অবধারিত গাড্ডা
দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাংলাদেশে কিছু মুসলমান মৌলবাদী হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করল, ইসকনকেও ছাড় দিল না। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের বহু মানুষ, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই হিংসার প্রতিবাদ করলেন, হিন্দুদের মন্দির বা মণ্ডপের সামনে মানব-শৃঙ্খল রচনা করলেন, কিন্তু তাতে তো আর আঁচ থেমে থাকে না, ভারতেরও সোশ্যাল মিডিয়ায় সঙ্গত ও অসঙ্গত তর্ক আলোচনা খেউড় উপচে পড়ল। মৌলবাদীদের কাজই হল আগুন উসকে দেওয়া, কারণ মৌলবাদের বিপক্ষে বলতে গেলে প্রথমেই গলায় রাগ উগরে আসে এবং একটা ফিরতি-জঙ্গি মনোভাব হুউউশ-তুবড়ির ন্যায় বহুবর্ণ ফণা তোলে, অতি কষ্টে ও অনেকটা শিক্ষার বাটখারা চাপিয়ে যাকে ফের নামিয়ে বসিয়ে থিতিয়ে সনিষ্ঠ শিক্ষিত কথাবার্তা চালাতে হয়। অনেকেরই পক্ষে সেই সংযম বা সংস্কৃতি সংগ্রহ সম্ভব হয় না, তাই মৌলবাদী আক্রমণে সবচেয়ে উপকৃত হয় উল্টো-মৌলবাদটাই। মৌলবাদের উল্টোটা নয়। মুসলমানরা হিন্দুদের মেরেছে, তাই ‘এবার মার মুসলিমগুলোকে’ স্লোগানটাই শনশনিয়ে ছড়াতে থাকে, ‘অ্যাই, কেউ কাউকে মারবে না, কারণ সভ্য মানুষ প্রহারে বিশ্বাস করে না’ কথাটাই যে আসলে মৌলবাদের বিপরীত অবস্থান, তা চট করে চোখে পড়ে না। অ-মৌলবাদ মানে সবার কথা ধৈর্য ধরে শোনা ও আলোচনার মাধ্যমে সবচেয়ে কট্টর গালাগালিবাজকেও বোঝানোর চেষ্টা করা। তা সাংঘাতিক শক্ত শুধু নয়, অধিকাংশ সময়ে ভস্মে ঘি ঢালার শামিল। এতে হাতে-গরম কোনও ফল পাওয়া যায় না, বরং অনেকটা হতাশা আর অনেকটা কান্না গিলে, পদে পদে ব্যর্থতার খচখচে কাঁটা মাড়িয়ে বহুদিন ধরে পথ চলতে হয়। তা বোরিং ও অতৃপ্তিময়। নিজের স্বর নিজের কানেই এক সময় ঘ্যানঘ্যানে ও নিস্তেজ রোদনের মতো লাগতে থাকে। এদিকে চতুর্দিকে রগচটা মতামত এমন হাঁড়িভরা কালিপটকার মতো ফেটে পড়ছে, আগ্রাসী বিতণ্ডাধর্মী হাত-নাড়ানি এমন কানফাট্টু হাততালি লাভ করছে, তা উপেক্ষা করে থাকাও কঠিন। তাই মৌলবাদের বিরুদ্ধে মাথা ঠান্ডা রেখে সুবিবেচকের মতো কথা বহু বছর ধরে বলে যাওয়া মানে এক পাকাচুলো ন্যুব্জ মৃদুভাষী প্রফেটের ভঙ্গিতে উঁচু বইয়ের তাক থেকে ধুলোভর্তি অভিধান বা উপনিষদ নামানো, তার ওজন বিরক্তিকর, হাঁচিও বাড়ে, দর্শকও অধৈর্য হয়ে ওঠে। সর্বোপরি, কথা ও যুক্তিগুলো একই, তাকে কতবার আর নানা মোড়কে পরিবেশন করা যায়। অন্যদিকে, মৌলবাদী তর্কগুলো এক হলেও, তার পেছনে ডঙ্কার ঝাঁজ, আর সামনে লাঠি-চক্করের হা-রে-রে-রে, ওর রক্ত-আবেদন ভিন্ন।
এই পরিবেশে ফ্যাব ইন্ডিয়া সবেগে সরিয়ে নিল তাদের একটা দিওয়ালি বিজ্ঞাপন (যদিও তারা বলছে, না না, ওটা ঠিক দিওয়ালির বিজ্ঞাপন ছিল না, আরেকটা বিজ্ঞাপন আসছে), যেখানে বলা হয়েছিল, ভালবাসা ও আলোর উৎসবকে স্বাগত জানাতে তাদের নতুন সংগ্রহ ‘জশন-ই-রিওয়াজ’ ভারতীয় সংস্কৃতিকে সম্মান জানাচ্ছে। আর যায় কোথা, উর্দু নাম দিয়ে একটা কালেকশন করব, সেটা হিন্দু উৎসব উপলক্ষে হইহই প্রচার করব, তা কখনও হয়? উর্দু, অনেকেরই মতে, মুসলিমদের ভাষা, তাই অনেকে বলল, এতে হিন্দু উৎসবকে অ-হিন্দু করে তোলা হচ্ছে, কেউ বলল অপ্রয়োজনীয় ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ছড়ানোর কী দরকার, কেউ বলল এ জশন-ই-রেওয়াজ ব্যাপারটা কী, ইদ উপলক্ষে কোনও পাকিস্তানি অনুষ্ঠান? অবশ্যই অনেকে বলল, ফ্যাব ইন্ডিয়াকে বয়কট করো। প্রথমে সংস্থার মুখপাত্র বলেছিলেন, না না, অপমান-টপমান কীসের, জশন-এ-রেওয়াজ’এর আক্ষরিক মানে তো ঐতিহ্যের উদযাপন, তারপর তাড়াতাড়ি সংস্থাটা বিজ্ঞাপন থেকে ওই নামটা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, বলছে আরে সামনেই আসছে আমাদের দীপাবলির বিজ্ঞাপন ‘ঝিলমিল সি দিওয়ালি’, অপেক্ষা করুন না মশায়। এর আগেও, যেই তানিশক-এর একটা বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল হিন্দু নারীর সঙ্গে মুসলিম পুরুষের বিয়ে হয়েছে (এবং মুসলিম শাশুড়ি গর্ভিণী পুত্রবধূর জন্য একটি হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করছেন, পুত্রবধূ বলছে, মা, এ অনুষ্ঠান তো আপনাদের বাড়িতে হয় না, শাশুড়ি বলছেন, মেয়েকে সুখী রাখার ঐতিহ্য তো সব বাড়ির?), সঙ্গে সঙ্গে তা ‘লাভ জিহাদ’-সমর্থনকারী বিজ্ঞাপন হিসেবে নিন্দিত হতে থাকে (কারণ হিন্দু নারীর সঙ্গে মুসলিম পুরুষের বিয়ে হয়েছে, তা তো আর স্বাভাবিক প্রেমের পরিণাম হতে পারে না, তা নির্ঘাত ধর্মান্তর-করণের চক্রান্তের অঙ্গ), বর্তমান ভারতের তীব্র ইন্টেলেকচুয়াল কঙ্গনা রানাওয়াত তাঁর টুইটে জনগণকে এইসব ‘সৃষ্টিশীল উগ্রপন্থীদের’ সম্পর্কে সাবধান করে বলেন, তারা আমাদের অবচেতনে কী ঢুকিয়ে দিচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন না হলে আমাদের ‘সভ্যতাকে বাঁচানো যাবে না’। তিনি এও বলেন, এতদিন ধরে মেয়েটি এই পরিবারে বিবাহিতা, আর তাকে প্রকৃত গ্রহণ করা হল কিনা যখন সে ওদের বংশধরকে গর্ভে বহন করছে? এ তো লিঙ্গবৈষম্যেরও সমর্থন! কে জানে ওই বিজ্ঞাপনে কখন বলা হল, মেয়েটিকে অ্যাদ্দিন নয়, আজই প্রকৃত গ্রহণ করা হয়েছে। হয়তো এতবড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানটাও শাশুড়ি এবাড়িতে করবেন সে ভাবতে পারেনি। যেমন খুব আদরের বউ ১৩ বছর বিয়ের পরেও স্বামীকে বলে উঠতে পারে, কালকে তুমি অত রাত অবধি আমায় হাওয়া করেছ? বা কোনও অভিনেত্রী প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভের পরেও কোনও বড় পুরস্কার পেয়ে বলে উঠতে পারেন, আমার অভিনয়ের এমন স্বীকৃতি আমি আশা করিনি। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ওসব লজিক-ললকার থোড়াই কেয়ার করেন। সিরিয়ালে সিরিয়ালে গণেশপুজো বা কড়ওয়া চৌথের ধুম দেখে তাঁদের চম্পকাঙ্গুলি (বা লৌহকব্জি) কোনও টুইট প্রসব করে না, যেই কোথাও হিন্দুধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের সমন্বয়ের বার্তা দেওয়া হয়, সহনশীলতার কথা বলা হয়, মিলেমিশে থাকার পক্ষে সওয়াল সাজানো হয় (তানিশকের গয়না-সংগ্রহের নাম ছিল ‘একত্বম’) , অর্থাৎ যেই বলা হয় একটা ধর্ম ভাল মানেই বাধ্যতামূলক ভাবে অন্য ধর্ম খারাপ নয়, অন্যকে হ্যাটা করা ও ঘৃণা করার মাধ্যমেই একটা ধর্মের মহিমা-বিচ্ছুরণ ঘটে না, তখনই ওঁদের অন্তঃস্থিত ক্যাঁচকোঁচ হু-হা জাগ্রত। তানিশক তড়িঘড়ি বিজ্ঞাপন তুলে নিতে স্বরা ভাস্কর বলেছিলেন, সবাই এত ট্রোলিং সহ্য করে, আর এতবড় একটা কোম্পানি তা করতে পারল না? স্বরা ভুলে গেছিলেন, যুদ্ধটা শুধু সামাজিক মাধ্যমে হচ্ছিল না, হিন্দু গুন্ডারা গিয়ে তানিশকের দোকানে দোকানে সতর্কবার্তা লটকে দিয়ে আসছিল। মান্যবর ক’দিন আগে এক বিজ্ঞাপনে দেখায়, বিয়ের কনে জিজ্ঞেস করছে কেন ‘কন্যাদান’ করা হয়, কন্যা তো কারও সম্পত্তি নয়, বরং ‘কন্যামান’ হোক, মানে তাকে সম্মান দেওয়া হোক, এবং দেখানো হয় পাত্রের বাবা-মাও ‘দান’-এর অনুষ্ঠানে শামিল হচ্ছেন। এ অ্যাড দেখেও বহু হিন্দু-হাঁউমাঁউয়ের ক্রোধ ছুবলে উঠল: হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে প্রগতিরোধী বলা হল! মৌলবাদীদের, সে হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান যা-ই হোক, সারকথা একটাই: যা হয়ে এসেছে, তা-ই হবে। যদি তুমি তাকে প্রশ্ন করো, যাচাই করো, ওজন করো, এবং নতুন মূল্যবোধের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সেই দুহাজার আড়াইহাজার পাঁচহাজার বছরের পুরনো রীতি-রেওয়াজকে, শ্লোক-অনুশাসন-ফরমানকে বদলাতে চাও, তবে তুমি সপাট শয়তান ও তোমার সঙ্গে কথা চলবে না, তোমার খুলি লক্ষ করে রড চলবে। সিয়াট টায়ার্স-এর বিজ্ঞাপনে বলা হল, দিওয়ালিতে রাস্তায় বাজি পোড়ালে গাড়ির যাতায়াতের অসুবিধে হয়, তাই একটু দেখেশুনে বাজি পোড়ানো ভাল। তাতেও প্রকাণ্ড গোসা-সর্প দিকে দিকে উত্থিত। ওই সংস্থাকে চিঠি লিখে বিজেপির লোকসভা সাংসদ অনন্তকুমার হেগড়ে বললেন, তবে এবার বিজ্ঞাপন হোক নমাজ পড়ার সময় রাস্তাঘাট আটকে যেভাবে গাড়ির অসুবিধে করা হয় তা নিয়ে, এবং মসজিদ থেকে মাইক বাজিয়ে তীব্র ডেসিবেলে আজান প্রচার করে যে শব্দদূষণ ছড়ানো হয় তার বিরুদ্ধে। কথাগুলো যুক্তিহীন নয়, সংখ্যাগুরু বলে তার দোষ পদে পদে ধরা হবে আর সংখ্যালঘুকে ছাড় দেওয়া হবে (কারণ তার বিরুদ্ধে বললে তার অবস্থান সমাজে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে), গণমাধ্যমের এই অভ্যাসে সংখ্যাগুরুর মনে ধারাবাহিক অবিচারের নালিশ গজাতে পারে, একে এক ধরনের বিপরীত সাম্প্রদায়িকতাও বলা যায়। কিন্তু চিঠিটির মধ্যে যদি এই রোয়াব-বিবৃতি গুঁড়ি মারে: আগে নমাজের বিরুদ্ধে কথা বলো তারপর দিওয়ালির রাস্তা-অবরোধী ফুর্তি বন্ধ করার কথা ভাবব, তাহলে তা মস্তানের কণ্ঠস্বর। অঙ্কের ভুল দেখিয়ে দিলে কেউ যদি ক্রমাগত পাশের ছেলের ভুল অঙ্কের দিকে আঙুল টিপ করে, বোঝা যায় সে নিজ ত্রুটি শোধরানোর প্রতি এতটুকু আগ্রহী নয়, স্রেফ কাদা-ছোড়াছুড়ি করে ব্যাপারটা গুলিয়ে দিতে উতসুক। তার সাফাই এই নয় যে সে ভুল করছে না, তার বক্তব্য: ও যদি ভুল করে, আমি করব না কেন? মানে, সে ততক্ষণ অবধি নিজের বদকর্ম আঁকড়ে অহংকারী গর্দান ফোলাবে, যতক্ষণ না অবশিষ্ট পৃথিবী চ্যুতিশূন্য হচ্ছে। মোদ্দা কথা, কক্ষনও আত্মসমীক্ষা বা আত্মসংশোধনের পথের কর্কশ কণাটি মাড়াবে না, শুধু গোঁয়ার তৃপ্তির গার্গল চোঁয়াবে। এই একমেটে মৌলবাদীর ভিড় বাংলাদেশেও, ভারতেও। মৌলবাদীরা টুইটও করতে পারে, দোকানও পোড়াতে পারে। মুশকিল হল, অ-মৌলবাদীরা শুধু টুইট করতে পারে। তাই তাদের জোর কম। তবে ইতিহাস দেখিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে লাঠি হারে, সে ভরসাটুকু আঁকড়ে চলতে হবে। কিন্তু যুগ যা পড়ছে, বাঘা সংস্থাও বিজ্ঞাপন গোটাচ্ছে, কারণ তাদের তো স্বল্পমেয়াদে প্রফিট হারালে চলবে না। তাছাড়া মারলে কর্মচারীদের লাগবে, ফলে আদর্শ আবার কাল দাবড়ানো যাবে’খন। এবং বাংলাদেশে যত মুসলিম মৌলবাদের দৌরাত্ম্য বাড়বে, তত ভারতে হিন্দু মৌলবাদেরও দৌরাত্ম্য বাড়বে, কারণ violence begets violence, money begets money, এবং মৌলবাদ begets মৌলবাদ, ক্রোধে ক্রোধকে চাগাবেই, তাই বিজ্ঞাপন কেন ওয়েব-সিরিজ করার সময়ও সব্বাই ঠোঁটে আঙুল রেখে সশব্দ শশশশশ বলছে, ‘তাণ্ডব’, ‘গুল’, ‘আশ্রম’, ‘লীলা’, ‘পাতাল লোক’ সম্পর্কে হিন্দু সংগঠন থেকে প্রখর প্রতিবাদ ও মামলা ঘটেছে। আর ক’দিন পরে শিল্প কেবল নিরপরাধ চকোলেট ও মিঠে গোলাপি ঘোড়ার কথা ফেনাবে, অবশ্য ঘোড়া আর্যহিন্দুদের প্রধান বাহন ঘোষিত হলে (এবং গরুর সমান প্রতিপত্তি বাগালে) সেও রিস্কি।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী