সত্যজিৎ রায় কখনও ‘প্রাক্তন ফিল্মমেকার’ হননি, জীবনের একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের সৃষ্টির জগতে ডুবে ছিলেন, এমনকী অসুস্থ শরীরেও। তার চেয়ে বড় কথা, তাঁর লেখালিখি ও সিনেমার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর ভেতরটা একেবারে ছটফটে নবীন। যিনি খুব কৌতূহলী— যেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন, যে অভিজ্ঞতা লাভ করছেন, সমস্তটায় বিভোর হয়ে থাকছেন।
আমি নিজে একজন ফিল্মমেকার বলেই, ফিল্মের প্রতি সত্যজিতের নিবেদন এবং কঠোর শৃঙ্খলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। সম্প্রতি একটা বিবিসি-র তথ্যচিত্র দেখলাম, যা সত্যজিতের একটি ছবির প্রস্তুতিপর্ব এবং তারপর শুটিং-এর সময় তাঁকে অনুসরণ করে। তাঁর কাজ করার প্রক্রিয়ার একটা বিরল ও অতুলনীয় দলিল এটি। আমার ছবি করার অভিজ্ঞতা এক দশকও হয়নি, তবু আমি বুঝতে পারি, কী পরিমাণ পরিশ্রম একটা ছবির পিছনে করতে হয় এবং কীভাবে তা প্রায় আত্মাকে নিংড়ে নেয়। এও মনে রাখতে হবে, সত্যজিৎকে সেই সময় কত কষ্ট করে তাঁর ছবির পয়সাকড়ি জোগাড় করতে হত। আমাকে তাঁর এই অনমনীয় উদ্যম ও দায়বদ্ধতাও ততটাই অনুপ্রেরণা দেয়, যতটা দেয় তাঁর অসামান্য ছবিগুলো।
আমি তাঁকে আবিষ্কার করেছি বেশ বড় বয়সে, আর তাঁর ছবি দেখার আগে তাঁর সাহিত্য পড়েছি। ‘ফ্রিৎস’-এর মতো গল্প পড়ে প্রথম তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে, আর ‘ফ্রিৎস’ বিশেষ করে আমায় টানে কারণ এটা একটা দুরন্ত ভয়ের গল্প। আরও কিছু গল্প আমার খুব প্রিয়, আর আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষটার অসামান্য প্রতিভা তাঁর লেখালিখিতেও সমান ভাবেই ধরা আছে কি না।
সত্যজিতের ছবির ভাল প্রিন্ট পাওয়া আমার পক্ষে শক্ত ছিল, কারণ আমার ছাত্রজীবনটা এমন একটা সময়ে, যখন ডিভিডি উঠে যাচ্ছে, আর তার বদলে আসছে ডিজিটাল ভাবে প্রিন্টগুলোকে মেরামত করে একদম আসল প্রিন্টের মতো করে দেওয়ার চল। যখন সত্যিই তাঁর ছবির ঝকঝকে প্রিন্ট দেখতে পেলাম, তখন বহু আশ্চর্য মুহূর্ত জীবনে তৈরি হল, যা আমার অনেক ভাবনাকে বদলে দিল। এমন একটি মুহূর্ত এসেছিল বছর পাঁচেক আগে, যখন ‘মামি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ ‘পথের পাঁচালী’ দেখলাম। ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের একেবারে অপূর্ব প্রিন্ট, এবং এমন একটি চলচ্চিত্র-অভিজ্ঞতার জন্য আমি প্রস্তুতই ছিলাম না। আমার মনে হয়, সত্যজিতের এটাই সেরা ছবি।
সিনেমার জাদু, ক্যামেরার কাজ, যেভাবে কাহিনিটা দর্শকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়— সব মিলিয়ে এই ছবিটাকে ‘অপু ট্রিলজি’র সেরা ছবি বলে আমার মনে হয়। ‘অপরাজিত’ আর ‘অপুর সংসার’-এ অবশ্যই স্মরণীয় মুহূর্ত এবং অনবদ্য অভিনয় আছে, কিন্তু সত্যজিতের প্রথম ছবিটার অভিঘাত ভাষায় প্রকাশ করা শক্ত। ‘নায়ক’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘জলসাঘর’, ‘কাপুরুষ-মহাপুরুষ’ও আমার খুব ভাল লাগে। ঠিক কী কারণে এগুলো তাঁর অন্য ছবির তুলনায় আমার চোখে এত বিশিষ্ট, তা খুব বিশ্লেষণ করে আমি বলতে পারব না। ‘নায়ক’ ছবিটির গল্প বলার ধরন ও সারল্য আমাকে টানে, আর অবশ্যই উত্তমকুমারের মনকাড়া ব্যক্তিত্ব। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আরেকটি অসামান্য ছবি, যা কিছুটা কম দর পেয়েছে তাঁর অন্য কিছু ছবির তুলনায়। এটির মধ্যে একটা প্রবল ক্রোধ রয়েছে, যা তাঁর ছবিগুলির মধ্যে এটিকে স্বতন্ত্র করেছে। আর এই ছবি যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায় তা আজও প্রাসঙ্গিক, ৫০ বছর পরেও। আমার খুব ইচ্ছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখার, কিন্তু এখনও ভাল প্রিন্টের সন্ধান পাইনি।
সত্যজিৎ রায়ের অনেকগুলি ছবি রয়েছে, আর রয়েছে তাঁর অন্ধ ভক্তের দল, আর রয়েছে তাড়া তাড়া সমালোচনা ও ব্যাখ্যা। একজন ছবি-করিয়ে হিসেবে, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, তিনি এই প্রশ্নাতীত ভক্তির প্রতিই বা কীভাবে তাকাতেন, আর ফিল্মস্কুলের দলবলের অনবরত সূক্ষ্মবিচারকেই বা কীভাবে দেখতেন। আমার ধারণা, দুটির কোনওটিই তাঁকে স্পর্শ করত না, তিনি নির্বিকার ভাবে শুধু নিজের কাজ করে যেতেন। কারণ তিনি উৎসাহী ছিলেন অভিজ্ঞতার জগৎটাকে নিয়ে, মতামতের বিশ্বটা নিয়ে নয়। তাঁর কৌতূহল ছিল নতুন কিছু শেখার প্রতি, এবং যে মহাবিশ্বে তিনি কাজ করে চলেছেন তার প্রতি, চেয়ারে বসে বসে সমালোচনার মতো কাজকর্মের প্রতি নয়।
কয়েকদিন আগে একটা লেখায় দাবি করা হযেছে, আমার সাম্প্রতিক ছবি, সত্যজিতের ছবির মতোই, পাশ্চাত্যকে আকৃষ্ট করার কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে। পড়ে প্রথমটায় খুব গর্ব হল, অতবড় একজনের সঙ্গে আমায় একাসনে বসানো হয়েছে বলে, তারপর মনে হল সমালোচক মশাইকে বলি, আমার ছবি নিয়ে যা খুশি বলুন, কিন্তু এরকম বোকা অভিযোগ ছুড়ে সত্যজিতের ছবিকে নোংরা করবেন না। এই অভিযোগের কিছুটা অবশ্য গড়ে উঠেছে সত্যজিতের ব্যক্তিত্বের কারণেই। তাঁর কেতাদুরস্ত উচ্চারণ আর কথা বলার ভঙ্গি থেকে মনে হয় তিনি খুব ধনী অভিজাত পরিবারে বড় হয়েছেন। তিনি যে কী পরিমাণ কাজ করেছেন, সঙ্গীত তৈরি, লেখালিখি, সিনেমা তৈরি জুড়ে— সে কথাটা অভিযোগকারীরা ভুলে যান। তাঁর সিনেমা তিনি করেছেন কখন? যখন ভারত এক নবীন গণতন্ত্র, তার খুব একটা সম্পদ বা রসদ নেই। এবং তাঁর ছবি এখনও সেই সময়টাকে, তার প্রেক্ষিতকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। তাই এটা বলা সহজ— তাঁর তো উঁচুবর্গের পরিবারে জন্ম, তাই অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধে ছিল যা অন্যদের তুলনায় তাঁকে এগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এটা লক্ষ করা কঠিন: সেই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে তিনি কী অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন!
সত্যজিৎ যা দেখতেন, তাতে উত্তেজিত বোধ করতেন, তা লখনৌয়ের ইমামবড়া হোক, বা কোনও জাদুকরের আশ্চর্য কারসাজি। তাঁর মধ্যে একটা খিদে ছিল, নতুন জায়গা সম্পর্কে জানার, নতুন মানুষ সম্পর্কে জানার, এবং সেই খিদেই তাঁর সাহিত্য ও ছবিকে প্রভাবিত করেছিল। যদি তাঁর ছবি যথেষ্ট ভারতীয় না হত এবং শুধু পাশ্চাত্যের জন্যই তৈরি হত, তাহলে কী করে সেগুলো আকিরা কুরোসাওয়ার কাছে এমন উষ্ণ সমাদর পেল? কেন তবে আমরা আজও সত্যজিত ও তাঁর ছবিকে নিয়ে কথা বলে চলেছি? মনে রাখতে হবে, তাঁর ছবিগুলোর প্রিন্ট জীর্ণোদ্ধার করা হয়েছে বিদেশে এবং সেই জন্যেই নতুন প্রজন্মও আজ তাঁর কাজ উপভোগ করতে পারছে। যদি এই সমালোচক ও পণ্ডিতেরা সত্যজিতের নাম শুনে থাকেন শুধু তিনি পশ্চিমে বিখ্যাত হওয়ার পরে, তবে তা তাঁদের সীমাবদ্ধতাই বোঝায়, সত্যজিতের নয়।
সত্যজিতের এমনই প্রাসঙ্গিকতা যে আজও তাঁর সম্পর্কে নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে, এবং সব তরুণ পরিচালককে (আমাকে সুদ্ধু) প্রশস্তি করতে গেলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ‘নতুন সত্যজিত রায়’। যখন একজন মানুষ একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে যান, তাঁর ছায়া দীর্ঘ হয়ে অনেকটা এলাকা ঢেকে রাখে এবং তাঁর পরে যারা আসে সবাইকেই তাঁর সঙ্গে তুলনা করা হয়। সত্যজিত ভারতীয় ছবিতে এমনই এক দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করে আছেন। আমরা এখনও অন্য পরিচালকের উৎকর্ষ বিচার করি তাঁর সঙ্গে তুলনা করে— যেমন রায় বনাম ঘটক— এবং এখনও সব প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারের মধ্যে সত্যজিতেরই নতুন অবতার খুঁজি।
শুরু করেছিলাম সত্যজিতের সাহিত্যের কথা বলে, শেষও করি তাঁর একটা বইয়ের কথা বলে, যা আমার প্রায় জীবন বদলে দিয়েছিল। ‘আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস’ পড়ে আমি লেখাগুলোর প্রজ্ঞা আর অন্তর্দৃষ্টিতে একেবারে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আট-ন’বছর ধরে ছবি বানিয়ে যেটুকু জ্ঞান কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সংগ্রহ করেছি, তা আগেই আমার আয়ত্তে থাকত, যদি বইটা পড়ে ফেলতাম। ‘স্পিকিং অফ ফিল্মস’ বইটার সঙ্গে মিলে, এই বইটি এমন নিখুঁত নৈপুণ্যে ছবি করার জগৎটাকে দেখায়, যা যে কোনও চলচ্চিত্রপ্রয়াসীকে সাহায্য করবে।