ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল: পর্ব ৯


    শ্রীজাত (November 27, 2021)
     

    সিঁড়িভাঙা অঙ্ক

    কলেজের সিঁড়িগুলোর কথা মনে পড়ে খুব। সেসব বিনীত সিঁড়ির শরীরে এসে পড়া দুপুরের উদ্ধত রোদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পাশের রাস্তা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বেওয়ারিশ ধুলোর চাদরের কথাও। আর মনে পড়ে এই সমস্ত কিছুকে জয় করে সেই সিঁড়ির সরণিতে হৈ হৈ যৌবন পার করতে থাকা কিছু ছেলেমেয়ের কথা। তাদের মধ্যে কখনও-সখনও, ঝোলায় কবিতার খাতা লুকোনো, উসকোখুসকো চুলের আর রোগা চেহারার একটা মুখচোরা ছেলেকেও যে দেখতে পাই না, তা নয়। যে আমার আয়নার দোসর।

    মানুষের এই এক স্বভাব। বহমান সময়ের যে-বিন্দুতে সে দাঁড়িয়ে, তাকে সে তেমন ভাল ভাবে দেখে উঠতে, বুঝে উঠতে পারে না। যেমনি সে পায়ে-পায়ে চলে আসে অনেকখানি দূরে, আর কীসের খেয়ালে যেন ফিরে তাকায় বারবার, তখন সে চিনে নিতে পারে ফেলে আসা সময়ের রং, তার গন্ধ, তার স্পর্শ। তার আগে সে-সুযোগ হয় না তেমন। এই যেমন, প্রাচীন সেই সিঁড়ির ঝাঁকের ক্ষয়িষ্ণু হলদেটে রঙের মধ্যে যে-চোরা বিষণ্ণতা, তা আমি এখন চিনতে পারি। ওই রাস্তায় বিছিয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার পাতা-পাতা ওড়না, তার বিদায়ী রং এখন এসে আমার মর্মে লাগে। ফেরিওলাদের ডাক যেমন, মিলিয়ে যাবার অনেকক্ষণ পরেও জেগে থাকে, সে কিছু বিক্রি হোক আর না হোক। কত কিছুই তো বিক্রি হয়ে গেল জীবনের, নিজেরাও আমরা কতবার দাঁড়ালাম চড়া আলোর বাজারে, কেবল অনেক পিছনের সেইসব দিনকাল, সেইসব ধূসর রাজ্যপাটের ঝলমলে ইতিহাস থেকে গেল আমাদের সম্পত্তি হয়ে। যাতে আমরা বেচাকেনার শেষে সেই সিঁড়ির ধাপে এসেই জিরিয়ে নিতে পারি একটু।

    আমার ছিল ভূগোল। ইস্কুলবেলা থেকেই ভূগোল পড়তে আমার ভারি ভাল লাগত। কীভাবে নদী বাঁক নেয়, কীভাবে পাললিক শিলায় লেখা হয় সময়ের ইতিহাস, কীভাবে প্রেইরি অঞ্চলের মানুষরা দুলে ওঠেন চাষের বাতাসে, আর কীভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন বদলে দেয় পৃথিবীর মুখ, এসব জেনে নেওয়ার মধ্যে যে-আশ্চর্য আনন্দ, তার হাত আমি ছাড়িনি কখনও। তাই স্কুল পেরিয়ে যখন যেমন-খুশি-সাজো ছাড়পত্র পেলাম, ইউনিফর্ম বিদায় জানিয়ে জায়গা নিল দেরাজে, ঠিক করলাম, ভূগোলই পড়ব। তখন তো জানি না, নিজের জাহাজের মতো বুকের মধ্যে সমস্তটাকে সেঁধিয়ে নেওয়া কলেজেও কত জলবায়ু পরিবর্তন হয়, এই বিভাগ থেকে সেই বিভাগে চলে কত চিঠির রেশম-বাণিজ্য, আর কত-কত অচেনা চোখের তলায় জমে থাকা পলি আমাদের টানে, নদীর সন্ধানে।

    অলীক এই বয়ে যাওয়া দুষ্প্রাপ্য সময়ের মধ্যে, ওই সিঁড়িই ছিল আমাদের বেস ক্যাম্প, আমাদের কন্ট্রোল রুম। কার ঝগড়ায় অভিমানের পিন আটকে গেছে, কার প্রস্তাবে একটা সেমিকোলন কম, কার ওড়নায় প্রজাপতি বসতে-বসতেও বসেনি, এসব গূঢ় সমস্যার সমাধানে রোজই আমাদের হাজিরা দিতে হত সেই সিঁড়ির ধাপে। ক’জন মাত্র গা-ঠেসাঠেসি করে বসে, বাকিরা তাদের ঘিরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়ানো

    তা সে যা-ই হোক, ভূগোল নিয়ে ভর্তি হবার এক সপ্তাহের মধ্যে, বন্ধুবৃত্ত তার ডানা ছড়াল সিন্ধবাদের রকপাখির মতোই। ইংরেজি, ইতিহাস, বাংলা, রাশিতত্ত্ব, সব বিভাগের একমনা ছেলেমেয়েদের সে এনে ফেলল তার ডানার ছায়ায়। আর আমরা, কয়েকজন ছন্নছাড়া, নিশ্চিন্ত, দিগন্তবিহীন ছেলেমেয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের দ্বিপ্রাহরিক সংসার খুললাম, সাজিয়ে বসলাম যার-যার দুঃসাহসের পসরা। দেখতে-দেখতে, ইংরেজি বিভাগের নতুন শেখা পদ্য-কোটেশন লুকিয়ে পৌঁছে গেল ইতিহাসের কাঁপা-কাঁপা হাতে, রাশিতত্ত্বের পকেট থেকে বেরোল বাংলার নামে সিনেমার টিকিট, বিষয় আলাদা হলেও বয়স যে এক, সময় তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করল না মোটেই।

    অলীক এই বয়ে যাওয়া দুষ্প্রাপ্য সময়ের মধ্যে, ওই সিঁড়িই ছিল আমাদের বেস ক্যাম্প, আমাদের কন্ট্রোল রুম। কার ঝগড়ায় অভিমানের পিন আটকে গেছে, কার প্রস্তাবে একটা সেমিকোলন কম, কার ওড়নায় প্রজাপতি বসতে-বসতেও বসেনি, এসব গূঢ় সমস্যার সমাধানে রোজই আমাদের হাজিরা দিতে হত সেই সিঁড়ির ধাপে। ক’জন মাত্র গা-ঠেসাঠেসি করে বসে, বাকিরা তাদের ঘিরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়ানো। কারও ক্লাস আজকের মতো শেষ, কারও অফ পিরিয়ড, কারও কোনও ক্লাসই নেই আজ। তবু, জড়ো সক্কলে। উল্টো দিকের তোবড়ানো টিনের ঠেলাগাড়িতে চা-বিস্কুটের দোকানদারি মাঝবয়সি বৌদির। মাঝেমধ্যে তাঁর সহকারী ছোকরা বিলিব্যবস্থায় এগিয়ে আসছে ধোঁয়া-ওঠা ভাঁড়ের ঝাঁক আর ক্রিম বিস্কুট নিয়ে। তার মুখ ঈষৎ বিরক্ত, কেননা সে জানে, ধারে খাওয়া চলছে। সে-ধার কবে মিটবে, বা আদৌ মিটবে কি না, তা অবশ্য সে জানে না। কিন্তু চা-বৌদি সদা হাস্যমুখ। আমাদের আগের অনেক ব্যাচ এমন ধারে কেটে গেছে তাঁর, ভিখারি রাঘবে ডরানোর পাত্রী তিনি নন। তার একটু দূরেই এক রাশভারী জ্যাঠা ভেজিটেবল চপ আর মাংসের শিঙাড়া নিয়ে বসেন। টাকা বাড়িয়ে দিয়ে কাগজের ঠোঙায় সেসব গরম-গরম পুরে একটু বিটনুন ছিটিয়ে দিয়ে ঝাঁকানোর পর পেশ করেন। বিকেল নাগাদ তাঁর সেইসব উষ্ণ আয়োজনের সুঘ্রাণে আমাদের মন বারবার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে সওয়াল করতে চায়। এইসবের মধ্যে দিয়েই সূক্ষ্ম ডজ আর ড্রিবল করে আমাদের চনমনে বয়স ঢুকে পড়ে ডি-বক্সে। তারপর একটা অতর্কিত শটের অপেক্ষা।

    এইসব অন্তর-জাতিক সমস্যার সমাধানে আমরা যখন ব্যস্ত, তখন আমাদের মনেরা কার সুতো কার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, সে-খবর আমাদের কাছেও নেই। যখন তিনদিন সে জ্বরে কাবু, আসছে না কলেজে, তখন টের পাচ্ছি, আলগোছে বাঁধা সুতোয় দিব্যি টান পড়ছে! এইরকম সব বিপদের খেলায় আমরা গোপনে নাম কিনছিলাম তখন। আর র‍্যাংকিং অনুযায়ী অদৃশ্য মেডেল গলায় পরার লোভে বসছিলাম পড়ন্ত রোদের সিঁড়িতে। অনেক সময় অবশ্য গোপন বৈঠকও দরকার হয়ে পড়ত। তাতে সকলের সামিল হওয়া সাজে না বলেই, আমরা যারা বেশি বুঝি সব কিছু, তারা আলাদা বসে নিতাম। অভিমানের ক্ষেপণাস্ত্র, অস্বীকারের পরিখা, মনকেমনের চুক্তি, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার দরকার হয়ে পড়ত মাঝেমধ্যেই। এবং সেসব গোপন বৈঠক হত আমাদের এক বন্ধুর চিলেকোঠার ঘরে। সে ছিল তার নিজের রাজ্য, আর সময় বিশেষে আমাদের অ্যান্টি চেম্বার। একটা চৌকি, একটা টেবিল, একটা ভাঙা আদ্যিকালের ফ্যান, জীর্ণ আলনা আর একখানা শতরঞ্চি, এই ছিল আয়োজন। কোনও রকমে আপৎকালীন তহবিল ভাঙিয়ে চাঁদা তুলে গ্রীষ্মের দুপুরের সোনালি পানীয় কেনা হত। তার হলদেটে কাচের শরীরে ভেসে ওঠা বিন্দু-বিন্দু শীতল ঘাম আমাদের ছুটির রোমাঞ্চ উপহার দিত এমনিই। বৈঠকের মাঝে হাজিরা দিতেন জগজিৎ সিং বা গুলাম আলি। ‘দো অওর দো কা জোড় হমেশা চার কাহাঁ হোতা হ্যায় / সোচ সমঝওয়ালোঁ কো থোড়ি নাদানি দে মওলা’। নিদা ফাজলির এই প্রবচনে যখন বিকেল চুঁইয়ে সন্ধে নামছে সেই ছোট্ট চিলেকোঠায়, আমাদের দিশেহারা মেহফিল কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না তখনও। অথচ আগামীকাল ঠিক দুপুর তিনটেয় সভা বসবে সিঁড়িতে, কী বলব আমরা তখন? 

    এই প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি। যেমন মেলেনি এক সুতোর সঙ্গে অন্য সুতোর রংমিলান্তি খেলা, যেমন মেলেনি বহু হাতছুট চিরকুটের ঠিকানা, যেমন মেলেনি বহু খেলার শেষে স্কোরের মীমাংসা। মেলে তো না, আর না-মেলারই তো কথা ছিল আসলে। আমরা সেসব তখন বুঝতে পারিনি, এই যা। রকপাখির ডানার ছায়াকে ছোট করে দিয়ে আমরা যার-যার রোদ বেছে নিয়ে ভেসে পড়েছি নিজেদের মতো। সেই ছোট চিলেকোঠায় এখন কে থাকে, কেউ থাকেও কি না, জানা হয় না আর। অনেক-অনেক ফ্রেশার্স ওয়েলকামের রাংতা পড়ে থাকে যুদ্ধশেষে মৃতদেহের মতো, সেসব মাড়িয়ে আমরা ভবিষ্যতের সমীক্ষায় মুখ লুকোতে আসি। আর দেখি, সিঁড়ি সেই একইরকম আছে, বদলায়নি তার শ্রান্ত শরীরে এসে পড়া অবেলার রোদও। বদলে গেছে কেবল সময়। আর সেই সময়ের ছাপ ধরা পড়ছে চা-দোকানি বৌদির প্রৌঢ়া মুখে। যেন পাললিক শিলা, যেন নদীর গর্ভে পলির ইতিহাস। আমি নিশ্চিত জানি, ওঁর কোনও এক তেলচিটে খাতায় আজও খুঁজে পাওয়া যাবে কয়েকখানা ঝাপসা-হওয়া নাম, যাদের পাশে জেগে আছে ঋণের বাতিঘর। তারা বলছে, আর যা-ই মিলুক, সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কখনও মেলে না। কক্ষনও না। দুই আর দুই যে চার হয় না সবসময়, সে আর তার চেয়ে ভাল কে জানে আজ…

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook