মাদ্রাজের এয়ারপোর্টে যখন আমি নামলাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা।
মাদ্রাজ আমার কাছে নতুন জায়গা নয়। কিন্তু তখন এসেছিলাম ট্রেনে। আর তাও সে অনেক বছর আগে। বলতে গেলে একেবারে আমার ছোটবেলাকার কথা।
কিন্তু সত্যি বলতে কি, কোনও দেশ দেখা মানেই আমার কাছে সে দেশের মানুষ দেখা। এতদিন গুরুকে দেখেছি হয় কলকাতায়, নয় তো বোম্বাইতে।
বোম্বাই–এর সেই ঘরোয়া পরিবেশেই গুরুকে বেশি মানাতো। মানুষ ভেতরেও যেমন সত্যি, বাইরেও তেমনি সত্যি। তার সেই বাইরের রূপটি এবার দেখতে পেলাম মাদ্রাজ গিয়ে!
সেটা ১৯৬৩ সালে জুলাই মাসের শেষ তারিখ। মাদ্রাজে তখন প্রচন্ড গ্রীষ্মকাল। দাক্ষিণাত্যে বর্ষা পড়ে নভেম্বরে। সুতরাং যখন কলকাতায় বর্ষার ঘনঘটা তখন মাদ্রাজে প্রখর খর–তাপ। প্লেনের শীততাপ–নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে আবহাওয়ার ফারাকটা বুঝতে পারা গেল।
নতুন জায়গা। এয়ারপোর্টে এ–এল–এস কোম্পানির একজন ডায়ালগ–ডাইরেক্টর এসে আমাদের অভ্যর্থনা করল। ভদ্রলোক ভারি সদালাপী! তাঁর ছেলে পুনা ফিল্ম ইন্স্টিটিউটে পড়ছে।
বরাবর দেখেছি সিনেমা সংক্রান্ত ব্যাপারে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকেই বড় পরিশ্রমী। আর নিজের–নিজের কাজে অবিচল শ্রদ্ধা। সিনেমা–লাইনে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই বটে, কিন্তু অন্য বিভাগের কর্মীর মতো অলস নয়, অপদার্থও নয়। এ সব আমার অনেক দিনকার অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বলেই এমন অকপটে বলতে পারছি।
শহরের মধ্যে দিয়ে গাড়ি একটা হোটেলে গিয়ে পৌঁছুল। কোনও হোটেলে তখন জায়গা ছিল না বলে কুইনস্-হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হোটেলের সামনে বাগান। বাগানের মুখোমুখি হোটেলের কাউন্টার। তার পাশাপাশি দুখানা এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে দুজনে উঠলাম। নতুন জায়গায় এসেছি। গুরুর সঙ্গে কথা হয়ে আছে যে সে শুটিং করবে, আর তারই ফাঁকে–ফাঁকে আমরা দুজনে গল্প নিয়ে আলোচনা করব।
জিনিস–পত্র হোটেলে রেখে আমরা চললাম এ–এল–এস স্টুডিওতে। ওখানেই গুরুর ‘সুহাগন্’ ছবি তৈরি হচ্ছিল। সবে মাত্র তখন ছবিটা আরম্ভ হয়েছে। প্রচুর খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন হয়েছিল আমাদের জন্যে। চেনা লোকের সঙ্গেও দেখা হল সেখানে। নাসির হোসেন সাহেব ‘সাহেব–বিবি–গোলাম’-এ সুবিনয়বাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বেশ বাংলা বলেন গড়–গড় করে। আগে এই কলকাতার নিউ থিয়েটার্সেও নাকি ছিলেন।
আমি এই সব সিনেমা–স্টুডিওর আবহাওয়াতে বেশ অস্বস্তি বোধ করি। একটু পরেই ওদের শুটিং আরম্ভ হবে। আমি গুরুকে সেখানে রেখে হোটেলে ফিরে এলাম। এসে একলা ঘরে গুরুর জন্য হাঁ করে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে রইলাম।
ফাঁকা হোটেল। অন্তত আমার চোখে তাই–ই মনে হল।
খানিকপরেই গুরু এসে দরজায় টোকা মারলে— বিমলদা, বিমলদা—
গুরুর আবির্ভাবে স্বস্তি পেলাম। একলা থাকতে তখন আর ভালো লাগছিল না। ও এলেই আমাদের কাজ শুরু হবে। কিন্তু দরজা খুলেই দেখি গুরু একলা নয়। সঙ্গে আর একজন। কে?
গুরুই পরিচয় করিয়ে দিলে। নাম ‘মানু ঘোষ’। মাদ্রাজের বিখ্যাত মেক–আপ–শিল্পী হরিপদ ঘোষ–মশাই–এর ছেলে। মাদ্রাজের সিনেমা–জগতে একজন নাম–করা লোক। বেশ জমাটি মানুষ।
গুরুর এ–রকম সব শহরেই একদল বন্ধু–বান্ধব থাকে। যেমন কলকাতায় বাগরি সাহেব, সূর্য লাডিয়া। লন্ডনে রামু সারিয়া। বোম্বাইতে কাঞ্জি ভাইয়া, ভাল্লা প্রভৃতি। মাদ্রাজে তেমনি মানু ঘোষ।
মানু ঘোষ এক মিনিটেই গল্প জমিয়ে তুলল। তারপর আমাকে বললে—আপনি আমাদের এখানে ছবি করবার জন্য যে গল্প পাঠিয়েছিলেন, তা আমাদের ভালো লাগেনি।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লুম। বললুম— আমি গল্প পাঠিয়েছি?
মানু ঘোষ বললে— আপনার ছাপানো বই পাঠিয়েছিলেন এখানে ভেনাস পিকচার্সের অফিসে। বইটার নাম ‘বসন্ত পাপিয়া’—
আমি হতবাক হয়ে মানু ঘোষের মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। জীবনে অপকর্ম যে কখনও করিনি তা নয়, কিন্তু সিনেমা–কোম্পানির অফিসে ছবি করবার জন্য দরবার করেছি, এমন অপকর্মের কথা কল্পনাও করতে পারি না আমি।
বললাম— আপনি কেমন করে ভাবলেন যে সে বই আমার লেখা?
মানু ঘোষ বললে— বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভিতরে তো ‘বিমল মিত্র’–এর নামই লেখা ছিল—
এও আমার জীবনে আর এক বিড়ম্বনা। খ্যাতির বিড়ম্বনা। আমার বই বিক্রির রেকর্ড
দেখে কোনো লোক আমার নাম দিয়ে বই ছাপিয়ে ব্যবসা করছে। আমি অবশ্য এখবর
আগেও পেয়েছিলাম। এক বিয়ে বাড়িতে আমার নাম দিয়ে ছাপানো জাল বই নববধূ উপহার হিসেবে পেয়েছিল। আমার এক পরিচিত বন্ধু সে বই আমাকে দেখিয়ে
বলেছিল— আজকাল এ কি ট্র্যাশ উপন্যাস–গল্প লিখছো তুমি?
—কেন, কি হল?
— এত খারাপ যে পড়া যাচ্ছে না, এটা কি তুমি বাঁ–হাতে লিখেছ?
বইটা হাতে নিয়ে দেখে বললাম— এ বই তো আমার লেখা নয়, কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে লিখেছে—
পরে জেনেছি বাজারে প্রায় তিনশো নকল বই আমার নামে চালু আছে।
মাদ্রাজ থেকে যখন প্রথম ডাক এল গুরুর, তখন গুরু নিজের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি নিয়ে ব্যস্ত। নিজের কোম্পানির বাইরে ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ আগে কখনও তার আসেনি। যখন এল তখন একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন বোম্বাইতে। গুরু একদিন বলল— জানেন, হঠাৎ অভিনয় করবার জন্যে আমাকে সবাই ডাকছে—
আমার কাছে এ–সংবাদের কোনও গুরুত্ব ছিল না। কারণ আমি গুরুকে অভিনেতা হিসেবেই জানতাম। তাকে বাইরের লোক ডাকবে, তাতে অবাক হওয়ার কি বা আছে!
কথাটা শুনে মনে হল সে যেন এ–সুযোগ পেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। বললে—আমার নিজের ছবিতে অভিনয় করার আগে আমার লোভ ছিল খুব অভিনেতা হব বলে। কিন্তু কেউ তখন ডাকত না। আজ চারদিক থেকে আমাকে ডাকছে—বললাম— কে-কে ডাকছে?
গুরু বললে— মহেশ কাউল। সে এখানকার একজন নাম করা ডাইরেক্টর, সে করছে শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুন্ঠের উইল’, আর তারপর ডাক এসেছে কে. আসিফের কাছ থেকে, সে একটা নতুন ছবি করছে, তার নাম ‘লায়লা-মজনু’।
এরপরে যখন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি বাজারে বেরোল, তখন ডাক এলো মাদ্রাজ থেকে। গুরুর কাছে এই মাদ্রাজ থেকে ডাক ছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। টাকা দরকার তার ছিল না, কিন্তু দরকার ছিল আর একটা জিনিসের। সেটাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য! সে চাইতো পালাতে। বোম্বাই শহর, বোম্বাই–এর স্টুডিও, বোম্বাইতে তার নিজের সংসার, সব কিছুই তখন তার কাছে বিষ হয়ে উঠেছিল।
বহুদিন ধরে বলত— বিমলদা, আমি কলকাতায় একটা স্টুডিও কিনব।
— কোন্ স্টুডিও?
গুরু বলত— এম্-পি স্টুডিওটা বিক্রি আছে, ভাবছি ওখানেই আমি ছবি তুলব—
— এ-সব কি হবে? এই এত স্টাফ? সেখানে থাকবার বাড়ি কোথায় পাবেন?
গুরু বলত— স্টুডিওর ভেতরে অনেক জায়গা আছে, সেখানে স্টাফ কোয়ার্টার করে
দেব—
গুরুর কথা শুনে আমার ভয় হত। বলা যায় না, যেমন করে গুরু তার নিজের বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল, তেমনি করে হয়তো একদিন স্টুডিওটাও ভাঙবার অর্ডার দিয়ে দেবে। একদিন সবাই সকালবেলা এসে দেখবে স্টুডিওটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মজুররা।
আমি বারণ করতাম। বলতাম— ও ভুল কখনও করবেন না। দয়া করে কলকাতায় কখনও যাবেন না। কলকাতায় গেলে আপনার সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার অনেক ভাগ্য ভালো যে আপনি বোম্বাইতে স্টুডিও করেছেন। দেখছেন কলকাতায় যত কোম্পানি সবাই তাদের অফিস বোম্বাইতে উঠিয়ে নিয়ে আসছে। সেখানে রোজ হরতাল, রোজ ধর্মঘট। কলকাতায় গেলে আপনার স্টুডিওতেও ধর্মঘট শুরু হবে।
গুরু বলত— আমার স্টুডিওতে কখনও ধর্মঘট হবে না বিমলদা, আমার স্টাফদের আমি সব চেয়ে বেশি মাইনে দিই—
শেষকালে কোনও উপায় না পেয়ে গুরুস্বামীকে একদিন বললাম সমস্ত। গুরুস্বামীও ভয় পেয়ে গেল। বললে— আপনি বারণ করুন, ওখানে গেলে আমাদের কোম্পানি উঠে যাবে। এখানে যদি গুরু শুধু টেলিফোন করে দেয় কাউকে তো সঙ্গে-সঙ্গে লাখ টাকা এসে
যাবে—
কিন্তু হয়তো গুরু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই তল্পি–তল্পা গুটিয়ে চলে আসত, যদি না ঠিক সময়ে মাদ্রাজ থেকে ডাক আসত। তাই বলেছি মাদ্রাজের ডাক ছিল তার কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো।
আসলে শুধু মাদ্রাজ নয়, গুরুর তখন মানসিক অবস্থা এমনই যে বোম্বাই ছেড়ে সে তখন রসাতলে যেতেও প্রস্তুত ছিল। শুধু মানসিক অবস্থাই বা বলি কেন, শারীরিক অবস্থাও শোচনীয়। বাইরে থেকে বোঝা যেত না, কিন্তু ভেতরে–ভেতরে তার নার্ভ তার লিভার সম্পূর্ণভাবে জখম হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার রোবেরো ছিল গুরুর বাড়ির ডাক্তার। তখন থেকেই ঘন-ঘন ডাক পড়ত তার। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিত। বড় যন্ত্রণা হত সে ইঞ্জেকশনে। বড় কষ্ট পেত গুরু।
গুরু বলত— আর ইঞ্জেকশন দেবেন না, আর সহ্য করতে পারি না—
ডাক্তার রোবেরো বলত— কিন্তু তাহলে হুইস্কি খাওয়া ছাড়তে হবে আপনাকে। সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে—
গুরু হাসতো ডাক্তারের দিকে চেয়ে। বড় করুণ সে-হাসি। বলত— ডাক্তার, সব জেনেও আপনি আমাকে হুইস্কি ছাড়তে বলছেন, সিগারেট ছাড়তে বলছেন? ডাক্তার, আমি যে এখনও বেঁচে আছি, সেইতেই যথেষ্ট—
ডাক্তার এ-কথার কিছু উত্তর দিত না। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের ভেতরে ওষুধ পুরে ছুঁচটা বিঁধিয়ে দিত তার পেটে। আর গুরু যন্ত্রণায় ছটফট করত—
এই ডাক্তার রোবেরোর কথা পরে আরো অনেক বলব। কারণ ডাক্তার জানত কোথায় গুরুর রোগের মূলটা। এই ডাক্তারের সঙ্গেই গুরুর মৃত্যুর পরে রামু সারিয়া দেখা করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল— গুরুর মৃত্যুর কারণটা কি ডাক্তার রোবেরো? এটা কি আত্মহত্যা, না দুর্ঘটনা।
কিন্তু সে-কথা এখন থাক। এবার মাদ্রাজের কথাই আগে বলি।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত