কখনও ভেবে দেখেছেন কি, কলকাতাতেই কেন বা কী করে, ‘রোল’ বলে জিনিসটার উদ্ভব হল, বিশেষত ‘এগ রোল’-এর? উত্তরটা খুব সহজ: খুঁজতে হলে সোম টু শুক্র যে-কোনও দিন দুপুরবেলা একবারটি শহরের খোদ কেন্দ্রে, এসপ্ল্যানেড-ডালহৌসি-চাঁদনি চকের অফিসপাড়া চত্বরে ঢুঁ মেরে আসতে হবে।
শহরে নবাগত হলে তো কথাই নেই— এক বর্গমাইল জুড়ে ফুটপাথ ধরে সারি-সারি অস্থায়ী রাস্তার দোকানের পসরা দেখে তাক্ লেগে যেতে বাধ্য। পোড়-খাওয়া শহুরে আদমি হলেও, দাদা ও দিদি; এক চক্করেই অফিসপাড়ার মাহাত্ম্য আরও একবার উপলব্ধি করে নিতে পারবেন। কী পাওয়া যায় না এই অফিসপাড়ায়? ঠাসাঠাসি সরকারি দপ্তর, ব্যবসাকেন্দ্র, ব্যাংক আর কলকাতা হাইকোর্ট মিলিয়ে এই তল্লাট যে কেরানির স্বর্গরাজ্য, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং সেই কলকাতাবাসী কেরানি যে তার খাবারের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস, তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে কি?
‘পথচলতি’ কথাটার সারমর্ম, যাকে বলে খোদ নির্যাস, কলকাতার খুচরো খাবারে বেঁচে থাকে। অফিসপাড়ায় সময়ের অগ্নিমূল্য; সংক্ষিপ্ত লাঞ্চ-ব্রেক বনাম ক্ষিপ্ত জনরোষের কম্পিটিশনে জনতাই বিজয়ী। যে স্পিডে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, মোটামুটি সেই স্পিডেই ফুটন্ত চা থেকে মোগলাই পরোটা যে গলাধঃকরণ করা আদৌ সম্ভব, এটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মন্ত্র একটাই; ‘সোজাসাপ্টা, চট্জলদি’। এগ রোল একজ্যাক্টলি এই দর্শনের অসামান্য উদাহরণ— কেজো দিনের ধর-তক্তা ‘ওয়ান-ডিশ-মিল’। এটা বুঝে গেলেই এগ রোলের জন্মস্থল হিসাবে কলকাতার ভূমিকা যুক্তিযুক্তভাবে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
পাঁচ মিনিটে পরিবেশন। ইয়ার্কি না— দেশপ্রিয় পার্কের জীশানে, একটু-আধটু রসিকতা সহ্য করেও, শুরু থেকে শেষ অবধি এগ রোল তৈরির পদ্ধতি আমি রীতিমত স্টপ-ওয়াচে ‘টাইম’ করেছি! মাখা ময়দার একটা মাঝারি সাইজের মন্ড বেলে বানানো হয় পরোটা, যাকে বেশ করে ভেজে তার উপরে একটা (বা দুটো) ডিম ফেটিয়ে ফেলে, পাতলা আস্তরণে তৈরি হয় একটা দু-সেকেন্ডের পোচ, যা অচিরেই বদলে যায় একটা অমলেটে, উল্টে দেওয়া হয় পরোটা। ভাজা পরোটার মাত্র এক দিকেই লেগে থাকা এই অমলেট বানানো কিন্তু মোটে সহজ কাজ নয়। রোল ভরাট করতে এর পর রইলো একটু কাটা পেঁয়াজ-লঙ্কা, একটু নুন-গোলমরিচ, আর বেশ খানিকটা পাতিলেবুর রস; কিন্তু খবর্দার, কোনও সস্ নয়! পাঁচ মিনিট, খেল খতম! আপনার হাতে সদ্য-ভাজা এগ রোল – ২০, ৩০ এমনকী ৫০ টাকার বিনিময়ে। যেটা খেয়ে ফেলতে হয়তো আরও পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগে না।
অফিসপাড়ার খাবারের স্টলগুলোয় ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনারের পরের মিষ্টি অবধি সবকিছু পাওয়া যায়। চা-টোস্ট থেকে বিরিয়ানি; ছয় পদের মাছ-ভাত থেকে চিলি চিকেন-ফ্রায়েড রাইস; মশলা দোসা থেকে শক্তিগড়ের ল্যাংচা, সব পাবেন এখানে। আছে বিখ্যাত খাদ্যগলিবিশেষ ডেকার্স লেন। এত কিছুর মধ্যেও, দৈনিক রেষারেষির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোলের দোকানগুলো সদা-বিরাজমান, যাদের মধ্যমণি হয়ে আছে এগ রোল।
‘কলকাতা রোল’-এর জন্ম যে অফিসপাড়ার কাছেই, নিউ মার্কেটের বিখ্যাত ‘নিজাম’-এ, এটা এখন মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। ‘নিজাম’-এ ঢোকার মুখের সাইনবোর্ডে বড় হরফে এ-কীর্তির বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তা সে লিখিত ইতিহাস থাক বা না-ই থাক। মজার কথা হল, এককালে যা নিজামের মোনোপলি ছিল, সেই ‘রোল’ মধ্য-কলকাতার রেস্তোরা-গন্ডি ভেঙে সারা দেশে তো ছড়িয়ে পড়েছেই, এমন কি দিব্যি সিয়াট্ল-নিউ ইয়র্ক-লন্ডনে খানেওয়ালাদের মন জিতে বেড়াচ্ছে। পায়েল সাহা’র ‘দ্য কাটি রোল কোম্পানি’ ২০০২ সাল থেকে ‘একদম কলকাতার স্বাদের’; ‘খাঁটি রাস্তার কাঠি (কাটি) রোল’ তক্মায় নিউ ইয়র্ক আর লন্ডনে রোল পরিবেশন করে যাচ্ছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ভারতীয়’ রেস্তোরাঁগুলোয় ‘কাটি রোল’ বিস্তর পাওয়া গেলেও, এ-ক্ষেত্রে পায়েলের প্রতিষ্ঠানই প্রথম। ম্যানহাটানে পাঁচটা, আর লন্ডনে পোল্যান্ড স্ট্রিট-এ একটা, এই ছয় আউটলেটে বিক্রি হয় দ্য কাটি রোল কোম্পানি’র ‘কলকাতা রোল’।
কলকাতার বাইরে যেখানেই রোল খেয়েছি, এই ‘কাটি’ শব্দটা না জুড়লে যেন ‘কলকাতার রোল’ জিনিসটা বোঝানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। ‘ফ্র্যাঙ্কি’ নামের একটা জিনিস দিল্লি-মুম্বই-ব্যাঙ্গালোরে বেশ চলে, কিন্তু সেটা ঠিক ভাজা পরোটার রোল নয়; অল্প তেল-টেল ইত্যাদি দিয়ে বানানো, তারপর মাঝখান থেকে কেটে ফেলা একটা ভজঘট ব্যাপার। এই ‘কাটি’ উপাধিটা নাকি আসে ‘নিজাম’-এর বাঁশের কাঠিতে তৈরি কাবাব থেকে, যা পরোটার ভেতর ঠেসে চিকেন-মাটন রোলের খোলতাই হয়। একদিক থেকে দেখলে এই বিশেষণ যথোপযুক্ত, কেননা পাশ্চাত্যদেশে ‘রোল’ বলতে সুদূর প্রাচ্যের রন্ধনপ্রণালীর, বিশেষ করে চিনের যে নির্দিষ্ট খাবারের কথা বোঝায়, নিজামের ভাজা পরোটার রোল তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। ভিয়েতনামের পর্ক/চিকেন/চিংড়িমাছের সফ্ট স্প্রিং রোল-ও একটা অনবদ্য ব্যাপার, কিন্তু সেটাও আমাদের পরিচিত রোলের থেকে ঢের আলাদা।
কোনও ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু এই ‘কাঠি’ শব্দটা আমার কাছে বিরক্তিকর। এগ রোলে কাবাব নেই, কাঠি-ও নেই— আছে সাকুল্যে একটু পেঁয়াজ-লঙ্কা-লেবু, খুব বেশি হলে আলু। বাঁচা গেছে! কলকাতার অন্য রোল – চিকেন, মাটন, এবং বিশেষত বিফ, নিয়ে কথা হবে, কিন্তু আজ নয়। এদের আবার নানা রকমের অবতারও দেখা যাচ্ছে আজকাল—‘ট্যাকো বেল’ নামের মার্কিন ফাস্ট-ফুড রেস্তোরাঁচেন ‘কাঠিত্তো’ নামে কলকাতার রোল আর মেক্সিকান ‘বারিটো’র এক মিশ্র ডিশ উদ্ভব করেছে। না খেয়ে মন্তব্য করা যাবে না।
ইউটিউবে কয়েকশো চ্যানেলে যতই ‘ঘরোয়া’ রেসিপি শেখানো হোক, বা সোহো বা ম্যানহাটানে আফটার-পার্টি জলখাবার হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করুক না কেন, নিজের দেশে এগ রোল ছাপোষা মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবিদের ত্রাণখাদ্য, দশকের পর দশক তা-ই হয়ে এসেছে। নব্বই-এর দশকে নটসেনার নাটক ‘ফাটা গোপাল’-এ খিটখিটে, আদ্যন্ত পরস্মৈপদী এবং বেজায় কৃপণ উকিলের ভূমিকায় তাপস কুমার দেব-এর এগ রোল খেতে-খেতে মঞ্চে প্রবেশ এই মধ্যবিত্ত খাওয়ার প্রতীক-বিশেষ।
অবশ্য গামছা-কাঁধে গোয়ার বিচেও ফটাফট এগ রোল বানাতে দেখেছি খোদ মেদিনীপুরের ছেলেকে। ডিসেম্বরের লম্বা অঞ্জুনা-লীলার রাতের শেষে আমোদগেঁড়েদের পেট ভরাতে হবে তো!