গুরুর কথা শুনে নিজের মনেই ভাবছিলাম আমরা সব মানুষই বোধহয় এক-একজন গুরু দত্ত। সবাই আমরা হাতের সুখে যা গড়ি আর পায়ের সুখে তা ভাঙি। অতি কষ্ট করে কত লোক সুনাম অর্জন করে। কেউ বই লিখে, কেউ জেল খেটে, কেউ বা সারারাত জেগে বই পড়ে। তারপর একদিন জীবনের দরজায় সাফল্য এসে হাজির হয়। তখন সেই সাফল্যের আনন্দে আত্মহারা হয়ে কত লোককে বেপরোয়া হতে দেখেছি। বছরের পর বছর জেল খেটে কত স্বদেশী-করা লোক মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তির পুজো পেয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফুলের মালার অভ্যর্থনা পেয়েছে। কিন্তু সেই দেশ-সেবককেই আবার দেখেছি নিজের হাতে নিজের মুখে চুন-কালি লেপতে। বাইরের মানুষ শুধু সেদিন তাকে জুতোর মালা দিতে বাকি রেখেছে। সংসারে এ-সব তো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
তবে কেন গুরুকে দেখে আমি আকৃষ্ট হলাম? সে কি গুরু দত্তের অর্থ? সে কি গুরু দত্তের খ্যাতি? সে কি গুরু দত্তের মিষ্টি স্বভাব?
কিন্তু আমার তো ও-সবের কিছুরই প্রয়োজন নেই। জীবনে আমার পাঠকরা আমাকে অনেক দিয়েছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে যা দেয়, তার বেশি আমার দাবি নেই। তাই গুরুর কাছে আমি নিস্পৃহ হয়েই গিয়েছিলাম। বলতে গেলে দর্শক হয়ে। সাহিত্যের অন্দর-মহল থেকে সিনেমার দেউড়িতে। সিনেমা-জগতের মানুষরাও তো মানুষ। তাদের দেখবার সুযোগ দিয়েছিল বলেই গুরু দত্তের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ‘একক-দশক-শতক’ শেষ করতে তখন আর চারটে কিস্তি বাকি। ‘ঘরোয়া’ সম্পাদক তখন কিস্তির জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। একদিন টেলিফোন কল এল গুরুর বাড়িতে। সম্পাদক একজনকে অনুরোধ করছেন আমাকে উপন্যাসের কিস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। আমি তখন গুরুর ভাড়াবাড়ির তেতলার ঘরে শুয়ে গুরুর সঙ্গেই গল্প করছি।
গুরু জিজ্ঞেস করলে— আপনার টেলিফোন? আপনাকে এখানে কে আবার টেলিফোন করবে? আপনি তো কারোর সঙ্গেই মেশেন না—
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম।
গুরু বললে— তাহলে তো আমি আপনার ক্ষতি করলাম?
গুরু তো জানেই না যে যন্ত্রণাই হোক আর যত যন্ত্রণাই হোক লেখার কথা আমি ভুলি না। ভুলতে পারি না। আর ভুলতে পারি না বলেই এই শরীরটাকে নিয়ে বড় মুশকিলে পড়ি। সারা জীবন শরীরটাকে আর কিছুতেই জুৎ করতে পারি না। তাই যখন বোম্বাই যেতুম মনটা কিছুদিনের জন্যে হালকা হত।
গুরুকে বললাম— আমাকে যে এখানে ডাকেন এতে আমার উপকারই হয়—
গুরু বুঝতে পারলে না। বললে— কি রকম?
— এখানে এলে আমি লেখার ভাবনা থেকে কিছুটা মুক্তি পাই—
গুরু বললে— অত লেখেন কেন?
— আমি তো লিখতে চাই না, কিন্তু আমাকে দিয়ে কে যেন লিখিয়ে নেয়—
— তার মানে?
বললাম— আপনিই কি ছবি না করে থাকতে পারবেন? আপনি তো অনেক টাকা উপায় করেছেন, আপনার তো অনেক টাকা হয়েছে, তাহলে আপনার আর কিসের দায়?
