত্যুর পরে কুয়োটা বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু মোজেসের কান্নার শব্দই ভাসে বাতাসে, সেটা সত্যি নয়। মা-হারা ছেলেটাকে এত দুষলে চলবে কেন? আরো শব্দ আছে তো, রে-রে করে লাঠি ঠুকে তেড়ে যায় রেবতী, চোররা বাগানে ঢুকলে। সব চুরি করে তারা, পয়লা ফাল্গুনে কিংবা অমর একুশের আগের রাতে উপড়ে নিয়ে যায় তাজমহল গোলাপ আর ডাচ-রোজ, ডিনারপ্লেটের মতো বড় বড় ডালিয়া ফুল, ফল-ফসল-সবজি তো খাঁচি ভরে চুরি করেই, এমনকী সিস্টারদের শুকোতে দেয়া কাপড়চোপড়ও নিয়ে যায়। রেবতীর বাপ সুনীল সরেন যখন ছিল এখানে, তখন এই অঞ্চলে এত মানুষের বাস ছিল না, মানুষের রকমও আলাদা ছিল, গির্জা আর আশ্রমের চাদ্দিক ঘেরাও করা ছিল কাঁটামেহেদির বেড়া দিয়ে। একমানুষ সমান বেড়া। তাতেই হত, পড়শিদের ছাগল চরতে আসত না এই প্রাঙ্গণে। পরে বেড়া মুড়িয়ে দেওয়াল তোলা হল। দেখা গেল ছয় ফুটের দেয়ালেও কুলানো যাচ্ছে না, আর্চবিশপ ঘুরে যাবার পরে খাম্বা গেঁথে দেওয়াল আরো তিনফুট তোলা হল, সিমেন্টের ক্বাথে গেঁথে দেওয়া হল ভাঙা বোতলের কাচ। মোজেস গাল ফুলিয়ে একবেলা কীসব ভাবতে ভাবতে এরপর প্রশ্ন করল, ‘ঈশ্বরের বাগান থাকি অল্প চুরি করিলে সেইলা চুরি হবে কেনে? সেই বাগানত্ তো সবারে অধিকার!’ আরেকদফা পিটুনি দেয়া ছাড়া আর রেবতী কী করবে! ছোঁড়া এত কথা জানে! মাদার সুপিরিয়র কিন্তু হাসেন। জবাব করেন না। বাপ তো তাই করছে, মা যা করত, স্তনলগ্ন করে গল্প শোনাত, সে গল্পে আছে—
আ’ল ডিঙাইয়া কে খায় ঘাস
বাছা, মায়ের কথায় প্রত্যয় চা’স…
কত কথারই তো জবাব নেই, জবাব চাই না বলে মন বেঁধে ফেলতে হয়। মাদার জানেন সেটা, জানে সিনিয়র-জুনিয়র মনাস্টারি সিস্টাররা, জানে নভিসরাও। নইলে প্রায়োরি স্কুলের বাচ্চারাও তো জানে সেই গল্প, গোলাপায়রারা জলপ্রপাতের গায়ে গায়ে বাসা করে তাতে ধান জমিয়ে রাখত, বর্ষার আকালে খুঁটে খাবে, তা পাখির জমা করা সেই ধান মানুষ তুলে আনত বলে সে মানুষের গায়ে ঈশ্বরের অভিশাপ লাগল, ঝুলে ঝুলে ধান তুলতে গিয়ে মরে গেল দড়ি ছিঁড়ে। ঈশ্বরের ভূমিতে যত ফুল-ফসল ফলবে, তাতে না সবার অধিকার! যে স্বার্থপর দৈত্য সেটা মানে না, তার বাগানে বসন্ত আসে না।
আশ্রমের এই উঁচু উঁচু দেয়ালের বাইরে সব আছে। আশ্রমের দেয়ালেই সাঁটা আছে পুতুলতন্ত্র দিয়ে বশীকরণের পোস্টার। মফঃস্বলের এইসব ভেঙে পড়া টালির চালাঘর আছে। মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রমত্ত পৌষকালী মেলা। বাসন মাজবার বারোয়ারি কলতলা। ‘জনপ্রিয়’ লন্ড্রিতে বাজতে থাকা রেডিওটা আছে, মোবাইল ফোনকে টেক্কা দিয়ে কেমন করে যেন এইসব রেডিও এখনো আছে। ফার্মেসিতে আছে দন্ত শেফা। ধানশুকানিয়া চাতালগুলিতে টাপর মাথায় করে ঢেকে আছে ধান, হাইব্রিড যাবে হাস্কিং মিলে, পাইজাম যাবে অটো মিলে। গুমগুম শব্দ করে চিনিকলে আখবোঝাই করে নিয়ে যায় ট্রাক। গ্লাস ফ্যাক্টরি ফেরতা লোকে যায় পথ দিয়ে, রুপালি ছাইয়ে ভুরু শাদা তাদের, হাতগুলি কালো কালো। চৌরাস্তা পেরুলেই জলকচুঝোপে আচ্ছন্ন পানাপুকুর, আর তার ধার ঘেঁষে রাজমিস্ত্রির কারুবাসনার মূর্তপ্রকাশ সব বাড়িঘর। মসজিদের ওয়াজিম চোখের জোলে ভেসে ডাকছেন— ‘আসমানের বালা আসমানে তুলিয়া লও, জমিনের বালা তুমি জমিনে দাবায়া দেও’… শৈশবে শীতের রাতে কান পাতলে রেবতী শুনতে পেত যাত্রার কুন্তী কেঁদে কেঁদে কাকে বলছে— ‘আমার সহদেবরে দেখিও গো মা, মোখে তুলে খাইয়ে দিও!’ বোধহয় দ্রৌপদীকে। এইসবই বাইরের। আশ্রমের দেয়ালের ভিতরে ঢুকলে এইসবই নেপথ্যের কোলাহল। ভিতরে ওই পানাপুকুরগুলির চেয়েও স্তব্ধ হয়ে আছে সময়। বছরের পর বছর একইরকম ঝকঝকে প্রাঙ্গণ, টাইমফুলের পংক্তিঘেরা চত্বর, দিশি কাশীগাঁদা আর শেয়ালমুতো পুটুশ ফুলের পাশেই কতপদের মৌসুমী ডালিয়া, কসমস, গোলাপ। গির্জায় ঢুকবার পথে কুঞ্জ, তাতে গুল্মগোত্রের গাছ কিছু, গন্ধরাজ- শ্বেতকরবী- হিমচাঁপা-কুন্দ আর ঝুমকোজবা। আশ্রমের দিকটা আড়াল করে ফলের বাগান— মধুকুলকুলি আর খিরসাপাতি আমগাছ, কান্তনগরের বাগান থেকে আনা মাদ্রাজি লিচুগাছ, গোলাপজামগাছ, লটকান, গুটিকয় কাঁঠালগাছ অন্ধকার করে রেখেছে কিছুটা জায়গা। অন্ধকার ছাড়িয়ে উঠলেই সবজিক্ষেত। সমান্তরাল সরলরেখায় বোনা শীতের সবজি। মাচায় শিম-লাউ-কুমড়ো। আগের কালে রেবতী বাপের সাথে গিয়ে রাজবাড়ির ছোটতরফের ঘোড়াশাল থেকে জীর্ণ ঘোড়াগুলোর গোবর নিয়ে আসত ধামা ভরে, ঘোড়ার গোবর উৎকৃষ্ট সার। এখন তো আর সেই ঘোড়াশাল নেই, যে জমিদাররা রাজা ছিল তারা তো কবে থেকেই নেই, রাজবাড়িতে ডিসি সাহেব থাকেন, রেবতী গোবর কুড়াতে যায় অন্যত্র। রেবতীর হাতের খুব গুণ কিন্তু, আলুটাও ওরা বাইরে থেকে কেনে না। পেঁপেও হয় অফুরন্ত।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র