ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • লোভের নীতিগল্প


    অর্ক দাশ (Arka Das) (October 23, 2021)
     

    সমালোচনা— ওয়েব সিরিজ, ‘স্কুইড গেম’  
    মুখ্য চরিত্র— লি জুং-জে, পার্ক হে-সু, উই হা-জুন, জুং হো-ইয়েওন, ইয়েয়ং সু-ওহ, অনুপম ত্রিপাঠি   
    পরিচালনা— হোয়াং ডং-হিউক  
    মোট পর্ব— ৯

    স্কুইড গেম’-এ যে ক’টা ভয়াবহ দৃশ্য দেখানো হয়, খেলার ময়দানে দৈত্যাকৃতি বাচ্চা মেয়ে পুতুলের অংশ তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। যান্ত্রিক এক কন্ঠস্বরে ছোটদের একটা ছড়া গাইতে-গাইতে এই ভয়ানক পুতুলটা সিরিজের প্রথম খেলা ‘রেড লাইট, গ্রিন লাইট’

    (‘লাল আলো, সবুজ আলো’) পরিচালনা করে। খেলার সময়সীমা কমে আসতে থাকার সঙ্গে-সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ে এই ছড়ার লয়; নেহাতই বাচ্চাদের একটা খেলায় হেরে যাওয়ার অকল্পনীয়, নির্মম ফল ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের কাছে। প্রতি সেকেন্ডে আতঙ্ক তুঙ্গে উঠতে থাকে, সঙ্গে বেজে চলে এই অপার্থিব, অমানুষিক, এবং ভীষণ নিষ্ঠুর ছড়া— নিষ্ঠুর, কেননা এই খেলায় একটা ভুল পদক্ষেপ মানেই অবধারিত মৃত্যু, আক্ষরিক ‘এলিমিনেশন’।      

    ‘স্কুইড গেম’-এর প্রথম পর্বের কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বাচ্চাদের খেলার সঙ্গে ভয়াবহ, নৃশংস মৃত্যুর যোগাযোগ দর্শকদের মনে বিঁধে যায়; একটা ঠাসবুনোট মরণবাঁচনের গল্পের ভিত্তি তৈরি করে দেয় উত্তাপহীন, অনুশোচনাহীন সন্ত্রাস। ‘দ্য হাঙ্গার গেমস’ সিরিজের ছবিগুলোর সঙ্গে তুলনা উঠে আসে ঠিকই— যেহেতু দুটো গল্পেই প্রকাশ্য মঞ্চে মৃত্যুর প্রদর্শনী গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ; বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের ভয়্যুরিজম নিয়ে অবসেশনের রূপক। কিন্তু শিকার একটা প্রাপ্তবয়স্ক বিনোদন। বাচ্চাদের গোল হয়ে বসা গুলি খেলায় বন্দুক ঢুকে পড়লে ফলাফল অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে পারে। 

    ‘রেড লাইট, গ্রিন লাইট’ খেলার সেই দানবীয় মেয়ে পুতুল

    যদি এই অদ্ভুত যুগলবন্দি— এবং তার সঙ্গে প্রথম পর্বেই ভয়ানক গণহত্যা— মেনে এগিয়ে যেতে পারেন, দেখা যাবে যে থ্রিলারের ছদ্মবেশে পেশ করা ‘স্কুইড গেম’ আদতে বর্তমান জগতে মানুষের অবস্থান নিয়ে তৈরি একটা অসামান্য রূপক-কাহিনি। যেটুকু প্রয়োজন, ঠিক সেটুকু রক্তক্ষরণে তৈরি শো’টা সেপটেম্বর ১৭, ২০২১-এ রিলিজ হওয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যেই দুনিয়াজুড়ে নেটফ্লিক্সে অভাবনীয় সাড়া ফেলে। এবং নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে এই ওয়েব সিরিজ দর্শকসংখ্যার নিরিখে (১১১ মিলিয়ন, বা দশ কোটির কিছু বেশি) এখনও অবধি প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।  

    ‘স্কুইড গেম’ নিয়ে এই মাতামাতির কারণ কী? প্রথমত, আকর্ষণীয় কাহিনি: একদল হতভাগ্য মানুষকে জীবনে একটা শেষ সুযোগ দেওয়ার গল্প, একদল প্রাপ্তবয়স্কদের কিছু ছোটদের খেলা খেলে ৪৬ বিলিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ান ‘ওন’ (বা $ ৩৯ মিলিয়ন) পুরস্কারমূল্য জিতে নেওয়ার গল্প। প্যাঁচ একটাই— এই খেলায় হার মানে মৃত্যু। রাউন্ডের পর রাউন্ড খেলা এগোয়, একের পর এক প্রতিযোগী ‘এলিমিনেটেড’ হতে থাকে, ভিআইপি অতিথিরা স্বচক্ষে, লাইভ, কনিয়াকে চুমুক দিতে-দিতে খেলা দেখতে দ্বীপে এসে পৌঁছন; খেলোয়াড়দের জীবন বা মৃত্যুর উপর বাজি ধরেন। ‘দ্য হাঙ্গার গেমস’-এর সুদূর ভবিষ্যতের ডিস্টোপিয়া নয়, এসবই ঘটে বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ায়, দেশের অতল সমাজ এবং অর্থবৈষম্যের পটভূমিকায়।        

    প্রধান নায়ক দেনায় জর্জ্জরিত, হতদরিদ্র জুয়াড়ি সিয়ং জি-হুন (ভূমিকায় অসাধারণ লি জুং-জে) আরও একবার জুয়ায় হারার পর পাতালরেল স্টেশনে বসে যখন নিজের ভাগ্যকে দুষছে, এক নামহীন সেলস্‌ম্যান (ভূমিকায় ট্রেন টু বুসান-খ্যাত গং ইউ) এসে তাকে তাস-উল্টানো ‘ড্ডাকজি’ খেলায় চ্যালেঞ্জ করে। শর্ত এক, এবং উদ্ভট— জিতলে জি-হুন পাবে অনেক টাকা, হারলে খাবে থাপ্পড়। হারতে-হারতে, মার খেয়ে-খেয়ে অবশেষে জি-হুন যখন সত্যিই জেতে, সেলসম্যান তাকে জানায় যে আরও অনেক টাকা জেতা যেতে পারে এমন খেলা আছে, এবং রেখে যায় একটাই টেলিফোন নাম্বার লেখা একটা অদ্ভুত দেখতে কার্ড— ‘স্কুইড গেম’-এর ত্রিকোণ-চতুর্ভুজ-বৃত্ত আঁকা কার্ড।

    হতভাগ্য জুয়াড়ি সিয়ং জি-হুনের ভূমিকায় লি জুং-জে

    ফোন করতে বেশি সময় লাগে না জি-হুনের, কারণ তার হারাবার আর কিছু বাকি নেই। রাতের অন্ধকারে, রহস্যময় গাড়ি এবং ফেরি পারাপারের পর, ৪৫৬ জন ‘প্রতিযোগী’ একটা বড় হলঘরে জেগে উঠতে থাকেন। সবার পরনে নম্বর লেখা একই ধরনের ট্র্যাকসুট; জি-হুন সব শেষ নম্বরে, ‘প্লেয়ার ৪৫৬’। তাদের চারপাশে টহল দেয় মুখোশ পরা, বন্দুকধারী সৈন্যেরা। জি-হুন অবাক হয়ে দেখে এই সর্বহারাদের দলে রয়েছে তার ছেলেবেলার বন্ধু চো সাং-য়ু (ভূমিকায় ; আপাতদৃষ্টিতে দারুণ সফল এক ব্যাঙ্কার, এবং ছেলেবেলা থেকেই পাড়া-পড়শীরা যাকে প্রতিভাধর এবং সম্ভাবনাশালী হিসাবেই ভেবে এসেছে। আদতে সাং-য়ু ঋণগ্রস্ত, গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়ানো এক জালিয়াত, এবং স্কুইড গেম-এ ‘প্লেয়ার ২১৮’। 

    পাকিস্তানি শ্রমিক আলি আবদুলের (‘প্লেয়ার ১৯৯’) ভূমিকায় ভারতীয় অভিনেতা অনুপম ত্রিপাঠি

    পুরনো এবং নতুন পরিচিতদের এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় অশীতিপর বৃদ্ধ ‘প্লেয়ার ১’ (ভূমিকায় ইয়েয়ং সু-ওহ), উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা, অনাথ তরুণী কাং সে-বিয়েয়ক (‘প্লেয়ার ৬৭’; ভূমিকায় জুং হো-ইয়েওন) এবং বেআইনি ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত পাকিস্তানি পরিযায়ী শ্রমিক আলি আবদুল-কে (‘প্লেয়ার ১৯৯’, ভূমিকায় ভারতীয় অভিনেতা অনুপম ত্রিপাঠি) নিয়ে। স্কুইড গেম-এর খেলোয়াড়রা এক-একটা দিন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে কাটায়; উপকাহিনিতে চলে নিখোঁজ দাদার সন্ধানে দ্বীপে লুকিয়ে আসা পুলিশ ইন্সপেক্টরের অ্যাডভেঞ্চার এবং খেলোয়াড়দের মরদেহ নিয়ে গেম-এর সেন্যদেরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জঘন্য ব্যবসা।     

    জি-হুন এবং তার সঙ্গী/শত্রুদের নিয়েই মূলত তৈরি হয় স্কুইড গেম-এর নাটকীয়তা। মহাসাগরের মাঝে এই নামহীন দ্বীপে, একটা বিরল কিন্তু নিষ্ঠুর অবস্থায় যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়, তা কতটা ভঙ্গুর? ছয় রাউন্ডে যেখানে ৪৫৬ প্রতিযোগী থেকে মাত্র একজনই বিজয়ী হতে পারে, এবং যেখানে প্রত্যেক খেলায় হারার মূল্য নিজের জীবন, সেখানে বন্ধু কে হতে পারে, সেই অবস্থায় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কী? প্রতি পর্বে নতুন বিশ্বাসঘাতকতা টান-টান কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। প্রথম পর্বেই, ভয়ানক পুতুলের মোকাবিলার পর, শান্ত ডরমিটরি রাতের অন্ধকারে হয়ে ওঠে রক্তাক্ত, নৃশংস যুদ্ধক্ষেত্র; পাশবিক শক্তির প্রদর্শনীতে একে-একে খুন হয় দুর্বল প্রতিযোগীদের দল। খেলার পর খেলায়, প্রত্যেক মূহুর্তে লৌকিকতার মুখোশ খসে পড়তে থাকে; বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষের কুটিল, সহজাত প্রবৃত্তিকে ঢেকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যেমন জীবনেই ঘটে থাকে। ছেলেবেলার বন্ধুকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে চো সাং-য়ু বেছে নেয় বলবান আলিকে, কিন্তু খেলার ময়দানে এই পার্টনারকেই সে ধোকা না দিয়ে পারে না— যা সে খুব সহজেই বাইরের দুনিয়ায় বহুবার করে এসেছে। 

    কি হবে এই ছোটদের খেলার ময়দানে?

    হ্যাঁ, ‘স্কুইড গেম’ নৃশংস। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় সিনেমায় ঠিক হলিউডি ধাঁচের দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হিংসা দেখা যায় না। ‘স্কুইড গেম’-এর নৃশংসতাও তাই দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রের অসামান্য ধারা মেনেই চিত্রনাট্যের একটা অপরিহার্য অঙ্গ; পার্ক চান-উকের ‘দ্য ভেঞ্জেন্স ট্রিলজি’, ইয়েওং সাং-হো’র ‘ট্রেন টু বুসান’, এমনকী কিম কি-ডুক-এর ‘মায়াবী, দ্য আইল’-এর ধারায় বহুস্তরপূর্ণ, যেখানে মৃত্যুর বিষণ্ণতা হিংসাকে ছাপিয়ে যায়। এই কারণেই ‘স্কুইড গেম’-কে শুধুমাত্র ‘থ্রিলার’ বা ‘হরর’ তক্‌মা লাগিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ‘স্কুইড গেম’ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে, এবং তার মধ্যে একটা হচ্ছে ‘কেন’? কেন এই নৃশংস খেলা, কেন এই ভায়োলেন্স? এবং খেলা তৈরি করার পেছনে যাদের মাথা, তাদের মধ্যে একজনের সোজাসাপ্টা উত্তর— ‘কেননা আমাদের আর কিছু করার ছিল না’, কেননা ‘অকল্পনীয় বিত্তশালী’ এবং ‘সম্পূর্ণ হতদরিদ্র’ কীভাবে এগিয়ে চলবে, তা তাদের আর জানা নেই। 

    শুধু বিনোদন নয় ‘স্কুইড গেম’। বরং বলা যেতে পারে, সিরিজটা যেন একটা বিশ্বাস বা মতের কথা বলে। সেখানে যেমন আছে মানুষের অতল লোভ এবং অর্থলিপ্সার দর্শন, মনুষ্যচরিত্রের স্বাভাবিক স্বার্থপরায়ণতা, তেমন রয়েছে ইতিহাস জুড়ে মানুষের স্বার্থত্যাগ। এ যেন বাচ্চাদের খেলার ময়দানের খুনসুটি, ঝগড়া আর রাজনীতির লেন্স-এ দেখা জীবন; উলঙ্গ, পাশবিক, বারংবার নিরাশ, কিন্তু একেবারে সান্ত্বনাহীন নয়। ঠিক এই কারণেই বোধহয় আমরা সারা পৃথিবীজুড়ে এখন ‘স্কুইড গেম’ দেখে চলেছি। 

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook