প্রিয় মোহনদাসজি, আপনাকে নিয়ে বিশেষ কিছু লিখতেই সঙ্কোচ বোধ করি। আসলে এত মানুষ আপনার বিষয়ে এত কিছু লিখেছেন, এত সিনেমা-নাটক-যাত্রা বানিয়েছেন, এমনকী ভারতবর্ষে প্রত্যেকটি মানুষকে দিনে অন্তত একবার যেভাবে আপনার মুখটি দেখতে হয় দশ-কুড়ি-পঞ্চাশ-পাঁচশো টাকার নোটের কাগজে— নতুন করে আপনাকে নিয়ে আর কীই বা বলার আছে? তবু আপনাকে নিয়ে এই সর্বজনীন আগ্রহের কথা ভেবেই একটু কৌতূহল হয়, আজকের ভারতবর্ষে আপনি ঠিক কী রূপে আর কেনই বা এত প্রাসঙ্গিক! দলমতনির্বিশেষে আপনাকে নিয়ে যেভাবে উৎসব করা যায়, কই আর কাউকে নিয়ে তো সেভাবে করতে দেখি না! আপনার এই জনপ্রিয়তার উৎসটি ঠিক কোথায়?
সোশ্যাল মিডিয়া বলে একটি জিনিস আধুনিক দুনিয়ায় হাজির হয়েছে, মোহনদাসজি। ভাগ্যিস আপনি ওই প্ল্যাটফর্মে নেই! থাকলে দেখতে পেতেন, জনসাধারণের মধ্যে (ঐতিহাসিক বা গবেষকদের ছেড়ে দিলাম, তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় নেহাতই এলেবেলে) আপনাকে নিয়ে মূলত দুটি মেরুতে আলোচনা চলে। এক পক্ষের কাছে আপনি ঈশ্বর, আপনার মূর্তিতে, আপনার ছবিতে নিয়ম করে ধূপ-ধুনো-ফুল-বেলপাতা চড়িয়েই তাদের প্রণামি জোটে। অপর পক্ষের কাছে আপনি বিরাগভাজন, আপনার বিরূদ্ধে তাঁদের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে— দেশভাগ আপনার জন্যই হয়েছিল, ভগৎ সিংহকে আপনি ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাননি, সুভাষচন্দ্র বসুকে আপনি যোগ্য মর্যাদা দেননি ইত্যাদি। আপনি না থাকলে ভারত-পাকিস্তান আজ এক হত, পার্টিশন হত না, ইমরান খান আর নরেন্দ্র মোদি হাতে হাত রেখে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের সমাধান করে ফেলতেন, এই আর কি!
এই দুই পক্ষের দ্বন্দযুদ্ধের মধ্যে আপনাকে ঠিকমতো আজকাল খুঁজে পাওয়া মুশকিল, মোহনদাসজি। আপনাকে ‘মহাত্মা’ বলে সম্বোধন করতে হয়, ভারতবর্ষের জাতির জনক আপনি— এসব আমরা সবাই স্কুলে পড়েছি। এও শুনেছি, ভারতের অন্তরাত্মাকে আপনি যেভাবে চিনতে পেরেছিলেন, আর কেউ তা পারেননি। আর পারেননি বলেই আপনার মতো করে একটি গোটা দেশকে একতার সূত্রে বাঁধতে সক্ষম হননি।
কিন্তু কোন ভারত? কোন অন্তরাত্মা? কোন জাতির জনক আপনি? মোহনদাসজি, ভারতবর্ষ যে ঠিক একটি দেশ নয়, একাধিক ভাষা-ধর্ম-শ্রেণি-জাতিকে কোনওমতে খিচুড়ি বানিয়ে রাখা একটি যুক্তরাষ্ট্র, এ কথা স্বাধীনতার সাত দশক পরে বেশ বোঝা যায়। অতএব এই এতগুলো ভারতবর্ষের মধ্যে ঠিক কোন ভারতের অন্তরাত্মা নিয়ে আপনার কারবার ছিল, সে প্রশ্ন তুললে আশা করছি আপনি রাগ করবেন না।
আপনার মতাদর্শে যে অন্তরাত্মাকে আপনি বারবার তুলে ধরতে চেয়েছেন, তার প্রকৃত রূপ সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্ট চিনেছিলেন একজন মানুষ। আপনার সাথে তাঁর হামেশাই ঝগড়া লাগত। তাঁর নাম ভীমরাও আম্বেদকর।
আম্বেদকরের সঙ্গে আপনার তর্ক বহুদিন গড়িয়েছিল, দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক থেকে স্বাধীন ভারতের সংবিধান লেখা পর্যন্ত নানা জায়গাতেই এই কলহের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এই তর্কের মূলে ছিল সমাজের ব্যাপারে আপনাদের মতের অমিল। আম্বেদকর চেয়েছিলেন, আইনের সাহায্যে, প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করেই, একটি সভ্য রাষ্ট্রের সরকার ধর্ম বা অন্ধবিশ্বাসের জায়গায় হস্তক্ষেপ করুক, এবং ধর্ম বা জাতপাতের নামে কোনওরকম বর্বরতা বা অন্যায় দেখলে কড়া ব্যবস্থা নিক। আম্বেদকরের এই মতামত শুনে আপনি গেলেন বেজায় চটে— ভারতবর্ষের ধর্ম কি ছেলেমানুষ, যে প্রয়োজনে তার কান মলে তাকে শায়েস্তা করতে হবে? কভি নেহি! আপনি বললেন, অন্ধবিশ্বাস বা ধর্মের নামে যতই উপদ্রব করা হোক, বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করে তাকে আটকানোর অধিকার কোনও সেকুলার (ধর্মবহির্ভূত) বা উদারপন্থী শক্তির নেই। যেসব কুপ্রথা ধর্মের নামে ভারতে প্রচলিত রয়েছে, ধর্মাচরণের ভিতর থেকে ধার্মিকদের হাত ধরেই তার অবসান আসুক। আসলে আপনি বিশ্বাস করতেন ভারতীয় সমাজ মূলত ধর্মপ্রধান সমাজ। অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, আপনি সত্যিই ভাবতেন বেঁধে দেওয়া কোনও আইন-কানুনের চেয়েও ভারতের সমাজকে ঢের বেশি করে বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষের দৈনন্দিন ধার্মিক আচার-ব্যবহার।
কিন্তু কোন ধর্ম, মোহনদাসজি? পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই যে আদতে সামন্ততান্ত্রিক হয়ে ওঠে, এবং ধর্মের আচার-ব্যবহারের জুজু দেখিয়ে ছোটয়-বড়য় ফারাক গড়ে দেয়, তা কি আপনি জানতেন না? দারিদ্র্যকে অবিনশ্বর ধরে নিয়ে তাকে সর্বত্যাগী মাহাত্ম্যের রূপ দেওয়ায় আপনার যে আগ্রহ, গরিব মানুষের দুঃখমোচনের চেয়েও তাদের ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’-র মন্ত্র শেখানোর যে ইচ্ছে, তা কি আদতে একটু হলেও এই সামন্ততন্ত্রকে মেনে নিয়ে তার উপর মলম লাগানোর প্রেসক্রিপশন ছিল না?
আম্বেদকর এ বিষয়ে আপনার বিরূদ্ধে বেশ গুরুতর অভিযোগ রেখে গিয়েছেন। আপনার রাজনীতির সমালোচনা করে তিনি লিখছেন, ‘গান্ধীবাদ সাধারণ মানুষকে শেখায়, সারাজীবন পরিশ্রম করে যাও, হীন হয়ে থাকো। গান্ধীবাদ যে বলে, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাও, তা আসলে এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে ডাক পাঠায়— নগ্নতায় ফিরে যাও, অজ্ঞতায় ফিরে যাও, দরিদ্র-নিপীড়িত হয়ে থাকো। রাজায়-প্রজায় যে শ্রেণির বৈষম্য, গান্ধীর রাজনীতি তাকে আকস্মিক বলে মনে করে না, বরং তাকে নিজের মূলমন্ত্র মনে করে।’
মোহনদাসজি, আপনি জনহিতের লক্ষ্যে রাজনীতি করেননি, এ অভিযোগ অতি বড় গান্ধীবিরোধীও করবেন না। তবে ভারতের ধার্মিক অন্তরাত্মার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধায় কোথাও একটা হয়তো আপনার বিশ্বাস ছিল— ভারতের সমাজে যে বৈষম্য, যে বিভেদ, তার মূলে রয়েছে ধর্মের আচরণে বিকৃতি, বা কিছু লোভী, মতলবি ধর্মগুরুদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মশাস্ত্রের অপব্যবহার। ধার্মিক আচার-ব্যবহারের মূলেই যে গলদ থাকতে পারে, তা আপনি স্পষ্টত কোনওদিন স্বীকার করতে চাননি। একাধিকবার এর প্রমাণ পাওয়া যায় ধর্মের নামে উপদ্রবের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়ায়। আপনার মতাদর্শ ছিল, ভারতের অন্তরাত্মা সনাতন এবং অবিনশ্বর, ধর্মের রূপেই তাকে চিনতে হবে। অথচ ধর্মীয় আচার-ব্যবহারের থেকেই যখন উপদ্রব উপস্থিত হয়েছে, আপনি ‘ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার, এই ব্যবহার উচিত নয়’ বলেই খানিক পাশ কাটিয়ে কঁহা কঁহা মুল্লুকে চলে গিয়েছেন।
কী জানেন মোহনদাসজি, উপদ্রবের মূলে যে মানুষের ইতিহাসবিস্মৃতি নয়, ইতিহাস নিজেই থাকতে পারে, সে বিষয়ে আপনাকে লিওনেল মেসির তৎপরতায় ড্রিবল করতে দেখা যায়। দলিত সমাজকে ওই নামে না ডেকে (কারণ তাতে দলিত-নিপীড়িত হবার ইতিহাসটি চোখে পড়ে), তাঁদের সংরক্ষণের অধিকারের বিরোধিতা করে ‘হরিজন’-এর মতো একটি ছেলেভোলানো নামে তাদের গ্লোরিফাই করায় এই ড্রিবলিং বেশ ধরা পড়ে যে!
আপনার এই মূল্যায়ন সঠিক ছিল কি না, নাস্তিকতা বা সেকুলারিজমের মাপকাঠি দিয়ে আপনার রাজনীতিকে বিচার করাটা কতদূর কার্যকরী— এ সব তর্কবিতর্ক কোনওদিন শেষ হবার নয়। কিন্তু আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থী থেকে দক্ষিণপন্থী সমস্ত শিবিরের বৃহদাংশের কাছে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা, তার মূলে হয়তো রয়েছে আপনার এই মতাদর্শটিই। কারণ মানুষের নিপীড়নের মূলে আছে ক্ষমতার অপব্যবহার, খোদ ক্ষমতার সিস্টেমটির কোনও দোষ নেই— এই মতবাদ একেবারে হুবহু মিলে যায় আধুনিক নিওলিবেরাল রাজনীতির সাথে। যে নিওলিবেরাল রাজনীতি ভারতে শুধু দক্ষিণপন্থী রাজনীতি নয়, একাধারে সুবিধাবাদী ‘নির্দল/অরাজনৈতিক’ মধ্যপন্থীদের পিঠ বাঁচানোর অস্ত্র এবং বামপন্থী রাজনীতিকে আত্মসাৎ করে নেবার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মোটামুটি নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই।
হিন্দুত্ববাদীদের সাথে আপনার কোনওদিনই বনেনি, মোহনদাসজি। এমনকী হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী নাথুরাম গডসের হাতেই আপনাকে খুন হতে হয়, কারণ সে আপনাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু যে হিন্দুত্ববাদ ভবিষ্যতে বাবরি মসজিদ ভাঙা সন্ত্রাসবাদী রূপ ত্যাগ করে নতুন জগতে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে ‘একমাত্র সনাতন ধর্মই সহনশীল’ মন্ত্রে নিজেকে নিরপেক্ষতার রূপ দেবে, সে যে ধার্মিক আচারের সনাতনত্বে আপনার এই বিশ্বাসকে একদিন ব্যবহার করে নিতে পারবে, তা কি আপনি আঁচ করতে পারেননি, মোহনদাসজি? হিন্দুত্ববাদ খাতায়-কলমে সেকুলার ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র এখনও ঘোষণা করতে পারেনি বটে, তবে ভারতের ভদ্রসমাজের সাংস্কৃতিক গঠনে সে ধর্মীয় আচরণকে একটু পরিশীলিত করে ‘শালীনতা/ভদ্রতা/সাত্ত্বিকতা’ ইত্যাদির রূপে ‘কমন সেন্স’ সাজিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশির মতে ‘কমন সেন্স’ কথাটির অর্থ কেবল কাণ্ডজ্ঞান নয়, এর মানে যে মতাদর্শকে আমরা ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সনাতন’ বলে ধরে নিই।
ঠিক যেমন আপনি ধরে নিয়েছিলেন, ভারতবর্ষের অন্তরাত্মা আসলে ধর্মকেন্দ্রিক, সেই ধর্মের হায়ারার্কি-জাত নানা বৈষম্যকে বড়জোর সান্ত্বনা দেওয়া যায়, দূর করা যায় না। আসলে, আপনার এই মতাদর্শটি খুব সুবিধের, খুব নিরাপদ। ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায় এ মতাদর্শের ব্যবহারে নিজেদের রক্ষণশীল এবং সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবকে পূর্ণমাত্রায় টিকিয়ে রাখতে পারেন, আবার এই রক্ষণশীলতার মূলে ধর্মের মাছ থাকলেও উপরে উপরে ধার্মিক তকমার আঁশের গন্ধটি না থাকায় প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধবদের কাছে গোঁড়ামির অপরাধে গালাগালিও খেতে হয় না। এই নিওলিবেরাল মধ্যপন্থার স্বর্গে যে আপনি সাদরে গ্রহণযোগ্য হয়ে রয়েছেন, এ আর আশ্চর্যের কী?
উঠি, মোহনদাসজি। আজ আপনার জন্মদিন, আরাম করে যে দু’পাত্তর বিয়ার খাওয়া যাবে তারও জো নেই। আপনার জন্মদিনে ড্রাই ডে, মদ্যপান নিষিদ্ধ করে আপনাকে ‘সম্মান’ জানানোর তলায় তলায় ‘সাত্ত্বিকতা’র যে আরোপিত ধর্মীয় ফতোয়া, তা কিন্তু কেউ স্বীকার করবেন না। বলবেন, আজ তো স্রেফ ড্রাই ডে, এর কোনও ধর্মীয় কারণ নেই, নেহাতই শালীনতার ব্যাপার। কী আশ্চর্য মোহনদাসজি, ঠিক কার বিচারে, কোন মতাদর্শের নিরিখে মদ্যপান এবং অশালীনতা ইক্যুয়েটেড হয়ে গেল, সে কথা কিন্তু আপনার জন্মদিনে ভুলেও কেউ তুলবেন না। পাছে নিওলিবেরাল শাকের তলায় ঢাকা ধর্মতান্ত্রিক মাছ বেরিয়ে পড়ে!
কভারের ছবি সৌজন্যে: www.gandhi.gov.in