আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে…
পুজো আসছে। উৎসবের মরশুম। পাশাপাশি আড়ম্বরের মরশুমও। শেষ কথাটাই আগে লেখা উচিত ছিল বোধহয়। কলকাতার বাসিন্দা হলেও আমি আদতে এসেছি দূর এক ছোট্ট-ছিমছাম শহর থেকে, যেখানে যেতে হলে আজকাল পাসপোর্ট লাগে। পাশ দিয়ে শান্ত একটা নদী, করতোয়া। আর চারদিকে গ্রাম। সেখানকার সবুজ যেন নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে উপচে পড়েছে আমাদের এলাকায়। জায়গাটা মুসলিমপ্রধান। সব মিলে প্রায় পাঁচ-ছ’টা পুজো। তার মেজাজ, ধরন-ধারণ— সেসবের কথায় পরে আসছি। আপাতত আসছি কলকাতার কথায়।
প্রথম প্রথম এ শহরেও বারোয়ারি কিংবা সর্বজনীন পুজোর চল ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার আবদার করে যতুটুকু পাওয়া যেত, তাই দিয়েই কাজ সারা যেত। মণ্ডপ সাজাত পাড়ার ছেলেরা, প্রতিমা আসত কুমোরটুলি নয়তো পোটোপাড়া থেকে। মহালয়ায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ থেকে শুরু করে বিজয়ায় ‘আসছে বছর আবার হবে’— এই ব্র্যাকেটের মধ্যে উৎসবের সীমানা বাঁধা থাকত। প্রতিমা নিরঞ্জন হত দশমীর সন্ধ্যায়। ব্যাস, আবার আসছে বছরের জন্য অপেক্ষা।
ধীরে ধীরে, সবার অলক্ষ্যে, সব কিছুই কেমন বদলে গেল। ভিড়ে ভিড়াক্কার রাস্তা, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে শোরগোল, দুগ্গা-ঠাকরুনের সঙ্গে নিজের ‘সেলফি’, চাউমিন, ফুচকা, ট্রাফিক পুলিশের হম্বিতম্বি, বড় বড় হোর্ডিং, কোন ঠাকুর কত লম্বা, কোথায় তাক-লাগানো আলোর খেলা, কোন মণ্ডপে বাইজ্যানটাইন শিল্পের ছোঁওয়া— আর এসবের যোগফলে কার ঝুলিতে ক’টা ‘শারদ সম্মান’ জুটল— এটাই হয়ে দাঁড়াল মুখ্য। উৎসব যে মিলনের পুণ্যভূমি, এই ভাবনাটাকে লাস্ট বেঞ্চে রাখা হল। ফলে ব্যাপারটা যে কতটা চোখের সুখ আর কতটা মনের— বিষয়টা ভবিষ্যৎ-গবেষকদের চর্চার খোরাক হয়ে বেঁচে রইল।
‘শারদ সম্মান’-এর কথা যখন উঠলই, তখন একটু পিছন দিকে হাঁটা যাক। এর বয়স এমন কিছু বেশি নয়। যতদূর মনে পড়ে, এর প্রথম প্রবর্তক ছিলেন কোনও এক কর্পোরেট হাউস— যাঁরা আসলে রংয়ের কারবারি। পণ্যকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলার পন্থা হিসেবে এঁরা বড় বড় হোর্ডিং লাগাতে শুরু করলেন। শুধুমাত্র মণ্ডপে মণ্ডপে নয়, আশেপাশের রাস্তার দু’ধারে অনেক দূর পর্যন্ত। আকারে এরা এতই বিশাল আর এতটাই উঁচু যে, দম-বন্ধ-করা ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে সংশয় জাগত যে, এটা রাজপথ, না কি ভূগর্ভস্থ কোনও পয়ঃপ্রণালী! পাশাপাশি আরও একটা বুদ্ধি খাটালেন এঁরা। আত্মপ্রচারের বাড়তি কৌশল হিসেবে আমদানি করলেন ‘শারদ সম্মান’ নামে একটি বস্তু। প্রতিমা, প্যান্ডেল, আলোকসজ্জায় কোন পুজোমণ্ডপ সবার সেরা, সেটা বাছাই করে, একটা খেলো ধাতুমূর্তি উপহার দিয়ে, পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের আত্মপ্রসাদের ফানুসে আরও খানিকটা হাওয়া ভরে দেওয়া। সোজা কথায়, নিজেদের বাজার বাড়াবার এক নতুন ফন্দি।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তো মুখিয়েই আছে— অভিনব কিছুকে অভিনবতর কায়দায় পরিবেশন করার জন্যে। ফলে, এক ঢিলে দুই পাখি। স্পন্সরদের মুখের হাসি আরও চওড়া হল, এদিকে চ্যানেল-কর্তারাও আহ্লাদে গদগদ— টিআরপি বাড়াবার জুতসই একটা মওকা পেয়ে। মণ্ডপে মণ্ডপে দুগ্গা-ঠাকরুন ক্যামেরাবন্দি হতে থাকলেন, আর উচ্ছ্বসিত সঞ্চালিকা মহোদয়ার উচ্ছল বর্ণনার গুণে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ আরও একটু সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল।
কম্পিটিশনের বাজারে অন্য খেলোয়াড়দেরও টনক নড়ে উঠল এবার। আরে, তাঁরাই বা কম কীসে? ফলে গাদা-গাদা ‘শারদ সম্মান’। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। বিষয়টাতে অভিনবত্ব আমদানি করার জন্যে নির্বাচিত বিচারকমণ্ডলী এবার ‘জেনারেল’ ছেড়ে ‘ডিটেল্স’-এ মনোযোগী হলেন। হিসেব কষতে বসলেন, কোন প্রতিমায় গণেশের শুঁড় আরও লীলায়িত, কোন অসুরের মাংসপেশি আরও ভীতিপ্রদ অথবা কোন মায়ের তৃতীয় নয়নটি আরও বেশি করুণাঘন। সেই বুঝে নম্বর।
নির্বাচকমণ্ডলীর গঠনও বিচিত্র। প্রকৃত শিল্পরসিক থেকে শুরু করে টলি-পাড়ার রূপসিরা পর্যন্ত— কে নেই সেখানে! ভাগ্যিস চার্লি চ্যাপলিন সাহেব দেহ রেখেছেন। নইলে আর দেখতে হত না। এসব নিয়ে অট্টহাসির বোমা ফাটিয়ে দিতেন সিনেমা হলগুলিতে।
পুজোকে নিয়ে হাজারো মজা। এত জাঁকজমকের যে বিপুল খরচ, তা কোন সুড়ঙ্গপথ বেয়ে কোথা থেকে কোথায় এসে জমা পড়ছে— এর পেছনেও গোয়েন্দা লাগানো যেতে পারে। রাজনীতির ময়দানে ‘হেভিওয়েট’ বলে যাঁদের খ্যাতি, তাঁদের অনেকেই এ ব্যাপারে ওয়াকেফ্-হাল। তাই পুরনো দিনের মতো ‘এপাড়ার পুজো’ ‘ওপাড়ার পুজো’ না বলে বলা হয় ‘অমুক দাদার পুজো’ নয়তো ‘তমুক দাদার পুজো’।
একবার আমন্ত্রিত হয়ে এই শহরেরই এক পুজোমণ্ডপে গিয়েছিলাম। দেখলাম প্রবেশার্থীদের জন্যে ওখানে তিনটে গেট। ওপরে তিনটে বোর্ড। ‘সাধারণ’, ‘ভি.আই.পি.’ আর ‘ভি.ভি.আই.পি.’। বাইরে ফেস্টুনে বড় বড় করে লেখা: ‘অমুক ক্লাবের সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। সর্বজনীন!
হেথা গ্রামপ্রান্তে নদী বহি চলে প্রান্তরের শেষে…
এসব দেখেশুনে যদি হঠাৎ আমার মন ছুটে যায় ছেলেবেলার সেই ছোট্ট শহরটার দিকে, করতোয়ার ধারে, তাকে কি নিছক স্মৃতিমেদুরতা অথবা অতীতচারিতা বলে ঠাট্টা করা হবে? হলে হোক! কিন্তু সেই স্মৃতি, সেই ছবিগুলি চোখ বুজলেই কেন স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার জবাব দেবে কে? এতগুলি বছরের এত ভাঙাগড়া, ওঠাপড়া— দাঙ্গা, দেশভাগ, রিফিউজির তকমা গায়ে এঁটে দেশান্তরী হওয়া— তার কত ছবিই তো ধুয়েমুছে গেল, কিন্তু এগুলো বেঁচে রইল কীসের জোরে?
প্রথম ছবিটাই ধরা যাক। পুজো আসছে, তার অনেক আগেই কুমোর কাকুরা এসে হাজির। বাঁশ-বিচালি-মাটি নিয়ে তোড়জোড়। আমরা সেঁটে আছি এঁটুলির মতো। সব দেখব— সব, সব। বাড়ির লোক ডেকে ডেকে হয়রান, কিন্তু আমাদের নড়ায় কে?
আগেই বলেছি, পুজো বলতে গোটা শহরে হাতে–গোনা মোটে কয়েকটা। মালতীনগর, জলেশ্বরীতলা, বড় গোলা, কাটনার পাড়া আর শিববাটি— ব্যাস, গেল ফুরিয়ে। শিববাটিতে আবার পাশাপাশি দুটো পুজো। ধনী দত্ত পরিবার, তাদের দুই শরিকের। আমরা বলতাম ‘বড় দত্ত’ আর ‘ছোট দত্ত’। পরিবারের পুজো হলেও মনে হত সর্বজনীন। কে কোথা থেকে আসছে, বসছে, খাচ্ছেদাচ্ছে আবার চলেও যাচ্ছে, হিসেবের পরোয়া নেই।
‘বড় দত্ত’দের কথা একটু আলাদা করে বলতে হয়। প্রচণ্ড রাশভারী আর অসম্ভব মিশুকে গৃহকর্তা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছেন। নহবতখানা থেকে নাটমন্দির অনেকটা পথ। পুজোয় তার দু’পাশে বসবে জমজমাট মেলা। চরকি থেকে শুরু করে ‘দিল্লি দেখো বোম্বাই দেখো’র উঁকি-মারা বাক্স, জিলিপি-গজা-রসগোল্লার দোকান। কাঠের বারকোশে স্তূপীকৃত খুরমার পসরা। চুলের ফিতে, কাচের চুড়ি, সোহাগ-আয়না। আদমদিঘির তাঁতিদের বোনা শাড়ি-গামছা। বাদুড়তলার কুমোরদের গড়া রকমারি পুতুল, ঘাড়-দোলানো বুড়োবুড়ি।
বড় তরফের নাটমণ্ডপটা প্রস্থে-দিঘে পেল্লায়। দুগ্গা-ঠাকরুনও মাথায় বড়। পুজোর চারদিন কত রকমের যে অনুষ্ঠান! তার মধ্যে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর। কোনও রকম প্রবেশমূল্যের প্রশ্নই ওঠে না। বাইরে থেকে বড় বড় ওস্তাদদের আনিয়ে সে এক জমজমাট আয়োজন। বড়ে গোলাম আলি, তারাপদ চক্রবর্তীরা সভা আলো করে বসতেন। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী— এঁরাও আসতেন। লখনউ ম্যরিস কলেজের সোনার মেডেল-পাওয়া ছাত্র, অতুলপ্রসাদ সেনের প্রিয় শিষ্য পাহাড়ী সান্যাল (পরবর্তীকালে আমার পাহাড়ীদা) একবার এসে ‘কে তুমি বসি নদীকূলে একেলা’ গেয়ে সেই মফস্সলি শ্রোতাদের এমন মনোহরণ করে বসলেন যে, পর পর তিনবার একই গান গেয়ে তবে তাঁর রেহাই।
একদিন থাকত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা— শহরের ‘চ্যাংড়াপ্যাংড়া’দের— অর্থাৎ ছোটদের জন্য। নবমীর রাতে হত নাটক— স্থানীয় শিল্পীদের কেরদানি দেখাবার সুযোগ। তার আগে লোক পাঠানো হত কলকাতায়। থিয়েটার-পাড়া চষে তাঁরা নাটক খুঁজে আনতেন। ‘বঙ্গে বর্গী’, ‘পি ডবলিউ ডি’, ‘তটিনীর বিচার’— এক এক বছরে এক-একটা। রিহার্সাল দিতে দিতে গলার বারোটা। গিন্নিরা তটস্থ। ঘন ঘন তুলসীর পাতা দেওয়া চা, গোলমরিচ-তালমিছরির ক্বাথ পাঠাতে পাঠাতে হয়রান। হে মা দুগ্গা, মান থাকে যেন। ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে এরই কিছু টুকরো স্যাম্পল দেখাবার চেষ্টা হয়েছিল।
পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এইসব অনবদ্য স্মৃতি। সেইসব আশ্চর্য দিন, আশ্চর্য শহর। বিজয়ার বিকেলে করতোয়ার পাড় লোকে লোকারণ্য— ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে। ভলান্টিয়ারদের নেতা আমাদের ইস্কুলের অঙ্ক-স্যার জসিমুদ্দিন আহমেদ। ডবল নৌকায় চড়ে দেবী বেড়াচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক। সন্ধে হল তো হাউই-তুবড়ি-রং মশাল। নিরঞ্জনের পর প্রণাম, কোলাকুলি, আশীর্বাদের পালা।
উৎসবের রেশ কিন্তু তখনও ফুরোয়নি। ওই যে বললাম, কোজাগরী রাতের কথা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাড়ু, মোয়া, ক্ষীরের তক্তি সাবাড় করা— এ তো আমাদের জন্মগত অধিকার।
এমনই এক কোজাগরী রাতের কথা বলি। শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা তফাতে রেলের প্ল্যাটফর্ম। আমার গলাগলি বন্ধু— অজয় তার নাম (যার কীর্তিকলাপের অনেক কিছুই ঢুকে পড়েছে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর নায়ক, ডানপিটে রসিকচন্দ্রের চরিত্রে), হঠাৎ এসে বলল, ‘চল, ইস্টিশনটা ঘুরে আসি।’
— এখন?
— তো?
— সে যে অনেকটা পথ। মাঝখানে ওই জলাটা। সাপের বাসা একেবারে।
— কিছু হবে না। চল তো। ফুটফুটে জোছ্না, দেখবি কেমন মজা।
সাপের ভয়ে মজা দেখতে দেখতে শেষ অবধি পৌঁছনো গেল। ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, বড় বড় শিরিষের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে। কাছাকাছি পৌঁছতেই একটা আওয়াজ কানে আসে। আওয়াজ নয় ঠিক। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ভেসে আসা একটা খালি গলার গান: ‘ঘরবাড়ি ছাড়লাম রে, নদীর চরে বাসা রে—’
এই জনহীন প্ল্যাটফর্মে, যেখানে শুধু ঝিঁঝিঁ আর কটকটি ব্যাঙের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই থাকবার কথা নয়, সেখানে গান গায় কে?
গুটিগুটি কাছে আসতেই থই পাওয়া গেল। অদূরে, মাল ওজন করার যন্ত্রটার ওপর পিছন ফিরে বসে এক ভদ্রলোক জ্যোৎস্না–ধোয়া জলাটার দিকে চেয়ে আপনমনে গেয়ে চলেছেন। পরনে ধুতি-শার্ট, ওপরে সুতির ইংলিশ কোট।
প্রৌঢ় স্টেশনমাস্টার মশাই তাঁর ঘরের দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারা করেন শব্দ না করতে। একটু পরে, গায়কের গান শেষ হয়ে এলে, কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন, ট্রেন ফেল করেছেন ভদ্রলোক। গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করো। পল্লিগানের বেতাজ বাদশা— আব্বাসউদ্দিন আহমদ সাহেব।
সব পুজোই পুজো। তবু কিছু ব্যতিক্রমও তো থাকে, যা আড়ম্বর দিয়ে ঢাকা যায় না। সেবারের পুজোর উৎসব আমরা এইভাবে শেষ করলাম।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র