গুরু বুঝল কথাটা। বললে— দেখুন, সম্প্রতি চারদিক থেকে ছবিতে অভিনয় করার জন্যে আমার ডাক আসছে প্রচুর এখন—
বললাম— সে তো ভালো কথা। যতদিন আপনার চেহারা আছে, ততদিন অভিনয় করে
নিন—
গুরু বললে— এতদিন কেবল নিজের প্রোডাকশনেই ছবিতে নায়কের অভিনয় করেছি। এবার মাদ্রাজের হিন্দি ছবিতে অনেক টাকা পাচ্ছি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করছি। বোম্বাই ছেড়ে মাদ্রাজে গেলেই শরীরটা ভালো হয়ে যায়— ওখানে গেলেই পাঁচ পাউন্ড ওজন বেড়ে যায়, আর বোম্বাইতে ফেরার সঙ্গে-সঙ্গে পাঁচ পাউন্ড কমে।
বললাম— আমারও তাই, কলকাতায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লিখে এখানে এসেও লেখার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাই না। এখানে এসেও লিখতে হয় বটে কিন্তু কলকাতার মতো কষ্ট হয় না লিখতে।
সকাল থেকে বারোটা পর্যন্ত দুজনে লিখি, গল্প করি, ঘুরে বেড়াই। গুরু ঘুরে বেড়ায়, ছটফট করে, আনচান করে। মাদ্রাজে তখন তিনটে ছবির কাজ। একটা ছবির নাম ‘ভরোসা’ আর একটা ছবির নাম ‘বহুরাণী’, আর একটা ছবির নাম ‘সুহাগন্’।
বললাম— কি রকম ছবি?
গুরু বললে— ওসব আলোচনা করবেন না। ও-সব ছবিতে অভিনয় করেও তৃপ্তি পাই না। শুধু টাকার জন্য করি। অনেক টাকা দেয় ওরা। এখান থেকে যে টাকা উপায় করি সমস্ত এখানকার স্টুডিওতে এনে ঢালি—
মাদ্রাজ যাওয়ার কথা ৩০ জুলাই। আর আমি বোম্বাই গিয়ে পৌঁছেছি ২৪ জুলাই। অর্থাৎ প্রায় ছদিন আমাদের একসঙ্গে কাটল। সে কদিন দেখলাম অনেক পরিবর্তন হয়েছে গুরুর বাড়িতে। রতন গুরু দত্তের পাশে নেই, এটা যেন কল্পনা করা যায় না। রতন মানেই গুরু, গুরু মানেই রতন। বহুকাল ধরে দেখে আসছি রতন না হলে গুরু অচল। সেই রতন গুরুকে ছেড়ে চলে গেছে এটা যেন অবিশ্বাস্য।
বললাম— কেন ছেড়ে চলে গেল রতন?
গুরু বললে— আমি তাড়িয়ে দিয়েছি তাকে। রতন ভেবেছিল, সে চলে গেলে আমি অনাথ হয়ে যাব—
— কিন্তু আপনার চলবে কি করে?
গুরু কিছু বললে না। কিন্তু গুরুর কথাই সত্যি! রতন বেশিদিন থাকতে পারেনি। আবার ফিরে এসেছিল। কিন্তু সে কথা পরে বলব।
আর একটা নতুন মানুষের আবির্ভাব হয়েছে সংসারে। সে গুরুর মেয়ে নীনা। গুরু তাকে কোলে করে সামনে নিয়ে এল। বললে— এই দেখুন, কাশ্মীরের এক সাধু বলেছিল এবার আমার মেয়ে হবে, তাই এ হয়েছে—
নীনার দিকে দেখলাম। অনেকটা গুরুর মতোই মুখের আদল। তার দিকে চেয়ে কিন্তু আমার দুঃখ হতে লাগল। ছোট্ট মেয়ে, এক বছরও বয়স হয়নি। কিন্তু আর একটু বড় হলেই বুঝত যে তার মা নেই, মা গেছে লন্ডনে গান গাইতে। বাপের কোলে উঠে নীনা তখন খিল্খিল্ করে হাসছে। গুরু নতুন চাকরটাকে ডাকলে। ওরে, একে নিয়ে যা—
নতুন চাকরটার নাম এখন ভুলে গেছি। আমাকে আড়াল থেকে বললে— বাবুজী, আপনি এসেছেন তাই সাহেবের মুখে হাসি বেরিয়েছে, এতদিন সাহেবের মন খুব খারাপ ছিল—
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত