সাধারণ মানুষের কাছে ‘কার্টুন’ শব্দটার সমার্থক আর কে লক্ষ্মণ। তাঁর কার্টুনের মধ্যে এমন কী ছিল, যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ একেবারে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল? এমনকী এখনও তাঁর আকা কার্টুন প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, কেন?
ওঁর ছিল সহজাত প্রতিভা, আর উনি কাজ শুরু করেছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় শহরে, যে-শহরটা বলা যেতে পারে তার নিজস্ব কার্টুনিস্টের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। কার্টুন-ইতিহাসবিদরা বলেন, কার্টুন আঁকার শিল্পটা সবথেকে বেশি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে শহুরে জায়গায়, যেখানে নানা প্রান্ত থেকে লোকজন আসতেই থাকে জীবিকার আশায় এবং বসবাস শুরু করে। অর্থাৎ যেখানে সব ধরনের মানুষের একটা মিশ্রণ আছে। মুম্বইয়ে বেশ বড় সংখ্যক মানুষ ইংরেজি পড়তে জানতেন আর এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন এসে নিজেদের আস্তানা গড়েছিলেন। লক্ষ্মণ যে-শহরটায় থাকতেন এবং কাজ শুরু করেছিলেন, সেখানে তিনি সবচেয়ে উপযোগী মিশ্রণের সর্বভারতীয় একটা পাঠককুল পেয়েছিলেন।
লক্ষ্মণ আর কার্টুনিস্ট কুট্টি একই বছরে জন্মেছিলেন। তাঁদের দুজনকে মানুষ ও শিল্পী হিসেবে জানার সুবাদে তাঁদের কাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
এই নিয়ে একটা পুরো বই লিখে ফেলা যায়। সোজা কথায় বললে, কুট্টি তাঁর কার্টুনের মধ্যে দিয়ে নয়া দিল্লিকে তুলে ধরেছিলেন, যা ছিল ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী। ওদিকে লক্ষ্মণ এমন একটা পাঠককুলের জন্য আঁকতেন যাঁরা ভারতের রাজধানীর প্রভাব থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর বড় বড় কার্টুনগুলি মূলত রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আঁকা হলেও, কুট্টির মতো ছিল না। কুট্টি রাজনৈতিক মহলের একজন ভেতরের লোক ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মণের রাজনৈতির ভঙ্গি বা দৃষ্টি ছিল একটু দূরের, একটু দূরত্ব রেখে তিনি দেখতেন।
ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কার্টুনিস্টদের যে স্বর্ণযুগ চলেছিল, তা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে লক্ষ্ণণের শতবর্ষটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর। আপনার মতে এঁদের মধ্যে খুব উচ্চমানের কারা? আন্তর্জাতিক স্তরে এঁদের গুরুই বা কারা?
কার্টুনিং-এর প্রথাগত মানচিত্রে যা ছিল না, ভারতীয় কার্টুন একেবারে সেই অপ্রত্যাশিত নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এদেশে দুর্দান্ত কার্টুন এঁকেছে। প্রতিটি প্রজন্মের অসামান্য কার্টুনিস্টরা পরের প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই, এই অনুশীলন বজায় থেকেছে।
মাত্র কয়েকজনের নাম বললে, অন্যদের প্রতি অন্যায় করা হবে। এটাও ভুললে চলবে না, কত ভাষায় অনবদ্য কার্টুন আঁকা হয়েছে— মারাঠি, তামিল, তেলুগু, মালায়লম…
তবে শঙ্কর বা লক্ষ্মণের প্রজন্মের একজন গুরু হলেন ডেভিড লো, যিনি ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু ফ্লিট স্ট্রিটের নক্ষত্র— অ্যাডলফ হিটলারকে গোড়া থেকেই নিশানা করার জন্য। আমাদের সময়ে, সত্তরের দশকে, আমরা মার্কিন কার্টুনিস্টদের খুব শ্রদ্ধা করতাম, হেরব্লক, ওলিফ্যান্ট, জুলস ফিফার…
আর কে নারায়ণ এবং আর কে লক্ষ্মণ— একজনের সাহিত্য কি অন্যজনের কার্টুনকে অনুপ্রাণিত করেছিল? দুজনের কাজের মধ্যে মিল ও অমিলগুলো কী?
দুজনের মধ্যে যোগসূত্রটা নিশ্চয়ই পুরনো মাইসোর। লক্ষ্মণ যখন তাঁর ভাইয়ের গল্পগুলোর সঙ্গে ছবি আঁকতেন, তখন কী অবলীলায় সব খুঁটিনাটিগুলো ফুটিয়ে তুলতেন। লক্ষ্মণ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই অনেকটা স্বাধীনতা নিতেন আঁকার ব্যাপারে, আর তা হয়তো নারায়ণের কল্পিত মালগুডির সঙ্গে মানানসই-ই হত। এর বাইরে, এই আঁকা ও লেখার তুলনা নিয়ে আলোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই।
সময় কি এখন বদলে গেছে, কৌতুক আর নিজেকে নিয়ে রসিকতার চল কি সাধারণ মানুষ ও রাজনীতির পরিসরের বাইরে চলে গেল? নেহরু কুট্টির প্রশংসা করেছিলেন কার্টুনের জন্য, তা কি আর আজ সম্ভব?
আমার তো মনে হয় পাঠকেরা আরও বেশি কঠোর এখন, তাঁরা কোনও পানসে জিনিস আর সহ্য করবেন না। নেহরু একজন ব্যতিক্রম। তাছাড়া একজন বন্ধুত্বপূর্ণ শাসক একটা নবীন গণতন্ত্রের গোড়ার দিকটার পক্ষে ভাল হতে পারেন, কিন্তু তার বেশি নয়। সারাক্ষণ তোমার আঁকার বোর্ডের পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি একটা বিভীষিকা হয়ে উঠবেন।
গণতন্ত্র আর কার্টুনিং— দুটোকেই বড় হয়ে উঠতে হবে। একটা পরিণত গণতন্ত্রে কার্টুনিং-এর সাংবিধানিক নিরাপত্তা থাকতে হবে। বা খুব শক্তিশালী ঐতিহ্য থাকতে হবে। আমাদের এসব কিছুই নেই। ইদানীং আদালতের কিছু রায়ে শিল্প বা কার্টুনের অধিকারকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। আরও এরকম রায়ের জন্য অপেক্ষা করে আছি।
আপনার সঙ্গে তো লক্ষ্মণের দেখা হয়েছে। মানুষ হিসেবে উনি কেমন ছিলেন?
দারুণ কথা বলতেন, দুরন্ত রসবোধ ছিল, তাতে দুষ্টুমিও মেশানো থাকত। কথার ফাঁকে ফাঁকে শিল্প সম্পর্কে কিছু পরামর্শ গুঁজে দিতেন, যেমনটা শুধু এক তুলনাহীন শিল্পীই পারেন।
আপনি আপনার প্রজন্মের একজন খ্যাত কার্টুনিস্ট, আপনি লক্ষ্মণের কোন বৈশিষ্ট্যটা পরবর্তী প্রজন্মের কার্টুনিস্টদের মধ্যে প্রবাহিত দেখতে চান? লক্ষ্মণ আজ জীবিত থাকলে, এই পৃথিবীটাকে কীভাবে দেখতেন বলে মনে হয়?
লক্ষ্মণের থেকে আমাদের শিখতে হবে, খুব রাগে ফেটে পড়ার চেয়ে জরুরি হল, কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে একটা অচল অবিশ্বাস, আর নাগরিকদের প্রতি প্রবল সহমর্মিতা।
উনি বেঁচে থাকলে এখনও সমানে কাজ করে যেতেন। ক্ষমতাশালী লোককে এবং বহু পাঠককে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট করতেন, আগের চেয়েও বেশি। এখনকার বহু রাজনীতিবিদ, যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মধ্যে বহু ভাল জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কামান দাগতেন।