ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীল কেটলি: পর্ব ৮


    শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (October 23, 2021)
     


    মনোহরপুকুর থেকে সতীশ মুখার্জি

    কলকাতার আকাশে তখন মুহুর্মুহু ঝাঁকে-ঝাঁকে এরোপ্লেন উড়ে যায়। ময়মনসিংহে আকাশে এরোপ্লেন উড়ে যেতে দেখেছি কালেভদ্রে। প্লেনের আওয়াজ শুনলেই ছেলে-বুড়োমেয়ে-পুরুষ ছুটে বেরিয়ে আসত ঘর থেকে, তারপর আকাশমুখো হয়ে অবাক বিস্ময়ে এরোপ্লেন দেখত। কলকাতায় আর সেই বিস্ময় নেই। সাইরেন আর ব্ল্যাকআউট গা-সওয়া। সবাই বলত, জাপানিরা না হারলে খুব বিপদ। যে-কোনওদিন কলকাতায় বোমা পড়বে বলেও শুনতে পেতাম। আর তাহলে নাকি আমরা সবাই মরে যাব! মরে যাওয়ার ব্যাপারটা তখনও ঠিক বুঝতে পারতাম না। তবে বুঝবার চেষ্টা করতাম। কলকাতায় আসার পরই আমাকে একটা ট্রাই-সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছিল। দোতলায় আমাদের দুটো ঘরে কোনও আসবাবপত্র ছিল না। রাতে মেঝেতে মাদুর আর তোশক পেতে বিছানা হত। চেয়ার-টেবিলের প্রাদুর্ভাবও ঘটেনি। ফলে আমার ট্রাই-সাইকেল অবারিত ঘরের মধ্যে বিরামহীন চক্কর কাটতে পারত। লাল মেঝেতে চাকার জটিল দাগ আঁকতে-আঁকতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে যেতাম। নেশার মতো। কী যে ভাল লাগত সাইকেল চালাতে! তার অতি দুষ্টু ছেলেটা সাইকেলে মগ্ন থাকার ফলে, আমার মা-ও তার গৃহস্থালির কাজকর্ম করার ফুরসত পেত। আমার চেয়ে দু’বছরের বড় দিদি সকালে যেত কর্পোরেশনের স্কুলে পড়তে। আমি একা-একাই থাকতাম। কখনও একতলায় নেমে গিয়ে গলিতে খেলা করতাম, দু’একজন বন্ধুও জুটে গিয়েছিল। ভারি নিরিবিলি ছিল আমাদের মনোহরপুকুরের সেই গলিটা। মাঝে মাঝে রহস্যময় সব ফেরিওয়ালা আসত। তারা চেঁচিয়ে কী বলত তা আমি বুঝতে পারতাম না। শুধু ‘শিল-কোটাও’ বুঝতে পারতাম। মাঝে মাঝে আমাদের শিলনোড়া কুটতে শিলকোটাওয়ালা আসত, আর আমি অতিশয় মনোযোগ দিয়ে তার শিল্পকর্ম দেখতাম। 

    আমি চিরকালের পেটুক। ময়মনসিংহে যেমন সকালে মুড়ি-দুধ-কলা জলখাবার ছিল, কলকাতায় সেটা একটু পাল্টে গিয়েছিল। ফারপোর পাঁউরুটি আর পলসনের মাখন দিয়ে চিনি ছড়ানো মুচমুচে টোস্ট বা চিঁড়েভাজা, অমলেট এসবই হত। আমার মুখে সবই অমৃতসমান। তবে মিষ্টির ওপর টান ছিল বেশি। আর পরিমাণটাও একটু বেশিই লাগত। জলখাবারের পরও মা একটু সকাল-সকাল আমাকে ভাত খাইয়ে দিত। আমার অতিশয় প্রিয় ছিল (এখনও আছে) ডাল, ঘি আর ভাত। একটু আলুভাজা হলে ভাল। মাছ-টাছ বেশি পছন্দ ছিল না, সব্জিও নয়। কিন্তু মজা হল, সব কাজকর্ম সেরে আমার মা যখন একটু বেলায় খেতে বসত, তখন আমিও আবার গিয়ে মায়ের সঙ্গে বসে পড়তাম। তখন আবার মায়ের পাতের মাছ-টাছ দিব্যি সাঁটিয়ে খেতাম। তখন পুঁইচচ্চড়ি বা বড়ির ঝালও খারাপ লাগত না। তখন মা আমার জীবনসর্বস্ব, ব্যথা পেলে বা কেটেকুটে গেলে দৌড়ে মায়ের কাছে হাজির হতাম। মা সব সমস্যার সমাধান করে দিত। খাওয়ার পর আমি মায়ের জন্য অপটু হাতে পান সাজতাম, পানের পাতা উল্টো হত, মা তাই খুব আহ্লাদ করে খেত, আবার সেই পানের ছিবড়ে মায়ের মুখ থেকে নিয়ে আমিও প্রসাদ পেতাম। মেঝেতে মাদুর পেতে আমাকে পাশে নিয়ে শুত মা। আর ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য প্রতিদিন হয়তো ‘চয়নিকা’, ‘মহুয়া’ বা ‘বলাকা’ থেকে কবিতা পড়ে শোনাত। কী মোহময় সেইসব পঙ্‌ক্তি! আমি যে তার অর্থ বুঝতে পারতাম, এমন নয়। তবু সেইসব দুপুরে রবীন্দ্রনাথ আমাকে যে কোথায় কোন অচিনপুরে নিয়ে যেতেন, তা কী করে বলি! কিন্ত ওই আশ্চর্য সম্মোহন আমাকে ঘুমও পাড়িয়ে দিত। মায়ের মুখে শোনা সেইসব পঙ্‌ক্তিনিচয় পরে আর না পড়েও আমার আজও মুখস্থ আছে। আর এই কারণেই বুঝি আজও কবিতার ওপর আমার এত নিবিড় টান! কবিতা লিখতে পারি না বলে আজও আমার গভীর দুঃখ। পরবর্তীকালে আমার মাথাটা আরও চিবিয়ে খেয়েছেন জীবনানন্দ আর এলিয়ট।

    মায়ের মুখে শোনা সেইসব পঙ্‌ক্তিনিচয় পরে আর না পড়েও আমার আজও মুখস্থ আছে।

    কলকাতায় একদিন আমার বমা অর্থাৎ জেঠিমা এসে হাজির। ময়মনসিংহে এই বমার সীমাহীন প্রশ্রয় পেয়েছি, কাজেই বমাকে পেয়ে আমার আনন্দ আর ধরে না। আমাকে পেয়ে বমাও ভারি খুশি। আমার দুষ্টুমির নানা কাহিনি আমাদের পরিবারে প্রচলিত ছিল। আমার মতো দুষ্টু নাকি বড় একটা দেখা যায় না! তারই একটা ঘটনা বমা আসার পর ঘটল। সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে বমা আমাদের ঘরের লাগোয়া ছাদে (ওপেন টেরাস) মাদুর পেতে শুয়েছেন। গভীর ঘুম। আমার মনে কী হল কে জানে! ঘরে একটা ভাঁড়ে রসগোল্লার রস রাখা ছিল, আমি নির্বিকারচিত্তে ভাঁড়টা নিয়ে বমার ডান কানে পুরো রসটা ঢেলে দিলাম। বমা চেঁচিয়ে উঠলেন, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মা আমার দিকে তেড়ে এল পাখার বাঁট নিয়ে, ওই বমাই আটকালেন মা-কে। কানে ন্যাকড়া ঢুকিয়ে পরিষ্কার করা হল। কিন্ত অস্বস্তি রয়েই গেল। ওই ডান কানটায় বমা পরবর্তী জীবনে একটু কম শুনতেন। 

    সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে বমা আমাদের ঘরের লাগোয়া ছাদে (ওপেন টেরাস) মাদুর পেতে শুয়েছেন। গভীর ঘুম। আমার মনে কী হল কে জানে! ঘরে একটা ভাঁড়ে রসগোল্লার রস রাখা ছিল, আমি নির্বিকারচিত্তে ভাঁড়টা নিয়ে বমার ডান কানে পুরো রসটা ঢেলে দিলাম। বমা চেঁচিয়ে উঠলেন, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মা আমার দিকে তেড়ে এল পাখার বাঁট নিয়ে, ওই বমাই আটকালেন মা-কে।

    কাছেই সতীশ মুখার্জি রোডে আমার বড় পিসিমার বাসা। পিসেমশাই সুধন্যমোহন জার্ডিন মেনজিস কোম্পানির ওভারসিয়ার। অতিশয় সৎ এবং ভালমানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ফর্সা, রোগা, কটা চোখের এই মানুষটিকে আমার খুব পছন্দ। ধুতি আর শার্ট পরে তিনি সাইকেলে চেপে বিভিন্ন সাইটে যেতেন। আমরা প্রায়ই বড় পিসিমার বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার চারজন পিসি, আর আমি এই চারজন পিসিরই আগ্রাসী স্নেহ আর প্রশ্রয় পেয়ে বড় হয়েছি। এখনও মনে হয়, যাদের পিসি নেই তারা বড্ড দুর্ভাগা। আমার কাঠবাঙাল পিসিদের কাছে আমি মায়ের মতোই স্নেহ পেয়েছি। আর এই বড় পিসির সতীশ মুখার্জি রোডের আস্তানাটা ছিল আমাদের দেশের বাড়ির যতেক আত্মীয়স্বজনের কলকাতার গেস্ট হাউস। কারণ, তখন যে-ই কলকাতায় আসত, সে-ই নিশ্চিন্তে সতীশ মুখার্জি রোডে বড় পিসির বাসায় হাজির হয়ে যেত। মাত্র দুখানা ঘরের সেই বাসাতে এঁটেও যেত সবাই। একদম শেষদিকে ছাড়া সেই বাসাটি আমি অতিথিশূন্য কদাচিৎ দেখেছি। পিসির দুই ছেলে। বড়জন মণিময় একজন বিষয়বুদ্ধিহীন আার্টিস্ট, আঁকতেন চমৎকার কিন্ত পয়সা রোজগার করতে পারতেন না, লোকে বেগার খাটিয়ে নিত। একটু মাথার দোষও ছিল। ছোটজন শুভময়, ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ সমর্থক ছিলেন আর একটু-আধটু লেখালেখি করতেন। পরীক্ষাভীতির জন্য মাধ্যমিকটাও ডিঙোতে পারেননি। কার্যত এই দুই দাদাই আজীবন বেকার ছিলেন। এই দুই দাদার সঙ্গে আমার বেশ সদ্ভাব ছিল। আর পিসেমশাই ছিলেন স্নেহপরায়ণ, অতিথিবৎসল মানুষ। রোজ লেক মার্কেট থেকে বাজার করতেন। বাজারের সেরা মাছ, সেরা সব্জি, সেরা ফলপাকড় নিয়ে আসতেন। অর্থব্যয়ে কোনও কার্পণ্য ছিল না। 

    মনোহরপুকুর থেকে সতীশ মুখার্জির দূরত্ব হাঁটাপথে বড়জোর মিনিট আট-দশ। কখনও মায়ের সঙ্গে, দাদু কলকাতায় এলে দাদুর সঙ্গে আমি আর দিদি টুকটুক করে হেঁটে রাস্তাটা পেরোতুম। পিসি কিছু-না-কিছু খেতে দেবেই। আর সেটাই ছিল এই পেটুকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। 

    ওদিকে বর্মা থেকে উদ্বেগজনক খবর আসছে। জাপানি বোমায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি। আমার ছোটপিসি আর পিসেমশাই থাকেন টাউনজি শহরে। সেখানে পিসেমশাই বিশাল বাংলোবাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন। খুব ভাল প্র্যাকটিস। সুখের শেষ নেই। বর্মার পোটেনশিয়ালিটি দেখে তিনি তাঁর নিকট কয়েকজন আত্মীয়কেও সেখানে নিয়ে গিয়ে বসতি করিয়েছেন। তার মধ্যেই এই যুদ্ধজনিত বিপত্তি। তবু বর্মা ছাড়ার ইচ্ছে ছিল না তাঁদের। আর তাঁদের জন্য আমাদের পরিবারে তখন ব্যাপক উদ্বেগ।

    কলকাতাও তখন নিরাপদ জায়গা নয়। শুনতাম, অনেকেই নাকি বেমার ভয়ে কলকাতা থেকে গাঁ-গঞ্জে পালাচ্ছে। কারণ জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলেছে এবং আরও ফেলবে। বর্মা ভেদ করে তারা এল বলে। 

    তখন মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে এসপ্ল্যানেড যাই। লিফটে চড়ি। আর রাস্তাঘাটে বিস্তর লালমুখো সাহেব-মেম দেখতে পাই। তখন চৌরঙ্গী চত্বরটা ছিল ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন, বিশাল বিশাল গাছ আর সবুজ ঘাসের জমি ছিল বিস্তর। কার্জন পার্কের পরিধি ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। রাস্তায় ধুলোময়লার বালাই ছিল না। এসপ্ল্যানেডে গেলেই মন ভাল হয়ে যেত। ওই চৌরঙ্গীর চওড়া ফুটপাথ ধরে একজন মোটাসোটা সাহেবকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম, যার সঙ্গে ছিল দুটো শেকলে বাঁধা প্রকাণ্ড কুকুর। কুকুর যে এত বড় হয় তার ধারণাই আমার ছিল না। পরে জেনেছিলাম ওগুলো ম্যাস্টিফ কুকুর। খুব ইচ্ছে হয়েছিল, বড় হয়ে একটা ম্যাস্টিফ কুকুর পুষব।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook