লক্ষ্মীপুজো ও পাকশালার পাঁচালি
দুর্গাপুজোর বাদ্যিবাজনা শেষ, এক কালান্তক অতিমারীর মধ্যেই আমরা হর্ষ ও বিষাদের এক দোলাচলে দুলতে দুলতে দেবীর আরাধনা করে নিলাম কয়েকদিন। বিজয়া দশমী সমাপ্ত, সব না হলেও অনেক প্যান্ডেল ইতিমধ্যেই ফাঁকা, যদিও খুলে ফেলা হয়নি, কারণ শুক্লপক্ষের সমাপ্তি ঘটবে কোজাগরী পূর্ণিমায়, একটি নিরভিমান লক্ষ্মীপ্রতিমার বন্দনা করে। বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেলে মঙ্গলদাত্রী সেই দেবীর পুজো হবে খানিকটা নমো নমো করেই, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ লক্ষ্মীপুজো আদতে সাড়ম্বর বারোয়ারি পুজো নয়, গৃহস্থের ঘরের অন্দরেই এই দেবীর অধিষ্ঠান, পুজোর উপচারও তাই ঘরোয়া অনুষঙ্গে পরিপূর্ণ। সাড়ম্বর দুর্গাপুজো করার সাধ্য খুব কম পরিবারেরই থাকে, কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর ‘উৎসব’ প্রায় সব বাড়িতেই, সে যেন প্রতি বৃহস্পতিবার সুর করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে দেবীকে ঘরের মধ্যে পুজো করারই এক প্রসারণ। তবে বাঙালি গার্হস্থ্যের অনুষঙ্গে লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখা মুশকিল, মনে রাখতে হবে যে ফাস্ট ফুড চেন বার্গার কিং কয়েক বছর আগে স্পেনে তাদের গাবদা সাইজের হ্যামবার্গার ‘হপার’ (Whopper)-এর বিজ্ঞাপনে লক্ষ্মীর ছবি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল ‘La merienda es sagrada’— এ হল পবিত্র খাবার। আমার মতো ‘নিষিদ্ধ’ খাবারে আসক্ত পাষণ্ডের পক্ষে হয়তো এই বিজ্ঞাপন অর্থবহ, কিন্তু বার্গার কিংকে এর জন্য কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। সে অবশ্য অন্য গল্প।
আটপৌরে গৃহস্থজীবনের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনের জন্যই হয়তো, দুর্গাপুজোর সঙ্গে ‘পুজোর বাজার’-এর যে সম্পর্ক বা অনুষঙ্গ, লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে তার থেকে অন্য রকম, সেখানে সাধ্যমতো উপচার জোগাড় করে পুজোর আয়োজন করেন সাধারণ মানুষ। পূর্ববঙ্গের বরিশালে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটানো আমার পিতামহের একটি অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায় পড়ি যে, উনিশ শতকের শেষে তাঁর গ্রামে সব শ্রেণির লোক, এমনকী অনেক মুসলমানও লক্ষ্মীর পুজো করতেন। অনুমান করি যে, অশুভের অসুর-দলনী মা দুর্গার তুলনায়, সামান্য সম্পদ অর্জনের প্রত্যাশী মানুষের কাছে মা লক্ষ্মীর আবেদন জাতিধর্মবর্ণের ভেদাভেদ অতিক্রম করেছিল। এখনও লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন থেকেই সাধারণ মানুষের ভিড় বাজারে জমে ওঠে শহর-গ্রাম সর্বত্রই— লক্ষ্মীপ্রতিমা, মাটির সরায় আঁকা লক্ষ্মীমূর্তি, ঘট, প্রদীপ, পদ্মফুল থেকে শুরু করে ভোগ-প্রসাদের নানান উপকরণ কেনার জন্য। সেই ট্র্যাডিশন এখনও সমানে চলেছে। তবু, সেই সর্বজনপূজিতা দেবীর উপাসনার উপচারেও বাংলার অঞ্চল ও সমাজভেদে নানান পার্থক্য ছিল, এখন যেগুলি প্রায় চোখেই পড়ে না।
অনেকে হয়তো জানেন না যে, কালীপুজোর সিজনে যতই আমরা সকাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি দিওয়ালি’ বার্তা আদান-প্রদান করি না কেন, বাংলা ছাড়া ভারতের সর্বত্রই দীপাবলি আসলে লক্ষ্মীরই উপাসনার উপলক্ষ। এই বঙ্গদেশেরও বিভিন্ন জায়গায় কালীপুজোর দিন লক্ষ্মীপুজো, এবং লক্ষ্মীপুজোর দিন মহাকালীর আরাধনার প্রথা আছে— এমনকী খোদ কালীঘাটের মন্দিরেই দীপান্বিতা অমাবস্যার সন্ধ্যায় অলক্ষ্মী বিদায়ের পর দক্ষিণা কালী মহালক্ষ্মী রূপে পূজিতা হন। এইসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলায় সাধারণত আশ্বিনের পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো, যে-সময়ে গ্রামের গোলাঘরে উঠেছে হেমন্তের ধান। লক্ষ্মীও অন্নেরই দেবী, কথিত আছে ‘অলক্ষ্মী’ আস্তানা গাড়েন যে গৃহে, সেখানে দু’বেলা হাঁড়ি চড়ে না। অন্ন, অর্থাৎ ধানের বিভিন্ন প্রকরণ তাই লক্ষ্মীপুজোর উপচারে নানা রূপে হাজির— ভেজা আতপ চাল, খিচুড়ি আর পায়েসের গোবিন্দভোগ, খই, মুড়ি, চালগুঁড়ো, ইত্যাদি যার সাক্ষ্য দেয়। স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ বইটিতে গ্রামবাংলায় লক্ষ্মীপুজোর উপচারের নানান ‘অনার্য’ অনুষঙ্গের— যেমন শুয়োরের দাঁত (অনেক জায়গায় যা পুজোর ফলমূল রাখার পাদানি হিসেবে ব্যবহৃত হত), মড়ার খুলির আদলে কুবেরের মাথা, প্যাঁচা, ইত্যাদি— সঙ্গে পেরুর ইনকাদের শস্যের দেবী ‘মামা সারা’-কে ভুট্টার ছড়া দিয়ে পুজো করার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে এই নানান, অনেক সময় আপাত-বিপরীত, রীতির মিলমিশ চোখে পড়ার মতো।
সেই বৈচিত্র্য প্রসাদের আয়োজন আর ভোগ রান্নাতেও দৃশ্যমান। অলক্ষ্মীর বিদায় যেমন বাড়ির বাইরেই করতে হয়, আলপনায় লক্ষ্মীর পা যেমন সবসময় গৃহাভিমুখী করেই আঁকতে হয়, তেমনই বাঙালিরা ঐতিহাসিক ভাবে অন্নের দেবীর পুজোর দিনটিতে ভাত বা খিচুড়ি খেতেন না। প্রসাদী ফল, মিষ্টি, আর লুচি-ভোগের মাধ্যমেই দিনটি উদযাপিত হত। সন্ধেবেলায় অনেক লোক খই আর দইয়ের ফলার দিয়েই নৈশাহার সেরে নিতেন, আর তার পর কিমাশ্চর্যম, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পল্লী চিত্র’-এ পড়ি যে, গ্রামেগঞ্জে যুবক-বৃদ্ধ সারা রাত কাটিয়ে দিতেন তাস-পাশা-দাবা খেলায়, নিশাচরী কোজাগরী (অর্থাৎ, ‘কে জেগে আছ? ’) লক্ষ্মীদেবীর কৃপা যাতে ফসকে না যায়!
প্রায় স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময় পর্যন্ত খিচুড়ি দিয়ে অন্নভোগ পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণগৃহেই সীমাবদ্ধ ছিল, কালক্রমে এই ‘অন্নভোগের অধিকার’ বর্ণাশ্রমের ভেদরেখা অতিক্রম করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে এখন গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডালের খিচুড়ি, সাধ্যে কুলোলে পাঁচ রকম ভাজা, আর না কুলোলে অন্তত বেগুনভাজা, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, লাবড়ার মধ্যে অন্তত দুটো, আর চাটনি-পায়েস তো প্রায় ‘সেট মেনু’। রকমভেদে কোথাও কোথাও, বিশেষত সন্ধেবেলা, পশ্চিমবঙ্গীয় গৃহে ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল, আর সুজির হালুয়াও পাতে পড়ত, এখনও পড়ে। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে অনেক বাড়িতেই অন্তত পাঁচ রকম ভাজার জন্য আসে আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো, কাঁকরোল, এবং— প্রায়শই— মরসুমের প্রথম ফুলকপি আর মটরশুঁটি। পুজোর প্রসাদের আয়োজনে যে কালের প্রবাহ খুব বেশি ছাপ ফেলতে পেরেছে তা নয়, তার জন্য চাই আখ ছাড়া আরও অন্তত পাঁচ-ছ’রকম ফল, গুড়, খই, কদমা, মঠ, আর সর্বোপরি নারকোল। সাদা আর লাল, দু’রকম নারকোল নাড়ুই তো লক্ষ্মীপুজোর সিগনেচার টিউন, তার সঙ্গে সঙ্গত করে মিহি করে পেষা নারকোল আর এলাচগুঁড়ো মিশিয়ে নানা ছাঁচে ফেলে গঙ্গাজলী, ক্ষীরের ছাঁচ আর নারকোল পাক দিয়ে তৈরি ক্ষীরের সন্দেশ, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, চিঁড়ের মোয়া, খইয়ের মুড়কি, সিন্নি। বিরল ক্ষেত্রে আরও স্পেশ্যালাইজড সব মিষ্টি বানান অনেকে, যেমন আতপ চাল আর খই মিশিয়ে মণ্ড করে ‘ফালার নাড়ু’, বা শুকনো খোলায় খই রোস্ট করে শিলে (এখন গ্রাইন্ডারে) পিষে নারকোল, গুড়, ইত্যাদি মিশিয়ে ‘উখড়া’, যা নাকি— রানী চন্দের স্মৃতিকথা ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’-তে পড়েছি— অলোকসামান্য হয়ে উঠত পরিবারের জ্যেষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠা পাচিকাদের হাতে সামান্য কর্পূরের সংযোগে। আজ দেখা যাচ্ছে প্রসাদ ও ভোগের ব্যাপারে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, মিষ্টি বানানোর ব্যাপারে লক্ষ্মীপুজোর বিশেষত্ব এখনও অমলিন।
দেশভাগের পর দলে দলে যে শরণার্থীরা এক ধ্বস্ত জীবন নতুন ভাবে শুরু করার প্রয়াসে এ দিকে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে লক্ষ্মীপুজোর ব্যঞ্জনা ছিল অন্যরকম, ফেলে-আসা ‘দেশ’ ও গ্রামের জীবন দু’দিনের জন্য এই পুজোর মাধ্যমে আবার মূর্ত হয়ে উঠত। পশ্চিমবঙ্গে সম্বৎসর অন্যান্য সময়েও লক্ষ্মীপুজোর চল ছিল, কিন্তু পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষগুলিই কোজাগরী পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীপুজোকে ব্যাপক প্রতিষ্ঠা দিলেন, খুব সম্ভবত পুজোর আঙিনায় সুন্দর করে আলপনা দেওয়ার প্রথাও তাঁরাই প্রচলন করেন। প্রায় দু’দশক ধরে ‘বাঙাল’-বিদ্বেষ পশ্চিমবঙ্গীয়দের মধ্যে কাজ করত, সহজে তাঁরা শরণার্থী পরিবারগুলিকে বাড়িভাড়াও দিতে চাইতেন না, আর এর বিপরীতে সম্পদের দেবীর পুজোর দিনটির উদযাপনের মাধ্যমে সর্বহারা মানুষগুলি তাঁদের অতীত সত্তাকে আঁকড়ে ধরে চাইতেন। তাঁদের লক্ষ্মীপুজোর ভোগের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল লপসি স্টাইলের নয়, বরং জল শুকিয়ে ঝরঝরে পোলাও স্টাইলের মশলাদার ভুনা বা ভুনি খিচুড়ি, পূর্ববঙ্গের রন্ধনশৈলীর সঙ্গে যার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
আর পূর্ববঙ্গের কথাই উঠল যখন, তখন লক্ষ্মীপুজোর মধ্যেও যে একটু আঁশটে গন্ধ এসে পড়বে, তাতে আর আশ্চর্য কী? পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে লক্ষ্মীপুজোর ভোগে ইলিশ মাছ দেওয়ার রীতি ছিল বহুল প্রচলিত। বস্তুত, মাছের ব্যঞ্জন ছাড়া পুজো হত অসম্পূর্ণ। সাধ্যে কুলোলে জোড়া ইলিশ, আর রেস্তয় টান থাকলে সবেধন একটি ইলিশ মাছের সঙ্গে একটি বেগুনকে স্যাঙাৎ হিসেবে জুড়ে দেওয়া হত। ভোগের ইলিশে কালোজিরে কাঁচা লঙ্কার সঙ্গে সাধারণত বেগুনের রাজযোটক। পূর্ববঙ্গের কোথাও কোথাও বিজয়া দশমী, আর কোথাও লক্ষ্মীপুজোর দিন সিজনের শেষ ইলিশ ভক্ষণ, তার পর কয়েকমাসব্যাপী ইলিশ-উপবাসের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি আবার সরস্বতী পুজোর দিন। এখানেই শেষ নয়, আমার পিতামহের স্মৃতিকথাটিতে পড়েছি যে অনেকেই লক্ষ্মীপুজোয় এমনকী পাঁঠাবলিও দিতেন, পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া আদা-জিরেবাটা দিয়ে যজ্ঞিবাড়ি স্টাইলে রান্না হত সেই ভোগের মাংস।
এসব রীতিনীতির তারতম্য আজকাল উঠেই গেছে বলা চলে, প্রসাদ আর ভোগে একটা জেনেরিক ব্যাপার এসেছে। আজকের ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এ লক্ষ্মীর প্রসাদের (কৃপা অর্থে) গণতন্ত্রীকরণ খুব একটা দেখা যায় না, তবে উপচারের এক গণতন্ত্রীকরণ প্রায় সর্বত্র দৃশ্যমান। সেখানে আমাদের ভোগের খিচুড়ি রান্নার লাইভ ব্লগিং-এর হিড়িকে ঢাকা পড়ে যায় সেই সব মানুষদের বিড়ম্বনা, যাঁদের ছন্নছাড়া সংসারে অলক্ষ্মীরই অধিষ্ঠান। লক্ষ্মীপুজোর সনাতন প্রথা প্রতিবেশী ও আতুরজনের সাথে প্রসাদ ও ভোগ ভাগ করে নেওয়া, সেই প্রথা মেনে দুঃস্থের পাশে থাকাই কি হতে পারে না আমাদের এবারের লক্ষ্মীপুজোর ব্রত? এই ধ্বস্ত, বিক্ষত পৃথিবীতে এ-ই হোক সেই মন্ত্র, সেই ‘ব্রতকথা’, যা কিনা ‘যেবা পড়ে যেবা রাখে ঘরে / লক্ষ্মীর কৃপায় তার মনোবাঞ্ছা পুরে’। অভিনেত্রী সালমা হায়েক তাঁর অন্তরের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যটিকে সম্যক অনুধাবন করার জন্য আমাদের লক্ষ্মীকে স্মরণ করেছিলেন। আমরা তবে পিছিয়ে থাকব কেন?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র