ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ১৫


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (September 17, 2021)
     


    ভোকাট্টা ভগবান

    দেবতা বলেই সবার ভাগ্য ভাল নয়। দুর্গার সব ছেলেমেয়েই পুজো নিতে একবার করে একলা আসেন, শুধু কার্তিকঠাকুরকে ব্যঙ্গ করে বলা হয়, তিনি নাকি হ্যাংলা, কারণ ‘একবার আসে মায়ের সাথে একবার আসে একলা’। এমনিতে কার্তিককে খুব একটা পাত্তাও দেওয়া হয় না, যেন তিনি অমন তীব্র তকতকে হ্যান্ডসাম মানেই রূপসর্বস্ব মাকাল। অথচ তিনি যুদ্ধ করেন, সেনা পরিচালনা করেন। এই বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্মা, সারিয়ে-সুরিয়ে চালু রেখেছেন বিষ্ণু, আর দরকার পড়লে ধ্বংস করে দিচ্ছেন (যাতে ফের গজাতে পারে) মহেশ্বর। বিষ্ণু আর শিবের ভক্ত বা মন্দির বা কীর্তনের শেষ নেই, কিন্তু ব্রহ্মা টোটাল বঞ্চিত। আরে, ও লোকটা প্রথম চ্যাপটারে বিশাল অণ্ডটি প্রসব না করলে, এই লীলাক্ষেত্রের ঝিংচ্যাক নকশা নিয়ে এত মুগ্ধতা ক্ষোভ গসিপ কোত্থেকে মুন্ডু তুলত? এ খুব অদ্ভুত ব্যাপার, যে নষ্ট করছে তাকে পুজো করছি, যে প্লাম্বারের জোগান দিচ্ছে তাকে উপাসনা করছি, আর যে গোটা কম্পাউন্ডটা বানিয়েছে সে এলে সোফায় বসতে দিচ্ছি না। ইন্দ্রকে শুধু লম্পট বলেই চিত্রিত করা হল চিরকাল। আরে ভাই, বিল ক্লিন্টনের গোটা ভূমিকাটা, বা তাঁর জমানায় তাঁর সিদ্ধান্তের ভুল-ঠিকগুলো তো শুধু মনিকা লিউইনস্কির কেচ্ছার চশমায় দেখলে হবে না। ইন্দ্র দেবতাদের রাজা, বছরশেষে ব্যালান্স শিট তাঁকেই গ্রাফ-টাফ দিয়ে বোঝাতে হয়। আদৌ অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন হবে কি না, হলে কখন সারেন্ডার করে ‘বাপ রে মা রে’ রবে পালাতে হবে, সমস্তটাই তিনি ঠিক করেন। তাহলে তাঁকে বিরাট আরতি-টারতি হাঁকড়ে মাছমাংস রেঁধে পুজো করা হচ্ছে না কেন? বরুণ জলের দেবতা, পবন হাওয়ার দেবতা। এই যে ঝড়জলের চোটে ভারত ধাঁইধাঁই লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে, তা রোধ করতে নতুন করে বরুণ-পবন জুটির পুজো শুরু হতে বাধা কীসের? কোভিড আসার পর করোনা দেবীর অবধি একটা না দুটো মন্দির জন্ম নিল, অ্যাদ্দিনে সিমেন্ট অবধি শুকনো, এদিকে পর পর সাইক্লোনে এত ঘরবাড়ি রইরই ভেসে যাওয়ার পরেও, বরুণ-পবন উপেক্ষিত? সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে দিনমান সব্বাই পর্নোগ্রাফি দেখে হেদিয়ে যাচ্ছে, সেখানে মদনদেবতার এই প্রখর অনাদর? অতি-ক্যাবলা পুরুষকে মদোওওন বা মঅঅদনা বলে বিদ্রুপ করার চল অবধি রয়েছে (একা মদন মিত্র স্মার্টনেসের ধ্বজা নিয়ে দুর্ধর্ষ লড়াই দিচ্ছেন)। মদন না থাকলে যৌন আকর্ষণ ব্যাপারটাই ধরণী হতে গ্যাঁড়া দেবে, তখন প্রজাবিস্তার, প্রেম, যৌনতা, খাজুরাহো, ফ্যাশন-দুরস্ত পোশাক বা পোশাকহীনতা: সপাটে অন্তর্হিত। এই পৃথিবীতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্যাশন ও টাইমপাসের যিনি ধারক-বাহক, তাঁকে ইগনোর দিয়ে মানবজাত কী প্রমাণ করতে চাইছে?

    প্রায় সেই দশাই হয়েছে বিশ্বকর্মার। তিনি একটা হাতিতে চড়ে একহাতে ঘুড়ি পাকড়ে যথেষ্ট হাসি-হাসি ঠাট বজায় রাখার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু ভেতরটা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠছে, হৃদয়টা গনগনে। লোকে তাঁর চেয়ে ঘুড়িকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এবং মাংস-মদকে। বিশ্বকর্মা পুজো আর যা-ই হোক তাঁর পুজোর দিন নয়। তিনি এক কোণে পড়ে থাকবেন, আর লোকে মাঞ্জা নিয়ে ঘুড়ি নিয়ে ভো-কাট্টা নিয়ে উদ্দাম হইহই মচাবে। যারা এখন ঘুড়ি ওড়ায় না তারা ‘হায় সেসব কী দিন ছিল যখন আকাশময় ঘুড়ি উড়ত মেঘে তাদের মাল্টিকালার ছায়া পড়ত চিল ও ঈগল ভির্মি খেত’ হুতাশ জুড়বে, এখনকার লোক গল্প করবে কীভাবে মা ফ্লাইওভারে বাইকে চড়ে লোকে যাচ্ছিল কিন্তু খরখরে মাঞ্জা-সুতোয় গলা কেটে গেল (বাইক তখনও কবন্ধ আরোহী নিয়ে স্পিডে চলছে), কেউ কেউ বলবে চাইনিজ মাঞ্জা শ্রেষ্ঠ কিন্তু দেশপ্রেমের চোটে তারা এবার মায়ের দেওয়া মোটা মাঞ্জায় নেমে এসেছে (তাদের ঘুড়িও নেমে এসেছে, কারণ সুতো তো দেশাত্মবোধক সুড়সুড়িতে ধারালো হয় না)। সাম্যবাদী আঁতেল সুমনের গান ভাঁজবে, যেন পেটকাটি চাঁদিয়াল শুনলেই তার রিকশা-চালকের শ্রম ও বঞ্চনার আখ্যান মনে পড়ে স্টমাক ছলকে ওঠে। পেটের অবশ্য দোষ নেই, কারণ তেড়ে ঝাল ঝাল কষা মাংস প্যাঁদানো  হয়েছে, যা বিশ্বকর্মা পুজোর খ্যাঁটনে আনঅফিশিয়ালি আবশ্যিক, সমস্ত কারখানায় এই দিনে স্পেশাল এমন রগরগে মাংস তৈরি হয় কীভাবে কে জানে, হয়তো যন্ত্রপাতির জং কিংবা পিস্টনের উদ্যমের কিছুটা ঝাঁঝ মশলায় অনায়াসে মিশে যায়। কালী তামসিক দেবী, তাঁর পুজোর দিনে লোকে গরগরে ঝাল-ঝাল লাল-লাল ঘনঘটা নিয়ে মত্ত হবে তা সহজে বোধগম্য, কিন্তু বিশ্বকর্মা কীভাবে ঘুড়ির মতো হালকাফুলকা রংরঙিন ব্যাপার এবং মাংস-মদের মতো পেট-গুড়গুড়ে ভোগ-থরথরে স্যাপারকে নিখুঁত বাবলা-আঠা দিয়ে জুড়ে দিলেন, বোঝা দায়। যে কাচের গুঁড়ো দিয়ে মাঞ্জা হয়, তাতেই কি হাত কেটে গেল মানুষের, আর সেই রক্ত চুষে নিতে গিয়ে তারা আচমকা টের পেল নিজের মধ্যে নেশার চুলবুলে তৃষ্ণা? তাই কি যে যেখানে আছে, মানে শ্রমিক শ্রেণির লোক, যারা সম্বচ্ছর গতর কাটিয়ে ফুসফুস ফাটিয়ে মেশিনে প্রাণসার ঢেলে দিচ্ছে, তারা এদিন স্থির করে: নিজের আফশোস ও ভাবনাস্রোতকে ছুটি দিয়ে খানাখন্দেও পড়ে থাকবে, তবু কিছুতে সাধারণ যুক্তির পথে পাতি চিন্তার গতে হাঁটবে না? যে দেবতা টি-স্কেল ও ছুঁচলো কলম নিয়ে নিখুঁত এঁকে ফেলছেন সাইটের মাপজোক থেকে সার্কিটের তলঝোঁক, তাঁর চ্যালা হয়ে কেউ যদি গণিতের বদলে শোণিতের নিশিডাক শোনে, তা কি তাঁকেই অস্বীকার করা হল না? 

    ভগবানদের মুশকিল হচ্ছে, দুর্ভাগ্যের জন্য কারও কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন না, প্রতিকারের জন্য কারও থানে মাথা কুটতে পারেন না। তিনি নিজেই দেবতা, নিজের সব প্রাপ্তির ও অপ্রাপ্তির দায় নিজের কাঁধেই নিতে হবে, তাতে স্পন্ডিলোসিস হলে সেই ব্যথা অবধি বিনা-গালাগালে বহন করতে হবে। এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই। কষ্টের মানে কী, যদি ‘আমি (পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল লোক, যাকে সব্বাই ভুল বুঝল) এই বেদনা কক্ষনও ডিজার্ভ করি না’ ডুকরে অন্যের কানের পোকা না নাড়িয়ে দেওয়া যায়? যদি না নিজের মায়ায় নিজের বুক ভাসিয়ে অ্যাংস্ট-টা গেলে দিয়ে, ‘যাক এবার ওয়েব সিরিজ দেখি’ মর্মে নাক ঝেড়ে বসে পড়া যায়? যদিও দেবতাদের দেখা গেছে, মাঝেমধ্যে ব্রহ্মার বা বিষ্ণুর কাছে নালিশ করতে বা পরামর্শ চাইতে হাজির হয়েছেন, কিন্তু মোটামুটি তাঁদের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়, তুমি অমর, তুমি ক্ষমতাবান, আজ না হোক কাল তোমার সাফল্যপথ তোমায় নিজেকে খুঁড়ে নিতে হবে। যেহেতু সময়টা তাঁদের কাছে কোনও বাধাই নয়, এখন হয়নি তো ঝামেলাটা কী, হাজার বছর পরে হবে তিনলক্ষ বছর পরে হবে গোছের আশ্বাস তাঁদের প্রবাহিত পোশাকে খুঁটে নিত্য বাঁধা, তাই এখনকার দুঃখটাকে গাঢ় ও ওজনদার বলে ধরার, সমীহ করার (বা দুঃখিতকে সান্ত্বনা দিয়ে, শত্তুরের বাপান্ত করে, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ‘চ বরং ফুচকা খেয়ে আসি’ বাগাবার) চলটাই তাঁদের ক্ষেত্রে নেই। হয়তো সত্যিই এমন দিন আসবে, যখন কার্তিককেই পুজো করা হবে, আর দুর্গা নামবেন নিতান্ত সাইড-রোলে। হয়তো সন্তোষী মা যেমন সিনেমার সাফল্যে ভেসে ঘরে ঘরে অবতীর্ণা হয়েছিলেন তেমন একতা কাপুরের (বা অনৈক্য সাঁতরার) দুরন্ত সুপারহিট সিরিয়ালের টিআরপি-তে চড়ে (হাতিটিকে লাত্থি মেরে) বিশ্বকর্মা হয়ে উঠবেন ‘নমো যন্ত্র’-বাচক হিরো হিরালাল। তখন বিশ্বকর্মাকে মাথায় তুলে সফ্টওয়্যার-ওয়ালারা এমন ফেস্টিভ্যাল রচবেন যে সব রাস্তা উন্মত্ত জ্যাম, ড্রোনে ড্রোনে ধাক্কাধাক্কির চোটে আকাশটা টাইট কলহ-ব্যোম, স্যাটেলাইটে আলপনা দিতে ইলন মাস্ক আবিষ্কার করছেন আলট্রা-মই, আর কলাম-লেখক প্রবন্ধ লিখছে: দুর্গা উপেক্ষিতা কেন, সরস্বতী ভুঁয়ে পড়ে কেন। সেসব জানেন বলেই কি বিশ্বককর্মার মূর্তিতে চিলতে হাসি লেগে আছে? 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook